#তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৩২
দুই হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে বসে আছে ইভান। মাথাটা প্রচণ্ড ব্যথা করছে। কিন্তু তার থেকেও বেশী মানসিক যন্ত্রণাটা। প্রচণ্ড টেনশন আর অপরাধ বোধ নিয়ে পার করেছে নির্ঘুম একটা রাত। পরিস্থিতি এভাবে পালটে যাবে সেটা হয়তো তার ধারনা ছিল না। মাথা তুলে সামনে তাকাল। সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে মেঘলার জ্ঞান শুন্য দেহটা। খুব খারাপ কিছু নাহলেও ভালো কোনভাবেই বলা যায়না এটাকে। অতিরিক্ত ব্লাড লসের কারনে বডি শকে চলে গিয়েছে। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যদি জ্ঞান না ফেরে তাহলে কোমায় চলে যাবে। মৃত্যু পর্যন্ত ঠিক হবে কিনা সেটা কেউ বলতে পারবে না। এক পাশে স্যালাইন আর এক পাশে রক্তের ব্যাগ ঝুলছে। ইভান অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। ইভানের বিয়ের কথা শুনেই নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি মেঘলা। নিজের পালস কেটেছে। সময় মতো হসপিটালে আনলে হয়তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকতো। কিন্তু তার বাবা মা তাকে আনতে অনেক দেরি করে ফেলেছে। আর ডক্টর হিসেবে মেঘলা ভালো করেই জানত কিভাবে কি করলে তাকে আর ফেরান সম্ভব হবে না। পুরোটাই প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু উপর ওয়ালার হয়তো সেরকম কোন ইচ্ছা নেই। তাই তার প্রস্তুতি তেমন একটা কাজে দেয়নি। এক মাত্র মেয়ের এরকম জীবন মরন আশংকায় তার বাবা মা দিশে হারা। ইভান কোনভাবেই তাদের সাথে কথা বলতে পারছে না। যদিও তার কোন দোষ নেই। তবুও কেন জানি একটা অপরাধ বোধ তার মাঝে কাজ করছেই। যদি মেঘলার বড় কোন ক্ষতি হয়ে যায় তাহলে এর জন্য ইভান সারাজীবন নিজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকবে। সারা রাত পাশে বসে মেঘলার সেবা করেছে সে। সে চায় মেঘলা সুস্থ হয়ে উঠুক। স্বাভাবিক জিবনে ফিরে যাক। প্রতিটা মানুষের সুখী হওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু মানুষ জিবনের সুখের চেয়ে না পাওয়ার বেদনাটাকে বড় করে দেখে। প্রতিটা মানুষের জিবনে অপূর্ণতা থাকেই। সেগুলকে উপেক্ষা করে বেঁচে থাকার লড়াইটাই মুখ্য। অপূর্ণতার জন্য জীবনকে শেষ করে দেয়ার মাঝে কোন প্রাপ্তি নেই। ইভানের ভালবাসা না পেয়ে নিজেকে শেষ করার কথা না ভেবে জদি মেঘলা নিজের জিবনে ভালো থাকার লড়াই করতো তাহলে হয়তো ইভানও আজ এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেত। নিজেও ভালো থাকতে পারবে না। আর তার ভালবাসার মানুষটাকেও ভালো থাকতে দিচ্ছে না। অদ্ভুত নিষ্ঠুরতার স্বীকার আজ ইভান। মেঘলা চাইলেই তাকে এই পরিস্থিতি থেকে বের করতে পারতো।
ইভানের ভাবনার মাঝেই নার্স এসে ঢুকল। ক্ষীণ সরে বলল
–স্যার ম্যাডামকে ইঞ্জেকশন দিতে হবে।
ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–তুমি সব কিছু এরেঞ্জ করো আমি দিচ্ছি।
নার্স ইঞ্জেকশন রেডি করে ইভানের হাতে দিলো। ইভান সেটা নিয়ে মেঘলার হাতে খুব সাবধানে পুশ করলো। নার্স ইভান কে বলল
–স্যার আপনি একটু রেস্ট নেন। আমি ম্যামের কাছে আছি।
