#তোমাতেই_অস্তিত্ব_আমার
লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
অন্তিম পর্ব
বেশ কিছুদিন কেটে গেলো এভাবেই।আরমান আমার সম্পর্কে এখনো কোথাও কিছুটা খাদ।বুঝতে দিতে চান নি উনি আমাকে,কিন্তু কেনো জানি না মনে হতো কোনো বিষয়ে উনি এখনো চিন্তিত।মুখ ফুটে বলতাম না কিছুই।অগাধ বিশ্বাস করি ওনাকে আমি।সময় হলে ঠিকই সবটা বলবেন উনি আমাকে।দৃঢ় বিশ্বাস আমার।এ বাসায় বেশ মানিয়ে নিয়েছি।সময় কাটে ভার্সিটি, আম্মুর কেয়ারিং,আরুর দুষ্টুমি,আব্বুর বাচ্চামো,আরমানের ছোটছোট ভালোবাসায়।আব্বু আম্মু,মিশু,রিজোয়ানও এসেছিলো এর মধ্যে।সুহানা আপু ওনার বাবার সাথে ওদেশে ফিরে গেছেন।
আজ রিয়াপি আর আদিব ভাইয়ার এনগেইজমেন্ট।আরমান বলেছিলেন,আদিব ভাইয়া নাকি অনেক আগে থেকেই চোরের মতো রিয়াপিকে ভালোবাসতো,বলার সাহস পায়নি।তাই আগেরদিন আরমান গিয়ে কবির আঙ্কেলের সাথে কথা বলে এসেছেন।আদিব ভাইয়ার মা বাবা কার এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর আরমানই ওনার সব।সবটা জেনে আপত্তি করেন নি কবির আঙ্কেল,তার কথা যেখানে আরমান নিজে এসে বলেছে,কোনো আপত্তির কারনই থাকতে পারে না।আমি রিয়াপির সাথে কথা বলেছিলাম।আপিও মানা করেনি।কবির আঙ্কেল যখন মত দিয়েছেন,আপি আর কিছু বলতোও না।আপির সাথে কথা বলে এটাও বুঝেছিলাম,ওরও আদিব ভাইয়ার জন্য সফট্ কর্নার আছে।
আয়নার সামনে বসে দুল পরছিলাম।আচমকা চোখ গেলো বেডের পাশে দাড়িয়ে রিস্টওয়াচ পরতে থাকা মানুষটার দিকে।আরমান নীল শার্টের উপর এ্যাশ ব্লেজার পরেছেন।এ্যাশ প্যান্ট।চুলগুলো স্পাইক করা।হাতা এলোমেলো,এখনি গুটিয়ে নেবেন।কিছুক্ষন আটকে থেকে দুল পরে চুল সেট করতে মন দিলাম।আরমান বললেন,
-আরো তাকিয়ে থাকো না।বরটা তো তোমারি।
আয়নায় দেখলাম ওনাকে।শার্টের হাতা ফোল্ড করতে ব্যস্ত উনি।ওভাবেই বললেন,
-নজরটিকা দিয়ে যাও,নইলে অন্য কারো নজর লাগবে।
ভেংচি কেটে উঠে গিয়ে ওনার দাড়িয়ে সামনে দাড়িয়ে বললাম,
-কোনো দায় পরেনি আমার আপনাকে নজরটিকা লাগানোর।
কথাটা বলে যেই চলে আসবো উনি আমার হাত হেচকা টানে ধরে ওনার সামনে দাড় করালেন।আমার চোখে আঙুল লাগিয়ে তা দেখে মুখ বাকিয়ে বললেন,
-সবসময় ভ্রমে ফেলে দেয় তোমার ওই চোখ।একফোটা কাজলও নেই ওখানে,আর দেখে মনে হয় যেনো…
আমি ভ্রুকুচকে তাকিয়ে দেখছি শুধু।আরমান আর কিছু না বলে ড্রেসিং টেবিল থেকে আঙুলে কাজল লাগিয়ে কানের পেছোনে ছোয়ালেন আমার।দুহাতে আমার গাল ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললেন,
-খুব কি দরকার তোমার এভাবে নীল শাড়ী পরে আমাকে দুর্বল করে দেওয়া?খুব কি দরকার এতোটুকো না সেজেও ওই মায়াবী চেহারার বারবার মোহে ফেলতে বাধ্য করা?খুব জরুরি কানের দুলটার উপরে পরা আলোর ঝলকানি দিয়ে আমার দৃষ্টিকে ঝলসে দেওয়া?কিসের এতোটা দরকার খোলা চুলের সুঘ্রানে আমার বোধশক্তি নষ্ট করে দেওয়া?কি দরকার তোমার মিথি?কেনো করো এমনটা তুমি?
