#তেজস্ক্রিয়_রক্তধ্বনি
#লেখিকা_রিয়া_খান
#পর্ব_৫২(অন্তিম পর্ব)
জাফর মারা যাওয়ার পর তীব্র দেশে ফোন করে ডিপার্টমেন্টে জানায়।
আগে থেকেই মালদ্বীপে সরকারী প্রশাসনে আবেদন করা ছিলো। তাই একটা ফোনের পর পর ই মালে থেকে সৈন্য এসে রিসোর্টের চারপাশে যে গার্ড গুলোকে মেরে আলু বেগুনের চাশনাই বানিয়ে রেখেছে ওদেরকে তুলে নিয়ে যায়, আর জাফরকে আলাদা করে। জাফরের যে প্রাইভেট প্লেন আছে সেটাতে করেই দেশে পাঠানো হয় সব কটাকে ।
মিশান তীব্র নিজেদের রিটার্ন টিকিট দিয়েই দেশে ফিরে আসে।
বাংলাদেশে ফিরে এয়ারপোর্ট আসতেই দেখা হলো মোশারফ হোসেন স্যারের সাথে।
মোশারফ হোসেন স্যার তীব্রকে রেখে মিশানের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে , তীব্র এসে সালাম দিতেই উনার ঘোর কাটে।মিশানকে উনি না চেনার কারণ,তীব্র ওর মেডিকেল রিপোর্ট গুলো সিনিয়রদের কাছে চাওয়ার পর তাঁরা দেয়নি, সেজন্য তীব্রও মিশানের ব্যাপারটা তাদের জানায়নি।
-আসসালামু আলাইকুম স্যার।
-ওয়ালাইকুম আসসালা।তীব্র! ওয়েল ডান মাই বয়।যে কাজটা করলে আমরা প্রত্যেকেই অপ্রত্যাশিত ছিলাম,ভাবতেও পারিনি মিশনটাতে সফল হবে। ভেবেছিলাম এবারও হয়তো কোনো দুর্ঘটনা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে,যাকে দেশে থেকেই কিছু করা যায় নি, তাকে বিদেশ থেকে কিভাবে কি করবে।
-স্যার! এটা আমার পারসোনাল ম্যাটার ছিলো, তাই সফল না হয়ে ফিরতে পারিনি।
আমি তো বলেছি এই জাফর অভিজিৎ এরা কে আমি জানি না।আমি শুধু জানি ওরা আমার ভাইয়ের খুনি।
মোশারফ হোসেন মিশানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-ওকে তো চিনতে পারলাম না?
তীব্র ঠোঁটে হাসি লাগিয়ে উত্তর দিলো,
-এটা আমার সেই বহুকথিত কল্পনার
বউ ।
-তুমি বিয়ে করেছো,এতো কিছু জানি এটা জানি না!
-কি করবো স্যার,আপনার মেয়ে তো দিলেন না, তাই পথে ঘাটে যাকে পেলাম বিয়ে করে নিলাম।
মোশারফ হোসেন মিশানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-সত্যিই কি বিয়ে করেছো তোমরা?
মিশান হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।
-দেশে কি ছেলের এতোই অভাব পড়েছিলো? তুমি বিয়ে করার জন্য ওকেই পেলে? দেখো আমি তোমাকে সাবধান করে বলছি মা, যদি বিয়ে টা না হয় তাহলে এখনি কেটে পড়ো,আর যদি সত্যিই বিয়ে করে ফেলো তাহলে স্বাগতম তোমার নরক জীবনে।
তোমাকে একদম পুড়িয়ে ফেলবে।
মিশান ঠোঁট টিপে হাসি দিলো,তীব্র মোশারফ স্যারের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-স্যার আমার সামনে আমার দুর্নাম করেন, ঠিক আছে।কিন্তু আমার বউয়ের সামনেও কেনো?
-তোমার এই ব্যাপার টা নিয়ে পরে আলোচনা করছি সবাই।দেখা যখন হলোই তাহলে একটা উত্তর দাও তো।
এসবি তে ফিরছো কবে?
-আজকেই এপ্লিকেশন করবো অফিসে।
-তোমার জন্য একটা সুসংবাদ আছে,এলেই বুঝবে।প্রস্তুত থেকো।
তীব্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-সময় যখন খারাপ যায় তখন সব কিছুই এক গতিতে ধ্বংসলীলায় মেতে উঠে,আবার যখন ভালো যায় সব এক গতিতে সাফল্য টেনে আনে।
-তাহলে যাও তোমরা, দেখা হয়ে ভালো লাগলো।
-যাবো মানে, আপনি যাবেন না?আপনি কি আমাকে রিসিভ করতে আসেন নি?
-না আমি এসেছি আমার মেয়েকে রিসিভ করতে।
-হাইরে কপাল,কেউ এক পয়সার দাম দিলো না।আছিই যখন আপনার মেয়েটাকে দেখে যাই এক নজর।না পেলাম দূর থেকেই দেখবো।
-তীব্র তোমার মশকরা আমি নিতে পারলেও তোমার পাশের জন নিতে পারবে না,চোখ ফিরে তাকাও।
তীব্র মিশানের দিকে ঘুরতেই দেখে মিশান তীব্রর দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
-মজা করছিলাম তো। তুমি রাগ করো না।
চলো চলো আমরা বাড়ি যাই।
তীব্র মিশানকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
এয়ারপোর্টের বাইরে রহমান গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলো ওদের জন্য।
মিশানকে বাড়িতে দিয়ে, তীব্র নিজের কাজে চলে যায়। যেসব পেপারসে জাফরের সাইন নেয় সেসব কাগজে জাফরের সমস্ত কুকীর্তির স্বীকারোক্তি থাকে।জাফরের যেখানে যতো লিংক আছে এগুলো সব বের করে জাফরের সৎ ছেলেকে আটক করে।তীব্রর উদ্যম কেলানি খাওয়ার পর ওর ছেলে মুখ খুলে জাফরের কোন কোন উৎস থেকে কোন কোন রাস্তা দিয়ে টাকা আসে।ওর সৎ ছেলেকে রাখা হয়েছিলো শুধু টাকা পয়সা দেখভাল করার জন্য। ব্যাংক ডিটেইলস থেকে শুরু করে তীব্র সব রকম তথ্য নিয়ে, সেসব জায়গায় ফোর্স পাঠায় যেখানে অস্ত্র মাদকের আরদ। একে একে জাফরের সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেয়।সুইচ ব্যাংকে জমানো সব টাকা উদ্ধার করে সরকারি কোষাগারে ট্রান্সফার করে দেয়। ওর সৎ ছেলে সহ ছোটো বড় যেসব দালাল ছিলো এই কাজের, তাদের সবাইকে জরিমানা সহ জেল দেয়া হয়।এখন জাফর নামের সমস্ত অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।
ওদিকে সেদিন কোম্পানিতে Raid পড়ার পর ওদের জালিয়াতি কুকর্ম ধরা খাওয়াই এমডি সহ অই কাজে সংযুক্ত সেসব কর্মীদেরও পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়,যাদের মাঝে দ্বীপও ছিলো।
সবার পেছনে ল’এয়ার সেট করা হলেও দ্বীপের জন্য কোনো ল’এয়ার সেট করা হয় না।
কারণ দ্বীপের বাবা মা এতোটা আঘাত পেয়েছে ছেলের এমন কাজে, তাঁরা চায় না দ্বীপ তাদের জীবনে ফিরে আসুক।
দ্বীপকে দেখতে অব্ধি যায় না।
মিশান দেশে ফেরার পর দ্বীপের বাবা মাকে বলে কয়ে দ্বীপকে দেখতে নিয়ে যায়।
-নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে, আমাদের জীবনে এমন কুসন্তান জন্ম নিয়েছিলো। যাকে সারাজীবন শিখিয়ে এসেছি সব সময় অন্যের উপকারে আসতে, অনাহারকে খেতে দিয়ে,অভাবগ্রস্তকে সাহায্য করতে, নির্যাতিতকে সঠিক বিচার এনে দিতে।জান বাঁচানো ফরজ,হোক সেটা নিজের জান কিংবা অন্যের।কিন্তু এমন কুলাঙ্গার জন্ম দিয়েছি যে সব শিক্ষার উল্টোটা ধারণ করেছে।দেখতে এসেছি বলে ভেবো না তোমাকে বাঁচাতে এসেছি।তুমি মরে পঁচে গলে গেলেও আমি আর দ্বিতীয় বার তোমার মুখ দর্শন করবো না।এখানে এসেছি শুধু তোমার উপর ঘৃণা প্রকাশের জন্য।আমি আদালতে আবেদন করে যাবো,যেনো কোনো ভাবেই তুমি এই লোহার ঘরটা থেকে বের হতে না পারো।এতো এতো মানুষের প্রাণ নিয়ে যে খেলতে পারে সে কোনো একদিন যে নিজের বাবা মাকেও মারতে আসবে না তাঁর কি গ্যারান্টি!
