#তোমাতেই_আমি
#হালিমা_চৌধুরী
#পার্ট_৭
রাতে শুয়ে শুয়ে চিঠি টা আরেক বার ভালো করে দেখে খুব যত্ন করে লুকিয়ে রাখলাম। তারপর মোবাইল নিয়ে পূর্ণ ভাইয়ার নাম্বার ডায়াল করলাম। কিন্তু ফোন করার সাহস হয়নি। কি না কি ভাববে পূর্ণ ভাইয়া সেই কথা ভেবেই মোবাইলটা জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
রাত যখন ২ টা বাজে ঠিক সেই সময়ে পূর্ণ ভাইয়া ফোন করেন। প্রথমবার ধরতে ধরতেই কেটে গেলো। ২য় বার কল আসার সাথে সাথেই রিসিভ করলাম।
‘ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?’
আমি ঘুমঘুম চোখে বলি,
‘এতো রাতে জেগে থাকবো কেনো? আর এতো রাতে কল করার মানে কি!’
‘তোমাকে তখন কল দেওয়ার পর তোমার ভাবি এসে গেলো তাই এতক্ষন ভয়ে ফোন করিনি যদি তোমার পাশে কেউ থাকে তাই।’
পূর্ণ ভাইয়ার এরকম অসহায় ভরা কন্ঠ স্বর শুনে আমার রাগ নিমিষেই হাওয়ায় মিশে গেছে। এরকম ভিতুর মতো কথা শুনে আমি মুখ টিপে হেসে দেই।
‘হাসছো নাকি?’
আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বলি,
‘আরে আজব হাসবো কেনো? আপনার মতো এতো ভিতু আমি দু’জন দেখিনি। এতোই যখন ভয় তাহলে প্রেম করতে আসলেন কেনো?’
‘আমার ভয় তো তোমাকে নিয়ে আমার জন্য যদি তোমাকে বকা খেতে হয় তাই জন্য। আমি এখন ও একটা স্টুডেন্ট কোনো চাকরি-বাকরি করি না। হুট করে তোমার পরিবার জেনে গেলে কি ভাববে বলো!’
‘সেটা প্রেম করার আগে ভাবা উচিত ছিলো। খুব তো আমাকে রাস্তায় দাড় করিয়ে ভাষণ দিয়েছেন আমি চেয়ারম্যানেরর ছেলে আরো কত কিছু বলেছেন তখন ভয় পাননি?’
‘আমার পরিবার তোমাকে মেনে নিবে তোমার পরিবার আমাকে মেনে নিবে? কখনো কোনো পরিবার একটা বেকার ছেলের হাতে তাদের মেয়েকে তুলে দেয় না।’
‘আমি আমাদের শেষ কি হবে সেই নিয়েই ভাবী। পূর্ণ ভাইয়া এই সম্পর্কের কোনো মানে হয় না। একটা সম্পর্কে যদি দুজনেই সম বয়সী হয় তাহলে তাদের সম্পর্কে টা টিকে থাকে না।’
আমার কথা শুনে পূর্ণ ভাইয়া ক্ষীপ্ত মেজাজে বলে,
‘সময়ের সাথে সাথে ম্যাচুউরিটি আসবে। এর জন্য কি আমরা আমাদের সম্পর্ক টা শেষ করে দিবো?’
‘আমি জানি না কি করবেন। সমবয়সী দুজন যদি বিয়ে করে তাহলে মেয়েটার সংসারের চাপে ম্যাচুউরিটি এসে যায় কিন্তু একটা ছেলে সে তো আগের মতোই থেকে যায়। এতে করে তাদের মনের মিল থাকেনা সাথে সম্পর্ক টা ডিবোর্সেরর রুপ নেয়। আমরা এখনো এতোটা গভীরে চলে যায়নি আমাদের সম্পর্ক শেষ করে দেওয়ার এখনো সময় আছে।’
আমার কথা শুনে পূর্ণ ভাইয়া রাগে গজগজ করছে তা আমি তার বিপরীত পাশে থেকেই বুঝে গেলাম।
‘এতোই যখন তোর চিন্তা সম্পর্কটা নিয়ে তাহলে আমার সামনে আসলি কেনো? আমাকে বললি অপেক্ষায় থাকতে সেটার কি হবে। কেনো আমাকে অপেক্ষা করতে বললি?’
