#তেজস্ক্রিয়_রক্তধ্বনি
#লেখিকা_রিয়া_খান
#পর্ব_৩৫
মিশান ভেতরে প্রবেশ করলেও দীপ্তি তীব্রর কথোপকথন খেয়াল করে নি,কারণ ওর চোখ ভরা ঘুম,যার রেশ এখনো কাটেনি।লোকটার ডাকে ছিটকে দাঁড়িয়ে পড়ে বেতালে।এই মুহুর্তে ভেতরে প্রবেশ করার পর মিশান খেয়াল করলো ও তীব্রকে কেনো খুঁজছে, পরক্ষণেই মনে পড়লো লোকটা তীব্রর খোঁজ করছিলো।কিন্তু কে এই লোক, আর কেনো খুঁজছে তীব্রকে সেটা জানা হয়নি। সেজন্য মিশান তীব্রকে ডাক না দিয়ে উল্টো ঘুরে বেরিয়ে যায় লোকটির সামনে।
-সরি স্যার!প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি। আপনি কে সেটা জানা হলো না।
-আমি স্যারের বডিগার্ড।আমার নাম জুয়েল তালুকদার।
স্যারের মা আমাকে দিয়ে স্যারের ওষুধ পাঠিয়ে দিয়েছে, যেনো কিছু খেয়ে ওষুধটা খেয়ে নেয়।
-এই মালটা আবার কবে আপডেট হলো?(মনে মনে)
-ম্যাডাম কাইন্ডলি স্যারকে ডেকে দেবেন প্লিজ?
-ওষুধটা আমাকে দিন আমি দিয়ে দেবো।স্যার ভেতরে আছেন, উনি এখন ব্যস্ত।
-কিন্তু ম্যাডাম স্যারের মা বলেছেন, আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে যেনো স্যারকে ওষুধ খাওয়াই,না হলে স্যার ফাঁকি দেবেন।
-ম্যাডামকে বলুন ওষুধটা আমার কাছে দিয়েছেন, আমি খাইয়ে দিয়েছি।
-সরি ম্যাম, এটা আমি করতে পারবো না।আমার দায়িত্ব আমিই নিজে পালন করতে
পছন্দ করি।
মিশান কড়া মেজাজে উত্তর দিলো,
-ঠিক আছে বাইরেই বসে থাকুন।স্যার কখন বের হবে সেটা নিয়ে
কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করবেন না।
আমার থেকে দূওওরে গিয়ে বসুন।
যান!
কথাটা বলেই মিশান আবার বসে পড়লো , কিছুক্ষণ পর তীব্র বেরিয়ে আসে।দীপ্তির এই অবস্থা কি করে হলো সেটা নিয়ে যে প্রশ্ন গুলো তীব্রর ভেতর ছিলো তার উত্তর এখন পেয়ে গেছে, তাই কোনো ইনভেস্টিগেশন করার প্রয়োজন মনে করলো না। মিশান আগ্রহ নিয়ে তীব্রকে কিছু জিজ্ঞেস করলোনা, ওর ধারণা তীব্রকে জিজ্ঞেস করলেই তীব্র ওকে কিছু একটা কাজ দিয়ে বসবে।
-স্যার আমি তাহলে বাড়ি চলে যাই?মামা একটু পর পর ফোন করছে ।
-ঠিক আছে যাও,তোমার আর কোনো কাজ নেই এখন, বাড়ি গিয়ে রেস্ট করো।
মিশান মাথা নাড়িয়ে চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো তীব্র পেছন থেকে ডাক দিলো,
-মিশান!
মিশান ঘুরে তাকালো,
-জি বলুন।
-টাকা আছে তোমার কাছে?
