#তুমি_অপরূপা (৩৯)
যাত্রা বিরতি দিতে বাস থামলো হোটেলের সামনে। সবাই বাস থেকে নামলো হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে।
হোটেলের বাহিরে খোলা জায়গায় ও বসার ব্যবস্থা আছে।
কৃত্রিম এসির বাতাসের চাইতে সবাই প্রাকৃতিক বাতাস উপভোগ করতে বেশি আগ্রহী হলো, তাই সবাই বাহিরে বসলো।
রূপার পাশের চেয়ারে এসে সমুদ্র বসলো। আর মুখোমুখি রূপক। রূপার হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগলো।
এতোক্ষণ তো বাসে ভালোই ছিলো, এখন কেমন অস্বস্তি লাগছে তার।
অথচ ওরা দুজনেই নির্বিকার। যেনো রূপাকে কেউ-ই চেনে না।
দুজন কথা বলছে নিজেদের মধ্যে।
রূপা থেকে থেকে রূপকের দিকে তাকালো। রূপক ওর দিকে তাকাচ্ছে না।
অথচ রূপার হঠাৎ করেই রূপকের জন্য ভীষণ মায়া লাগছে।
এই মানুষটাকে সে যতটা খারাপ ভেবেছিলো এই মানুষটা তেমন নয়।
সে ভাই হিসেবে যেমন পারফেক্ট, তেমনই ভাইপো হিসেবে ও দায়িত্ববান, বন্ধু হিসেবেও তেমন বুক ফুলিয়ে সামনে দাঁড়ানোর মানুষ।
এই মানুষ স্বামী হিসেবেও তেমন হবে।
এ’কে যে স্বামী হিসেবে পাবে তার মতো সৌভাগ্যবতী মনে হয় আর কেউ নেই এই দুনিয়ায়।
সেই মেয়ে নিজেও জানে না,একটা খাটি সোনা সে পেতে যাচ্ছে যে কি-না সারাটা জীবন ছায়ার মতো তার পাশে থাকবে।
ভাবতে ভাবতে রূপা লজ্জা পেলো।
কি ভাবছে এসব সে!কেনো ভাবছে?
মন কে কেনো আর আটকে রাখতে পারছে না।
কিন্তু কি করবে রূপা,না রূপককে সে ভালোবাসে না কিন্তু তবুও কেনো এসব এলোমেলো ভাবনা মাথায় আসছে!
ভাবতে ভাবতে রূপা পানির বোতলের জন্য হাত বাড়ালো।
রূপা হাত বাড়াতে বাড়াতে রূপক বোতলের ক্যাপ খুলে রূপার দিকে এগিয়ে দিলো।
আরো একবার রূপা মুগ্ধ হলো। রূপক সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তার সাথে কথা বলতেছিলো। কিন্তু তবুও তার খেয়াল রেখেছে ঠিকই।
এরকম একজন যত্নবান মানুষ কে না চায়?
রূপার বুক কেঁপে উঠলো। এই মানুষটা অন্যের হয়ে যাবে একদিন।রূপা ও একদিন অন্যের হয়ে যাবে।
আচ্ছা, রূপা যার হবে সে কি এভাবে রূপার যত্ন নিতে পারবে?
এই প্রথম বারের মতো রূপার ইচ্ছে হলো রূপককে ভালোবাসতে।একটা মানুষ যে কি-না জীবনে কারোরই ভালোবাসা পায় নি সে ও তো কারো না কারো ভালোবাসা ডিজার্ভ করে।
অথচ রূপার হাত পা বাঁধা। মনে সে পাথর চাপা দিয়ে হলেও বাবার কথা রাখবে।
রূপার খাওয়া শেষ হয়ে গেলো সবার আগে। একটা ব্যাপারে রূপা অবাক হলো। তার পাশাপাশি বসে ও সমুদ্র একবার ও তার দিকে তাকায় নি অথবা একটা কথা ও বলে নি।অথচ এই ছেলেটা অন্যান্য দিন হলে ৫ মিনিটেই রূপাকে অস্থির করে ফেলতো।
হারানো বন্ধু খুঁজে পেয়ে এখন আর রূপার দিকে তাকাচ্ছে ও না।
হাসলো রূপা।বন্ধুত্ব ভীষণ দামী শব্দ।সবার বন্ধু ভালো থাকুক।এভাবেই পাশাপাশি থাকুক।
বাসে উঠে রূপা তার মায়ের পাশে বসলো।
সালমা মেয়ের মাথা নিজের কাঁধের উপর এনে রাখলেন।
সিরাজ হায়দারের থেকে শুনেছেন মেয়ের সাথে কতো বাজে ব্যবহার করেছেন তিনি।শুনে লজ্জায় একটুকু হয়ে গেছেন যেনো।
তার কতো আদরের মেয়ে এরা,তা তিনি জানেন আর আল্লাহ জানে।
গাড়ি চলতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর রূপা বললো, “মা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
সালমা বেগম মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”হ্যাঁ, বল।”
রূপা সোজা হয়ে বসে বললো, “মা,রূপকদার সাথে তার মায়ের কেনো এতো অমিল?
