#তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২৪
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। প্রকৃতির নিয়মে ধিরে ধিরে সব কিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। কিছু সময় আগেই সন্ধ্যা পেরিয়ে অতি সজ্জিত পসরা নিয়ে রাত নেমেছে। রাস্তায় রাস্তায় নিয়ন বাতির ঝলক। আবদ্ধ ঘরের এক কোনায় খাটের সাথে মাথা লাগিয়ে মেঝেতে বসে আছে ঈশা। হাঁটু মুড়ে দুই হাতে সেটা চেপে ধরে আছে। চোখটা বন্ধ। মাথাটা এলিয়ে দেয়ায় এলোমেলো চুলগুলো বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঘরটা অন্ধকার। দরজাটা কিঞ্চিত ফাকা থাকায় বাইরের হালকা একটা আলো এসে গুমোট অন্ধকারে বাধা সৃষ্টি করেছে। তার মনের মাঝে এলোমেলো ঝড় বয়ে যাচ্ছে। রুমা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। ঈশাকে এভাবে অন্ধকারে বসে থাকতে দেখে লাইট জ্বালাতে জ্বালাতে বলল
–ঈশা তুমি রেডি?
ঈশা চোখ খুলে তার দিকে তাকাল। ক্লান্ত সরে বলল
–কেন ভাবি?
রুমা ভ্রু কুচকে ফেলল। চারিদিকে ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–কি হয়েছে? এই অবস্থা কেন?
ঈশা নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
–কিছু হয়নি ভাবি। একটু টায়ার্ড ছিলাম। আর রেডি হওয়ার কথা বললে যে? কোথাও যাচ্ছি আমরা?
–কেন তুমি কিছু জাননা? আজ ইফতির মামা মামি আসছে মিরার সাথে ওর এঙ্গেজমেন্টের তারিখ নিয়ে কথা বলতে। ওখানেই যাচ্ছি সবাই। বাবা আর তোমার ভাইয়া চলে গেছে। তুমি রেডি হলেই আমরা চলে যাবো।
ঈশা মনে মনে একটু খুশি হল। ইভান দের বাড়িতে যাবে। উঠে দাঁড়ালো। আলমারির সামনে গিয়ে এলোমেলো ভাবে সব কিছু খুজতে খুজতে বলল
–জানতাম ভাবি। ভুলে গিয়েছিলাম।
রুমা ঘর থেকে বের হতে যাবে তখনই ঈশা ডাকল
–ভাবি?
রুমা ঘুরে তাকাল। এগিয়ে এসে বলল
–কিছু বলবে?
ঈশা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। অসহায়ের মতো বলল
–ভাইয়া যখন তোমার উপরে কোন কারনে রাগ করে তখন তুমি কিভাবে মানাও?
রুমা ভ্রু কুচকে তাকাল। অনেকটা সময় নিয়ে ভাবল। চিন্তিত ভঙ্গিতেই বলল
–অভিমান আর রাগ দুইটা আলাদা জিনিস। আগে তোমাকে বুঝতে হবে সেটা কোনটা। তারপর মানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। রাগ যে কেউ করতে পারে। অভিমান করতে অধিকার লাগে। রাগ সহজেই ভেঙ্গে যায়। কিন্তু অভিমান ভাংতে লাগে তীব্র ভালবাসা। নাহলে সেই অভিমান ক্রমশ দূরত্ব তৈরি করে।
ঈশা অসহায়ের মতো মুখ করে ফেলল। গভির চিন্তায় ডুবে গেলো। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে অভিমান আর রাগের পার্থক্যটা বুঝে উঠতে পারেনি। রুমা একটু হেসে বলল