মিশান মলিন হেসে উত্তর দিলো,
-আমার টাকা থাকলেই কি আর না থাকলেই কি। টাকা না থাকলে একবেলা খারাপ যায় না, থাকলেও একবেলা ভালো যায় না।
-টাকা নিয়ে যাও।
আর রহমান গাড়ি নিয়ে আসছে ও তোমাক বাড়িতে পৌঁছে দেবে।
তীব্র পকেট থেকে টাকা বের করে মিশানের হাতে দিলো। মিশান টাকাটা নিয়ে চলে গেলো।
বেলা নয়টা বাজার পর আদিবকে নিয়ে ওর মা বাবা হসপিটালে আসে মিথ্যে কথা বলে।
দীপ্তির আরেকটা বড় বোন আছে, সে দেশের বাইরে থাকে স্বামী সন্তান সহ।
তীব্র আর বাড়িই ফিরেনি।সেই যে এসেছে রাতে, হসপিটালেই পড়ে আছে।
আদিব আসার পর ওদের সাথে কিছুক্ষণ থেকে চলে যায়। দীপ্তি একটু একটু করে কথা বলতে পারলেও ডাক্তার ওকে কথা বলতে বারণ করছে, কথা বলতে ওর উপর অনেক প্রেশার পড়ছে।
তীব্র চারপাশে গার্ডদের সতর্ক করে রেখে চলে যায়।
বেশ কিছুদিন কেটে যায় দীপ্তির, আই সি ইউতে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে করে সময় যাচ্ছে। এই মনে হচ্ছে মরে গেলো গেলো আবার প্রাণ ফিরে আসছে।
প্রাণ যাচ্ছে আর আসছে।কখন যেনো, না ফেরার দেশে চলে যায়।
তীব্র রোজ দীপ্তির খোঁজ খবর নিয়ে যায়, দীপ্তির পাশে বসে থাকে।
একটা ব্রিজের দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে, জুসের গ্লাসে এলকোহল ড্রিঙ্কস ভরে স্ট্র দিয়ে টেনে যাচ্ছে মিশান।আকাশের দিকে তাকিয়ে মিশান তুচ্ছ হেসে বলছে।
-আকাশ ভরা এতো তারা, অর্ধচন্দ্র ভাসমান,কিন্তু আলো নেই আকাশে, কি আজব!
আকাশ দিনের বেলা তুমি কিসের বড়াই করো? রাত হলে যেখানে তুমি অন্ধকার? এক দিনে তুমি কত রূপের ডালি দেখাও,এই সাদা মেঘ ছড়াও, নীল রঙ ধারণ করো,ধোঁয়াশা কালো রূপ নাও,ক্লান্ত সূর্যের আলোতে লাল-কমলা রঙের ঝলক দেখাও।
আকাশ তোমার কিসের বড়াই বলোতো?এইযে রাতে এতো তারা আলো দিচ্ছে,এই বিশাল চাঁদ আলো দিচ্ছে, কোথায় তোমার সেই সাদা,নীল, লাল,কমলা, ধোঁয়াশা রঙের ডালি?
এইযে রাতে রাতে কতকিছু হারালাম জীবনে, তুমি তো সব উপর থেকে দেখেছো তাই না? সৃষ্টিকর্তার কাছে সাক্ষী দিও আমি জীবনের কাছে বিনা যুদ্ধে হেরে যাওয়া পথিক।আমি সর্বহারা, নিঃশ্ব, অকর্মা, প্রতারক।
প্রিয়জনদের দেয়া কোনো কথা আমি রাখতে পারি নি।
তুমি কি জানো আকাশ? সৃষ্টিকর্তা আমার উপর বড্ড ক্ষিপ্ত আছেন, আমি তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে ভয় পাই। আমি কিন্তু অপরাধী নই,আমি তো সময়ের রূপের শিকার।
আমি তো এখন সিরিয়াল কিলার,সাইকো কিলারও বলা যেতে পারে,আবার এলকোহল এডিকটেড।মিশান যে কবে মরে গেলো বুঝতেও পারলাম না। মিশানের খুনিটা কে?
রেস্ট এন্ড পিস মিশান!
আকাশ! তুমি কি মিশানের আসল খুনিটাকে দেখেছো?খুঁজে দিতে পারবে তাকে?একটা মেঘের বিচ্ছুরণের নিশানা দাও না! আমি সেই মেঘের পিছু পিছু গিয়ে খুনিটাকে ধরবো।
আবোলতাবোল বলতে বলতে মিশান আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো। হঠাৎ মিশানের পাশে কেউ একজন ধপ করে বসলো, মিশান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে তীব্র।তীব্রকে দেখতে খানিকটা বেহাল ছন্নছাড়ার মতো লাগছে।
মিশান তীব্রর থেকে নজর সরিয়ে অন্যদিকে ঘুরে ফিক করে হেসে দিলো। তীব্র এক হাঁটু ভাঁজ করে সিগারেট ধরাতে ধরাতে মিশানকে বললো,
-হাসছো কেনো?
