#তেজস্ক্রিয়_রক্তধ্বনি
#লেখিকা_রিয়া_খান
#পর্ব_৪৭
বেশ কিছুদিন হুঁশ বিহীন জ্ঞান নিয়ে হসপিটালের বেডে পড়ে থাকে ঝলক। হৃদপিন্ডের আঘাতের কারণে সব সময় অক্সিজেন মাস্ক পড়িয়ে রাখা হয়, রক্তে অক্সিজেন সরাবরাহ করার জন্য।
ভয়াবহ মৃত্যু তাণ্ডব থেকে যে ফিরে এসেছে এটাই তো অনেক।
যেদিন ঝলক চোখ খোলার পর বুঝতে পারে সব কিছু, জ্ঞানের সাথে হুঁশটাও ফিরে আসে।নিজেকে হসপিটালের বেডে দেখে বুঝলো সেদিন মারা যায়নি, বেঁচে আছে এখনো বিধ্বস্ত অবস্থায়।
কিন্তু এটা বুঝেনি ঝলক দেশ থেকে অনেক দূরে আছে। কেবিনে থাকা নার্সকে দেখে একটু আজব লাগছিলো,ঝলকের ধারণা ছিলো ওকে সিএমএইচে রাখা হয়েছে, কিন্তু নার্সের পোশাকের ধরণ দেখে মেলাতে পারছে না। সিএমএইচের নার্সদের পোশাক অন্যরকম।
নার্সকে ইশারা করে কিছু বলতে যাবে তখনি বেহুঁশ হয়ে যায়।
বেশ কিছুদিন চলে যায় ঝলকের হসপিটালের জীবন। সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে, একটু একটু করে, ঠিক মতো শ্বাস প্রশ্বাস নিতে পারে।
কথা বলতে পারলেও কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেনা, ঝলক তখনো ঘোরের মধ্যে ছিলো।পরিচিত মুখ দেখতে না পেয়েই মূলত চুপচাপ থাকার কারণ। ওখানে কেবল ডক্টর আর নার্সদের ই দেখতো ওদের কথাবার্তাতে বুঝতে বাকি থাকে না, ওটা বিদেশ,কিন্তু কোথায় আছে সেটা জানার আগ্রহ প্রকাশ করে না ঝলক।
ঝলক বেডে শুয়ে থাকা অবস্থায় দেখতে পায় ওদের ক্যান্টনমেন্টের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, স্পেশাল ব্রাঞ্চের এডিশনাল আইজি, তীব্রর বাবা এবং একজন ডক্টর।
ডক্টর ঝলকের অক্সিজেন মাস্ক সরিয়ে দিতে বললে, নার্স মাস্ক খুলে দেয়।ঝলক এমনিতে সুস্থই ছিলো মোটামুটি,হার্টের সার্জারির কারণে সুষ্ঠু ভাবে অক্সিজেন সরাবরাহর জন্য অক্সিজেন মাস্ক পড়িয়ে রাখতো সব সময় ।আস্তে আস্তে উঠে বসার চেষ্টা করে,নার্স সাহায্য করার পর বসতে পারে।
ঝলক জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে আস্তে আস্তে করে প্রশ্ন করে,
-ভাইয়া কেমন আছে বাবা?
-………………
সেলিম রেজার মুখে কোনো আওয়াজ নেই । এডিশনাল আইজি স্যার ঝলকের পাশে বসে ধীরে ধীরে বলতে লাগলো,
-ঝলক!
-জ্বি স্যার।
-মানুষ আসবে যাবে, এটাই সত্য।কেউ চিরস্থায়ী নয়।তীব্র সব সময় একটা কথা বলতো”মৃত্যু সত্য”
তুমি তীব্রর ভাই!এই বাক্যটা হয়তো একাধিক বার শুনেছো। নিশ্চয় তুমি তোমার ভাইয়েরই মতো,এবং তাঁর প্রবাদে বিশ্বাসী।
তীব্র ফিরে না আসলেও,
তুমি চাইলে ওর তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি গুলো ধরে রাখতে পারো নিজের মাঝে।
ঝলক চোখের মাঝে একরাশ ভয় আর বিষ্ময় নিয়ে ঠোঁট কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে বললো,
-মা মা মানে,আমার ভাই নেই?
