তুমি শুধু আমারই হও পর্ব ১৩

0
1784

#তুমি_শুধু_আমারই_হও
লেখনীতে- অরনিশা সাথী

|১৩|

সপ্তাহ দুই পরের কথা।
কিছু নোটসের জন্য অর্নি নূরদের বাসায় যায়। সারা বিকেল দুই বান্ধবী জমিয়ে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ আনিতা বের হয় বাসায় যাওয়ার জন্য। রুম থেকে বের হতেই উৎসবের সাথে ধাক্কা লাগে অর্নির। উৎসব ছোট্ট করে ‘স্যরি’ বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। যা মোটেও হজম হলো না অর্নির। যে ছেলে অর্নিকে দেখলেই একপ্রকার দৌড়ে আসে ওর সাথে কথা বলার জন্য, সবসময় ওর আশেপাশে থাকে। আজ সেই ছেলে এভাবে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো? একবার চোখ তুলে তাকালোও না? ব্যাপারটা ভালো লাগছে না অর্নির। অর্নিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নূর বললো,
–“দাঁড়িয়ে পড়লি যে?”

নূরের কথায় অর্নি সম্বিত ফিরে। নিচে নেমে নূরের আম্মুকে বিদায় জানিয়ে চলে আসতে নিলেই অর্নিকে আটকে দেন উনি৷ রাতের খাবার না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়বেন না। অগ্যতা অর্নিকে থাকতেই হলো।

রাতের খাবার শেষে অর্নি আর নূর সোফায় বসে আছে৷ অর্নি আড়চোখে উৎসবকে দেখছে৷ খাবার টেবিলে দুজনে মুখোমুখি বসেছিলো। কিন্তু তখনো একবারের জন্যও অর্নির দিকে তাকায়নি৷ কোনোরকম কথা বলার চেষ্টাও করেনি৷ যা অর্নির একদমই ভালো লাগছে না। চুপচাপ খেয়ে নিয়েছে৷ অর্নিদের থেকে কিছুটা দূরের একটা সোফায় বসে একমনে ফোন দেখছে উৎসব। অর্নি আড়চোখে তাকাচ্ছে বারবার। নূর মৃদু হেসে বললো,
–“লুকিয়ে লুকিয়ে ভাইয়াকে দেখছিস?”

চমকে তাকালো অর্নি। নূর মুচকি হাসলো। অর্নি তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
–“তোর ভাই আজকাল কেমন পাল্টে গেছে না?”

নূর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
–“কেন?”

–“আগে উৎসব ভাই আমাকে দেখলে কথা বলতে আসতো, বারবার দেখতো আমাকে। আর এখন না কথা বলছে না ভুলেও একবার তাকাচ্ছে।”

অর্নির আড়ালে নূর হাসলো। বললো,
–“ভাইয়া তোর সাথে কথা না বলাতে তোর খারাপ লাগছে? ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সবকিছু?”

অর্নি উৎসবের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক ভাবেই বললো,
–“হ্যাঁ__”

–“সত্যি?”

নূরের কথায় হুশ ফিরলো অর্নির। দ্রুত বললো,
–“না মানে__”

–“তাহলে আর কি? তুই তো আর ভাইয়াকে ভালোবাসিস না। তো ভাইয়া শুধু শুধু তোর পেছনে কেন পড়ে থাকবে? তুই চাস না ভাইয়া তোকে ভালোবাসি বলুক, তাই ভাইয়া তোকে বিরক্ত করা ছেড়ে দিয়েছে। তুই তোর মতো থাক, আর ভাইয়া ভাইয়ার মতোই থাকুক।”

অর্নি শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো নূরের দিকে। নূর এবার অর্নির আরো কিছুটা কাছে গিয়ে বললো,
–“দোস্ত জানিস, ইশা আপু ভাইয়াকে প্রচুর ভালোবাসে। যে করেই হোক এবার ইশা আপুর সাথেই ভাইয়ার প্রেমটা আমি করিয়ে দিবো।”

অর্নি ভ্রু কুঁচকে তাকালো নূরের দিকে। জিজ্ঞেস করলো,
–“এই ইশাটা আবার কে?”