-এলকোহল নিচ্ছি আমি,তার রিয়্যাকশন কি আপনার উপর হচ্ছে?
-হুম্মম, কেমন যেনো লাগছে আমাকে তাই না?
মিশান মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো।
-আজকে অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি এখানে, তাই ক্লান্ত লাগছে।
-আপনি জানলেন কি করে আমি এখানে? আমি তো আপনার এরিয়ার বাইরে।
-অমনিই বুঝে যাই,আমার মধ্যে একটা আধ্যাত্মিক শক্তি আছে, যেটা আন্দাজ করি সেটাই হয়।
-তাহলে আমার একটা হেল্প করুন না স্যার
-কি?
-মিশানের খুনিটাকে খুঁজে দিন না? আর আমার ছোটো বেলার সেই প্রশ্নের উত্তর গুলো!আচ্ছা স্যার আপনি যেহেতু আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন কে কোথায় আছে বুঝে যান, আপনি এটা বলতে পারবেন? কে কেমন আছে?মা, বাবা, আমার পুরো পরিবার। নিশান,ঝলক। ওরা কেমন আছে?ওরা কি জানে আমি কেমন আছি?
তীব্র দীর্ঘশ্বাসের সাথে ধোঁয়া নিঃশ্বরণ করে মিশানকে বললো,
-দীপ্তি মরে গেছে শুনেছো মিশান?
দীপ্তির মৃত্যুর কথা শুনে মিশান তীব্রর চোখের দিকে তাকালো, কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো।
-মরেই গেলো! যাক তাও আপনার ভাগ্য ভালো প্রেমিকার মৃত্যুর দৃশ্যটা দেখতে পেরেছেন,আমি তো ঝলকের মৃত্যুর সংবাদটাও পাইনি।না হয় মানলাম ঝলকের সাথে আমার সম্পর্কের কথা কেউ জানতো না, তাই বলে ইউনিটের একটা প্রাণীও কৌতুহল বশতও আমাকে বললো না, এমনকি আমার মামাও আমাকে বললো না মেজর ঝলক আর দুনিয়াতে নেই!
– ঝলক কিভাবে মারা যায়?
-জানি না সঠিক, তবে ক্যান্টনমেন্ট থেকে জানতে পারি হেলিকপ্টার ক্র্যাশ হয়েছিলো।
-ঝলক তোমায় অনেক ভালোবাসতো তাই না?
-জানি নাহ,তবে আমার বিশ্বাস, হয়তো।
-…………………
-কি একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো, ভেবে দেখেছেন স্যার?
-কি?
-আমার প্রেম ছিলো ঝলক,আপনার প্রেম ছিলো দীপ্তি।অথচ দেখেন আমাদের জীবনটা যাদের সাথে জোড়া লাগার কথা ছিলো তাদের দুজনের রাস্তা একদিকে আর আমরা তার বিপরীতে।
ওরা ডলে পড়েছে মৃত্যু নগরীতে আর আমরা জীবিতো লাশের নাগরীতে। খুব বেশি ভালো হতো না?যদি আমাদের প্রেম গুলোর সাথে আমাদেরও কবর হতো?
-তোমাকে কে বলেছে দীপ্তিকে আমি ভালোবাসি?
