#তুমি_নামক_সপ্তর্ষি_মন্ডলের_প্রেমে?
#মিফতা_তিমু
২.
খট করে আওয়াজ হতেই আমার ঘুম উড়ে গেলো।আসলে স্যারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ নাকে তীব্র নিকোটিনের গন্ধ এলো।মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আসছে।আমি নাক বন্ধ করে ফেললাম হাত দিয়ে।সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাহরীম স্যার আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।আমি বিছানা থেকে নেমে উনার দিকে এগিয়ে গেলাম কিন্তু উনি কিছু বলছেন না বলে আমিও নিঃশব্দে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ উনি আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন।আমি ঘাবড়ে গেলাম। শুকনো ঢোক গিলে পিছতে লাগলাম। পিছতে পিছতে একসময় আলমারির দরজায় আমার পিঠ ঠেকে গেল।উনি আমার দুই দিকে হাত বেরিকেট করে দাড়ালেন।আমি বেরও হতে পারছি না।তারপর আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এলেন।আমি ভয়ে চোখ দুটো খিচে বন্ধ করে ফেললাম। হঠাৎ নিজের আশেপাশে উনার উপস্থিতি অনুভবে ব্যর্থ হলাম।চোখ খুলে দেখলাম উনি নেই।উনি হাতে টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকছেন।আমি ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম আলমারির পাশেই আলনা আছে। ওহ শিট উনি টাওয়েল নিচ্ছিলেন আর আমি কি না কি ভাবলাম।ইস আফরিন তোর মনটাও এতক্ষণ ফিরোজা বেগম,অর্ণব আর পাড়ার আন্টিদের খারাপ কথা শুনে শুনে খারাপ হয়ে গেছে।
মিনিট দশেক পর ডাক্তার সাহেব গোসল সেরে বের হলেন।উনি বের হতে হতে ততক্ষণে আমি শাড়ী বদলে নিলাম। শাড়ী বদলে একটা ঢিলেঢালা কুর্তি আর ডিভাইডার পড়েছি।এখন মনে হচ্ছে সস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছি নাহলে এভাবে লং টাইম শাড়িতে থাকা ইজ ইম্পসিবল।
বারান্দায় টাওয়েল মেলে দিয়ে ডাক্তার সাহেব এসে বেডের ডান দিকে শুয়ে পড়লেন।আমি হাতে বালিশ নিয়ে কাচুমাচু মুখে দাড়িয়ে আছি।বুঝতে পারছিনা শুবো নাকি না।আমি শুচ্ছি না দেখে ডাক্তার সাহেব বললেন,
তাহরীম: এখন কি তোমায় ঘুমানোর জন্যও ইনভাইট করতে হবে?
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
আফরিন: না মানে আপনি আমার সাথে বেড শেয়ার করবেন?
তাহরীম: তোমায় তো কেউ আর আমার সঙ্গে শুতে বলেনি। তোমায় শুধু বলা হয়েছে ঘুমোতে আমার সঙ্গে। তাছাড়া আমাদের দুজনেরই জানা আছে আমাদের সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে। তাহরীম মেহমাদ তার লিমিট সম্পর্কে ওয়াকিফ তাই সে লিমিট ক্রস করবে না।তুমি নিশ্চিন্তে শুতে পারো। এমনিতেও আমাদের বিয়েটা শুধু দেড় বছরের একটা আগ্রিমেন্ট।
ডাক্তার সাহেবের কথায় আমি চমকে উঠলাম।আমাদের বিয়ে দের বছরের এগ্রিমেন্ট মানে।আমি বললাম,
আফরিন: দেড় বছরের এগ্রিমেন্ট মানে?বিয়ে তো বিয়ে হয়।তার মধ্যে আবার সময় সীমাবদ্ধ করা থাকেনি।
এবার আমার কথা শুনে তাহরীম স্যার উঠে বসলেন আর আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,
তাহরীম: কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ এ থাকে।তোমায় আমি এমনই এমনই বিয়ে করিনি।তুমি সমাজের চাপে পড়ে বিয়ে করেছো আর আমি তোমার এবং আমার সম্মান বাঁচাতে বিয়ে করেছি।তাই শুধু শুধু এই সম্পর্কটা কে সারাজীবন বয়ে বেড়ানোর মানেই হয়না।আমরা তোমার এমবিবিএস শেষ হওয়ার আগ অব্দি এজ এ হাসব্যান্ড ওয়াইফ একসাথে থাকবো তারপর তুমি মুক্ত। এরপর তুমি কি করছো,কি খাচ্ছ, কোথায় যাচ্ছ সেটা তোমার ব্যাপার কিন্তু স্টিল দেট তুমি আমার রেসপনসিবিলিটি আর তোমায় আমার কথা শুনতে হবে।তোমার কোনো আপত্তি আছে?