দ্বীপের বাবার সাথে সাথে দ্বীপের মাও কঠিন স্বরে বলে উঠলো,
-শুধু এইটুকুই না। ওকে তেজ্যপুত্র করার ব্যবস্থাও করবো। আমাদের মাত্র একটা ছেলেই আছে আর কোনো ছেলে নেই। যদি তাপসিনও একই কাজ করে কোনোদিন, তবে ওরও একই মাশুল দিতে হবে। প্রয়োজনে আমরা সন্তান শুন্য হয়ে বাঁচবো তবুও এমন কুলাঙ্গার অপকর্মে যুক্ত এমন ছেলের বাবা মা পরিচয় দেবো না।
ওর মুখটাও দেখতে ইচ্ছে করছে না। চলো এখানে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না আমার।
দ্বীপের বাবা মা দুজনেই চলে গেলো, পাশেই তাপসিন ছিলো, ভাইয়ের দিকে নিরবে তাকিয়েছিলো, বিশ্বাস হচ্ছে না ওর ভাই এমন কাজে জড়িত। দ্বীপ বাবা মায়ের মুখে এমন কথা শুনে ভেতরে অনুশোচনার আবির্ভাব হলো।
মিশান তাপসিনকেও ওর বাবা মায়ের সাথে যেতে বললো।তাপসিন চলে যাওয়ার পর মিশান দ্বীপের দিকে তাকিয়ে বললো।
-একটা হাদিস আছে মামাই শুনিয়েছিলো বহুবছর আগে।আমার মাথার ব্রেইন তো একটু এবনরমাল, শঠিক উক্তি মনে নেই,যতোটুকু মনে আছে ততোটুকুই বলছি।
ক্ষমা একটি মহৎ গুণ।সৃষ্টিকর্তা বলেছেন , কেউ যদি খুন করে তাকে যদি তুমি ক্ষমা করতে না পারো তবে তুমি খুনের বদলা খুন করো, সেই সম্মতি তোমায় দিয়ে দিলাম, তবুও তুমি ক্ষমা করো।
জানি না এটা সত্যি কিনা,সৃষ্টিকর্তা আদৌ এই কথা বলেছেন কিনা । তবে আমি আর খুন করবো না, হাঁপিয়ে গেছি খুন করতে করতে। যা শাস্তি উপরওয়ালাই দেবেন।
তোকে বলেছিলাম না তোকে আমি খুন করবো না, তাঁর কারণ কি জানিস?আমি তোর বাবার নুন খেয়েছি।তাঁর ছেলেকে আমি কিভাবে মারি? তোকে তো শাস্তি দেবেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা, একটু একটু করে মরবি, তুই পঁচে মরবি আমার বোনের অতৃপ্ত আত্মার অভিশাপে। আর বাকি মানুষ গুলোর কথা বাদ ই দিলাম।
মিশানের গলা ধরে আসছিলো,আর কিছু ন। বলে মিশানও চলে গেলো।দ্বীপ কিছু বলতে পারছে না। ওর মাথায় ঘুরছে এখান থেকে বের হবে কি করে।কোনো ভাবে ওর এমডি বের হতে পারলে ওকে বের করার চেষ্টা তো দূর চিন্তাও করবে না,উল্টো এমন কাজ করে রাখবে যেনো কোনোদিন বের হতে না পারে।ওর জন্যই আজকের এইদিন দেখতে হচ্ছে তাঁর।
কিছু ঝড়ে সব কিছু এমন ভাবে উলটপালট হয় সব প্রশ্নরা থাকে এক প্রান্তে, উত্তর গুলো থাকে আরেক প্রান্তে, যার কারণে জীবনের অর্ধেক সময় কেটে যায় সঠিক প্রশ্নের সাথে সঠিক উত্তর মেলাতে গিয়ে ভুল প্রশ্নে ভুল উত্তর বসিয়ে রাখি।একটা পর্যায় যখন বুঝতে পারি এই প্রশ্নের এই উত্তর না, কিংবা এই উত্তরটার প্রশ্ন এটা না, তখন আবার ছুটতে শুরু করি সঠিক সমাধানের জন্য।
র্যাব থেকে ট্রান্সফার হয়ে তীব্র আবার এসবিতে ফিরে আসে।ফিরে আসতেই থাকে ওর জন্য চমক।
বেশ কয়েক মাস আগে তীব্র পদোন্নতির পরিক্ষা দিয়েছিলো, রেজাল্টও ভালো এসেছিলো, এত এত খারাপ সময়ের মাঝেও সব ক্যান্ডিডেটদের মাঝে থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলো,প্রমোশনটা পেন্ডিং ছিলো।
এখন সেই প্রমোশনটা লেগে গেছে। SP থেকে AIG পদে পদোন্নতি হয়েছে তীব্রর।
এই খুশির সময়েও তীব্রর মন খারাপ ভাইয়ের জন্য, ইচ্ছে ছিলো দুই ভাই একসাথে সাফল্য নিয়ে ঘরে ফিরবে।
-কংগ্রাচুলেশন স্যার !
-স্যার?
-আজকে স্যার বলতে দাও,তোমার ব্যাচটা চেঞ্জ হয়েছে,সিনিয়র থেকে আরেক ধাপ সিনিয়র হয়েছো।মুখ দিয়ে স্যার ই বেরুবে আজ!
আচ্ছা আপনার মুখ এমন গোমড়া লাগছে কেনো? এই খুশির সময়ে?
-তোমার কি মনে হয় এই দেশে কেবল একটাই জাফরের চক্র? আরো কত শত হাজার হাজার জাফর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদের কালো ধান্দা নিয়ে। আমি জানি না আমি কতটা পারবো আমার ভাইয়ের মতো দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে।আমার ভাই তো ছিলো সুপার হিরো,আর আমি ফেইক।আমার ভাইয়ের রোল প্লে করা এক বান্দা মাত্র।চারদিকে বিশ্বাসঘাতকে ভরা,সাহায্য করার মতো একটা মানুষও নেই, যাকেই ভরসা করবো সেই ছুরি মারবে।
-চিন্তা করো না তীব্র।তোমার পাশে এই মিশান সর্বদা একটিভ আছে।তোমার লড়াই মানে আমার লড়াই। এই রক্তে যতদিন তেজস্ক্রিয়তা আছে ততোদিন আমি একটিভ থেকে যাবো।
-আমি জানি মিশান তুমি আমার পাশে থাকবে। কিন্তু সব সময় তোমাকে ব্যবহার করলে তো ভেতরে হারানোর ভয় চেপে আসবে। আরেকটা চিন্তা তো মাথায় আছেই,মাকে কিভাবে রাজি করায় বলোতো তোমার ব্যাপারে?
-তোমার বাবাকে আগে রাজি করাও।
-বাবা তো জানেই।কিন্তু বাবা মাকে অনেক ভালোবাসে যার কারণে মাকে কখনো কোনো কিছুতে জোর করে না।
-তৃপ্তি?
-তৃপ্তি জানে না ও মাকে বলে দেবে বলে ওকে জানাই নি,ওর একটু পেট পাতলা স্বভাব।
-নিজের বোনের নামে এভাবে একটা মেয়ের সামনে বদনাম করছো? হে খোদা কি ভাই দিয়েছো আমাকে!