মিশান বোকা বোকা হাসি দিয়ে বললো,
-স্যার আমি বোকা না, সব বুঝি!প্রথম যেদিন আপনাকে আর ম্যাডামকে দেখেছি সেদিনই আপনাদের পাস্ট আমি পড়ে ফেলেছি।আর দীপ্তি ম্যাডামের সাথে আমার অনেকদিন দেখা হয়েছে,উনার সাথে প্রায় ভালো ফ্রেন্ডশিপও হয়।
তখন আপনাদের পুরো পাস্ট এক্সপ্লেইন করে বলেছিলো ম্যাডাম,উনি প্রথমে আমাকে বলতে চায় নি, কিন্তু আমি উনাকে আগে আমার পাস্ট জানাই,তারপর আমার কথাতে গলে গিয়ে উনিও আমাকে সবটা বলেন,আপনাদের ছোটো বেলাটা কেমন কাটতো,আপনার প্রতি ম্যাডামের মনে ভালোবাসার অনুভূতি জাগা।আপনি ম্যাডামকে ভালোবাসেন সেটা তাকে ইন্ডাইরেক্টলি বুঝানো,সবটা আমাকে বলে।
ম্যাডামের ভেতর টা খুব সাদাটে,আপনি কেনো উনাকে ছেড়ে আমাকে ধরেছেন আপনিই ভালো জানেন।
-আকাশের রঙ আর মানুষের ভেতরের রঙ এক ছন্দের।যখন তখন বদলায়।
গতকাল দীপ্তিকে ভালোলাগতো,আজ তোমাকে, আগামীকাল হয়তো অন্যকাউকে, কিংবা কাউকে না।
তুমি ভাবছো দীপ্তির লাইফটা আমি নষ্ট করে দিয়েছি,কিন্তু এটা ভুল।আমি দীপ্তির পেছন থেকে সরে গিয়েছিলাম ওর ভালোর জন্য, আমার পাশে তোমার মতো একটা মেয়েই দরকার,যাকে হারানোর ভয় থাকবে না কখনো।
হয়তো তীব্রর দ্বারা দীপ্তির মন ভেঙেছে,কিন্তু তীব্র যেমনটা মিশানকে বিয়ে করে ওর সাথে কিছু করেনি, তেমনটা দীপ্তির সাথেও কিছু করেনি। আমার যতদূর মনে পড়ে, দীপ্তির হাতটাও কখনো ভালোবেসে ধরা হয়নি, দু একবার কি নিয়ে যেনো রাগ হয়েছিলো তখন ওর হাত ধরে টেনে সেই জায়গা থেকে সরিয়ে অন্য জায়গাতে নিয়েছি তাছাড়া তীব্রর জীবনে ভুল করেও মিশান ছাড়া আর কোনো মেয়ে সংস্পর্শতে আসেনি।
-আপনার এই কথাটা বিশ্বাস করে নিলাম স্যার।কারণ আপনার মতো বদরাগী লোকের পাশে কোনো মেয়ে শখ করেও দাঁড়াবে না। পিয়ার মোহাব্বত তো বহুত দূরকি বাত!
-দীপ্তির জন্য কখনো এতোটা কষ্ট হয়নি, যতোটা আজ ওর রক্তশুন্য ফ্যাঁকাসে বর্ণের মৃতলাশটা দেখে যন্ত্রণা হচ্ছিলো ।ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো ওর শরীরে একফোঁটা রক্ত নেই,সাদা কাগজের সাথে ওর সাথে কোনো তফাৎ ছিলোনা, ও কি যেনো বলতে নিচ্ছিলো কিন্তু বলার আগেই একটা মলিন হাসি দিয়ে ও চলে গেলো।আমি কারো মৃত্যু এতোটা মনোযোগ আগ্রহ নিয়ে দেখিনি।মৃত্যু নাকি যন্ত্রণাময় হয়,কিন্তু দীপ্তিকে দেখে মনে হচ্ছিলো, ও ওর মৃত্যুতে বেশ খুশি,স্বইচ্ছায় পরলোক যাচ্ছে।ওর জানাজা শেষে দাফন করে যখন উল্টো ঘুরে হেঁটে আসছিলাম মনে হচ্ছিলো দীপ্তি আমাকে পেছন থেকে ডাকছে, আমি শুনেও না শোনার অভিনয় করে যাচ্ছি।
-আমি আবার এরকম কোনো ডাক অনুভব করিনি। তবে স্বপ্নে যখন ঝলক আমাকে ডাকে তখনি আমি ছিটকে উঠি,প্রথম প্রথম তো মেনেই নিতে পারছিলাম না ঝলক আর নেই, ওর মৃত্যুটা ছিলো অপ্রত্যাশিত! স্বপ্নে যখন ঝলক আমাকে ডাকতো আমি অই কন্ঠস্বর চিনতে পারতাম না, আস্তে আস্তে ব্রেইনটা নিতে শেখে, হ্যাঁ অই অদৃশ্যের আড়াল থেকে যে আমাকে ডাকে সে আমার হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকের কণ্ঠস্বর, আমার ঝলক!