ইভান মাথা নাড়িয়ে মেঘলার দিকে তাকাল। তারপর বের হল। বের হতেই মেঘলার মা এসে ইভানের সামনে দাঁড়ালো। মুখে আচল চেপে ডুকরে কেদে উঠলো। ইভান নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। সন্তানকে এই অবস্থায় দেখে তার কতটা কষ্ট হচ্ছে সেটা অনুভব করতে না পারলেও আন্দাজ করতে পারছে সে। ইভান অসহায়ের মতো বলল
–এভাবে কান্না কাটি করলে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আপনি রেস্ট নেন। আমি আছি তো।
মেঘলার বাবা মা দুজনেই গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করলো। মেঘলার বাবা ইভানের হাত ধরে বলল
–আমার মেয়েটাকে ঠিক করে দাও বাবা। আমি ওকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো। ওকে ভালো রাখার চেষ্টা করবো। একবার ঠিক হয়ে যাক।
ইভান নত দৃষ্টিতে মেঘলার বাবাকে বলল
–দোয়া করেন আঙ্কেল। ইনশাহ আল্লাহ মেঘলা ঠিক হয়ে যাবে।
তার কথা শেষ হতেই ইফতি এসে সামনে দাঁড়ালো। ইভান কে জিজ্ঞেস করলো
–ভাইয়া মেঘলা আপু এখন কেমন আছে?
ইভান কোন কথা বলল না। মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিলো খুব ভালো নেই। ইফতি যা বুঝার বুঝে গেলো। কিছু বলতে গিয়েও মেঘলার বাবা মাকে কাঁদতে দেখে থেমে গেলো। ইভান কে উদ্দেশ্য করে বলল
–তোমাকে খুব টায়ার্ড লাগছে। তুমি একটু রেস্ট নাও।
ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
–হুম। আমি বাসায় যাবো। ফ্রেশ হয়ে তারপর আসবো। তুই তো আছিস। কোন প্রবলেম হলে ফোন করিস।
–আমার পরিক্ষা আছে ভাইয়া। শেষ হলে আমি ফ্রি।
ইফতির কথা শুনে ইভানের মনে পড়ে গেলো ঈশারও আজ পরিক্ষা আছে। একটু ভেবে বলল
–ঈশা কোথায়?
–ওপাশে হয়তো সারাদের সাথে কথা বলছে।
ইভান চোখটা বন্ধ করে ফেলল। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
–ঈশাকে আমার কেবিনে আসতে বল। আমি ওখানেই আছি।
কথা শেষ করে ইভান ওর কেবিনের দিকে গেলো। আর ইফতি ঈশার কাছে। ইভান কেবিনে ঢুকে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে ঈশার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু সেটা বেশিক্ষন সম্ভব হল না। ফোন বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নার্স বিচলিত কণ্ঠে বলল
–মেঘলা ম্যামের পালস ড্রপ করছে। তাড়াতাড়ি আসুন স্যার।
ইভান খুব দ্রুত চলে গেলো মেঘলার কাছে। গিয়ে দেখল সত্যি সত্যি মেঘলার অবস্থা ক্রিটিক্যাল। ইভান নার্সকে বলল
–ইমিডিয়েট ইঞ্জেকশনের ব্যবস্থা করো আর আব্বুকে একবার আসতে বল।
নার্স বের হয়ে গেলো। কিছুক্ষন পর ফিরে এসে বলল
–চেয়ারম্যান স্যার এখনো আসেন নি।
ইভান একটু বিরক্ত হল। নার্সের হাত থেকে ইঞ্জেশনটা নিয়ে পুশ করে ফোনটা হাতে নিলো। ইমতিয়াজ রহমান কে ফোন করে বলল
–আব্বু মেঘলার কন্ডিশন ক্রিটিক্যাল। তোমাকে আসতে হবে এখনি।
ইমতিয়াজ রহমান চিন্তিত ভঙ্গিতে ‘আচ্ছা’ বলেই ফোনটা রেখে দিলো। ইভান যথাসাধ্য চেষ্টা করছে মেঘলার পালস স্বাভাবিক করার জন্য। কিন্তু কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। যত সময় যাচ্ছে ততই অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে।
ঈশা ইভানের কেবিনে এসে দেখল কেউ নেই। বের হয়ে বাইরে দাড়াতেই ইফতি এসে বলল
–ভাইয়া মেঘলা আপুর কেবিনে। পালস ড্রপ করছে। অবস্থা ভালো না।
ঈশা বিস্ময় নিয়ে বলল
–মানে?