– হ্যাঁ ঝলক।তীব্র আমাদের মাঝে থেকেও নেই।আমাদের চেষ্টার কমতি ছিলো না। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা সহায় ছিলেন না, তিনি যেটা ভালো নির্ধারণ করেছেন, তাই ই হয়েছে।
ভেঙে পড়ো না ঝলক, ধরে নাও তুমিই তীব্র, ঝলক মরে গেছে।এই যে তোমার হৃদপিন্ডটা বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলো,অই হৃদপিন্ড নিয়ে তোমাকে বেশিদিন বাঁচানো যেতো না। আমরা সব থেকে ভাল ডক্টরদের শরণাপন্ন হয়েছি, তোমার হার্টের জন্য দেবী প্রসাদ শেডির কাছে গিয়েছি।
তীব্রর হার্টটা ব্যবহার যোগ্য ছিলো, তাই ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী তোমার বুকে তীব্রর হৃদপিন্ড স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
তোমার বুকের এই বাঁ পাশটাতেই তোমার প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের অস্তিত্ব বাস করছে। নিজের ভাইয়ের এই অস্তিত্বটাকে ধরে রাখতে তোমার তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে, তোমার ভাইয়ার জায়গাটা ধরে রাখতে হবে।
বুঝেও না বুঝার ভান করে, ঝলক প্রশ্ন করলো,
-স্যার এটা তো আমাদের সিএমএইচ না । কোথায় আছি এখন?
-আমরা সিঙ্গাপুর আছি।তোমাদের দুই ভাইকেই এখানে ট্রিটমেন্ট করেছি।
– ভাইয়া কোথায় এখন?
এডিশনাল আইজি স্যার কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে উত্তর দিলো,
-তীব্রর জানাজা হয়ে গেছে ঝলক।
ঝলক নিরব হয়ে গেলো,চোখের কোণা বেয়ে অঝোরে পানি ঝরতে লাগলো। ভাইয়ের মৃত্যুর সময় পাশে থেকেও কিছু করতে পারেনি, মৃত্যুর পর জানাজাতেও শামিল হতে পারেনি।নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে,অন্তরে যেনো রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেছে।
– ভাইয়ার গায়ে তো তেমন কোনো আঘাতের চিহ্ন দেখিনি।ভাইয়ার মৃত্যু কি করে হলো?ভাইয়াকে তো গুলিও করেনি,হঠাৎ করে অমন করে রক্ত বের হলো নাক মুখ দিয়ে,তাঁর পরেই আর কোনো সাড়া পাই নি।ভাইয়া বলছিলো ওরা নাকি কি একটা ইনজেক্ট করেছে গায়ে যার কারণে খুব বমি পাচ্ছিলো, আর মাথা ঘুরাচ্ছিলো। ওটা থেকেই কি এমন হয়েছে ভাইয়ার সাথে?