–“বড় চাচার মেয়ে, কালই আসবে আমাদের বাড়িতে। ভাইয়া বিডিতে ব্যাক করেছে শোনার পর থেকেই পাগল হয়ে আছে এখানে আসার জন্য। কিন্তু এক্সামের জন্য আসতে পারেনি। ফাইনালি কাল আসবে।”

অকারনেই ইশা মেয়েটাকে অর্নির সহ্য হচ্ছে না। বিশেষ করে এই বাড়িতে এসে থাকবে সেটা অর্নির মোটেও ভালো লাগছে না। নূর অর্নির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। বললো,
–“ইশা আপু কাল আসলে আমি বলবো ভাইয়াকে প্রপোজ করতে। আই হোপ, ভাইয়া রাজি হয়ে যাবে। কয তুই তো আর ভালো__”

নূরকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো অর্নি। থমথমে গলায় বললো,
–“বাড়ি ফিরবো, আসছি।”

নূরের আম্মু কথাটা শুনতে পেয়ে বললো,
–“একটা মার খাবি, একা যাবি নাকি? দাঁড়া উৎসবকে বলছি আমি।”

–“না আন্টি, দুটো গলি পরেই তো বাসা। আমি একাই যেতে পারবো৷”

নূরের আম্মু অর্নির কথার কোনো তোয়াক্কা করলেন না৷ উৎসবকে ডেকে বললেন অর্নিকে দিয়ে আসতে৷ উৎসবও আম্মুর বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ালো৷ উৎসব বেরনোর আগে নূরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“নূর, তোর ফ্রেন্ডকে আসতে বল৷”

এইটুকু বলেই উৎসব চলে গেলো৷ নূর অর্নিকে ভালো করে লক্ষ্য করছে৷ নূরের হাসি পাচ্ছে বেশ অর্নিকে দেখে৷ অর্নি বললো,
–“দেখলি? উৎসব ভাই কিভাবে চলে গেলো? তোর মাধ্যমে আমাকে যেতে বলছে। কই আগে তো এরকম করতো না। আগে তো কথা বলে বলে আমার কানের পোকা বের করে ফেলতো। আর আজ, আজ দেখলি__”

অর্নির এরকম সব প্রশ্নে নূর ঠোঁট চেপে হাসলো। বললো,
–“আগে তো তোকে ভালোবাসতো, এখন তো আর___”

–“ভালোবাসে না তাই না?”

–“তাই তো মনে হচ্ছে।”

অর্নির কাঁদোকাঁদো চেহারা দেখে নূরের বেশ হাসি পাচ্ছে৷ নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
–“ভাইয়া বাইরে অপেক্ষা করছে তো, যা।”

অর্নি কিছু না বলেই গটগট করে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। অর্নি যেতেই নূর ফিক করে হেসে দিলো। বিড়বিড় করে বললো,
–“ফাইনালি আমার ভাইটাকে ভালোবাসতে শুরু করলি। ভাইয়া যখন জানবে তুইও ভাইয়াকে ভালোবাসতে শুরু করেছিস, তখন তো ভাইয়ার জ্বালাতন আরো বেড়ে যাবে। বি রেডি ডিয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড, উপস্ স্যরি ডিয়ার উডবি ভাবী।”

অর্নি বের হতেই উৎসব গাড়ির দরজা খুলে দিলো৷ অর্নি জোরে শব্দ করে গাড়ির দরজা লাগিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা লাগালো। উৎসব নিজেও অর্নির পিছু নিলো। দুজনেই চুপচাপ হাঁটছে। অর্নি নিজেই নিরবতা ভেঙে বললো,
–“আপনি বাসায় ফিরে যান উৎসব ভাই। এইটুকু পথ আমি একাই যেতে পারবো।”

উৎসব সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললো,
–“আম্মু বাসায় দিয়ে আসতে বলেছে, মাঝপথে ছেড়ে যেতে বলেনি।”

অর্নি শান্ত চোখে তাকালো উৎসবের দিকে। বললো,
–“শুধু আন্টি বলেছে বলে?”