কথাগুলো বলে আর একমুহুর্ত দাড়ালেন না উনি।রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।কিছুক্ষন ফ্রিজড হয়ে থেকে কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করলাম।বোধগম্য হলো না আমার কিছুই।আরুর ডাকে রুম থেকে বেরিয়ে সবার সাথে আপিদের বাসায় পৌছালাম।রিয়াপি গোলাপি শাড়ি পরেছে,আদিব ভাইয়া কোট পরে কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে।বেচারাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে আপির চেয়ে বেশি নার্ভাস সে।আরমান গিয়ে তার কাধে চড় মেরে বললেন,
-কিরে ভাই!বলেছিস?
আদিব ভাইয়া ঠোট উল্টে ঘাড় দুলিয়ে না বুঝালো।আমিও আপির পাশেই দাড়িয়ে ছিলাম।আপিকে তো টিজ করা যাবে না সবার সামনে,তবে ওনাদের কথায় মনোযোগ দিলাম।
-আপি বলেছে?
-না।
আরমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-ঠিকই আছে ভাই।এর নাম রিয়া।ভাঙবে তবু মচকাবে না।
-ওই!আমার বউ ও,এভাবে বলিস না।
-ওম্মা ওম্মা ওম্মা!!!উডবি নিয়েই এই দশা?চাল আরমান।তু আব কোই নেহি!
বলে সরে যেতে লাগলে আদিব ভাইয়া ওনার হাত জাপটে ধরে বললেন,
-প্লিজ প্লিজ ভাই।মাফ চাই।জীবনেও আর তরে ছাড়ি রিয়ার গুন গাইতাম না।আজকে পার করায়া দে।
আরমান টেডিস্মাইল দিয়ে বললেন,
-তাহলে বল,নেক্সট দু সপ্তাহের মিটিং তুই সামলাবি?মিথির সাথে প্রেম করবো,সময় লাগবে।
-দুইইইই সপ্তাহ?
-ভেবে দেখ!
-দেখেছি।দেখেছি ভাই।ফিউচার ট্রাভেল করে এসেছি আমি।আজ সবার সামনে রিয়াকে না বললে,আজীবন খোটা দিবে আমাকে ও,কাল ফোনে এই টেক্সট করেছে।তোর দু সপ্তাহ আমার যা।
আরমানের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।উনি সরে গিয়ে ড্রয়িংরুমের মাঝে দাড়িয়ে বললেন,
-এটেনশন প্লিজ!আদিব রিয়াপিকে কিছু বলতে চায়।
সবাই কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে।আদিব ভাইয়া কেস খেয়েছে এমন লুকে চোখ বড় বড় করে সবাইকে দেখছে।রিয়াপি উল্টোটাই।চোখ ছোটছোট করে আদিব ভাইয়ার দিকে তীক্ষ্মনজরে দেখছে।ভাইয়া এদিকে দেখলেই ভস্ম হয়ে যাবে যেনো।আদিব ভাইয়া ঢোক গিলে এগিয়ে আরমানকে ফিসফিসিয়ে বললো,
-তোকে বলেছিলাম ম্যানেজ করতে,উল্টে কেস খাইয়ে দিলি?
-তো তোর কথা আমি গিয়ে বলবো রিয়াপিকে?আই লাভ ইউ রিয়াপি?
আদিব ভাইয়া জোর গলায় বললো,
-তুই কেনো বলবি?আমিই বলবো।
-তো বল!
আবারো মিনমিনে গলা আদিব ভাইয়ার।বললো,
-কি করে বলবো?