ইফতি উত্তর দিলো না। মাথা নিচু করে এগিয়ে গেলো। ঈশা বুঝে গেলো বিষয়টা খুব খারাপ পর্যায়ে। সেও তার পিছে পিছে গেলো। ইফতি দরজা খুলে ঢুকল ভিতরে। ইভান চমকে তাকাল। ইফতি মনিটরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো অবস্থা ভালো না। সব কিছু এখন ভাগ্যের হাতে। ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলল
–মেঘলার কিছু হলে আমি নিজেকে কখনও মাফ করতে পারব না। ওর বাবা মাকেই বা কি জবাব দিবো। তাদেরকে শান্তনা দেয়ার ভাষা আমার জানা নেই।
ইফতি ইভানের ঘাড়ে হাত রাখল। ইভান ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখল ঈশা দরজায় দাড়িয়ে এক দৃষ্টিতে মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভানের কথাটা যে ঈশা শুনেছে সেটা সে বুঝতে পারছে। ঈশার মনের অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করছে সে। চোখে মুখে অসহায়ত্ব। কষ্টের ছাপ। ঈশা যে মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে সেটা ইভান ভালো করেই জানে। কিন্তু সে কি করবে। সে যে বড় অসহায়। ইভান উঠে দাঁড়ালো। ঈশার সামনে এসে দাঁড়ালো। ঈশা দৃষ্টি ফিরিয়ে ইভানের দিকে তাকাল। ভীষণ ক্লান্ত সে। ঈশা জানে ইভানের ক্লান্তি এই বিমর্ষতা কিভাবে দূর করতে হবে। একটু হেসে বলল
–ঘুমাওনি সারা রাত না?
ইভান উত্তর দিলনা। উলটা ঈশাকেই বলল
–তুইও তো ঘুমাস নি।
ঈশা ইভানের কথার উত্তর না দিলেও স্বাভাবিক ভাবে বলল
–সকাল থেকে কিছুই তো খাওনি। আব্বু আসলে একটু রেস্ট নিও। নাহলে যদি তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ো তাহলে আরও প্রবলেম হয়ে যাবে।
ইভান ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ঈশা ইফতিকে উদ্দেশ্য করে বলল
–চল। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ইফতি মাথা নাড়িয়ে বের হতেই ইভান ঈশার গালে হাত রাখল। শান্ত কণ্ঠে বলল
–থ্যাঙ্কস!
ঈশা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে ফেলল। ইভান বলল
–জীবনের কঠিন সময় গুলতে আমাকে এভাবে সামলে নেয়ার জন্য।
ঈশা হালকা হেসে বলল
–তোমার মতো করে আমি হয়তো ভালবাসতে পারিনি কিন্তু তোমার কাছ থেকে দায়িত্ব বোধটা ঠিক মতো শিখে নিতে পেরেছি। তুমি আমাকে সব সময় সামলে নিয়েছ। জীবনের অনেক কঠিন সময়ের কথা আমাকে জানতেও দাওনি। এমন অনেক কিছুই আমি আঁচ করার আগেই তুমি সামলে নিয়েছ। তোমাকে সামলানো আমার দায়িত্ব।
ইভান ঈশার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল
–যেতে দিতে ইচ্ছা করছে না।
ঈশা হেসে বলল
–আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ইভান আর কিছু বলল না। ঈশা চলে গেলো। নিজেকে খুব স্বাভাবিক ভাবে প্রকাশ করলেও ঈশার ভিতরে কি চলছে সেটা ইভানের বুঝতে কষ্ট হল না। ঈশাকে সে খুব ভালো মতো চেনে। তার অনুভূতিগুলোর সাথে খুব ভালভাবে পরিচিত সে।
চলবে………