তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি পর্ব ২
লেখক – এ রহমান
— ইভান স্যারের জন্য কফি নিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু উনি সেটা না খেয়ে ফেলে দিলেন। আবার বানিয়ে নিয়ে যেতে বলেছেন। বুঝতে পারছিনা কিভাবে বানালে ওনার মন মতো হবে। খুব রাগ করেছেন।
রিসিপশনের সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছিল ঈশা। কথাটা কানে আসতেই থেমে গেলো। পিছনে ঘুরে মেয়েটাকে দেখে নিয়ে কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে একদম নতুন। তাই ইভানের আচরণ সম্পর্কে জানেনা। এই কারণেই ঠিক মতো কফি বানাতে পারেনি। ঈশা মেয়েটাকে বলল
— আমাকে দাও আমি বানিয়ে দিচ্ছি।
ঈশার কথা শুনে সস্তির নিশ্বাস ফেলে সব কিছু তার দিকে এগিয়ে দিলো। ঈশা খুব যত্ন করে কফি বানিয়ে কাপটা হাতে ধরিয়ে দিল। মেয়েটা ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা ভয় পাচ্ছে সেটা বুঝতে পেরে ঈশা একটু হেসে বলল
— ভয় পেয়োনা। এবার কিছু বলবে না।
— যদি রাগ করে তাহলে বলবে ডক্টর ঈশা বানিয়েছে। তাহলেই আর কোন ভয় নেই। আর কোন কথা বলবে না। নামটা শুনলেই সব হাওয়া ফুরুৎ হয়ে যাবে।
ইফতি কথাটা বলেই ঈশার ঘাড়ে ভর দিয়ে দাড়ালো। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আবারও বলল
— ডক্টর ইভানের যখন মুড অফ থাকবে তখন তার সামনে দাড়িয়ে ঈশার নাম নিবে তোমার সকল কষ্টের অবসান হয়ে যাবে বৎস।
হাত উঠিয়ে আশীর্বাদের ভঙ্গি করলো। তার কথা শুনে আসে পাশে সবাই হেসে ফেললো। ঈশা ইফতিকে হালকা হাতে মেরে বলল
— এগুলা কি ভাষা ইফতি?
— কোন গুলা?
একটু ভাব নিয়ে বলল ইফতি।
— ওই যে হাওয়া ফুরুৎ!
— এসব তুই বুঝবি না মাই ডিয়ার ভাবী!
— তুই মানুষ হলিনা ইফতি।
ইফতি অবাক হয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
— কিসব বলিস। তোর আঙ্কেল আমাকে আর আমার ভাইকে মানুষ করতে এতো বড়ো একটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বানালো আর তুই কিনা বলিস আমি মানুষ হয়নি। এই কথা তোর আঙ্কেল শুনলে এখনি স্ট্রোক করবে। নিজের হসপিটালে আর ট্রিটমেন্ট হবে না।
ঈশা বেশ বিরক্ত হলো ইফতির আচরণে। এভাবেই সব সময় সে বিরক্ত করে। ঈশার মজাও লাগে আবার বিরক্তও লাগে। ইফতি ছেলেটা বেশ হাসি খুশি। সবাইকে হাসতে পছন্দ করে। নিজেও সব সময় হাসতে পছন্দ করে। এর সম্পূর্ণ বিপরীত তার বড় ভাইয়া ইভান। জল্লাদের মত আচরণ।
— তুই তোর জল্লাদের সাথে দেখা করেছিস?
ঈশা না বলে মাথা নাড়ালো। ইফতি তার সামনে দাড়িয়ে হাত জোর করে বলল
— প্লিজ এখনি যা। দেরি করিস না। তুই দেরি করলে আমাদের সবার উপরে কিয়ামত সৃষ্টি হবে। কেনো খামাখা এই নিরীহ প্রাণীদের জানের পিছে পড়ে আছিস। রহম কর।
ঈশা রাগী চোখে তাকাল। ইফতি কে ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল
— আমার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যাবনা।
কথাটা বলেই দ্রুত পেয়ে চলে গেলো।
——————-
ইভান কেবিনে বসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলো। দরজায় নক করার আওয়াজ কানে আসতেই গলা তুলে বলল
— কাম ইন!
মেয়েটা কফি নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। ইভান মেয়েটাকে দেখে ভ্রু কুচকে তাকাল। সে ধরেই নিয়েছে যে এবারও কফি আগের মতোই হয়েছে। তাই রাগ দেখানোর জন্য রেডি হয়ে গেলো। কিন্তু কফিতে চুমুক দিয়ে থেমে গেলো। মেয়েটা বেশ ভয় পেল। আরেকবার চুমুক দিয়ে হাসলো। এবার মেয়েটা একটু স্বস্তি পেল। ইভান হেসে বলল
— কফি কি ঈশা ম্যাডাম বানিয়েছে?