আরমান কপাল চাপড়ে বললেন,
-বউ হয় তোর!চল যা!
কথাটা বলে ধাক্কা মেরে দিয়েছে আদিব ভাইয়াকে।একদম রিয়াপির সামনে এসে পরেছে।বেচারা সিংহের খাচায় ঢোকা টাইপ ফিল নিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।একটা দম নিয়ে গরগর করে বলে উঠলো,
-আইলাভইউরিয়া।ভালোবাসিতোমাকে।
এ কথায় সবাই হোহো করে হেসে উঠলো।আদিব ভাইয়া চোখ খুলে বোকার মতো বোঝার চেষ্টায় আছে কি হয়েছে এখানে।বড়রা হাসাহাসি করে একটু দুরে চলে গেলেন।আমরা তখনো হাসছি।রিয়াপি দাতে দাত চেপে বললো,
-আই লাভ ‘ ইউরিয়া ‘?ইউরিয়া ভালোবাসেন আপনি?আংটিবদল হোক একবার,ইউরিয়া,পটাশ,ম্যাঙ্গানিজ সব সার আর প্রেসটিসাইডস্ বের করবো আপনার।
আপির কথায় আরো হাসলাম সবাই।আদিব ভাইয়া মেকি হেসে চুপসে রইলেন একদম।আরমানের উচ্ছস্বরের হাসিও দেখলাম আমি।কে বলবে,ওনাদের এর বাইরেও জীবন ছিলো,আছে!!আংটিবদল শেষে শাড়ীটা গোছাতে আপির রুমের দিকে যাচ্ছিলাম।করিডোরে যা দেখলাম পা থেমে গেলো আমার।চেচিয়ে বললাম,
-ওই হারামিইইইই!
সামনের দুজন ধরা পরা চোরের মতো আতকে উঠলো।সবাই যখন ওখানে এনগেইজড্ কাপলের সাথে বিজি,সবার চোখ এরিয়ে দেয়ালে লেপ্টে আরিশা দাড়িয়ে আছে,একপাশে হাত দিয়ে হেলান দিয়ে রায়হান দাড়িয়ে।দুজনে মিটমিটিয়ে হাসছে আর কথা বলছে।বোঝাই যাচ্ছে ওরা প্রেম করছে।আমাকে দেখেই দুজন সামাজিক দুরুত্ব বজায় রাখা থিওরি অ্যাপ্লাই করলো,ছিটকে সরে গেলো একদম।আমি এগিয়ে গিয়ে রাগী গলায় রায়হানকে বললাম,
-ও,এই তোর সেই গফ?আমার ডিপার্টমেন্টের?তাইনা?এজন্যই তো চান্দু সবাইরে তুই বললেও এরে তুমি বলতা!তখনি বোঝা উচিত ছিলো আমার।
-ম্ মিথি…
আরুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
-ও,এই তুই সিঙ্গেল আরু?দাড়া তোর ভাইয়াকে ডাকছি।বার করে দিবে তোর ব্যাচমেটের সাথে প্রেম করা।
আরু ভয়ে একদম কাপাকাপি করছে।রায়হান বাবু হয়ে মেঝেতে বসে দুহাত জোর করে বললো,
-মাফ করে দে মিথি।ওর হিটলার ভাইকে কিছু বলিস না।এতোদিন কেমনে যে ফাকি দিছি তা আমিই জানি।আজই ব্রেকাপ করবো।পাক্কা!
এরমধ্যে আশু মালুও চলে এসেছে।আমি ইশারাতেই বুঝিয়ে দিলাম কাহিনী কি।ওরাও শুরু করলো রায়হানকে ভয় দেখানো।আচমকাই আরমান এসে বললেন,
-আশা,মালিহা,মিথি,কাবাব মে হাড্ডি হওয়া ছাড়া কিছু শেখো নি না তোমরা এই গ্রুপের মেয়েগুলো?