উৎসব হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। অর্নির দিকে তাকিয়ে বললো,
–“তা নয়তো কি?”

–“কিছু না।”

বলেই অর্নি আবার হাঁটতে শুরু করলো৷ বেশ কিছুটা সময় আবারো নিরব থাকলো দুজনে। এবারেও অর্নি নিরবতা ভেঙে বললো,
–“আপনার কি হয়েছে উৎসব ভাই?”

উৎসব কপাল কুঁচকে বললো,
–“কিছু না তো।”

–“পালটে গেছেন অনেক।”

উৎসব কোনো জবাব দিলো না। অর্নিও জবাবের আশা করলো না আর। কয়েকদিন যাবত উৎসবের নিরবতা ওকে বড্ড পোড়াচ্ছে৷ তবে কি অর্নি___আর ভাবতে পারলো না কিছু। অর্নির মনে হচ্ছে খুব কাছের কিছু অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। কথা বলতে বলতে বাসার কাছে এসে পড়েছে ওরা। অর্নি উৎসবের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। কয়েক সেকেন্ড কেটে যায় এভাবেই৷ অর্নির দু হাত কচলাচ্ছে। কিছু একটা বলতে চেয়েও পারছে না। উৎসব সেই সবটা খেয়াল করলো খুব মনোযোগ সহকারে। তারপর বললো,
–“কিছু বলবে?”

অর্নি আমতা আমতা করে বললো,
–“আ্ আসছি।”

উৎসব ছোট করে ‘হুম’ বললো। অর্নি আসছি বলেও দাঁড়িয়ে থাকলো সেখানে। বললো,
–“ভি্ ভিতরে চলুন না___”

–“ইট’স ওকে, আসছি আমি।”

বলেই উৎসব উলটো ঘুরে দু কদম এগোলো। অর্নি পিছু ডেকে বললো,
–“শুনুন।”

অর্নির ডাকে থেমে যায় উৎসব। অর্নির দিকে পূর্ণ দৃষ্টি তাক করে বললো,
–“কিছু বলবে?”

আনিতা দু দিকে মাথা ঝাকিয়ে না বোঝায়। উৎসব আবারো চলে যেতে গেলেই অর্নি বললো,
–“আপনার কিছু বলার নেই?”

–“কি বলবো?”

–“যে কোনো কিছু, কিছুই কি বলার নেই?”

–“উঁহু।”

উৎসবের জবাবে অর্নি একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে এক ছুটে বাসার ভিতর চলে গেলো। অর্নির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে উৎসব বাঁকা হেসে বললো,
–“সোজা পথে কাজ না হলে কিছু কিছু সময় বাঁকা পথেই যেতে হয় মিস অর্নি। খুব বেশি দেরী নেই তুমি নিজে আমার কাছে আসবে, আমাকে ভালোবাসি বলবে। সেই মূহুর্তটার অপেক্ষায় আছি আমি।”

কথাগুলো একা একা বলেই আবার উলটো ঘুরে বাড়ির পথে হাঁটা লাগালো উৎসব৷

বাসায় ফিরে সবেই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো উৎসব। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ এলো। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পেলো নূর দাঁড়িয়ে আছে। দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালো উৎসব। নূর ভিতরে ঢুকে বিছানায় বসে বললো,
–“অর্নি কিছু বললো ভাইয়া?”

–“তোর ফ্রেন্ড এত সহজেই মুখ ফুটে মনের কথা বলবে বলে তোর মনে হয়?”