-ডক্টর বলেছেন,তীব্রর গায়ে এক প্রকার পয়জন ইনজেক্ট করা হয়েছিলো।পয়জনটার কাজ এমন ছিলো,ওটা মানব দেহের কোষ গুলোকে একটু একটু করে নিস্তেজ করে দিতে থাকে, পিটুইটারি হরমোন থেকে শুরু করে সব কটা হরমোনে তীব্র প্রভাব ফেলার কারণে বমি আসে,অস্বাভাবিক ভাবে মাথা ঘুরায়,আর জীবকে তৃষ্ণার্ত করে তোলে। যখন দেহে পানি প্রবেশ করে,বিদ্যুৎ গতিতে পয়জনটার আসল কার্যকারিতা শুরু হয়ে যায়। শ্বাস নালী বন্ধ করে দেয়,মস্তিষ্ক থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। যার কারণে নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে কয়েক সেকেন্ড বা এক দেড় মিনিটেই মারা যায়।
কথাগুলো শোনে ঝলক তাকিয়ে থাকার বা কানে কিছু শোনার মতো শক্তি পাচ্ছে না। নিজের অজান্তেই ভেতরে অপরাধীর বোঝা এসে চেপে ধরলো। না বুঝেই নিজের ভাইকে মৃত্যুর কোলে তোলে দিয়েছে।তীব্রর গায়ে অই পয়জনটা ইনজেক্ট করার ফলেই ওর অমন অবস্থা হয়েছিলো,প্রচন্ড পানি তৃষ্ণা পেয়েছিলো।ভাইয়ের তৃষ্ণা মেটাতে, পানি খাইয়ে অজান্তেই মৃত্যুকে প্রবেশ করিয়ে দেয় ভেতরে।
বাবার দিকে তাকিয়ে ঝলক করুণ স্বরে বলে উঠলো,
-বাবা আমি আমার ভাইয়ার খুনি, বাবা!
ভাইয়াকে পানি টা আমি খাইয়েছিলাম!ভাইয়ার কথামতো যদি আমি অই সময় পানিটা, না খাওয়াতাম তাহলে আজ আমার ভাই বেঁচে থাকতো।
সেলিম রেজা ঝলকের হাত জড়িয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,
-এমন কথা বলে না বাবা।তীব্রর হায়াত ই ছিলো না,ওটা কেবল উছিলা ছিলো।তুমি পানি না দিলেও অন্য কোনো ভাবে মারা যেতো তীব্র!তুমি ভেঙে পড়ো না বাবা।তোমার মাঝেই তীব্র বেঁচে থাকবে।আমার এক ছেলের মাঝেই দুই ছেলে বাস করবে।
ঝলক তখনো জানে না, ওর চেহারাটা বদলে দেয়া হয়েছে,ও তখন তীব্র রূপধারী।
ঝলকের সামনে সব কথা বলতে পারলেও এটা বলার সাহস পাচ্ছিলো না কেউ। জানার পর, কেমন না কেমন রিয়্যাকশন দেবে ।
সবাই আমতা আমতা করছিলো,কিন্তু ঝলক কিচ্ছুটি আঁচ করতে পারেনি।
আঘাত টা একটু বেশি মাপের পড়ে যাবে বলে সবাই বার বার থেমে পড়ছিলো।
ঝলকের বুক চেপে আসছিলো,মনে হচ্ছিলো ওর বুকে কেউ পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে।
অপরাধীদের প্রতি ওর আর কিসের প্রতিশোধের আগুন জ্বলবে, নিজেকেই খুনি দাবী করছে বার বার।নিজের প্রতি নিজের ই ঘৃণা জন্ম নেয়া শুরু করে অই সময়টাতেই।কারো শান্ত্বনাতেই ভেতর শান্ত হচ্ছে না।
সেলিম রেজার শান্ত্বনা গুলোও জোরালো হচ্ছিলো না, কারণ তাঁর ভেতরে এক সন্তান হারানোর বেদনাটা জুড়ে বসেছিলো।
দিন শেষে, সেও ক্ষতবিক্ষত। তীব্র ছিলো অনেক সাধনার পর পাওয়া এক রত্ন।যে রত্ন বার বার হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় থাকতো, আবার চিরতরে হারিয়েও গেলো।
তীব্রর মা ঝলককে হারানোর শোক হয়তো একমাস এক বছর মনে ধরে রাখবে,কিন্তু তীব্রকে হারানোর শোক আজীবনেও শেষ হবে না।
সেলিম রেজা ঝলকের পাশে বসে ওর হাতের উপর হাত রাখলো, ঝলক বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো কিছু বলতে চাচ্ছে হয়তো ওর বাবা,
-কিছু বলবে বাবা?