–আগে পার্থক্যটা বুঝতে শেখ তারপর বাকি সব কিছু ভাববে। এখন রেডি হও। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ঈশা নিজের মতো একটা কাপড় বের করে রেডি হয়ে নিলো। হালকা করে একটু সাজল। বাইরে বের হয়ে রুমা আর তার মার সাথে ইভান দের বাড়ির দিকে বেরিয়ে গেলো। দরজায় কলিং বেল বাজাতেই ইভানের মা দরজা খুলে দিলেন। সবার সাথে কথা বলে ঈশার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন
–এটা আসার সময়? বাড়ির বড় বউ হিসেবে তোর কোন দায়িত্ব আছে কিনা বল? তোর আরও আগে আসার কথা ছিল।
ঈশা ঠোট কামড়ে কান ধরে বলল
–সরি মামনি। ভুল হয়ে গেছে।
ইভানের মা হেসে ফেলল। বাড়ির ভিতরে ঢুকেই ঈশা চারিদিকে চোখ ফিরিয়ে দেখল ইভান সোফায় বসে আছে সবার সাথে। ফোনে কি যেন করছে। কাজ শেষ করে উঠে এসে ঈশার মা আর রুমার সাথে কথা বলল। কিন্তু ঈশার দিকে একবারও ফিরে তাকাল না। ঈশার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ইভান কথা শেষ করে ইফতির কাছে গেলো। তার সাথে কথা বলছে। ঈশা সেখানে গিয়ে দাড়াতেই ইভান চলে গেলো। ঈশা অসহায়ের মতো ইভানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইফতি ঈশার ঘাড়ে হাত রেখে বলল
–তোর জল্লাদের কি হয়েছে রে? মুড অফ মনে হচ্ছে। আবার তোর সাথেও কথা বলছে না। কি ব্যাপার?
ঈশা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ইফতির দিকে তাকিয়ে বলল
–কাজটাই এমন করেছি। তাই তো এসব মেনে নিতে হচ্ছে।
ইফতি এবার নড়েচড়ে ঠিক হয়ে দাঁড়ালো। মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলো। বলল
–কি করেছিস? খুলে বল।
ঈশা অসহায়ের মতো মুখ করে বলল
–ওই যে সেদিন সন্ধ্যায় ক্লাস শেষে তুই থেকে গেলি আর আমি সারাদের সাথে বাসায় এসেছিলাম।
ইফতি একটু মনে করার চেষ্টা করলো। মনে পড়তেই বলল
–হ্যা। তুই সারা আর মনি একসাথে বাসায় আসার জন্য বের হয়েছিলি। তো কি হয়েছে?
–আমরা বের হয়ে অর্ধেক রাস্তায় চলে এসেছিলাম। কিন্ত তখনি সারার বয় ফ্রেন্ড নিরাদ ফোন দেয়। দেখা করতে বলে পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে। সারা একা যেতে চায়না। তাই আমাদের দুজনকেই জোর করে যেতে। আমরা প্রথমে যেতে না চাইলেও সারার অনুরধের কাছে হার মেনে যাই। বাধ্য হয়ে চলে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি নিরাদ একা না তার একজন বন্ধুও আসে। আমি আগেও কয়েকবার ওই ছেলেটাকে দেখেছি। কিন্তু কথা হয়নি। আমরা সবাই বসে গল্প করছিলাম। তখন তোর ভাই আমাকে ফোন দেয় জিজ্ঞেস করার জন্য আমি বাড়ি পৌঁছে গেছি কিনা। ওই মুহূর্তে কিছু মাথায় ঢুকছিলো না। আর জানলে খুব রাগ করবে। তাছাড়া কিছুক্ষনের মধ্যেই বাসায় চলে আসার কথা ছিল। তাই ফটাফট একটা মিথ্যে বলে দেই যে আমি বাড়িতে চলে এসেছি। কিন্তু সব দুরভাগ্য তো আমি সাথে নিয়েই ঘুরি। তাই সেটা বেশিক্ষন কাজে দিলো না। মুহূর্তেই মুষল ধারে বৃষ্টি শুরু হল। সেই বৃষ্টিতে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠে। তাই আমরা সেখানেই বসে থাকি।
ঈশা থেমে গেলো। ইফতি জিজ্ঞেস করলো
–ভাইয়া মিথ্যাটা জানতে পেরেই রাগ করেছে তাই তো?