কথাটা শুনেই তীব্র পেছনে ঘুরলো,ঘুরে তাকিয়ে দেখে তৃপ্তি আর ওর হাজবেন্ড।
এতোক্ষণ মিশান তীব্র একটা ক্যাফেতে বসে কথা বলছিলো, দুজনে একপাশে পাশাপাশি বসার কারণে ওদের পেছনে তৃপ্তিকে দেখতে পায়নি।তৃপ্তি পেছন থেকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বুঝে এটা তীব্র আর পাশে একটা মেয়ে,পেছন থেকে কান পাততেই এটুকু শুনে।
-কি স্বভাব তোমার!পাব্লিক প্লেসে এসেও আড়ি পাতছো? বেশ করেছি,তোমার যে স্বভাব সেটা তো বলবোই।
তৃপ্তি গোয়েন্দা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-উনি কে?
-আমার বউ,তোমার ভাবী।মাকেও বলে দিও কেমন?
যদি সে বরণ করতে রাজি হয় তাহলে আমি ওকে নিয়ে বাড়িতে যাবো।
না নিলে আমি ওকে নিয়ে আলাদা থাকবো।
– ইয়ার্কি করছো?
-না তৃপ্তি সিরিয়াসলিই বলছি।
আর কয় মাস গেলে আমাদের বিয়ের দু বছর চলে যাবে।
তৃপ্তি মুখে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তীব্র তৃপ্তির হাজবেন্ড সুমনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-দাঁড়িয়ে থেকো না, বসো তোমরা।
ওরা দুজনেই বসলো
-আমাদের কেনো জানাও নি?
-এমনিই, পরিস্থিতিটা অমন ছিলো। এখন বলো না আবার ভাইয়ের বিয়ে আর বোন হয়েও আনন্দ আমোদ করতে পারলাম না, সবটা বুঝার চেষ্টা করো তৃপ্তি, কোনো কিছুই তো প্ল্যান মতো হলো না, দুই ভাই মিলে যেসব ভাবনা গুলো গুছিয়ে রেখেছিলাম, সব মিলিয়ে গেলো না পাওয়ার ভীড়ে।
-বুঝেছি ভাইয়া। কিন্তু আমাদের কেনো জানালে না একবার?
-বাবা জানে তো।শুধু তুমি আর মা জানো না।তোমরা তো দীপ্তিকে নিয়ে পড়েছিলে, তাই বলিনি।এরমধ্যে আরেক সমস্যা বেঁধেছে,মিশান আমার সাথে প্র্যাংক করার জন্য বাড়িতে গিয়েছিলো মাতালের অভিনয় করে,কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত মিশান মায়ের সামনে পড়ে,
মা মিশানকে ভুল বুঝে। সেখান থেকে মা অনড় হয়ে আছে,মিশানকে হয়তো মেনে নেবে না ।
-তুমি আপসেট হইয়ো না ভাইয়া, মা হয়তো এখনো দীপ্তির ঘোরে আছে। দীপ্তি তো এখন আর নেই, তাই পিছুটানে না ফেরাই ভালো।মা আমাকে বলেছিলো” তীব্রর একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক, মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দর কিন্তু উৎশৃঙখল টাইপের।নেশা করে একদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলো।”
আমি ব্যাপার টা তেমন ভাবে মাথায় নিই নি।
কিন্তু সেদিন হসপিটালে দেখার পর থেকে মনে হলো আমি উনাকে চিনি কোথাও দেখেছি,এখনোও মনে পড়ছে না কোথায় দেখেছি।
-তুমি ওকে দেখো নি,ওর বোনকে দেখেছো।ওর বোনের সাথে ওর ৮০% ই চেহারার মিল আছে ।তুমি যে একদিন আমার মোবাইল নিয়েছিলো অই মোবাইল টা মিশানের ছিলো,আর স্ক্রিনে নিশানের ছবি ওয়াল পেপার দেয়াছিলো। ওটা দেখেই ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেলেছো।নিশানকে বাস্তবেও দেখোনি, কারণ নিশান মারা গিয়েছে।
তৃপ্তি চুপ করে রইলো। সুমন তৃপ্তিকে বললো,
-তৃপ্তি,তুমি তো অনেক মা ভক্ত, তুমি মাকে যা বলবে মা সেটা পজিটিভ দিক দিয়ে মেনে নিতে পারে।আমার কি মনে হয়,তুমি কিছুদিনের জন্য মায়ের কাছে যাও,আর একটু একটু করে মায়ের কানে ভাবীর ব্যাপারটা তুলে ধরো,দেখো মা রাজি হয়ে যাবে।
তীব্র সুমনকে বললো,
-তুমি ঠিক বলেছো সুমন।আমারও তাই মনে হয়। মা আমাকে বেশি ভালোবাসলেও আমি তো কথা শুনি না মায়ের, তাই আমার কথা শুনে মা দশবার ভাবে,কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে তেমন হবে না তৃপ্তি, তুমি দেখো পারবে কাজটা।এক কাজ করো কিছুদিনের জন্য বাড়িতে আসো সুমন সহ আসো।
-ঠিক আছে দেখছি, কি করা যায়।
তৃপ্তি সুমনের সাথে কথাবার্তা শেষে তীব্র মিশানকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। গাড়িতে থাকা অবস্থায় মিশানের ফোনে ওর মামা কল করে, তীব্রকে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে যেতে বলে।
ওরা দুজনেই ক্যান্টনমেন্টে যায়।
সাদেক খান তাঁর নিজ অফিসেই ছিলো।
মিশান তীব্র যাওয়ার পর ওরা দুজন অফিসে বসে।
-মিশান!
-হ্যাঁ মামা।
মন ভারী করে মামা বলতে লাগলো,
-তুমি তো জানোই, নিশানের কত বড় স্বপ্ন ছিলো তোমাকে নিয়ে। তুমি একজন আর্মি অফিসার হবে, নিশান সেটা নিয়ে প্রাউড ফিল করবে।তুমি সেই স্বপ্ন টা পূরণ করেছো ঠিকি কিন্তু স্বপ্নটাকে জীবন্ত রাখতে পারোনি।আমি চাই না আমার নিশান মায়ের স্বপ্ন টা ওর সাথে সাথে মরে যাক।তাই তুমি যখন রিজাইন করো,লেটার টা এপ্রুভ করিনি।সিনিয়রদের অনেক রিকুয়েস্ট করে কিছু টাকা ইনভেস্ট করে তোমার জায়গাটা টিকিয়ে রেখেছি,এতোদিন তোমার দায়িত্ব অন্য একজন পালন করেছে তাই কোনো সমস্যা হয় নি।কিন্তু ইদানীং উপর থেকে চাপ আসছে হয় তোমাকে এর মধ্যেই তোমার জায়গায় জয়েন হতে হবে নয়তো তাঁরা তোমার জায়গাটা পার্মানেন্ট শুন্য করে দেবে।এতো কষ্ট করে বোনের জন্য এই অব্ধি এলে,এভাবে হেরে গিয়ে থেমে যাবে মা? বোনের স্বপ্নটাকে জীবিতো রাখবে না?
মিশান খানিকটা ভাবগাম্ভীর ভাবে বললো,
-মামা!
-প্লিজ মিশান! তোমাকে আর ছন্নছাড়া দেখতে পারছি না মা।প্লিজ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসো অন্ততো নিশানের জন্য!
মিশান তীব্রর দিকে তাকালো,তীব্র চোখ দিয়ে ইশারা করলো প্রস্তাব মেনে নিতে।ভেতরে একটু সংকুচ রেখে মিশান উত্তর দিলো।
-ওকে মামা!আমি জয়েন করবো আবার।
-থ্যাংকস মা!