আমরা সবাই হা করে তাকিয়ে আছি।আরমান বললেন,
-কি?অমন লুক দিচ্ছো কেনো?আশা,মালিহা যাও তো।আরু,তুই আমাকে বড্ড জ্বালিয়েছিস,তোর বেলায় কিন্তু ছাড় দিলাম।
রায়হানকে বললেন,
-একমাত্র বোন আমার!তাড়াতাড়ি পড়াটা শেষ করে জবে ঢোকো,খালি এভাবে প্রেম দিয়ে তো আর জীবন চলে না।আর শুধুশুধু ব্রেকাপ ব্রেকাপ করলে কিন্তু তোমারই ব্রেক ফেইল করাবো আমি।আমার বোন যেনো কষ্ট না পায়।গট ইট?
রায়হান তাড়াতাড়ি মাথা ঘুরালো।আমি আর আরু শকেই আছি।আরমান বললেন,
-গুড।ইউ মে কন্টিনিউ।
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-এইযে ম্যাডাম,ওদের প্রাইভেসি দিবেন তো,নাকি?
আহম্মকের মতো বললাম,
-হু?
আরমান বিরক্তি নিয়ে হাত ধরলেন আমার।টেনে নিয়ে এসে দাড় করালেন এককোনে।বললেন,
-ওদের মাঝে ছিলে লজ্জা করছিলো না তোমার?দুটো লাভারদের একান্ত সময়ে এন্ট্রি মেরে বসে আছেন।
-আপনি জানতেন?
উনি ভাব নিয়ে বললেন,
-আমার চোখকে রায়হানের মতো বাচ্চা ফাকি দিবে?ইউ থিংক সো?ছেলেটা ভালো,মিথির ফ্রেন্ড বলে কথা।খোজ নিয়েছি আমি,তাই কিছু বলি নি।বাই দ্যা ওয়ে,ওদের জ্বালাচ্ছিলে কেনো তুমি?
বিরবির করে বললাম,
-ইতিহাসে আমিই একমাত্র বান্ধবী যে বান্ধবীর রিলেশন নিয়ে ওকে সাহায্য না করে ভয় দেখিয়ে পৈশাচিক আনন্দ নেওয়ার ধান্দায় ছিলাম।আর এই একমাত্র ভাই যে বোনের লাভারের খবর শুনে তাকে ছেড়ে নিজের বউকে ধরতে এসেছে।
-কিছু বললে?
-না।
-তুমি ভুলে যাও আমি মাইন্ড রিড জানি।
একবার তার দিকে তাকিয়ে ঠোট উল্টে চলে এলাম।আরুকে কথা শোনাতে না পেরে ভীষন রাগ হচ্ছে ওনার ওপর।আমার বান্ধবী প্রেম করলো,মাগার কথা শুনাতে পারলাম না।রায়হানটাও বেচে গেলো!ডিনার শেষে বাগানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম সবাই।সবাই মিলে আরমানকে জোরাজুরি শুরু করলো গান গাওয়ার জন্য।উনি মানা করছিলেন প্রতিবারই।কিন্তু আমি অধীর হয়ে ছিলাম ওনার গান শোনার জন্য।শেষে আমিই বললাম,
-গান না একটা গান।
আরমান একপলক আমার দিকে তাকিয়ে গিটারটা হাতে নিলেন।সবাই ওওওও! বলে শব্দ করে উঠলো।উনি মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়েই গাইতে শুরু করলেন,
দিল ইবাদাত,কার রাহা হে
ধারকানে মেরি সুন,
তুঝকো ম্যায় কারলু হাসিল
লাগি হ্যায় ইয়েহি দুন,
জিন্দেগী কি শাখ সে লু