-বলবো,কিন্তু বলতে পারছি না। কিভাবে বলবো, তার বাক্য গঠন করতে পারছি না।
ঝলক চোখে ভয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-মা ঠিক আছে তো বাবা?
-তোমার মা ঠিক আছে, কিন্তু!
ঝলক বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
-তোমার মা জানে, ঝলক মারা গেছে।তীব্র বেঁচে আছে।যতোটা ভেঙে পড়েছে তোমার মৃত্যু সংবাদে, তারচেয়ে দ্বিগুণ হারে ভেঙে পড়বে তীব্রর মৃত্যুর কথা শুনলে।তুমি তো বুঝো সব, তাই না ঝলক?
-সেটা তো বুঝতে পারছি, কিন্তু ভাইয়া তো নেই। এখন কি হবে বাবা?
-তোমাদের দুই ভাইকে যখন সেনাবাহিনী ফোর্স রক্ষা করে তখন দেখা যায় ওরা তোমাদের চারপাশে পেট্রোল ছড়িয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেছে।
সেনাবাহিনীরা খুব কম সময়ে পৌঁছে গেছিলো বলে তোমার কোনো ক্ষতি হয়নি, শুধু পিঠে কিছুটা জায়গা জুড়ে পুড়ে গেছে আর মুখে।
ঝলক নিজের মুখে হাত দিয়ে হাতিয়ে দেখে মুখে কোথাও কোনো ক্ষত নেই।
-আমার চেহারা তো একদম ক্লিন ই লাগছে বাবা।কোথাও ব্যান্ডেজও নেই।
-আমার কথা শেষ হয়নি ঝলক।
এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো , মাথায় কোনো কিছু কাজ করছিলো না। তখন আমাদের এডিশনাল আইজি খাইরুল হক স্যার আমাকে রিকুয়েস্ট করে জানায়।এসব কিছু হয়তো উপর আলার ইশারা,তোমার চেহারাটা বদলে তীব্রর মতো করে দেয়ার।
আমি অতো কিছু মাথায় ধরিনি,আমি কেবল তোমার মায়ের কথা ভেবে রাজি হয়ে যাই।এরপর সার্জারি করে তোমার চেহারাটা তীব্রর মতো করে দেয়া হয়েছে। এমনকি ঝলকের মৃত্যুর ডেড সার্টিফিকেটও হয়ে গেছে। মিথ্যে হলেও সত্যি এটাই এখন যে,ঝলক বেঁচে নেই,তীব্র বেঁচে আছে।
ঝলক নির্বাক হয়ে বাবার মুখের কথা গুলো শুনছিলো। মনে হচ্ছিলো সব কিছু কল্পনা করছে,যে কল্পনাতে যা কিছুর রূপ যেমন ইচ্ছা হতে পারে।তেমনি ওর বাবা ওকে রূপক গল্প শোনাচ্ছে, ঝলক সেই রূপক গল্পে প্রবেশ করেছে।পলকবিহীন দৃষ্টিতে ঝলক থ হয়ে বসে আছে। নার্স একটা আয়না এনে ঝলকের সামনে ধরতেই আয়নাতে নিজের চেহারায় চোখ পড়তেই ঝলক ভয় পেয়ে যায়, হৃদস্পন থেমে যায়।
একটা মৃত মানুষের চেহারা ওর চেহারাতে ভেসে উঠছে।সেই মৃত মানুষ, যে ছিলো প্রাণের থেকে প্রিয় বড় ভাই। আবার তাঁর ই মৃত্যুর খুনী।
ভয়ে ঝলক আর অই চেহারার দিকে তাকাতে পারে না, গায়ে কাঁপুনি উঠে যায়, শরীর থেকে ঘাম ছুটে একাকার ।হাত পায়ের রগ যেনো কেমন অসাড় হয়ে আসছিলো ঝলকের ।
চোখ সরিয়ে নেয়ার পর চোখ বন্ধ করে বসে রইলো।
এডিশনাল আইজি স্যার, ঝলককে বললো,