ঈশা অসহায়ের মতো বলল
–সেটা হলেও তো একটা কথা ছিল। আগে যা হয়েছে এটা তো তার কাছে কিছুই না।
ইফতি কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলো
–তার মানে আসল ক্লাইমেক্স এখনো বাকি। কি করেছিস তুই খুলে বল তো।
ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–আমি কিছুই করিনি। আমার কোন দোষ ছিল না। আমরা ওখানে বসেই ভাবছিলাম কিভাবে বাসায় যাবো। কোন উপায় খুজে পাচ্ছিলাম না। বৃষ্টির বেগ বেড়েই চলেছে আর এদিকে সময়। অনেক রাত হয়ে গেছে। আর সেখানে থাকা সম্ভব হল না। বাধ্য হয়ে বৃষ্টিতে ভিজেই রওনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আশে পাশে কোথাও কোন রিকশা বা সি এন জি কিছুই ছিলোনা। হেটে হেটে আসতে হল। একটু সামনে মোড়ে এসে সারা আর মনি তাদের বাড়ির দিকে চলে গেলো। আমি বললাম একাই যেতে পারব। কিন্তু তারা কেউ মানল না। ফাকা রাস্তা তার উপর অনেক রাত। তাই নিরাদ ওদের সাথে গেলো আর নিরাদের বন্ধু শোভন আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে আসলো আমার সাথে। বিষয়টা আমি তখন বুঝতে পারিনি। তখনও বৃষ্টি ছিল। বাসার কাছাকাছি এসে শোভন আমাকে দাড়াতে বলল। আমি কিছু না ভেবেই দাড়িয়ে যাই। আর সে ফাকা রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে প্রপোজ করে। সে নাকি অনেকদিন থেকে আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু বলার সাহস হয়ে উঠেনি। হয়তো আমার এঙ্গেজমেন্টের কথা জানে না। আমি কিছুই বুঝতে পারিনা কি হচ্ছে। বুঝতে চেষ্টা করি সব কিছু। কিন্তু জতক্ষনে আমি বুঝে উঠি তার মাঝেই একজন এসে পড়ে।
বলেই ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেলে। ইফতি বিস্ময় নিয়ে বলে
–মাই গড! কেস তো বেশ জটিল। এটা তো কয়েকদিন আগের কথা। তুই আমাকে এসব কিছু বলিস নি কেন? এই জন্য বেশ কয়েকদিন থেকে দেখছি ভাইয়ার মুড অফ।
ঈশা চোখ খুলে বলল
–সেদিন থেকেই মানানোর চেষ্টা করছি। কোন লাভ হচ্ছে না। না কথা শুনছে না কথা বলছে। ফোন দিলেও রিসিভ করে না। এস এম এস দিলেও সিন করেনা। এসব নিয়ে আমারও মুড অফ ছিল। তাই তোকেও জানাতে পারিনি।
ইফতি হতাশ হয়ে বলল
–তুই তো জানিস তোর জল্লাদ কেমন। এতো সহজে কি মানবে?