কুছ হাসি পাল ম্যায় ছু
তুঝকো ম্যায় কারলু হাসিল
লাগি হ্যায় ইয়েহি দুন
যো ভি জিতনে পাল জিয়ু
উনহে তেরে সাঙ জিয়ু,
যো ভি কাল হো আব মেরা
উসে তেরে সাঙ জিয়ু
যো ভি সাসে ম্যা ভারু
উছে তেরে সাঙ ভারু,
চাহে যো হো রাসতা
উছে তেরে সাঙ চালু
*
মুঝকো তু দে মিট যানে
আব খুদছে দে মিল যানে
কিউ হ্যায় এ ইতনা ফাসলা,
লামহে এ ফির না আনে
ইনকো তু না দে যানে
তু মুঝপে খুদকো দে লুটা,,
তুঝে তুঝছে তোর লু
কাহি খুদছে জোর দু
মেরে জিসমো পে তু আ
তেরে খুশবু ওর লু
যো ভি সাসে……
দিল ইবাদাত……পাল ম্যা ছু
আরমানের গান শেষে সবাই তালি বাজাতে লাগলো।আশু,মালু তো সিটিও বাজালো।আমি আরমানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখ ছলছল করছে।অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছেন উনি আমার দিকে।উনি কি কোনো কষ্টে আছেন?কি কষ্ট ওনার?কাছে আছি,তবুও দুর!গানের কথাগুলো তো আমার জন্য নয়।আমি তো দুরে রাখিনি ওনাকে।ওনার ঐ চাওনি যে একদমই প্রত্যাশিত নয় আমার!গাল বেয়ে একফোটা পানি গরিয়ে পরলো।সবার আড়ালে সেটা মুছে হাসিমুখেই আরমানের সাথে ও বাসা থেকে আসলাম।
বাসায় এসে কারো সাথে কোনো কথা না বলে সোজা রুমে চলে আসলাম।রুমের লাইটস্ও অন করি নি।ওই অবস্থাতেই ব্যালকনিতে দাড়িয়ে নিশব্দে অশ্রুবিসর্জন দিলাম কিছুক্ষন।কেনো আরমান এখনো আমাকে দুরে সরিয়ে রেখেছেন?ওনার এমন বিহেভের তো কোনো কারন নেই।কেনো এই আরমানকে আমার অচেনা লাগছে?দরজা খোলার শব্দে তাড়াতাড়ি চোখ মুছলাম।কেউ একজন পিছন থেকে পেট জরিয়ে ধরে আমার ঘাড়ে নাক ডুবালো।এটা আরমান! এটুকো চিনি আমি তাকে।তার স্পর্শে বরাবরের মতো শরীরে শিহরন বয়ে গেলো।কিন্তু মনের মধ্যের প্রশ্নের পাহাড় যে অভিমান তৈরি করেছে,সেটার জন্য কোনো কথা বেরোলো না।আরমান আমার ঘাড়ে ওনার নাক ঘষতে ঘষতে মাতাল কন্ঠে বললেন,
-ভালো করেছো লাইট অন করো নি।আজ চাদের আলোতে চকোরের মতো আমিও তৃষ্ণা মেটাবো মিথি।
আরমানের কথায় বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো।উনি আমাকে নিজের দিকে ঘোরালেন।দুহাতে আমার গাল ধরে কপালে ঠোট ছুইয়ে দিয়ে ওভাবেই ঘোর লাগা কন্ঠে বললেন,
-আজও কিছু বলার নেই তোমার?
ওনার কথার মানে বুঝলাম না।মাথা নিচু করে ফেললাম।উনি বললেন,
-একটাবার বলবে না,এ কয়দিন কেনো কাছে আসি নি তোমার?