সাদেক খান মুখে হাসি নিয়ে মিশানকে কিছু পেপারস দিলো,মিশান তাতে সিগনেচারের মাধ্যমে নিজের রিজাইন লেটার গুলো প্রত্যাখ্যান করে পুনরায় জয়েনিং পেপারসে সাইন করলো।
সাদেক খান তীব্রকেও ওর প্রমোশনের জন্য শুভেচ্ছা জানালো,যদিও ফোন করে একবার জানিয়েছে,এখন সামনা সামনি জানালো। কিছুক্ষণ পর তীব্র সাদেক খানকে প্রস্তাব দিলো মিশানকে নিয়ে কিছুদিনের জন্য পাকিস্তান যাবে। সাদেক খান রাজি হয়ে গেলো।
মিশানকে নিয়ে দু এক দিনের মাঝেই পাকিস্তান যাবে ঘুরতে।
#তেজস্ক্রিয়_রক্তধ্বনি
#লেখিকা_রিয়া_খান
#পর্ব_৫২(অন্তিম পর্বের বাকি অংশ)
ভিসা প্রসেসিং কমপ্লিট হতেই তীব্র মিশান পাকিস্তানে যায়।
পাকিস্তানে পা রাখতেই যেনো মিশান বিশুদ্ধ অক্সিজেনের আভাস পায়।প্রতিটা নিশ্বাসে মনে হচ্ছে বহু বছর পর দম আটকে থাকার পর প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারছে।জীবনের বেশিরভাগ সময় বাংলাদেশে কাটলেও মূল শেকড় তো এই পাকিস্তানের মাটিই। জন্মটা যেহেতু পাকিস্তানেই তাই এদেশের প্রতি আলাদা টান থাকবেই।
মা সেদিন অন্ধকার রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে কিভাবে কোথায় নিয়ে গিয়েছিলো কিচ্ছু জানা নেই।কাউকে নিজের ঠিকানা বলতে মানা করে দিয়েছিলো সেজন্য মিশান ভুল করেও বলেনি কাউকে নিজের পরিচয় ঠিকানা, যে বয়সে ঘটনা গুলো ঘটে সে বয়সে মিশান ভালো মতো নিজের নাম, বাবা মায়ের নাম, তাদের পেশা ও ঠিকানা ভালোমতো লিখতে পারে । ভুলে যাবে বলে একটা ডায়েরীর পাতায় একটু করে লিখে রাখে নিজের ঠিকানাটা। সেদিন ঠিকানা লিখে না রাখলে সঠিক ঠিকানা হয়তো ভুলেই যেতো,এতোবছর ধরে মাথায় রেখে চলাটা সম্ভব না।
চারদিকটা দেখে যেনো চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে মিশানের।কত পরিবর্তন হয়ে গেছে দেশটার। চেনা শহরটা অচেনা লাগছে।
জানালাই হাত ঠেকিয়ে হাতের উপর থুতনি রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের শহরের অপরূপ দৃশ্য দেখে যাচ্ছে।
লাহোর থেকে এক /দেড় ঘন্টার পথ পেরিয়ে এম এ আলম রোড আসতেই তীব্র ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে।মিশানের কাঁধে হাত রেখে মিশানকে ডাক দেয়,
-মিশান!
মিশান ঘোর কেটে তীব্রর দিকে ফিরে তাকায়।
-নামো।তোমার লিখা ঠিকানা অনুযায়ী এম এ আলম রোডে এসে গেছি।
-এটা এম এ আলম রোড?
-হুম।
মিশান তাকাতাকি করে নামতে যায়।
দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে যায়।কত্ত পরিবর্তন হয়ে গেছে জায়গাটা । ছোটো বেলায় এই রাস্তাটা দিয়ে কতোই না চলাচল করছে,আর এখন চেনাই যাচ্ছে না।
গাড়ি থেকে নামার পর দুজনে হাঁটতে থাকে, কারণ এই এরিয়াতেই মিশানের বাড়ি।হেঁটে হেঁটে খুঁজাখুঁজি করতে থাকে। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে জনবহুল একটা এরিয়াতে ঢুকে যায়।
এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে দেখা মেলে মিশানের বাড়ির।
-জানেন আগে আমাদের বাড়ির আশেপাশে তেমন কোনো বাড়িঘর ছিলো না ,আমাদের বাড়ির চারপাশে অনেক গাছ ছিলো মাঠের মতো খালি জায়গা পরে ছিলো,এখন নগরায়নের জন্য, না আছে সেই গাছ গুলো, না আছে সেই খালি মাঠ গুলো।একটার দেয়াল ঘেঁষে আরেকটা দেয়ালের দালান লেগে আছে, এখন তাই সব অপরিচিত লাগছে।কিছুই নেই আগের মতো।
হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। বাড়িটা বিশাল বড়,পুরোনো দিনের রাজপ্রাসাদ মনে হচ্ছে অনেকটা,বাড়ির চারপাশের দেয়ালে শেওলা ধরে কালচে সবুজ হয়ে আছে।মিশান নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে বাড়ির দিকে।তীব্র এমন ভাবে তাকিয়ে আছে বাড়িটার দিকে, যেনো ভূতুড়ে বাড়ি এটা।
রাস্তা দিয়ে কিছু পথিক যাচ্ছিলো, মিশান তীব্রর মুখ তাদের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা, তার ওপর এই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে,এই বাড়িটাকে এই এলাকার মানুষ ভূতুড়ে বাড়ি বলে, অনেকের ধারণা এই বাড়িতে ভূত আছে।
মিশান লোহার গেটটা হাল্কা ধাক্কা দিতেই কড়কড় শব্দ করে গেট টা খুলে যায়। যে বাড়ির সামনে পুরোটাই ফুল ফলের বাগান ছিলো সেখানে ফুল গাছের জায়গা নিয়েছে বন ঘাস,ফল গাছ গুলো কিছু আছে কিছু নেই।রাম্বুটান গাছ,সফেদা গাছ, আম গাছ,কাঠ লিচু গাছ,ব্ল্যাকবেরি গাছ। এগুলো এখনো জীবিতো আছে।মিশান দৌড়ে গিয়ে গাছ গুলোকে হাত দিয়ে স্পর্শ করে।
-জানেন এই গাছ গুলো আমি বুনেছিলাম,ভাবতে পারিনি এখনো বেঁচে থাকবে।আমার দাদাজান মাটি খুঁড়ে গর্ত করে দিতো, আমি আর দাদীজান গাছ নিয়ে অই গর্তে রাখতাম।অনেক গাছ রূপণ করেছিলাম আমরা।তার মাঝে এই কয়টা গাছ বেঁচে আছে এখনো।
মিশানের ঠোঁটে হাসি আর চোখ ভরা পানি জ্বলজ্বল করছে,তীব্র মিশানের খুশিটাকে খুব গভীর থেকে অনুভব করতে পারছে। মিশান বাড়িটা সম্পর্কে কতকিছু বলছে, আর তীব্র সব কান পেতে শুনছে।
বাড়ির ভেতরটাতে যেতেই আত্মাটাতে খুব স্বজোরে ধাক্কা লাগলো। কোনো কিছুই তালাবন্ধ নেই,ধাক্কা দিলে খুলে যাচ্ছে প্রতিটা ঘর। মিশান বাড়ির ভেতরে প্রতিটা আসবাবপত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে।যদিও সব কিছু ধুলোয় জরাজীর্ণ। হাতে কেবল গাদি গাদি ধুলোই উঠে আসছে,তবুও মিশান সব কিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করছে হারিয়ে যাওয়া সময় গুলো। একটা ঘর ছিলো অনেক বড়,অই ঘরটা ছিলো মিশানের খেলার ঘর,ওয়ালের সাথে লাগানো তাক ভর্তি খেলনা এখনো ধুলো জড়িয়ে সেই একই স্থানে পড়ে আছে, ঘরের ভেতর একটা দোলনা ছিলো, দোলনা টা জং ধরে গেছে,এই দোলনাতে বসে কতোই না দোল খেয়েছে।
ঘরের এক পাশে একটা বিশাল ছবির ফ্রেম যেটাতে মিশানের পুরো পরিবারের ছবি,মিশানের, বাবা, মা,দাদা,দাদী,আর মিশানের কোলে ছোট্ট নিশান, সবাই হাসিমুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে।
মিশান হাত দিয়ে ধুলো মুছে ছবিটার দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদছে। কত জীবন্ত লাগছে ছবিটা। তীব্রর ভেতরে খুব কষ্ট হচ্ছে মিশানের ভেতরটাকে অনুভব করে। ছবিটার দিকে অপলক হয়ে তাকিয়ে আছে, ছবিটা দেখেই মনে হচ্ছে একটা সুখী পরিবারের উদাহরণ । কিভাবে কি হলো এদের জীবনে সবার জীবন অগোছালো। তাঁরা কি আদৌ বেঁচে আছে নাকি কালঝড়ে মিলিয়ে গেছে!