-তোমার ভাই ছিলো একটা চিতা বাঘ। যে শিকারি ধরার জন্য কোনো কিছুর পরোয়া, না করে যেকোনো স্টেপ নিতো। ওর কারণে অনেক অপরাধ কমে এসেছিলো।শহরের অনেক বড় বড় সন্ত্রাস মাস্তান গ্যাং ছিলো, যারা তীব্রর ভয়ে সোজা হয়ে গেছে।যদি ওরা জানে তীব্র নেই তবে আবার ওরা আগের মতো মেতে উঠবে ধ্বংস লীলায়। আমরা চাই তুমি তীব্রর সেই জায়গা নাও।আমাদের পুরোপুরি সাপোর্ট তোমার সাথে পাবে।তুমি আমাদের ছেলের মতো। এইযে তোমার বাবা আর আমি এক সাথে চাকরি করে এসেছি,আমার প্রমোশনের কারণে চাকরির মেয়াদ বেড়েছে, আর তোমার বাবা ইচ্ছে করে প্রমোশন না নিয়ে উল্টো পেনশনের আবেদন করে,কারণ তাঁর ছেলেদের উপর তাঁর পুরোপুরি আস্থা ছিলো যে, তাঁরা তাদের দায়িত্বের অবহেলা করবে না।ঠিক তাই ই হলো, দায়িত্বের অবহেলা না করে,প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তীব্র কাজ করে গেছে, আর প্রাণটাও হারালো। এখন তুমিই সম্বল তীব্রর জায়গাটার স্থায়িত্ব বাড়ানোর।
তোমাকে খুব জরুরী তীব্র হিসেবে,কারণ তীব্রর রোল কেবল তুমিই প্লে করতে পারবে। তোমাদের রক্তধ্বনি গুলো এক, তেজস্ক্রিয়তাও এক। তুমি জানো তীব্র কেমন ছিলো, তাই তুমিই পারবে ঝলক।
ঝলক অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-মানে আমি আর সেনাবাহিনীতে থাকতে পারবো না?
মাজহারুল হক স্যার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল স্যারের দিকে ইশারা করতেই,উনি জানালেন,
-সেনাবাহিনীর সাথে তোমার সম্পর্ক থাকবে আজীবন,তুমি যেকোনো সময়, যেকোনো সাপোর্ট পাবে আমাদের থেকে,তুমি আমাদের সম্পদ ছিলে আর আছোও।শুধু পার্থক্য এইটুকুই তুমি থাকবে তীব্রর জায়গায়,এসপি সাফওয়ান রেজা তীব্র হিসেবে। তোমার কাজ গুলো হবে তোমার ভাইয়ের মতো দুঃসাহসিক, বেপরোয়া, অন্যায়কে হারিয়ে ন্যায়ের পথে আনা।তোমার লক্ষ্য তোমার ভাইয়ের মতোই হবে, দেশটাকে সন্ত্রাসবাদ মাদকমুক্ত করা, দূর্বলকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দেয়া, অন্যায়কারীকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া।
-বুঝাতে হবে না আমাকে।আমার কি করতে হবে আমি জানি। তবে আমি আগেই জানিয়ে রাখছি, রক্তের বন্যা বইয়ে দেবো আমি। সব ই ভাইয়ার মতো হবে, কিন্তু কিছু জায়গায় পরিবর্তন হবে। আমার ভাই যেখানে তিনবার ওয়ার্নিং দিয়ে এনকাউন্টার করতো, আমি সেখানে একবার ওয়ার্নিং দিয়ে এনকাউন্টার করবো। আমার ভাই কাদের পিছু লেগেছিলো আমি জানি না, কিন্তু আমি তাদের লাশের বন্যা বইয়ে দেবো যারা আমার ভাইকে মেরেছে। একটা পোকাও ছাড় পাবে না। আপনারা কেউ কোনো আপত্তি করতে পারবেন না।
-তীব্র!
-হুমহ?