আমি বিস্ময় নিয়ে ওনার দিকে তাকালাম।কিভাবে না বলা সত্ত্বেও সবটা বুঝে যান উনি?আর বুঝেও কেনো কষ্ট দেন আমাকে?অভিমানি মনের প্রকাশ চোখের জলেই বেরিয়ে এলো।উনি আমার চোখ মুছে দিলেন।আমার দু হাত মুঠো করে একটা জোরে শ্বাস ফেলে বললেন,
-কেদো না প্লিজ।আর আমাকে প্লিজ ভুল বুঝো না।আমি জানি আমি ভুল করেছি।কিন্তু তোমাকে হারাতে পারবো না আমি মিথি।আর যাই করো,আমাকে ছেড়ে চলে যেও না।তুমি না থাকলে আমি মরে…
হাত ছাড়িয়ে ওনার মুখ আটকে দিলাম আমি।উনি হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন,
-একটা কথা তোমার কাছে এ কয়দিন লুকিয়েছি মিথি।ভয় ছিলো জানলে তুমি আবারো আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।কিন্তু এই একটা কথা তোমার আড়াল করার অপরাধবোধ যে আমাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে।অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার মিথি।সহ্য করতে পারছি না।
ওনার কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠেছি আমি।কি এমন কথা লুকিয়েছেন উনি,যার জন্য আমি ওনাকে ছেড়ে যাবো এমন ভয় পেয়েছেন উনি?কি এমন কথা,যা আমার কাছে আসতে দেয় নি ওনাকে?আজ যখন উনি বলতে চাচ্ছেন,আমি সহ্য করতে পারবো তা?নিজেকে বুঝিয়ে বললাম,
-আরমান,আপনি আমার স্বামী।যা আপনার,তা আমারো।যদি আপনার অপরাধবোধ থেকে থাকে তবে তার অংশীদার আমিও।কিছু বলতে হবে না আপনাকে।আমি শুনতে চাই না।
উনি তাচ্ছিল্যে হেসে বললেন,
-ভয় পাচ্ছো?সত্যিটা ফেইস করতে না পারার ভয়?
-হ্যাঁ।ভয় পাচ্ছি।কোনো কিছুর বিনিময়ে আপনাকে হারাতে পারবো না আমি।
-তোমাকে না বললে যে আমি আজীবন এভাবেই ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাবো।
ছলছল চোখে একবার তার দিকে তাকালাম।কাপাকাপা গলায় বললাম,
-বলুন তবে।কিন্তু এটাও শুনে রাখুন,আমি আপনাকে হারাতে চাইনা,পারবো না সহ্য করতে।
আরমান আমাকে ছেড়ে রেলিংয়ে হাত রাখলেন।আকাশের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললেন,
-আমি আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যাংয়ের কাজগুলো এখনো ছেড়ে দেইনি মিথি।
দু পা পিছিয়ে গেলাম আমি।ব্যালকনির দেয়ালের সাথে পিঠ আটকে গেছে।কাদছি আমি।উনি আমার দিকে ঘুরে অসহায়ভাবে বললেন,
-প্লিজ ভুল বুঝো না আমাকে।এ কাজ আমি ছাড়তে পারবো না।
…..
-মিথি,আমার কাজগুলো বে আইনি।কিন্তু সেগুলো সবার ভালোর জন্যই।আমি যদি এ কাজ ছেড়ে দেই তবে অনেক হতদরিদ্ররা ন্যায়বিচার পাবে না।সেদিন তোমার আব্বুকে যা যা বলেছিলাম,সে অনুযায়ী কেউ জানবে না এসব আমিই করি।কিন্তু তোমার আড়াল আমি রাখতে পারবো না,নাই বা পারবো এ কাজ ছাড়তে।দিনের আলোতে আব্বুর অফিস সামলালেও,রাতের আধারে ওইলোকগুলোর পাশে দাড়াতে আমাকে গ্যাংটা চালাতেই হবে।
…..
-কিছু বলো মিথি।
…..
-প্লিজ কিছু বলো।আমি ঠকাতে চাইনি তোমাকে,তাইতো সত্যিটা বললাম।বলো না!
আমার চোখ দিয়ে শুধু পানি পরছে।আরমান এগিয়ে এসে আমার দু হাতের কনুইর উপরে চেপে ধরে চেচিয়ে বললেন,
-মিথি কথা বলো!আমার কলার ধরো,চড় মারো,যা খুশি করো।তবুও এতোবড় শাস্তি দিও না আমাকে।কথা বলো।
হাত ছাড়িয়ে বুকে ধাক্কা মেরে দুরে সরিয়ে দিলাম ওনাকে আমি।টাল সামলাতে না পেরে দু পা পিছিয়ে গেলেন উনি।আরমানের চোখেমুখে ভয়।আমি তেড়ে এগিয়ে ওনার কলার মুঠো করে চেচিয়ে বললাম,
-হ্যাঁ,হ্যাঁ।মেরে ফেলবো আপনাকে।একদম মেরে ফেলবো।তারপর নিজেও মরে যাবো।এই একটা কথার জন্য এভাবে কষ্ট দিয়েছেন আমাকে?এতোগুলো দিন দুরে সরিয়ে রেখেছেন?যখন এটা আমি জানি।আমি জানতাম আপনি মানুষের উপকার করা ছাড়বেন না।সেটা যে উপায়েই হোক।শুধু অপেক্ষায় ছিলাম আপনি নিজে থেকে কবে বলবেন কথাটা।কিন্তু ভাবতেও পারি নি এই নুন্যতম কথার জন্য এভাবে কষ্ট দিবেন আমাকে।আপনাকে হাজারটা চড় মারলেও গায়ের জ্বালা জুড়োবে না আমার!