-মিশান!
-হুম?
-তোমার দাদা দাদুও কি বেঁচে ছিলো সে সময়?
-হ্যাঁ,দাদাজান দাদীজান সে সময় কত ইয়াং ছিলো দেখছেন না ছবিতে।এই ছবিটা তো আমাদের জীবনে ঝড় আসার কয়েক মাস আগের, নিশান জন্মের পর পর ই বলা যায়।আমার বোনটাকে দেখেছেন?মনে হচ্ছে একটা পুতুল কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি, বোনটাও কেমন পুতুলের মতো তাকিয়ে আছে,যেনো অইটুকু বাচ্চা বুঝতে পারছিলো এখানে ছবি তোলা হচ্ছে, ওর এখন ক্যামেরার দিকে তাকাতে হবে।
অনেক সুখী একটা পরিবার ছিলাম আমরা। দাদাজান দাদীজান হয়তো বেঁচে নেই এখন।কিন্তু মাম্মাম পাপা কি আছে নাকি নেই সেই প্রশ্নের উত্তর আজও পেলাম না। নাকি তাঁরাও আমারই মতো দিশেহারা হয়ে খুঁজাখুঁজি করছে কোনো এক প্রান্তে।
আমার জীবনের এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর গুলো কে এনে দেবে তীব্র? বলো না?
তীব্র মিশানের কাঁধে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকিয়ে রইলো।সব গুলো ঘর মিশান ঘুরে ঘুরে দেখলো,সব স্মৃতি গুলো আজ খুব করে আগলে নিচ্ছে মিশানকে। অনবরত চোখের পানি মুচছে আর সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।
ভেতরে বার বার মনে হচ্ছে বাবা মা এই বাড়িতেই কোথাও আছে, একটু পর পর মিশান পিছু ফিরে তাকায় এই বুঝি বাবা মা পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মলিন হাসি দিয়ে,মা বাবাকে খুব গভীর থেকে অনুভব করতে পারছে।
কাঠের আসবাবপত্র গুলো ঘুণপোকায় ধরে নষ্ট হয়ে গেছে, কাপড় জাতীয় সমস্ত বস্তু ইঁদুর তেলাপোকা কেটে টুকরোটুকরো করে ঘরের ভেতরটা ছড়িয়ে রেখেছে, মিশানের কিছু পুতুল ছিলো সেগুলোও নষ্ট করে ফেলেছে ইঁদুর গুলো।
সব কিছু ঘুরে দেখতে দেখতে শেষ, মিশানের ইচ্ছে করছে না বাড়িটা ছেড়ে চলে যেতে, ইচ্ছে করছে বছরের পর বছর এখানেই কাটিয়ে দিতে।
ভেতরটা ছিঁড়ে আসছে।
ওদিকে রাতও হয়ে আসছে, তীব্র মিশানের চোখের ভাষা স্পষ্ট বুঝতে পারে।
-তুমি থাকো এখানে আমি আসছি কিছুক্ষণের মধ্যেই।
মিশান মাথা নাড়ালো।
তীব্র বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে যায়, আসার সময় একটা বাজার দেখেছিলো, সেই বাজারে গিয়ে একটা বড় চাদর,কিছু মোম বাতি, আর কিছু খাবার। সেগুলো কিনে বাড়ির দিকে আসে।রাস্তা ঘাটে আশেপাশে যত মানুষের সাথে দেখা হয় তাদের প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করে এই বাড়ির ব্যাপারে মিশানের বাবা মায়ের ব্যাপারে, কেউ কিচ্ছু বলতে পারে না। উল্টো তীব্রকে বলে দেয় এইটা ভূতুড়ে বাড়ি এখানে নাকি মাঝে মাঝে বিকট শব্দ হতো কিসের যেনো। যার কারণে এই বাড়ির ভেতর তো দূর আশেপাশেও কেউ যায় না,রাত হলে এই বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে একটা কুকুরও যায় না।
এলাকার মানুষের সাথে কথাবলে তীব্রর একেকজনের একেক মতামত শুনলো,কিন্তু কেউ মিশানের বাবা মায়ের খবর বলতে পারলো না, এক লোক জানায় সে পনেরো বছর ধরে এই এরিয়াতে আছে এই বাড়িতে একটা পোকাও দেখতে পায়নি।দু একজন পর্যটক আসে এখানে,তাদের কাছে এই বাড়িটা একটা এডভেঞ্চার বাড়ি, তবে কেউ এবাড়ির কিছু বিকৃত করেনি,সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে এক সিনেমা ডিরেক্টর এই বাড়ি বাইরে থেকে দেখেই নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই বাড়িটাতে একটা হরর মুভি করবে।
অনেকের ভাষ্যমতে এবাড়িতে নাকি ভূতের দেখাও পেয়েছে। কিছু পর্যটকও নাকি এখানে রাত করে এসছিলো ঘুরতে, ভূত দেখে তাঁরা পালিয়ে গেছে বাড়ির বাইরে থেকেই।
একেক জনের একে আজগুবি মতামত শুনে হতাশা নিয়ে তীব্র বাড়ি দিকে ফিরে যায় জিনিস গুলো নিয়ে।
এদিকে মিশান কাবু হয়ে বসে বসে বাবা মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে।
-মাম্মাম পাপা! তোম ছাব লোক কাহাহু? কিউ মেরি ছাত লুকাচুপি খেলড়াহাহু? দেখো তোমহারা বেটি আপনা ঘর লট আয়ে, কিয়া তোম লোগ মেরি ছামনে মোকাবিলা নেহি কারুগী?দেখো না জারা!তোমহারা মিশান কিতনা বাড়া হুগায়ী।কাব তাক তোম দোনোকো ডুনতে রাহুঙ্গে মেইনে?দাদাজান দাদীজান কিয়া তোম দুনো নিশান কি পাছ চালে গায়ী হু? মেইনে থাগ গায়ি, অর নেহি সেহ ছাকতা ম্যে!
দুই হাঁটুতে মাথা রেখে অনবরত কেঁদে যাচ্ছে,এমন সময় মিশানের গায়ে কেউ স্পর্শ করলো,মিশান সটকে গিয়ে পেছনে তাকায়, চোখে একরাশ পিপাসা নিয়ে তাকিয়ে দেখে অপ্রত্যাশিত তীব্র,সেকেন্ডের জন্যও মিশানের মনে প্রত্যাশা জেগেছিলো হয়তো ওর বাবা মা ওকে স্পর্শ করেছে।
-তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
-এই তো বাইরেই।আজ রাত এখানে কাটানোর মতো একটা ব্যবস্থা করতে।
-মানে?
-মানে হলো,একটা চাদর এনেছি এই ধুলো ময়লাতে তো আর রাতে শুতে পারবো না, বালিশ খুঁজলাম কিন্তু পেলাম না, বাজারটা ছোট্ট ছিলো,বেশি দূর গেলাম না, অচেনা শহর।
আর কিছু মোমবাতি সারারাত ঘরে জ্বালানোর জন্য,এখানে তো আর ইলেক্ট্রিসিটি নেই এখন, আর কিছু খাবার ও পানি।
মিশান তীব্রকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-তুমি কি করে সব সময় বুঝো আমাকে?