মেয়েটা অবাক হয়ে গেলো। না বলতেই ইভান কিভাবে বুঝে গেলো। ঈশা ইভান কে অনেক বড় কফি বানিয়ে খাইয়েছে। ইভান এই টেস্ট টা খুব ভালো মত বুঝতে পারে। তাই তো সে একবার মুখে দিয়েই বুঝে গেছে। ইভান আবার জিজ্ঞেস করলো
— ম্যাডাম এখন কোথায়?
— ইফতি স্যারের সাথে কথা বলছে।
মেয়েটা নত দৃষ্টিতে উত্তর দিলো। ইভান কোন কথা বলল না। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে সে বের হয়ে এলো। ইভান হাসি মুখে কফিতে চুমুক দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বলল
— তোর এই ছোট ছোট কেয়ার গুলাই একদিন আমাদেরকে অনেক কাছে নিয়ে আসবে দেখিস!
আবার কফিতে কামুক দিতে যাবে তখনই দরজা খুলে ফোন কানে লাগিয়ে কথা বলতে বলতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ভিতরে ঢুকলো ইমতিয়াজ রহমান। বাবাকে দেখে ইভান দাড়িয়ে যেতেই তিনি হাত দিয়ে তাকে বসতে ইশারা করলো। ইভান বসে পড়লো। তিনিও ছেলের সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পড়লেন। ফোনে কিছুক্ষণ কথা বলে তারপর রেখে দিলেন। ইভান এর দিকে তাকিয়ে বলল
— ইভান তোমার সাথে আমার কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে।
— বলো আব্বু।
— আমাকে একটা জরুরী কাজে আজ রাতেই সিঙ্গাপুর যেতে হবে। ৪ দিনের জন্য। কিন্তু সব থেকে বড়ো প্রবলেম হলো আমরা যে রেয়ার অপারেশনটা করতে যাচ্ছি সেটার জন্য কলকাতা থেকে ডাক্তারের টিম আসছে। আর আমি থাকতে পারবো না। সব কিছু কিন্তু তোমাকেই সামলাতে হবে।
ইভান কথাটা শুনেই চিন্তিত হয়ে গেলো। এলোমেলো চিন্তা গুলো সব কেমন মস্তিষ্কে ভিড় করেছে। অল্প কিছুদিন হলো পড়া শেষ করে সে জয়েন করেছে। এখনো তেমন এক্সপার্ট হয়নি। এতো কিছু সামলানোর মত ক্ষমতা এখনো তার তৈরি হয়নি। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ইমতিয়াজ রহমান ইভানকে চিন্তায় পড়ে থাকতে দেখে বলল
— আমি জানি তুমি কি ভাবছো। পরিস্থিতি মানুষকে সব কিছু শিখিয়ে দেয়। আজ যদি আমি না থাকি কাল তোমাকে ঠিকই সব সামলাতে হবে। আর আমি জানি তুমি সামলে নিতেও পারবে। সময়ের শিক্ষা অনেক বড় শিক্ষা ইভান।
ইভান ভাবতে লাগলো। তার বাবার কথা ভুল না। কিন্তু তবুও কিছু একটা থেকেই যায়। ইমতিয়াজ রহমান আবার বললেন
— তুমি চাইলে কাউকে হেল্প এর জন্য সিলেক্ট করতে পারো। কাকে চাও?
ইভান চিন্তিত হয়ে ভেবে বলল
— আমি বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নিবো আব্বু।
ইমতিয়াজ রহমান হাসলেন। ইভান যে ভয় পাচ্ছে সেটা তার মুখ এবং গলার সর শুনেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু দায়িত্ব তো তাকে নিতেই হবে। তাই তিনি উঠতে উঠতে বললেন
— আমি উঠি আজ রাতেই আমাকে যেতে হবে। আল্লাহ হাফেজ।
— আল্লাহ হাফেজ আব্বু।
কথা শেষ করে ইমতিয়াজ রহমান দ্রুত পেয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলেন ঈশা দাড়িয়ে আছে। ঈশা ওনাকে দেখেই বললেন
— আস সালামু আলাকুম আঙ্কেল। কেমন আছেন?
ইমতিয়াজ রহমান সশব্দে হেসে উঠলেন। উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন
— ওয়ালাইকুম আস সালাম। ভালো আছি। তুমি কেমন আছো মামনি?