পূর্ণ ভাইয়ার এই রুপ দেখে আমি কেদেই দিলাম। নিজেকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে বলি,
‘আমি তো জানতাম না আপনি আমার জন্য অপেক্ষায়… ‘
আর কিছু বলার আগেই ফোন কেটে গেলো।
.
সারারাত নির্ঘুমে কেটে গেলো। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে স্কুলের জন্য বেরিয়ে পড়লাম। স্কুলে ক্লাস করার মাঝখানে হঠাৎ ক্লাসরুমে চেয়ারম্যান পৃথুল প্রবেশ করেন। সবাই তার যত্ন করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। উনি তার পরোয়া না করে আমার সামনে এসে দাড়ান। আমার দিকে আহত পাখির ন্যায় তাকিয়ে আছে।
‘তুমি আমার সাথে একটু হাসপাতালে আসবে?’
আমি পূর্ণ ভাইয়ার আব্বুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। পেছন থেকে আদ্র স্যার বলেন,
‘কেনো স্যার কোনো কাজ আছে?’
‘ও তো আমার মেয়ের মতো। নিজের মেয়েকে নিতে তো কোনো সমস্যা নেই।’
আদ্র স্যার আমাকে ইশারায় উনার সাথে যেতে বলে। আমি আর কোনো উপায় না পেয়ে উনার সাথে ক্লাস থেকে বের হই। উনি একটা সিএনজি ডেকে আমাকে উঠতে বলে। আমি বাদ্য মেয়ের মতো সিএনজিতে উঠে বসি।
.
সিএনজি এসে একটা হাসপাতালের সামনে থামে।
‘স্যার আমরা এখানে এসেছি কেনো?’
উনি হঠাৎ আমার সামনে হাত জোর করে বলে,
‘মা পূর্ণ আমার একমাত্র ছেলে তুুমি ওকে কষ্ট দিয়ো না।’
আমি অবাক হয়ে বলি,
‘কি হয়েছে পূর্ণ ভাইয়ার?’
‘জানিনা কালকে রাতে অনেকগুলো ঘুমের ঔষধ একসাথে খেয়ে ফেলে। তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নেওয়াতে একটু আগে জ্ঞান ফিরেছে। জ্ঞান ফেরার পর থেকে শুধু তোমার নাম নিচ্ছে।’
আমি অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। পূর্ণ ভাইয়া যে এমন করবে আমি তা কল্পনাও করিনি। পূর্ণ ভাইয়ার আব্বু আমাকে তাড়া দিয়ে বলে,
‘তাড়াতাড়ি চলো মা। আমার ছেলেটা কারোর কথা শুনছে না।’
আমি তাড়াতাড়ি উনার পিছন পিছন হেটে হাসপাতালের ভিতরে প্রবেশ করি। উনি একটা কেবিনের সামনে এসে আমাকে ভিতরে যেতে বলে নিজেও ভিতরে আসে।
‘পূর্ণ উঠ দেখ কে এসেছে!’
পূর্ণ ভাইয়া আগের মতোই শুয়ে আছে কোনো হেলদোল নেই।
‘মা তুমি একটু দেখো না ছেলেটার কি হয়েছে। আমরা বাহিরে অপেক্ষা করছি।’
বলেই পূর্ণ ভাইয়ার আব্বু কেবিন থেকে বের হয়ে যায়। আমি আস্তে আস্তে গিয়ে ছোট্ট বেড টার এক পাশে বসি।
‘পূর্ণ ভাইয়া কি হয়েছে আপনার?’