-তোমার চোখের আর্তনাদ গুলোই বার বার বুঝাচ্ছিলো,তীব্র কিছু একটা কর মিশানের জন্য।
ফ্লোরে ধুলোর উপর চাদরটা বিছিয়ে দুজনে বসে পড়লো,মিশান তীব্রর কাঁধে মাথা রেখে বলতে লাগলো,
-জানো, আমার না বার বার মনে হয় আমার বাবা মা বেঁচে আছে।আমি যেরকম তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছি তাঁরাও হয়তো আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাঁরা তো এটাও জানে না আমি কোথায় আছি, তাদের ধারণারও বাইরে হয়তো, আমি বাংলাদেশে থাকি।নাকি তাঁরা ধরে নিয়েছে আমরা বেঁচে নেই।
-মিশান একটা কথা বলবো?
-কি?
-এই বাড়িটাকে ভালোমতো মেরামত করলে কেমন হবে?
-নাহ।
-কি?
– এটা চাইলেও সম্ভব না, অনেক ব্যয়বহুল আর সময়সাপেক্ষ।
-চেষ্টা তো করতে পারি।
-কি লাভ বলো, আমার পরিবার তো আর ফিরে আসবে না। যেমন আছে তেমন ই থাক, বছরে দু একবার এখানে এসে স্মৃতি গুলো ছুঁয়ে যাবো, এভাবেই একটা চাদর বিছিয়ে ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাত কাটিয়ে যাবো।
-মিশান ধরো তুমি যেরকম এখানে এসে তোমার বাবা মায়ের স্মৃতি গুলো অনুভব করার জন্য বাবা মাকে খোঁজার জন্য এখানে এসেছো।যদি তোমার বাবা মা বেঁচে থাকেন তাহলে তো তাঁরাও একই কাজ করলো, তোমাদের দেশ বিদেশ খুঁজছে, আবার তোমাদের স্মৃতি স্মরণে এখানে আসছে।
মিশান তীব্রর চোখের দিকে তাকালো,
-এমনটা হতে পারে?
-ধরো যদি হয়।
-তখন কি করবো?
-একটা লেটার লিখে অই ছবির ফ্রেমে লাগিয়ে রেখে যাও, যদি তাঁরা এখানে আসেন তবে চিঠিটা দেখে তোমার সাথে যোগাযোগ করবে।
মিশান চোখে মুখে একরাশ আশা নিয়ে উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে বললো,
-এটা তো দারুণ আইডিয়া!এটা করা যায়।
যাওয়ার আগে কাজটা করে যেতে হবে।
রাতটা মিশান জেগে জেগেই কাটিয়ে দেয় তীব্রর কাঁধে মাথা রেখে,তীব্র মিশানকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে।
সারাটা রাত ছবিটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পুরোনো স্মৃতি গুলো মনে করতে থাকে যতোদূর মনে পড়ে।
সকাল বেলা তীব্র বাইরে থেকে একটা কাগজ আঠা কিনে আনে, মিশান তাতে উর্দুতেই লিখতে শুরু করে অনেকটা এরকম,
“বাবা-মা, আমি মিশান বলছি,জানি না তোমরা কোথায়,এটাও জানি না বেঁচে আছো কিনা নেই। তোমরাও হয়তো তাই ভাবছো মিশান-নিশান বেঁচে আছে কিনা।কোথায় আছি সেটাও হয়তো জানো না। কিংবা জেনে থাকলেও হয়তো সামনে আসছো না কোনো কারণে,যদি এরকম কিছু হয় তবে প্লিজ দূরে থেকো না, সামনে এসো। আমি তোমাদের খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।আমার একটা তৃষ্ণা পেয়েছে, সেটা হলো তোমাদের দেখতে চাওয়ার তৃষ্ণা,তোমাদের স্পর্শ করতে চাওয়ার তৃষ্ণা!
মা,তুমি কেনো এতো গুলো প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছো আমায়? আমি খুব নিস্তেজ হয়ে পড়ছি তোমাদের হারিয়ে। মা তুমি জেনে হোক না জেনে হোক কার হাতে তুলে দিয়েছো জানো?পৃথিবীর সব থেকে ভালো মানুষের কাছে আল্লাহ আমাদের পৌঁছে দিয়েছিলেন, তোমাদের মতো করে ভালোবেসে আপন করে নিয়েছে আমাদের, তোমার চিঠিতে লিখা প্রতিটা অনুরোধ সে রেখেছে, আমাকে মানুষের মতো মানুষ বানিয়েছে, আমি একজন আর্মি অফিসার, মিশান খান নামের আগে ক্যাপ্টেন যোগ হয়ে ক্যাপ্টেন মিশান খান হয়েছি। আমি না বিয়েও করেছি, আমার স্বামী পুলিশ অফিসার,AIG Safwan Reza Tibro.
কিন্তু মা, তোমাকে দেয়া কথা আমি রাখতে পারিনি, নিশানকে আগলে রেখেছিলাম ঠিক কিন্তু বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি, নিশান বেঁচে নেই।
আমি কথা দিয়ে কথা রাখতে পারিনি,আমায় ক্ষমা করে দিও।
যদি আমাকে ক্ষমা করতে পারো তবে আমার সাথে যোগাযোগ করো,আমাকে দর্শন দিও তোমাদের। আমি বাংলাদেশে থাকি,এইযে আমার ফোন নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি, এটাতে যোগাযোগ করলেই পাবে, -০১*********।
যদি এই নাম্বারে না পাও তবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এসে আমার খোঁজ করলেই পেয়ে যাবে,ওখানে আমি না থাকলেও আমার পরিচিত অনেক মানুষ আছে যারা তোমাদের আমার কাছে পৌঁছে দেবে।
ভালো থেকো তোমরা।
ইতি,
তোমাদের অগোচরে ছোট বেলায় হারিয়ে যাওয়া বড় বেলার মিশান!”
চিঠি লিখে তীব্রর কথামতো ছবির পাশে আঠা দিয়ে লাগিয়ে রেখে চলে যায় ওরা।
যাওয়ার আগে তীব্র পেছনে ঘুরে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে এমন ভাবে, এতে বুঝা যায় এই বাড়িটা নিয়ে মিশানের জন্য কোনো প্ল্যান আছে, যেকোনো ভাবেই হোক বাড়িটাকে মেরামত করে আগের মতো সুন্দর চাকচিক্য করে মিশানকে সারপ্রাইজ দেবে।
বাংলাদেশে ফেরার জন্য ওরা লাহোরে যায় লাহোর এয়ারপোর্ট থেকে দেশে যাবে।
এয়ারপোর্টের কাছাকাছি আসতেই রাস্তাই জ্যাম থাকার কারণে ওরা গাড়ি থেকে নেমে দু মিনিটের রাস্তা হেঁটে যেতে নেয়, এমন সময় রাস্তার পাশে এক জরাজীর্ণ বৃদ্ধ কাবু হয়ে বসে বনরুটি খাচ্ছে। গায়ের চামড়া গুলো ঝুলে আছে, শরীরটা খুব কাঁপছে। সামান্য বনরুটি মুখে তুলে খেতেও যেনো তাঁর কষ্ট হচ্ছে। তীব্র মিশান এক পলক দেখে নজর ফিরিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো,এমন সময় তীব্র পেছন ঘুরে পকেটে হাত দিয়ে টাকা বের করে, লোকটাকে দিতে গিয়ে মুখের দিকে তাকায়, লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে তীব্র থেমে যায়, খুব চেনা চেনা লাগছে চেহারাটা। তীব্র মিশানকে ডাক দিতেই মিশান ঘুরে তাকায়,ইশারায় ওকে তীব্রর কাছে যেতে বলে,মিশান কাছে যেতেই বৃদ্ধ লোকটার দিকে মিশানের নজর আটকে যায়। পরোখ করে দেখার পর মিশান বৃদ্ধলোকটার সামনে বসে জিজ্ঞেস করে,
-কিয়া আপকা নাম, সৈয়দ কাওসার?
লোকটা মিশানের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়,কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করে,
-তুম কোন হু বেটি?