মা ছেলে কেউ কাউকে পছন্দ করে না।আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম আর উনি বলেছেন তুমি সুস্থ হলে তোমার থেকে শুনতে।”
সালমা একটা নিশ্বাস ফেলে রূপকের দিকে তাকালেন।তারপর বললেন,”তানিয়া ভাবীর সাথে আমার ভাইজানের যখন বিয়ে হয় তখন ভাবী অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়েন।ভাবী ভীষণ চঞ্চল মেয়ে ছিলো। সাজগোজ, ঘুরাঘুরি, বাহিরে খাওয়া দাওয়া এসবের প্রতি তার ভীষণ আগ্রহ।
মা চাইতেন ভাবী সংসারী হোক।কিন্তু তিনি এসব চাইতেন না একটুও।
বিয়ের পর পরই ভাবী গর্ভবতী হইয়া যান।এতে আমাগো
দিক থাইকা সবাই খুশি হইলেও ভাবীর বাপের বাড়ির সবাই নারাজ হয়।তাদের কথা তাগো মাইয়া ছোট, এখনই ক্যান বাচ্চা নিতে চায় ভাইজান।
ভাবী জেদ ধরলেন বাচ্চা নষ্ট করে ফেলবেন।তার সামনে লেখাপড়া, ক্যারিয়ার পইড়া আছে।
এইটা লইয়া ভাইজানের লগে প্রতিদিন ঝগড়াঝাটি। একদিন তো নিজে নিজে সবাইরে ফাঁকি দিয়া হাসপাতালে চইলা গেছে। ভাগ্যিস ডাক্তাররা কইছিলো ভাইজানরে নিয়া যাইতে।
এই দিকে ভাইজান কিছুতেই রাজী হন না বাচ্চা নষ্ট করতে। এসব নিয়ে রাগারাগি কইরা ভাইজান দুই দিন ভাবীর গায়ে হাত তোলেন।
ভাবীর বাপের বাড়ির মানুষ আসে ভাবীরে নিতে কিন্তু আব্বাজান দেয় না।ভাইজান আব্বাজান রে নিষেধ কইরা দিছিলো বাচ্চা হওনের আগে ভাবীরে কোনো খানে যাইতে না দেয় যাতে।
সবাই ভয় পাইতো ওই বাড়ি গেলে ভাবী বাচ্চা নষ্ট করবো।
এরপর যখন ভাবী দেখলো বাচ্চা রাখতেই হবে সেই থেকে ভাবী বাচ্চার উপরে রাগ।সবসময়ই কইতো এই বাচ্চারে উনি দুই আঙুল দিয়া ধইরা ও দেখবেন না।বাচ্চা পালতে যাইয়া নিজের ক্যারিয়ার শেষ করনের মতো বোকামি করবেন না উনি।
তারপর যখন রূপক হইলো, সত্যি সত্যি ভাবী রূপকরে তেমন একটা নিতে চায় না।
জন্মের পর থাইকা রূপকরে কৌটার দুধ খাওয়ায়।
ভাইজান রাগারাগি, গায়ে হাত তোলা সব ভাবেই চেষ্টা করছেন কিন্তু ভাবীর এক কথা। বুকের দুধ তিনি খাওয়াইবেন না।
তার সমস্ত রাগ তখন রূপকের উপর। রূপকের খাওয়া, ঘুম,গোসল,বাথরুম, কাথা ধোওন সব কিছু আমি করতে শুরু করি।
ভাবী ওনার পড়ালেখা লইয়া ব্যস্ত হইয়া যায়।রূপকের যখন ৯ মাস বয়স তখন ভাবীর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা।
ভাবী বাপের বাড়ি পরীক্ষা দিতে গেলো রূপকরে নিয়া।
ভাবী যাওনের এক সপ্তাহ পর ভাইজান ওই বাড়ি যায় রূপকরে দেখতে। যাইয়া দেখে রূপক একলা এক রূমে শুইয়া কানতাছে আর ভাবীরা সবাই মিইল্লা আরেক রুমে গল্প গুজব করে।