তীব্র মিশান দুজনেই নিরব হয়ে বসে রইলো, দিন শেষে ওরা একটা জায়গায় এসে ব্যর্থ প্রেমিক-প্রেমিকা।
পৃথিবীতে আমরা শুধু পেতেই আসি না, অনেকে শুধু হারাতেও আসি। কারো কারো জীবনের হিসেবের লিস্টে কিছুই পায়নি আবার হারায়ও নি। কারো হয় সফল গন্তব্য, আর কারো ব্যর্থ।
তবে আমরা প্রত্যেকেই পেতে ভালোবাসি,হারাতে বা বিলিন হতে নয়।
-স্যার, শোক রাত্রি পালনের জন্য আপনি আমার এই স্পেশাল জুসটা ট্রাই করতে পারেন।
-নাহ দরকার নেই। আমি ঠিক আছি,একটাএকটু ট্রাজেডিতে আমার কিছু হয় না। লাইফে ট্রাজেডির প্রয়োজন আছে, হেসে খেলে জীবন চলে না।
-এই ট্রাজেডিময় লাইফ বিলং করতে করতে আমি ফেড আপ হয়ে গেছি।
-মিশান!
-বলুন।
-তীব্র দীপ্তির অতীতটা তো তুমি জানোই।এখন ঝলক আর মিশানের লাভ স্টোরিটা
বলবে?খুব শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।
-আমার আবার লাভ স্টোরি! বোরিং হয়ে যাবেন স্যার, মাথা নষ্ট বোরিং।
-বোরিং হলেও শুনবো,তুমি বলো।
-তাহলে শুনুন,
এক দেশে ছিলো এক রাজা, আরেক দেশে ছিলো… (মিশানকে তীব্র থামিয়ে দিয়ে বললো)
-আগের যুগের বাংলা সিনেমার কাহিনী বাদ নিয়ে,নিজের স্টোরিটা বলো।
-বলছি বলছি, রাগ করবেন না স্যার।
আসলে একটু নেশা নেশা লাগছে তো তাই ঘোরে অন্য কিছু বলে ফেলেছি।
-ওটা খাওয়া বন্ধ করে পুরো স্টোরিটা বলবে। তারপর খাবে ওটা।
-ঝলক এমন একটা মানুষ ছিলো ওকে বুঝার জন্য ধ্যান ধরে চুপ করে থাকতে হতো। আপনি আমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করলেও পরে এসে একটু হলেও ভালো ব্যবহারের চেষ্টা করেন।কিন্তু ঝলক এমনটা ছিলো না ও যদি ভুল করেও কিছু করতো সেটা জেনেও অনুতপ্ত হতো না, ওর কথা ছিলো যেটা হয়েছে হয়েছেই মাথা ঘামালেই আরো জল গড়াবে।
ঝলককে প্রথম কবে দেখেছি আমার খেয়াল করা হয় নি।
ট্রেনিং সেন্টারে যখন নানান রকম স্টেপের উপর পরীক্ষা নেয়া হয়,ক্লান্ত শরীর নিয়ে রেস্ট করার টাইম নেই। আর্মি ট্রেনিং গুলো এতো বেশি কষ্টকর ছিলো, প্রতি সেকেন্ডে মনে হতো গাঁধাকে পিটিয়ে ঘোড়া বানানোও এর থেকে সহজ কাজ হবে।প্রথম প্রথম শরীরের প্রতিটা জয়েন্টে এতো এতো ব্যাথা করতো ২৪ ঘন্টা, ব্যাথায় ঘুমাতে পারতাম না, আবার এই ব্যাথাময় শরীর নিয়ে ট্রেনিংয়ে যেতে হতো।
ট্রেনিংয়ের সময় আমাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার জন্য একেক টিমের জন্য দুটো করে অফিসার থাকতো, আমাদের মেয়েদের জন্য থাকতো একজন নারী অফিসার আর একজন পুরুষ । আর সেই পুরুষ একজন ই ছিলো ঝলক। ওর র্যাংক টা ছিলো মেজর।
ছোটো বেলা থেকে আমি ছিলাম একটু অলস টাইপের, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার অলসতায় আমি পড়ার টেবলে বসে থাকতাম সেখান থেকে বিছানায় যেতাম ঘুমাতে। মিমি এসে খাইয়ে দিয়ে যেতো,হাত দিয়ে খেতে পারতাম কিন্তু খেতাম না। আমি হয়তো পড়ার টেবিলে থাকতাম নয়তো বিছানায়, দশবার বলার পর গোসলের জন্য বাথরুমে ঢুকতাম,গোসলটাও মিমিই করিয়ে দিতো আমাদের।
নিশান যখন এসে আমার সাথে খেলতে চাইতো ওকে নিয়ে ঘরের ভেতরেই খেলতাম, এরকম অলস ছিলাম। সব সময় পড়ার টেবিলে বসে থাকতাম কোনো কাজ করার থাকতো না বলে বসে বসে পড়ালেখা করতাম, সেজন্যই হয়তো পড়ালেখায় একটু উন্নতি ছিলো।
আর অই সকাল বেলা মামার ভয়ে হাঁটাহাঁটি, দৌড়াদৌড়ি, এক্সারসাইজ এটুকু করেই মনে হতো বিশ্বজয় করে নিয়েছি।