-কিয়া আপকা কইয়ি বেটা থি?জিসকি ঘার দু বেটি থি,এক কি নাম মিশান,অর এক কি নাম নিশান।
লোকটার চোখে আরো প্রশ্ন জাগলো।
-তুম ইতনা ছাব ক্যেসি জানতি হু?কিয়া তুম জানতি হু,বো চারো কাহাপ্যে হ্যে?মেরা বেটা, মেরা বেটা কি বহু অর উছকি দু বেটিয়া।
মেনে কাব তাক উন চারোকো ঢুনতে রাহাহু, নেহি মিলা উন চারও নে। কিতনা সুন্দর পরিবার থা হামকো, কাহা গায়ি ছাব?
বলতে বলতেই লোকটা কেঁদে দিলো,মিশানও কেঁদে দিয়ে লোকটাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-দাদাজান! মে মিশান হু আপকা!
-মিশান! তুম মেরি মিশান?
-হা দাদাজান!
দাদাজানও মিশানকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতে শুরু করে।
মিশান খুব প্রশান্তি পাচ্ছে ভেতরে,অন্ততো একজনের দেখা তো মিললো। ভাগ্যিস তীব্র তখন টাকা দিতে এসেছিলো
দাদাজানের থেকে জানতে পারে ওর দাদীজান নিউমোনিয়া রোগে মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে।
আর ওর বাবা-মা নিশান মিশানের মতোই ওর দাদা দাদীকেও অনেক দূরে পাঠিয়ে দেয়, আর বলে দেয় যতোদিন তাঁরা না ফিরছে যেনো সেখান থেকে কোথাও না যায়, আর কাউকে যেনো নিজেদের পরিচয় না বলে।যদি কখনো তাদের মৃত্যু সংবাদও শুনতে পায় তবুও যেনো তাঁরা দিশেহারা হয়ে ওর বাবা মাকে খুঁজতে না যায়। আর অই বাড়িটাতে ভুল করেও যেতে মানা করে।কেনো এসব করে তার প্রশ্ন অজানা।
কি ছিলো এসবের কারণ সবটা অজানা।
মিশানের বাবা মায়ের ব্যাপারটা আজীবন রহস্যই রয়ে যাবে যতোদিন বাবা মাকে না পাচ্ছে, আর যদি মারা যায় তবে রহস্য রহস্যই থেকে যাবে।
প্রায় দেড় বছর পর……
মিশানকে তীব্র পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে গালের সাথে গাল লাগিয়ে বললো,
-এইবার Sad না।এইবার Happy Third Marriage Anniversary সেন্টিখোর!
মিশান মিষ্টি হাসি দিয়ে তীব্রর দিকে ঘুরে তীব্রর গলা জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে বললো,
-থ্যাংক ইউ টুইন ওয়ান!
কিন্তু এনিভার্সারী গিফট কই?মাগনাই তো বিয়ে করে নিয়েছেন, অন্তত ম্যারিজ এনিভার্সারী গিফট তো দেবেন?
-গিফট চাই?
মিশান হাত বাড়িয়ে বললো,
-ইয়েস!
-কি গিফট?
-শপিং মলে চলুন, আমি নিয়ে নিচ্ছি, আপনি শুধু কার্ড টা বের করবেন।
-না না তা হবে না। নাম বলো এনে দিচ্ছি।
-একই জিনিস বসুন্ধরাতেও পাওয়া যায় আবার গুলিস্তানও পাওয়া যায়।আপনি তো হাড়কিপ্টে আনবেন গুলিস্তান থেকে।
-না না, তুমি আমার একমাত্র বউ এটা কি করতে পারি বলো?
তীব্রকে ছেড়ে দিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে কড়া স্বরে বললো,
-অই আমার গিফট লাগবে না, আমার দেনমোহরের টাকা দাও।আমি ওটা দিয়েই গিফট কিনে নেবো।
তীব্র মুখ কুঁচকে বললো,
-দেনমোহর?
মিশান কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বললো,
-শালা! তিন বছর হয়ে গেছে। অর্ধেক দেনমোহর দিয়ে বাকি গুলো দেয়ার নাম নেই!হ্যে মালিক!এ কি হাড়কিপ্টে পাঠিয়েছিলে আমার জীবনে!
-কোথায়! তোমার দেনমোহর তো সব শোধ ই হয়ে গেছে সেই কবে!
অর্ধেক নগদ দিয়েছি,বাকি অর্ধেক তো তুমি প্রতি মাসের শুরুতে শপিং করেই উশুল করেছো!টাকা তো তুমিও ইনকাম করো আমি কখনো ভাগ বসিয়েছি? আমার টাকা গুলো শকুনের মতো সাবাড় করছো!
মিশান রেগে গিয়ে তীব্রর চোখের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে দাঁত চেপে বললো,
-অসভ্য, বেয়াদব, ফাজিল, বাটপার,লম্পট, ইতর, রাবিশ,খবিশ,পটলের বিচি,করলার বিচি,বিরিয়ানির এলাচ!
-আর তুই একটা গাইছছ্যা আলু।
-তুই!
-তুই।
মিশান ধমক দিয়ে বললো,
-হপ ব্যাটা,সাত সকালে মাথা খারাপ করতে আসছে। অফিস থেকে ফিরে তোকে ধরছি থাক ব্যাটা।
মিশান রাগ দেখিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, তীব্র পেছন থেকে বলে উঠে,
-তোমার নেইম ব্যাচ টা লাগাওনি।
-ওটা তুই পড়ে থাক।
-ঘাউড়ামি সারাটা পথ।মাতাল সেন্টিখোর!আজকের দিনটা আমি ড্রপ করে দিয়ে আসি?
মিশান তীব্রর দিকে ঘুরে বলে,
– যাতে রাস্তায় ধাক্কা মেরে গাড়ির নিচে ফেলে মারতে পারিস তাই?তারপর আরেকটা বিয়ে করবি তুই?
-আরে কি থেকে কি কথায় টানছো?আসো আমার এটিএম কার্ড নিয়ে যাও।
-চাটনি বানাইয়া খা ওটা দিয়ে।
মিশান আর থেমে না থেকে ঘরের ত্রিসীমানায় থাকে না।নিচে নেমে শাশুড়ি মায়ের সামনে দিয়ে গদগদ করে বেরিয়ে যাচ্ছে এমন সময় শাশুড়ি সন্দেহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
-অফিস যাচ্ছো মিশান?
মিশান পিছু ঘুরে উত্তর দিলো,
-হ্যাঁ মা!
-তোমার চোখ অমন লাল দেখাচ্ছে কেনো?