— ভালো আছি আঙ্কেল।
নম্র কণ্ঠে বলল ঈশা। মেয়েটার এই নম্রতাই সবাইকে আকৃষ্ট করে। ইমতিয়াজ রহমান মেয়েটাকে বেশ পছন্দ করেন। এই মেয়ে তার ছেলের বউ হবে ভেবেই মনটা বেশ ভালো হয়ে গেলো। তিনি খুব খুশি। এই মেয়ে যে তার ছেলেকে এতো ভালোবাসে সেটা আগে বুঝতে পারলে তিনি তার ছোট বেলার বন্ধুর কাছ থেকে জোর করে এই মেয়েকে বাড়ির বউ করে নিয়ে আসতেন। কিন্তু এই মেয়ে এতই নরম যে সে তার মনের কথাও কাউকে জানায়নি। এমন কি ইভান কেও নয়। তিনি মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করার ভঙ্গিতে হাত নাড়তেই থেমে গেলেন। পিছনে ঘুরে ইভানের দিকে তাকিয়ে বললেন
— তুমি চাইলে কিন্তু ঈশা কে সাথে নিতে পারো। সে খুব বিচক্ষণ মেয়ে। তোমাকে যথেষ্ট হেল্প করতে পারবে।
ইভান কথাটা শুনেই হাসলো। তার খুব ভালো লাগলো। সে একটু হেসে বলল
— অবশ্যই আব্বু। আমি জানি। তুমি ভেবোনা।
ইমতিয়াজ রহমান ঈশার মাথায় হাত দিয়ে বললেন
— পারবে না দুজনে মিলে সব সামলে নিতে?
ঈশা হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো। ইভান হাসলো। কারণ সে জানে ঈশা কোন ভাবেই কারও মুখের উপরে কথা বলবে না। ইমতিয়াজ রহমান হেসে ঈশার মাথায় হাত দিয়ে বললেন
— তুমি খুব ভালো। অনেক সুখী হবে তুমি মামনি।
বলেই তিনি চলে গেলেন। ঈশা তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো। কিভাবে সুখী হবে? সুখটা যে এই ইভান নামক জল্লাদের হতে বন্দী। তাহলে সুখী হওয়ার স্বপ্ন দেখা কি তার জন্য ঠিক? ইভান চেয়ারে বসে ইশাকে দেখছে। কি ভাবছে সে সেটা বুঝতে পেরে মন খারাপ হলো ইভানের। সে ঈশা কে এতো ভালবাস তবুও তার মন ছুতে পারেনা। তার নিজেরও খুব খারাপ লাগছে এখন। ঈশা ভিতরে এসে দাড়ালো। ইভান তার দিকে না তাকিয়েই বলল
— ক্লাস শেষ?
ঈশার খুব রাগ হলো। নিজের ইচ্ছা না থাকার সত্বেও আজ এই জালিমের হুকুম পালন করতে তাকে এখানে দাড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ইভান এর আদেশ ঈশা যেনো ক্লাস শেষ করে বাড়ি যাওয়ার আগে তার সাথে দেখা করে তারপর যায়। তাই তো সে এখানে এখন। ইভান ঈশার চুপ করে থাকা দেখে রেগে গেলো। একটু ধমকের সুরে বলল
— কথা কি মেশিনে তৈরি হয় তারপর তোর মুখে আসে?
ঈশা রেগে গেলো এমন কথা শুনে। বিরক্ত হয়ে বলল
— আমি ভিশন টায়ার্ড। বাসায় যাবো।
ইভান কোন কথা বলল না। চেয়ার থেকে উঠে ঈশার সামনে এসে দাড়ালো। টেবিলে বসে ঈশার মুখের দিকে একটু ঝুঁকে গেলো। ক্লান্ত মুখে ছোট ছোট চুল গুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। ফু দিয়ে সেগুলো সরিয়ে দিল। তারপর বলল
— তুই জানিস আমি তোকে কেনো এখানে প্রতিদিন আসতে বলি?
— কেনো?
মুখটা একটু কাছে এনে মোহনীয় কণ্ঠে বলল
— এই যে তুই পুরোটাই একটা জ্বলন্ত অগ্নি কুণ্ড! এই অগ্নি কুণ্ডের যত কাছে আসি ততই তার উষ্ণতা আমার তৃষ্ণা বাড়িয়ে দেয়। আর এই তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আমি আরো কাছে চলে যাই। কিন্তু পানির তৃষ্ণার চেয়ে যে দৃষ্টির তৃষ্ণা বড়ই ভয়ংকর! এর নিবারণ একেবারেই অসম্ভব!
চলবে….
(সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। এতটা সাপোর্ট পাবো ধারণা ছিলনা। আপনাদের ভালবাসা লেখার আগ্রহ বাড়িয়ে দিচ্ছে। সবাইকে অনুরোধ করবো একটু ধৈর্য ধরে গল্পটা পড়বেন। প্রতি পর্বে একটু একটু করে কাহিনীর খোলাসা হবে। তাই একটু ধৈর্য ধরে সাথে থাকবেন।)