এডিশনাল আইজির ডাকে অপ্রস্তুত ভাবেই ঝলক সাড়া দিয়ে দেয়। তিনি ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বলে।
-আমাদের ডিপার্টমেন্টের ছেলে তুমি,আমাদের সম্পদ, আমাদের গর্ব।
ন্যায় বিচারের জন্য যতোদূর তোমার যেতে হয় তুমি যাও, কিন্তু একটা ব্যাপার মাথায় রেখো।এনকাউন্টার করলে আমাদের সরকারের কাছে জবাবদিহিতা করতে হয়।
আমাদের যে সরকারি গান গুলো,এগুলো তো জাস্ট শো অফ করার জন্য,যেনো ক্রিমিনালরা ভয় পায়।কিন্তু সরকারী পারমিশন ছাড়া একটা বুলেট ভুলেও বেরিয়ে গেলে আমাদের চাকরী নিয়ে টানাটানি বেঁধে যাবে।
তাই গান ইউজ করলে আনঅফিসিয়াল গান ইউজ করবে,আগে পেছনে আমরা সিনিয়ররা সর্বোচ্চ সাপোর্ট দেবো তোমাকে।
-ভাইয়া যে স্পেশাল ব্রাঞ্চে জাফর অভিজিৎয়ের সমস্ত পেপারস দিয়েছিলো ওগুলো কি করে জাফরের কাছে গেলো?
-সে এক লম্বা কাহিনী, যে করেছে তাকে আমরা ধরেছি, আর সাসপেন্ড করে জেলও দিয়েছি।শুধু ওকেই না,বাবলুকেও জেল দিয়েছি,এমনকি তোমার মোবাইল যে সরিয়েছিলো তাকেও ধরে একই হাল করেছি।
-শুধু জেল দিলে হবে না।জেলে বসেও মানুষ ইয়াবার ব্যবসা করে।ওদের দন্ডও বাকিদের মতোই হবে।
-তুমি যেটা ভালো বুঝো।অপরাধ তো অপরাধ ই, আমাদের কথা একটাই,অপরাধ থামলেই হলো।
ঝলক নিরব হয়ে যায়।সবার কথামতো ধরে নেয় ঝলক ই মরে গেছে,আর তীব্র বেঁচে আছে,নিজের মাঝে তীব্রকে ধারণ করা শুরু করে।
দিন যতো যায় ঝলককে চেনা মুশকিল হয়ে যায়,এতো বেশি তাড়াতাড়ি তীব্রর ক্যারেকটারে নিখুঁত ভাবে প্রবেশ করে, যারা আসল সত্যি জানে, তাঁরা প্রত্যেকেই অবাক।
সেলিম রেজা অব্ধি বুঝে উঠতে পারে না ওটা তীব্র না, ঝলক।
দেশে ফেরার কয়েকদিন পর বাড়ি ফিরে। সব অভিনয় নিখুঁত ভাবে করলেও মায়ের চোখের দিকে তাকালে যেনো মনে হয় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে,আর ভেতরে ভয় প্রবেশ করে।ঝলক কোনো মতেই মায়ের চোখে চোখ রাখার সাহস পায় না।
বাড়ির ভেতর যতোদূর ওর দৃষ্টি যায়,কোথাও কোনো আয়না রাখতে দেয় না, কারণ আয়নার দিকে তাকালেই ভয় লাগে।
ডিপার্টমেন্টের কেউ ধরতে পারে না ওটা ছদ্মবেশী তীব্র।ওর কাজ গুলো হুবুহু তীব্রর স্টাইলের মতো।একটা কেস সলভ করতে যেমন তীব্রর জন্য ঘড়ি ধরতে হতো না,ঝলকের ক্ষেত্রেও তেমন হয়।
ডিপার্টমেন্টের সিনিয়ররা তো সত্যিটা জানতো,তাই ওর প্রতি যেনো আরো আবেগ এসে জড়ো হতো।মানুষ হয়েও কি করে এতো নিখুঁত রোল প্লে করে!