আমার কথা শুনে উনি চোখ খুলে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
‘ম্যাচুউর একটা মেয়ে কি করে একটা অবুঝ ছেলেকে দেখতে এসেছে?’
উনার কথার মানে বুঝতে আমার বেশিক্ষন লাগেনি।
‘আমি আপনাকে আমাদের ভবিষ্যৎ ভেবে এগুলো বলেছি। আপনাকে তো ছেড়ে দিতে বলিনি আমাকে। আপনার মতো এরকম ভিতু লোক দিয়ে আমার চলবে না।’
‘আমাকে দিয়ে না চললে চালাক কাউকে খুজে নাও। সবাই তো আর সবার মনের মতো হতে পারে না।’
‘এই শুনুন কাপুরুষেরর মতো না চলে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে চলেন। আমি সত্যি আপনাকে চাই না আপনাকে এতোদিন একটা চ্যালেন্জ দিয়েছি আপনি সেটাতে জিতে গিয়েছেন আমি হেরে গিয়েছি। হয়তো আমি একটু দূর্বল হয়ে পড়েছি আপনার উপর কিন্তু সেটা ক্ষনিকের ভালো লাগা। তাই সম্পর্ক টা থেকে মুক্তি চাই আমি। শুধু শুধু আমার জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিলেন।’
কথাগুলো বলার সময় কপোল বেয়ে একফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। আমি চোখের পানি মুছে দাড়িয়ে পড়লাম যাওয়ার জন্য পিছন থেকে পূর্ণ ভাইয়া আমার হাত ধরে ফেলে।
‘ওহ রিয়েলি? এতোই সহজ এই পূর্ণর থেকে মুক্তি পাওয়া? আমি কাপুরুষ না!’
বলেই উনি চিৎকার দিয়ে উনার বাবাকে ডাকে। উনার বাবা একপ্রকার দৌড়ে কেবিনে প্রবেশ করে।
‘বাবা আমি এই মেয়েকে ছাড়া বাঁচবো না। আমি ওকে চাই।’
হঠাৎ উনার এতো পরিবর্তন দেখে আমি আৎকে উঠি।
‘তোমাদের বয়স অনেক কম নাহলে তোমাদের আমি বিয়ে দিয়ে দিতাম।’
‘আমি ওকে চাই বাবা কিন্তু ও আমাকে চায় না আমি ওকে বিয়ে করবো বাবা। ওকে আমার মাঝে বন্ধি করে রাখবো।’
‘আপনারা কি শুরু করেছেন? আমি বিয়ে করতে চাই না। আমাকে বন্ধি করা এতো সহজ না।’
বলেই আমি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যাই।
.
হাসপাতাল থেকে আমি একেবারে বাড়িতে চলে আসি। এসেই রুমের দরজা আটকে দিয়ে বেলকনিতে চলে এলাম। বেলকনিতে কখন যে কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরই পাইনি। ভাবির ডাকে ঘুম ভাঙে আমার। দরজা খুলে দিতেই ভাবি হুড়মুড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।
‘নিচে চলো স্রুতি।’
ভাবির এতো ভয়ার্ত কন্ঠ স্বর শুনে বলি,
‘কি হয়েছে ভাবি?’
‘নিচে চেয়ারম্যান এসেছে। তুমি চলো আমার সাথে।’
বলেই ভাবি আমাকে একপ্রকার টেনে ড্রয়িং রুমে নিয়ে যায়। নিচে এসেই আমি পুরো স্তব্ধ হয়ে যাই। ছয় সাত জন লোক পুরো বিয়ের আসর নিয়ে এখানে উপস্থিত হয়। পূর্ণ ভাইয়ার মা আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বলে,
‘এইতো আমার বউমা চলে এসেছে।’
বলেই আমাকে টেনে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দেয়। আর আমি স্তব্ধ হয়ে এদের কর্মকান্ড দেখছি।
চলবে…….