ঈশা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল
–কিভাবে মানাবো বুদ্ধি দে না।
ইফতি একটু ভেবে বলল
–ঘরে নিয়ে যা। গলায় চাকু ধরে বল ‘তুমি যদি আমার সাথে কথা না বল তাহলে আমি নিজেকে শেষ করে দিবো।’
ইফতির কথা শুনে ঈশার মাথা ঘুরে গেলো। কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
–তোর জত্তসব বুদ্ধি নিজের কাছেই জমা রাখ। সেদিন তো একটা থাপ্পড় মেরেছিল শুধু। এরকম কিছু করলে ওই চাকু দিয়েই আমার গলা কেটে দিবে। আমি এতো তাড়াতাড়ি মরতে চাই না।
ইফতি অসহায়ের মতো বলল
–এখানে এখন কিছুই করা সম্ভব না রে। ভাইয়া নিজে থেকে যতক্ষণ চায়নি ততক্ষন কেউ কিছুই করতে পারবে না। তুই তো জানিস। তাই এখন রিলাক্স থাক। এমনিতেই রাগ কমে যাবে। তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।
পাশ থেকে ইফতির ডাক পড়তেই সে চলে গেলো। ঈশা সামনে দাড়িয়ে থাকা ইভান কে দেখছে। টেবিলে হেলানি দিয়ে হাত গুঁজে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে। এই পর্যন্ত একবারও ঈশার দিকে তাকায় নি। ঈশার খুব কষ্ট হচ্ছে ইভানের এমন আচরন মেনে নিতে। যদিও বা তার দোষ আছে চাইলেই অন্য ভাবে শাস্তি দিতে পারে কিন্তু এরকম অবহেলা ঈশা মেনে নিতে পারছে না। ইভানের অভিমানটা যে তার ভালবাসার মতই তীব্র। ঈশাকে প্রতি মুহূর্তে জালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে।
——————
ইফতি আর মিরার এঙ্গেজমেন্টের ডেট ঠিক করা নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। ইভানের দাদিও এসেছে। সবাই সোফায় বসে আলোচনা করছে। ঈশা চা নিয়ে আসলো। সবাইকে দিয়ে চলে যাবে তখনি ইভানের দাদি তাকে ডাকল। সেখানে গিয়ে দাড়াতেই পাশে বসতে ইশারা করলো। ঈশা একটু হেসে পাশে বসলো। সামনের সোফায় বসে ছিল ইভান। তার দাদি ইভান কে ইশারা করে ডাকল। ইভান উঠে দাড়াতেই তাকে ঈশার পাশে বসতে বলল। ইভান তার পাশে বসলো ঠিকই কিন্তু দূরত্ব রেখে। সবাই সেখানে থাকায় ঈশা বেশ লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে বসে থাকলো। ইমতিয়াজ রহমান তাদের দিকে তাকিয়ে একটু ভেবে বললেন
–আমি একটা বিষয় ভেবেছি। যদি কারও কোন আপত্তি না থাকে।
সবাই তার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাল। তিনি একটু সময় নিয়ে বললেন
–আমি ভাবছিলাম ইফতি আর মিরার সাথে আমরা ইভান আর ঈশার এঙ্গেজমেন্ট টাও সেরে ফেলি। এক সাথেই হয়ে যাবে। আর যত তাড়াতাড়ি হয় ততই ভালো।
সবাই কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকলো। ঈশার বাবা বললেন
–আমি আর কি বলবো এখন তুমি যেটা ভালো মনে করো। সেটাই করো।
সবাই সম্মতি দিতেই ইমতিয়াজ রহমান বললেন
–তাহলে আগামি শুক্রবার একসাথে অনুষ্ঠানটা হচ্ছে। এতে তো কারও কোন আপত্তি নাই। আমরা সেভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। হাতে ৬ টা দিন আছে। এর মাঝেই সব রকম প্রস্তুতি শেষ করতে হবে। সময়টা একটু কম হয়ে গেছে কিন্তু সবাই মিলে কাজ করলে খুব একটা অসুবিধা হবে না।
ইমতিয়াজ রহমান কথা শেষ করলেন। ঈশার দিকে তাকিয়ে বললেন
–মামনি? তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পার। মানে তোমারও তো অনেক ধরনের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে। কোন সমস্যা নেই। তুমি যেভাবে চাও সব সেভাবেই হবে।
ঈশা একটু ইতস্তত বোধ করলো। কিন্তু মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
–আমার কিছু বলার নাই আঙ্কেল।
ঈশার কথা শেষ করতেই ইভান গম্ভীর গলায় বলল
–কিন্তু আমার কিছু বলার আছে আব্বু। এই সিদ্ধান্তে আমার আপত্তি আছে।
‘আপত্তি’ কথাটা ঈশার কষ্টের মাত্রা দিগুন বাড়িয়ে দিলো। ছলছল চোখে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান ভাব্লেশ হীন ভাবে নিচের দিকে আছে। ইভানের তো কোন আপত্তি থাকার কথা না।
চলবে…………