রূপকের নানী ভীষণ ভালো মানুষ আছিলেন।কিন্তু উনি ও অসুস্থ মানুষ। ভাইজান যাওনের পর মাওই মা ভাইজানরে কইলো রূপকরে যাতে ভাইজান সাথে কইরা নিয়া আসে,ভাবী ওরে ঠিকঠাক মতো ফিডার ও দেয় না,বুকের দুধ তো না ই।পোলাডা সারাদিন কান্দে শুইয়া শুইয়া।ভাইজান রাগ কইরা রূপকরে নিয়া আইলো।ভাবী একবার ও বাঁধা দিলো না।
তারপর থাইকা ভাবী কোনো খানে যাওনের সময় ও আর রূপক রে নেয় না।উনি জানেন রূপকরে রাখনের মানুষ আছে।
এরপর চাকরিতে ঢুকেন।ভাইজান ও ভাবীরে ভাবীর মতো কইরা ছাইড়া দিছে।যেমনে ইচ্ছে চলুক ভাইজান আর কিছু কয় না।
এমনেই মা পোলার দূরত্ব। আমি চইলা আসনের পরেও এখনো আর মা পোলা এক হইলো না।
আমার রূপকের লাইগা কেউ রইলো না। ”
রূপা জানে না কেনো ও কাঁদতে লাগলো এসব শুনে। তার ইচ্ছে করলো ছুটে গিয়ে রূপককে জড়িয়ে ধরে। চিৎকার করে বলে, “আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসবো।আপনার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিবো।”
চাইলেই যেমন সব করা যায় না তেমনই রূপা ও পারলো না। শুধু মনে মনে বললো, “সৃষ্টিকর্তা আপনার জন্য এমন কাউকে রাখুক যার বুক ভর্তি ভালোবাসা শুধু আপনাকে ঘিরেই থাকবে।”
বাড়ি পৌঁছাতেই সিরাজ হায়দার দুই হাত ভরে বাজার করে আনলেন।আজ তার আনন্দের দিন।তার ঘরের মানুষ আজ আবারও ঘরে ফিরে এসেছে সুস্থ হয়ে।
সালমা রান্না করতে বসলো। গ্রামের সবাই সালমাকে দেখতে আসতে লাগলো।
রান্না হতে হতে দুপুর গড়িয়ে গেলো।বিকেলেই সবাই মিলে খেতে বসলো। সিরাজ হায়দার খাবার মুখে দিয়ে চুপ করে রইলেন।টপটপ করে তার দুই চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো। সালমা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তিনি নিজে রান্না করতেন।যা পারতেন করতেন।কতো মাস সালমার হাতের রান্না খান নি।তখন তিনি বুঝতে পেরেছেন একজন স্বামীর জীবনে স্ত্রী কতো অমূল্য সম্পদ।
কতো দিন খাবার খেয়েছেন নুন বেশি দেওয়া, অথবা নুন না দিয়ে অথবা মরিচ বেশি দিয়ে।
তৃপ্তি পান নি খাবারের। অথচ আজ এক লোকমা মুখে দিতেই মন ভরে গেলো।
খাওয়ার পর সিরাজ হায়দার দোকানের জন্য বের হলেন।রূপক বাহিরে পাটিতে শুয়ে পড়লো।
সমুদ্র সিরাজ হায়দারের কাছে গিয়ে বললো, “ফুফা,আমি ও আসি আপনার সাথে?আমার কিছু কথা বলার ছিলো আপনার সাথে। ”
সিরাজ হায়দার হেসে বললেন, “আসো বাজান।”
সমুদ্র সিরাজ হায়দারের সাথে বাজারে চলে গেলো।
চলবে…….
রাজিয়া রহমান