-এমনিই মা, মাথা ব্যাথা করছিলো তো তাই মলম দিয়েছিলাম, মলমের কারণেই হয়তো লাল দেখাচ্ছে।আমি আসি এখন মা?লেট হয়ে যাবে।
স্বভাবতই একটু রেগে গেলে মিশানের চোখ লাল হয়,তীব্রর সাথে রাগ দেখানোর কারণে চোখ লাল লাগছে।আর এদিকে তীব্রর মা,যাকে অনেক বলে কয়ে রাজি করিয়ে মিশানকে মেনে নিলেও, উনি এখনো মিশানকে সন্দেহ করে, মিশান হয়তো নেশা করে । এই সন্দেহ আজীবনেও তাঁর ভেতর থেকে কেউ পরিষ্কার করতে পারবে না।
মিশান কোনো মতে পাশ কাটিয়ে বাড়ি থেকে বের হতেই তীব্র চিতা বাঘের গতিতে দৌড়ে মিশানের পিছু নেয়,তীব্রর মা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে যায় কর্মকান্ড।
বাইরে মিশানের সাথে তীব্র জোরাজুরি করছে ওকে আজ একা যেতে দেবে না, আর মিশান জেদ করছে ও একাই যাবে।
এদিকে তীব্রর মা দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে ওদের অঙ্গভঙ্গি দিয়ে মেলাচ্ছে,মিশান নেশা করেছে তাই ওকে একা একা ড্রাইভ করে যেতে দেবে না, যদি রাস্তা ঘাটে এক্সিডেন্ট করে, সে রিস্ক নেবে না বলে তীব্র ওর উপর জোর করছে।
তীব্রর মা নিজের দুঃখ নিজেই বানায়।অবশ্য কখনো মিশানের সাথে খারাপ ব্যবহার করে না তীব্রর ভয়ে।মিশানকে একটা ধমক দিলে তীব্র সোজা মিশানকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে। তীব্র জানে মিশান কেমন। তবে তীব্রর মা মিশানের সাথে প্রায় ই নেশার ব্যাপার টা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও মিশান এসবের তোয়াক্কা করে না, স্বাভাবিক ভাবেই নেয়।তীব্র ওর বাবা মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার না করলেও, মিশান করে।সেদিন মামাকে কথা দেয়ার পর মিশান এলকোহলের ধারে কাছেও যায় নি।
সময়ের সাথে মিশানের জীবন একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছে।
বাবা মাকে আজও খুঁজে পাওয়া যায় নি।সেদিন দাদাজানকে দেখার পর ভিসা পাসপোর্ট প্রসেসিং করে দাদাজানকে বাংলাদেশে নিয়ে আসে, আর দাদাজানকে মিশানের মামা মিমির সাথে রাখে।মিশান রোজ অফিস থেকে বাড়ি ফেরার আগে মিমি আর দাদাজানের সাথে দেখা করে আসে,আর মামার সাথে তো দেখা হয় ই ক্যান্টনমেন্টে।
তাপসিন লেখাপড়া নিয়ে অনেক ব্যস্ত।দ্বীপ যাবৎ জীবন জেল খাটছে।
তীব্র মিশান ওদের অতীতের যন্ত্রণা গুলো একটু একটু করে ভুলার চেষ্টা করে খুশির মূহুর্ত গুলো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শুরু করেছে।
সারাটাদিন কেটে যায় তীব্রর, মিশানের রাগ ভাঙাতে।পুরো বেলা মিশানের সাথে ক্যান্টনমেন্টেই থেকে যায় মিশানকে বিরক্ত করতে। এতে মিশান বিরক্ত না হয়ে ভেতরে ভেতরে খুশিই হয় অনেক। উপরে উপরে রাগ দেখায় মাত্র।
নিজের অফিস থেকে ছুটি নিয়ে, আব্দুর রহমানকে দায়িত্ব দেয় মিশানের জন্য একটা সুন্দর প্লেসে এরেঞ্জমেন্ট করতে।
মিশান অফিস থেকে বেরিয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর হাঁটাহাঁটি করে, তীব্র পাশ দিয়ে হাঁটে মিশানের দিকে ঘুরে , একটা একটা কৃষ্ণচূড়া ফুল মিশানকে বাড়িয়ে দেয় মিশান হাতে নিয়ে তীব্রর দিকে ছুঁড়ে দেয়, তীব্র তবুও থেমে থাকে না ফুল দিতেই থাকে মিশান ছুঁড়তেই থাকে।ফুল দেয়ার পর্যায়ে পকেট থেকে টুপ করে এটিএম কার্ড বের করে বাড়িয়ে দিতেই মিশান হাতে নিয়ে ওটা আর ছুঁড়ে দেয় না, নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নেয়।তীব্র আবার ফুল দেয় মিশান আবার ফুল হাতে নিয়ে ছুঁড়ে দেয়।অবশেষে তীব্র নিজের ওয়ালেটটাই মিশানকে বাড়িয়ে দেয়,
মিশান তীব্রর কান্ড দেখে ফিক করে হেসে দেয়।
রাতে ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্ট পুরোটা বুক করে মিশানের জন্য স্পেশাললি সাজানো হয়।রেস্টুরেন্ট টা এতো উঁচু ভবনে অবস্থিত, ওখানে দাঁড়িয়ে পুরো শহর দেখা যায়। বেশ মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।
-সরকারি চাকরী, বেতন আর কয়টাকা পাই,এখানে সম্মান অনেক হলেও টাকা অনেক কম।একটা গ্রামীণ প্রবাদ আছে না, নাম তাল্লুকধার হইলে কি হইবো, ধার আছে কিন্তু তাল্লুক নাই।আমার হলো সেই হাল।
মিশান চোখ ট্যাড়া করে তাকায়,
-ঘুষখোর!
-তুমি দিয়ে থাকলে তবে তাই!
মিশান ঠোঁট টিপে হাসি দিয়ে বলে,
-জায়গাটা সুন্দর আছে, থ্যাংকস!
তীব্র মিশানের গাল টেনে বললো,
-সুন্দর তো হবেই!আমার একমাত্র বউয়ের জন্য এরেঞ্জমেন্ট বলে কথা।
-থ্যাংকস টা রহমানকে দিয়ে দিও। আমার সাথে তো দেখা হবে না আজ।
-তুমি জানলে কি করে এটা রহমানের কাজ?
-আমি চেহারা দেখলেই বলে দিতে পারি,কার বাপের নাম কি!
-আহা! গো কি কথা!দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?আসো একটু বুকে আসো আদর করি।
-মানলাম মানুষ নেই আশেপাশে,তবুও এটা পাব্লিক প্লেস।কিপ ডিসটেন্স প্লিজ স্যার!
তীব্র মিশানের থেকে এক হাত দূরে গিয়ে দাঁড়ালো, মিশান হেসে দিয়ে তীব্র কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো।
তীব্রও হেসে দিয়ে মিশানের পেছন দিয়ে হাত কাঁধে রেখে জড়িয়ে ধরলো।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শহরটাকে দেখছে, কেবলই একদল স্থির আলো আর এক দল অস্তির আলোর ছুটাছুটিই দেখা যাচ্ছে।
-একটা কথা বলবো মিশান?
-বলো।
তীব্র রহস্যময় ভাবে বললো,
-হতে পারে তো ঘটনা উল্টো। আমি যা যা বলেছি সব উল্টো হবে সত্যিটা।আমার মুখের কথায় তুমি নির্বিঘ্নে সবটা বিশ্বাস করে নিলে।হতে পারে না আমিই তীব্র?
মিশান মলিন হেসে তীব্রর হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
-তুমি যেই হও।ঝলকময় তীব্র কিংবা তীব্রময় ঝলক! দুটোতেই ঝলকের নাম মিশ্রিত। আমি মেনে নিয়েছি, তুমি যেমন আমি তেমন ই মেনে নিয়েছি।হতে পারে তুমি তীব্র,কিন্তু তোমার শরীরে পাম করা রক্তের অই হৃদপিন্ডটা নিশ্চয় ঝলকের,ওটাই ঝলকের অস্তিত্ব রয়ে যাবে এই তীব্রর বুকে।
আর ঝলক হলে তো কথাই নেই।ওভার অল টুইন ওয়ান!
তীব্র মিশানের কপালে চুমু খেয়ে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো।
দুজন দুজনের জীবন এমন ভাবে আঁকড়ে ধরেছে কেউ কাউকে হারাতে দেবে না। একে অপরকে ভালোবেসে বাঁচতে শিখেছে। একজন আরেকজনের জীবন গোছানোর বাহক হয়ে এসেছে।
জীবনে মানুষ অনেক কিছু পাবে হারিয়ে যাবে, অনেক বাঁধা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে।হেরে যাবে, ব্যর্থ হবে, ক্লান্ত হবে, হতাশ হবে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে।তবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাটা সময় সাপেক্ষ,সেটা কেবল নির্ভর করে আত্মবিশ্বাস ও প্রচেষ্টার উপর।
পর্যায় ক্রমে জীবনের গতি এভাবেই চলবে।সুখ আসবে যাবে, দুঃখ চিরস্থায়ী আঁচড় কেঁটে যাবে।
কেউ একজন বলেছিলো জীবনটা হলো নাটকের মঞ্চ,এখানে যা কিছু ঘটবে, কিন্তু কখনো মঞ্চ ছেড়ে যাবেন না, কারণ এ মঞ্চ কেবলই আপনার জন্য বরাদ্ধ।এই নাটকের নায়ক /নায়িকা আপনিই!
সমাপ্ত………………