সবাই খুব বাহঃ বাহঃ! দিতো।
সময়ের চাকার সাথে ঝলক মরে গিয়ে, তীব্র হয়ে উঠে জীবন্ত।
অনেক দিন চলে যাওয়ার পর ঘোর কেটে ঝলকের মনে পড়ে মিশানের কথা।মিশানের খোঁজ নিতে আব্দুর রহমানকে প্রথমে পাঠায়, ও যে দেশে ফিরেছিলো চলে গেছে কিনা।
আব্দুর রহমান জানায় চলে যায় নি,তবে দু একের মধ্যে চলে যাবে।
রহমানের থেকে জানে মিশান বাড়ি থেকে কখন কখন বের হয়।
একদিন রাতে মিশানকে দেখতে রহমানকে নিয়ে বের হয়ে মিশানের মামার বাড়ির রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। রাত বারোটার পর মিশান একা একা বাড়ি থেকে বের হয়, সেখান থেকে মিশানকে ফলো করতে করতে দেখে, মিশান বারে প্রবেশ করছে, ভেতরে ঢুকেই সে মদে মত্ত হয়ে যায়।এই দৃশ্য দেখে ঝলক ভেতরে ভেতরে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায়।
মিশান চলে যাওয়ার পর বারের লোকের থেকে জানতে পারে মাস হয়ে আসে প্রায় মিশান অই জায়গায় ড্রিঙ্কস করে।ঝলক বুঝতে পারে মিশান ওর জন্যই এমন ভেঙে পড়ে গেছে।
দিনের পর দিন যেতে থাকে মিশানের করুণ পরিণতি দেখে ঝলক শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। মিশানকে সবটা জানাতে গেলে মিশান বিশ্বাস করবে না কিছু।তাই মেডিকেল রিপোর্ট গুলো ওর বাবার কাছে চাইতেই সেলিম রেজা জানায় ওগুলো সব পেপারস ডিপার্টমেন্ট সিনিয়রদের কাছে।
ডিপার্টমেন্ট সিনিয়রদের কাছে পেপারস গুলো চাইলে তাঁরা নানান রকম এক্সকিউজ দিয়ে ঝলককে ঘুরাতে থাকে।তাঁরা কোনো ভাবেই প্রমাণ গুলো ঝলককে দিতে রাজি হয় না, সেখান থেকে ঝলকের ভেতর বিরক্তি আসতে থাকে তাদের উপর।এসব প্রমাণ ছাড়া, খালি মুখের কথা মিশান কোনো ভাবেই বিশ্বাস করবে না। এমনিতেও মিশানের সামনে দাঁড়ানোর সাহস হয় না।
মিশান কুয়েত চলে যাওয়ার পর কুয়েতে খোঁজ নিয়ে দেখে মিশান ওখানেও ড্রিঙ্কস করে রেগুলার।ভেতরে আরেক প্রকার ভয় চাপে,ওকে ভূলার জন্য মিশান আবার নিজের জীবনের সাথে অন্য কাউকে জড়িয়ে না নেয় ।একজন লোক লাগিয়ে রাখে মিশানের সমস্ত এক্টিভিটিস ফলো করার জন্য, সেখান থেকেই মিশানের উইক পয়েন্ট গুলো ক্যামেরা বন্দী হয়,আর এই সুযোগে তীব্র মিশানকে জোর করে বিয়ে করে নেয়।
আদ্য অন্ত সবটা শোনার পর মিশান তীব্রর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে পলক বিহীন দৃষ্টিতে, কান্না থেমে চোখের জলের রেখা হয়ে আছে গালের উপর, চোখের পাপড়ি গুলো একটা আরেকটার সাথে লেগে আছে।নিজের হাত দুটো কাঁপছে।ডান হাতটা নিয়ে ধীরে ধীরে তীব্রর বুকের বাঁ পাশে রাখতেই যেনো তীব্রর হৃদস্পন প্রবল হয়ে যায়, মিশান নিজের মাথা টা তীব্রর বুকের ডান পাশে রেখে ওর হৃদস্পনের গতি হাত দিয়ে স্পর্শ করে অনুভব করার চেষ্টা করে।
-আমি তোমার পাশে থাকবো,সবার মতো আমিও বলছি,তুমি ধরে নাও ঝলক মরে গেছে।আর মিশান তীব্রকেই ভালোবাসে।মিশান কেবল ই তীব্রর। আমি তোমার পাশে থাকবো আজীবন। যখন যা করতে হবে আমরা দুজন মিলে করবো।নিজের অজান্তেই তোমাকে আমি কত কষ্ট দিয়েছি।
-তুমি কোথায় কষ্ট দিলে,যত কষ্ট তো আমিই তোমাকে দিলাম।
-থাক এটা নিয়ে কথা কাটাকাটি না করি।যা হয়েছে সব অতীত।আজ আমি মনে অনেক শক্তি পাচ্ছি জানো? কেউ তো আছে আমার জীবনের অস্তিত্বে মিশে যেতে।আমার সোলমেট!