আরমান বিস্ময়ে বললেন,
-তারমানে তুমি…
আমি ওনার কলার ঝাকিয়ে আরো ঝাঝালো কন্ঠে বললাম,
-কি আমি?হ্যাঁ?কি আমি?বউ আমি আপনার!অর্ধাঙ্গীনি!আপনার এটুকো বুঝবো না আমি?দিনশেষে যখন কাটা হাতে আমাকে জরিয়ে ধরতেন,আপনার শার্টে রক্তের ছিটেফোটা লেগে থাকতো,অসময়ের ফোনে আপনাকে যেতে হতো,রাস্তায় দু চারজন গরিব লোক আপনাকে দেখলে সম্মান আর কৃতজ্ঞতায় চোখের কোনের জল মুছতো,সেটা চোখে পরবে না আমার আপনি ভাবলেন কি করে?
আরমান মাথা নিচু করে ফেললেন।আমি ওনার কলারটা আরো ঝাকিয়ে বললাম,
-কি?এখন চুপ কেনো?আপনার কাজে এতোটুকো মাথাব্যথা নেই আমার।গর্ব হয় আরো আমার।আব্বু যাই ভাবুক না কেনো,আমি সাপোর্ট করি আপনার কাজকে। আর আপনি চিন্তা করে বসে আছেন এসব জানলে আমি চলে যাবো আপনাকে ছেড়ে?এই ভেবে দুরে সরিয়ে রেখেছেন আমাকে?
ধাক্কা মেরে ছেড়ে দিয়ে রাগে মাথার চুলগুলো মুঠো করে উল্টোদিক ফিরে তাকালাম।উনি মিনমিনে গলায় বললেন,
-সরি।
….
-সরি বললাম তো।
তাচ্ছিল্যের স্বরে বললাম,
-হুহ!সরি বললে দিনগুলো সময়গুলো কষ্টগুলো মুছে যাবে না আরমান!
আরমান আবারো হাত ধরে তার দিকে ঘুরালেন আমাকে।বললেন,
-তো কি করলে মুছবে?
….
-বলো প্লিজ।আর তো পারছি না মিথি!
আমি তাকালাম ওনার দিকে।চোখেমুখে শুধু অপরাধবোধ।আরেকটা অনুভুতি! ভালোবাসা!ভালোবাসা থেকে দুরে থাকার কষ্ট!রাগ রইলো না আমার।ওনার বুকে মাথা রেখে বললাম,
-ভালোবাসুন না।আমি যে ভালোবাসি আপনাকে আরমান।অনেক ভালোবাসি।
আরমান কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে ছিলেন।আমার থুতনি উচু করে ধরে বাকা হেসে বললেন,
-এই একটা কথা বলতে আটমাস সময় লাগিয়েছো মিথি।এটুকো কষ্ট প্রাপ্য ছিলো তোমার।
চোখ বড়বড় করে তাকালাম।সত্যিই তো!একবারো মুখে ওনাকে বলিনি আমি,যে ভালোবাসি ওনাকে।তাই বলে এমনটা করবেন উনি?এতো রহস্য কেনো ওনার মাঝে?আবারো অভিমান হলো আমার।আরমান একটু হেসে হাত ধরে রুমে নিয়ে আসলেন আমাকে।বাইরের বাগানে জ্বলতে থাকা লাইটের রুমে আবছা আলোতে আরমানের মুখে এক তৃপ্তির হাসি দেখতে পেলাম।উনি রুমের লাইট অন করতেই তব্দা খেয়ে গেলাম আমি।আরমান ফিসফিসিয়ে আমার কানে বললেন,
-হ্যাপি সিক্সথ মান্থ এনিভার্সেরি !
একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে আবারো রুমের দিকে তাকালাম।ফুল,ক্যান্ডেলস্,রঙিন বেলুন দিয়ে পুরো রুম ডেকোরেট করা।অসম্ভব সুন্দরভাবে সাজানো।আবারো আরমানের দিকে তাকালাম।উনি পাশেই পকেটে হাত দিয়ে ঠোটে হাসি ঝুলি দাড়িয়ে।বললেন,
-তুমি তো বড়সর প্রোগ্রাম পছন্দ করো না,আবার ওসব কথা নিয়ে মুডও ভালো ছিলো না আমার।তাই রুমটাকেই শুধু সাজিয়েছি।ওয়েট!
উনি মোমগুলো জ্বালিয়ে দিলেন।এরপর লাইট অফ করে দিলেন।মোমের আলোতে যতনা ঘরটা সুন্দর লাগছিলো,আরমানের চেহারার হাসিটা আরো বেশি মোহনীয় লাগছিলো।আমার তো মনেই ছিলো না এসব।আর উনি?কতো কি করেছেন!
-আপনি এসব কখন…
আরমান এগিয়ে এসে আমার ঠোটে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিলেন আমাকে।বললেন,
-হুশ!কোনো কথা না।ভালোবাসি বলতে এতো সময় লাগিয়েছো!তার শাস্তি তো পেতেই হবে তোমাকে ম্যাডাম!
কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বললাম,
-শ্ শাস্তি?
-হুম।শ তে শাস্তি।
-ক্ কি শাস্তি?
-বললাম না,চকোরের মতো আমিও আজ তৃষ্ণা মেটাবো।ভালোবাসার!আমার ভালোবাসায় তোমাকে আজ সম্পর্নরুপে রাঙাতে চাই আমি মিথি।যেখানে কোনো অপরাধবোধ নেই,কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।শুধু ভালোবাসার প্রবাহ আছে।আপন করতে চাই তোমাকে আরো মিথি।আজ আমার সবটুকো ভালোবাসা উজার করে দিতে চাই তোমাকে।
ওনার নেশা ভরা কথায় হাত পা কেমন যেনো জমে যাচ্ছে আমার।উনি আমার আঙুলগুলো তার আঙুলের ভাজে নিয়ে বললেন,
-মে আই?
আবারো সেই মাদকমিশ্রিত স্বর।লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলাম।আজ অবদি তার প্রতিটা ছোয়াকে একেকবার একেকভাবে অনুভব করেছি আমি।কিন্তু আজ? ভয় করছে আমার,সাথে এক অদ্ভুত আনন্দ।আরমান আমার চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে বললেন,
-কিছু বলবে না?ওভাবে লাল হলে চলবে?
মাথা নিচু রেখেই বললাম,
-ভালোবাসি আপনাকে।
আর কিছু বলার প্রয়োজন হয়নি আমার।না আরমানের বোঝার জন্য আর কিছু বলার প্রয়োজন ছিলো।কোলে তুলে নিলেন উনি আমাকে।ব্যালকনি দিয়ে উকি দেওয়া আকাশের চাদ,ফুরিয়ে আসা মোমের নিভু নিভু আলো বলে দিচ্ছিলো,হ্যাঁ আজ আমি সম্পুর্ন।আমার ভালোবাসা সম্পুর্ন।আর আরমান!তার বুকে মাথা রেখে প্রতিটা হৃদস্পন্দনে যেনো শুনতে পেলাম,তোমাতেই অস্তিত্ব আমার,
তোমাতেই অস্তিত্ব আমার…
~সমাপ্ত?
®
[ আসসালামু আলাইকুম পাঠকমহল,
রিপোস্ট করা গল্প! শুধু বলবো,যারা গল্পটা পড়লেন,একটু রেসপন্স করে যাবেন প্লিজ। শেষ পর্বে রিপোস্টের মূল্যায়ন দেখতে চাই। ভালোবাসা সবার জন্য❤ ]