যখন জানতে পারলাম নিশানের অসুখের কথা তখন থেকে আমি কর্মঠ হওয়ার চেষ্টা করি,পড়ালেখার পাশাপাশি পারটাইম জব শুরু করে দিই।এতো বড় ফ্যামিলি যার ভরণ পোষণ সম্পূর্ণ মামার উপর ছিলো তারউপর প্রতি মাসে নিশানের চিকিৎসার জন্য মামার মোটা অংকের টাকা গুনতে হতো,এটা আমার চোখে লাগতো খুব,তাই মামার পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমি পারটাইম জব করা শুরু করি,মামা আমার টাকার হেল্প নিতে চায় না, কিন্তু আমি শুনিনি।
এরপর গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে আর লেখাপড়ার প্রতি মন টানলো না।মামাও চাইতো আমি আর্মিতে জয়েন করি আর নিশানেরও স্বপ্ন ছিলো আমি আর্মি অফিসার হবো।
ভেবেছিলাম সেনাবাহিনীর পথটা আমার জন্য সহজই হবে,কারণ মামা কর্নেল, তার ফেভার নিয়েই আমি অফিসার হয়ে যাবো,যদিও এটা অপরাধ ।আর মামা চায়নি আমি এরকম বেকায়দাতে অবৈধভাবে সেনাবাহিনীতে ঢুকি।যেখানে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীদের এতো সুনাম সেখানে আমি যদি এভাবে দু নম্বরি করে একটা পদে ঢুকি সেটা এই পেশা ও পদটার জন্য লজ্জাজনক!সত্যি কখনো চাপাও থাকে না। একদিন না একদিন প্রকাশ পেয়ে যেতো, শুধু লেখাপড়ার সার্টিফিকেট নিয়ে বিনা যোগ্যতায় সেনাবাহিনীতে ঢুকেছি মামার সাহায্যে।সেজন্য আমি সব ধরনের বৈধ স্টেপ ফলো করেই সেনাবাহিনীতে ঢুকি।
হাত পা বেঁধে দিয়ে জলে ফেলে দেয়া হতো সেখানে ঘন্টার মতো টিকে থাকতে হতো, কাদার মধ্যে আত্মরক্ষা শত্রুদের উপর হামলা করার ট্রেনিং।হাত, পা , মুখ বেঁধে
ট্রেনিং দেয়া হতো যেনো শত্রুদের করা অত্যাচারে কখনো মুখ না খুলি। ঘন্টার পর ঘন্টা মাইলের পর মাইল কাঁধে ভারী বোঝা নিয়ে দৌঁড়ানো, জংগলের মধ্যে রাত কাটানো, নানান রকম অখাদ্য খাবার খাওয়া, মাঝ আকাশ থেকে হেলিকপ্টার থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া, আরো নানান রকম প্রাণ নেয়া ট্রেনিংয়ের সাথে মুখ বুজে দিন রাত কাটছিলো যখন, বার বার হতাশ হোতাম , আমি হয়তো এই রাউন্ডে হেরে যাবো,পরের রাউন্ডে টিকবো না, আমার দ্বারা আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। আমাকে মোটিভেট করার জন্য তখন শুধু আমার মাথায় একটা উক্তিই ছিলো “আপি আমার না খুব ইচ্ছে, তুমি আর্মি অফিসার হবে, তোমার নামের পাশে থাকবে ক্যাপ্টেন মিশান খান ” এটা যখন ভাবতাম তখন স্পীড বেড়ে যেতো।
সেই সময়টাতেই ঝলকের সাথে আমার দেখা। আমি কখনো ঝলককে খেয়াল করিনি। কিন্তু ঝলক খেয়াল করে আমাকে
একদিন আমাদের ক্লাস নেয়া হচ্ছিলো সে সময়। সেদিন ক্লাসটা ঝলকই নিচ্ছিলো, আর আমি গালে হাত দিয়ে ঝিমাচ্ছিলাম, তখন ঝলক আমাকে মার্কারের হেড ছুঁড়ে মেরেছিলো সেখান থেকেই আমি ওর নজরে পড়ি,ওর ধারণা ছিলো আমি অলস টাইপের ফাঁকিবাজ। যখন জানতে পারে আমি কর্নেলের ভাগ্নী তখন থেকে আমাকে আরো কড়া নজরে রাখে যেনো আমি জালিয়াতি না করতে পারি।
এক রৌদ্রতেজময় দুপুরে আটশো কিলোমিটার হেঁটে গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ অবস্থা,ব্যাগে হাত দিয়ে দেখি পানি একফোঁটাও নেই ওয়াটারপটে, মাথা টা ঘুরিয়ে আসছিলো, একটা সময় ক্লান্ত হয়ে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি, চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি, এমন সময় ঝলক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলে,
-যেখানেই রাত সেখানেই কাত! কিন্তু এখন তো দুপুর, আপনি কাত হলেন কেনো? সূর্যের আলোয় স্নান করছেন?একটা বালিশের ব্যবস্থা করবো?