নূর ক্ষানিকটা সময় নিরব থেকে বললো,
–“এভাবেই আগাও, দেখবে বেশি সময় আর ওয়েট করতে হবে না। ঠিকই এসে ভালোবাসি বলবে।”

–“দেখা যাক কি হয়।”

কথাটা বলে উৎসব নূরের চুলে বিলি কেটে দিলো। নূর ভাইকে ঘুমাতে বলে চলে গেলো নিজের রুমে।

দুটো ক্লাস শেষে মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছে নূর রুশান আর অর্নি। অর্নির অবশ্য আড্ডায় মন নেই৷ ওর মাথায় শুধু উৎসবের কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। ও মানতে পারছে না ছেলেটা এভাবে বদলে গেছে। হঠাৎই অর্নির চোখ আটকায় দূরে বটগাছের নিচে বসা উৎসব আর একটা মেয়ের দিকে। অর্নি কিছু সময় সেদিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। নূরকে বলে,
–“তোর ভাইয়ের সাথে ওই মেয়েটা কে রে নূর?”

নূর একবার ভাইয়ের দিকে তাকালো। তারপর বেশ খুশি মনে বললো,
–“তোকে তো একটা কথা জানানো হয়নি অর্নি।”

অর্নি সেদিকে কোনো পাত্তা দিলো না। একদৃষ্টে উৎসব আর মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে৷ নূর আবারো নিজের মতো করেই বললো,
–“ওটা ইশা আপু, কাল রাতেই এসেছে। ভাইয়া নিজে গিয়ে রিসিভ করেছে ইশা আপুকে৷ কি সুন্দর না ইশা আপু? ভাইয়ার সাথে মানাবে সুন্দর বল? জানিস দুজনে যখন একসাথে বাসায় ঢুকেছে, ইশ্ কি কিউট লেগেছে। দুজনকে একসাথে এত্ত ভালো___”

অর্নির নূরের উপর রাগ হলো বেশ৷ ক্ষানিকটা উঁচু গলায় বললো,
–“এইসব আজাইরা প্যাঁচাল পারবি না আমার সামনে৷ কোনো ইশার টিশার কথা শুনতে ইচ্ছুক না আমি।”

নূর মুচকি হাসলো৷ অর্নিকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“আহা! শোন না, ইশা আপু বলছে আজই ভাইয়াকে প্রপোজ___”

অর্নি নিজেকে নূরের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
–“চুপ, একদম চুপ। একটা কথাও বলবি না আর।”

কথাটা বলে অর্নি নিজেই সেখান থেকে উঠে চলে গেলো৷ ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নূর আর রুশান ফিক করে হেসে দিলো৷

লাইব্রেরীতে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে অর্নি। চোখদুটো বইয়ে সীমাবদ্ধ থাকলেও মস্তিষ্কে উৎসব আর ইশার কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে৷ ইশা কি সত্যিই আজ উৎসবকে প্রপোজ করবে? উৎসব কি রাজি হবে? তবে কি উৎসব অর্নিকে ভালোবাসে না? এরকম হাজারো চিন্তা মাথায় ঘুরছে৷ অর্নি আর না পেরে ঠাস করে বই বন্ধ করে টেবিলের উপর রাখলো৷ সেল্ফে বইটা রেখে বেরিয়ে পড়লো লাইব্রেরী থেকে। উদ্দেশ্য বাসায় ফিরবে এখন। তাই নূর আর রুশানকে টেক্সট করে জানিয়ে দিলো ও বাসায় যাচ্ছে।

গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে অর্নি। এমন সময় দেখলো রাস্তার অপর প্রান্তে উৎসব আর ইশা। রাস্তা পার হচ্ছে দুজনে। ইশা উৎসবের একটা বাহু ধরে আছে৷ তা দেখে ধপ করেই অর্নির মাথায় আগুন জ্বলে গেলো৷ রাগে গাঁ রিঁ-রিঁ করছে। ইচ্ছে করছে ওখানে গিয়ে ইশাকে কষে দুইটা থাপ্পড় মারতে৷ ইচ্ছাটাকে নিজের মাঝেই চেপে রাখলো অর্নি। একটা রিকশা ডেকে দ্রুত উঠে পড়লো রিকশায়। রিকশা চলতে শুরু করেছে। অর্নি আরো একবার পিছু ফিরে উৎসবের দিকে তাকালো রাগান্বিত চোখে।

চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here