আমার ভালোবাসার মনটা আজও বেঁচে আছে আমার মনের টানে।
তুমি হতাশ হয়ো না তীব্র।তোমার মিশান তোমাকে আর ভূল বুঝবে না বোকার মতো।
-এতোগুলো সময় পেরিয়ে গেছে,জাফর বা অভিজিৎ কেউ ই তো তোমার উপর নতুন করে এট্যাক করলো না। এটা রহস্যজনক না?
-নাহ,এটা সিম্পল।কথায় আছে বড় বড় বোকামি তাঁরাই করে, যারা অতি চালাক।
এরা ভেবেছে সেদিন এরা যে চাল দিয়েছিলো তাতে আমরা দুই ভাই ধুলোয় মিশে গেছি।
হয়তো এক সপ্তাহ দু সপ্তাহ খোঁজ নিয়েছে আমরা আছি কি নেই।কিন্তু আমাদের সিনিয়ররা প্রথমবস্থায় যে চাল দিয়েছিলো বুঝিয়েছিলো আমরা দুজন ই মরে গেছি ।
এরপর তো আনুষ্ঠানিক জানাজা হয় আমার ভাইয়ের তাও আমার নাম করে। যারা বিশ্বাস ঘাতক ছিলো ওরা সত্যিটা জানার পর জাফরকে জানানোর আগেই ওদের দুনিয়া থেকে উঠিয়ে দিই। আর ওদিকে জাফর অভিজিৎ এতোটাই ব্যস্ত মানুষ আমাদের মত সাধারণ মানুষকে নিয়ে রোজ রোজ ভাবার সময় ওদের নেই।ওরা আমাদের মেরেছে, আমরা মরে গেছি।যদি বেঁচে উঠি তাহলে আবার মারবে,এই ধারণা নিয়েই চলছে। ওদের ধারণার বাইরে যে আমি বেঁচে আছি, ঝলক বেঁচে থাকলেও তীব্রর বাঁচার কোনো চান্স ই নেই।
আর অভিজিৎকে তো মেরেছিই।
এখন বাকি জাফর।
-আর কাদের মোল্লা, মোনায়েম, ওরা?
-ওদের হিসেব আলাদা ভাবে হবে।দীপ্তিকে ওরাই মেরেছে।তুমি এখন বাড়ি চলে যাও মিশান, রাত হয়েছে।
-এখন বাড়ি যাবো না,
-কেনো?
-আজকে আমার লাস্ট শিকার ধরবো।
-লাস্ট?
-হুম,অইযে ব্যাংকক গেলো যেটা।ধরতে পারলাম না ওকে।
-কি করে বলবো মিশান, এটাই লাস্ট নয়।মেইন কালপ্রিট তো বাকিই আছে।তোমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে সেই মানুষ টার রূপ । কি করে বলবো তোমাকে সত্যিটা?ভুল বুঝবে কি আমায়?(মনে মনে)
চলবে………
(