আমি তখন ক্লান্ত শুকনো গলায় উত্তর দেই।
-স্যার পানি হবে একটু?খুব তৃষ্ণা পেয়েছে আমার।
ঝলক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ধমকের স্বরে বলে,
-ইউজলেস! অকর্মা কোথাকার,এইটুকু দায়িত্বজ্ঞান নেই ভেতরে? যে এতোদূর হাঁটার পথে পানিটা পর্যাপ্ত পরিমাণে রাখতে হয়!
-স্যার ছিলো তো পানি, কিন্তু শেষ হয়ে গিয়েছে। একটু পানি দিন আমাকে প্লিজ!আমি মরেই যাবো এখন পানি না পেলে।
সেদিন ঝলক আমাকে পানি দেয়, পানি দেয়ার আগে যে আমাকে কড়া ঝাঁঝালো কথা শুনায় সেগুলো আমি কানে নিই না।কারণ সেই সময় আমার মন শুধু পানির মাঝেই পড়ে ছিলো, ঝলকের থেকে পানি পেয়ে আমি খুব কৃতজ্ঞ হই ওর কাছে,ওকে আমি অনেক ভালো মানুষ বলে গণনা করি, সেদিন ঝলককে ধন্যবাদ জানালে ঝলক কোনো পাত্তা না দিয়ে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চলে যায়,আমি আবার হাঁটতে থাকি আমার নিয়মে।
আস্তে আস্তে যতো দিন যায় আমি ঝলককে সব সময় খেয়াল করতাম, ঝলকের ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করে একটা সময় বুঝতে পারি এই ছেলে কেবলই রোদের ঝলক, যার মাঝে অনেক রোদের তাপের প্রখরতা। ওর দিকে যখনি তাকাতাম আমার দিকে বাজপাখির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো,আমার প্রতিটা কাজে ভুল ধরতো, ধমকাতো, আর ডি মোটিভেট করতো।মাঝে মাঝে আমাকে তুচ্ছ করে বলতো”আপনাকে দ্বারা সেনাবাহিনীর চাকরী হবে না, সেনাবাহিনী ট্রেনিং ছেড়ে মডেলিং করুন।কিংবা আপনার রেজাল্ট তো ভালোই আছে ইন্টার্রনি টা করে ভালো কোম্পানির জব করুন।”এরকম নানান রকম কথা বলতো।
সেখান থেকে ওর প্রতি আমার তিক্ততার সৃষ্টি হয়। ওকে দেখলেই গা জ্বলতো, বিরক্তবোধ করতাম, মেজাজ টা এতো চড়া হতো মাঝে মাঝে মনে হতো ফায়ারিং ট্রেনিংয়ের সময় বোর্ডে গুলি না করে তাঁর বুকে গুলি করে দেই।
কিন্তু এসবের মধ্যে খেয়াল করি ও যখন আমাকে তেঁতো কথা শুনাতো,আমার আশেপাশে কেউ থাকতো না তখন, হয়তো আমি অপমানিত বোধ করবো বলে এরকমটা করতো।
চলবে…………