ডাক্তার সাহেব এর কথা শুনে মনে হচ্ছে কেউ আমার মাথায় পঞ্চাশ কেজির বস্তা চাপিয়ে দিয়েছে।এই অল্প কয়টা কথার খুব গভীর অর্থ।উনার কথাগুলো স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে উনি আমার থেকে মুক্তি চাইছেন,উনি আমার সঙ্গে থাকতে চাননা। অগত্যা আমিও দ্বিমত না করে বললাম,
আফরিন: আমার কোনো আপত্তি নেই…
উনি আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বললেন,
তাহরীম: কিসের ব্যাপারে? না মানে আমার কথা শোনার ব্যাপারে নাকি সেপারেশন এর ব্যাপারে।
আমি কিছুক্ষন উনার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম,
আফরিন: দুটোই…
এবার হঠাৎ উনার চেহারা বদলে গেলো।উনার চেহারায় রাগ ফুটে উঠলো।আমি উনার হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ ধরতে পারলাম না।উনি আমার দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় ‘ শুয়ে পড়ো রাত হয়েছে ‘ বলেই শুয়ে পড়লেন পাশ ফিরে।অগত্যা উপায়ন্তর না পেয়ে আমি স্যারের পাশে বালিশ রেখে খানিকটা চেপে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়লাম।
একসময় শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়েও পড়লাম।ঘুম ভাঙলো সকালের মিষ্টি রোদে।ঘুম ভেংগে নিজেকে ঘুমন্ত ডাক্তার সাহেব এর পাশে আবিষ্কার করলাম।নিজের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি করে কুর্তির জামা নামিয়ে দিলাম কারণ কুর্তি পেট থেকে সরে গিয়েছিল।
আমার নড়াচড়ায় ডাক্তার সাহেব পাশ ফিরে আমার মুখোমুখি আমায় গলায় মুখ রেখে শুলেন।আমার বেশ খানিকটা কাছাকাছি থাকায় পাশ ফিরতেই উনি আমার উপর চলে এলেন।উনার ঠোট আমার গলা ছুঁয়ে যাচ্ছে।উনার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার ঘাড়ে আছড়ে পারছে।আমি উনার হুট করে কাছে আসাটা মেনে নিতে পারছি না তাই আস্তে আস্তে সরে এলাম যার কারণে উনার হাত আমার জামায় থাকায় সেই ছিটকে গিয়ে উনার উপরই পড়লাম।
ঘুম ভেংগে আমায় উনার উপর দেখে ভ্রু কুচকে ডাক্তার সাহেব বললেন,
তাহরীম: আমার ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নিয়ে কি আমার সুযোগ নিচ্ছিলেন মিসেস মেহমাদ?
উনার কথা শুনে উনার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালাম আমি।এমন একটা পরিস্থিতি তে উনার মুখ থেকে এরকম একটা কথা আসা করিনি।আমি উনার উপর থেকে তড়িৎ গতিতে সরে গিয়ে বললাম,
আফরিন: আসলে আপনি গড়াগড়ি খেতে খেতে আমার কাছে চলে এসেছিলেন তাই আপনার কাছ থেকে সরতে গিয়েই টাল সামলাতে না পেরে আপনার উপর পরে গেছিলাম।
আমার কথায় ডাক্তার সাহেব আর কিছু বললেন না। নির্লিপ্ত ভাবে উঠে বিছানা ছাড়লেন।অতঃপর আলমারি থেকে জামা কাপড় নিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন।যেতে যেতে কি মনে করে আবার আমার দিকে ফিরে এলেন আর বিছানা থেকে আমার ওড়না উঠিয়ে আমার গায়ে পেঁচিয়ে দিয়ে বললেন,
তাহরীম: হয়তো আমরা নামে স্বামী স্ত্রী তবে প্রকৃত অর্থে নই তাই ওড়না ছাড়া আপনাকে দেখার অধিকার আমার নেই মিসেস মেহমাদ। এন্ড ওয়ান থিং আমাদের বিয়ের কথা যেন কলেজে জানাজানি না হয়।আমি চাই না কিছুতেই কেউ আমাদের বিয়ের কথা জানুক বলেই উনি আর এক মিনিটও সেখানে না দাড়িয়ে বাথরুমে চলে গেলেন।
উনার প্রথমের কথাগুলো শুনে যতটা না ভালো লাগছিলো পরের কথা শুনে ঠিক ততটাই খারাপ লাগছে।উনি তবে চাননা আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কাউকে জানাতে।হয়তো আমাদের বিয়ের মেয়াদ সবে দেড় বছর বলে। দেড় বছর তো দেখতে দেখতে কেটে যাবে তাই হয়তো কলেজে হাসির খোরাক হতে চাননা।
সব আজেবাজে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বিছানার সঙ্গে সঙ্গে ঘর গুছিয়ে নিলাম অতঃপর নিজের জামা কাপড় বের করে ফেললাম।একটা কলাপাতা রঙের শাড়ী বের করলাম।
স্যার এখনো বাথরুমে গোসল করতে ব্যস্ত আর আমারও এখন আর কোনো কাজ নেই দেখে বারান্দায় এসে দাড়ালাম। শীতের সকালে হালকা রোদ পোহাতেও খুব ভালো লাগে।আমি চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে বেতের সোফায় বসলাম।আমার চুল বলতে গেলে মোটামুটি লম্বা তাই সোফায় বসাতে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।কিছুক্ষণ পর শুনলাম ঘর থেকে দাড়িয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাক্তার সাহেব বলছেন,
তাহরীম: এই যে রানী ভিক্টোরিয়া এভাবে যে চুল ছেড়ে দিয়ে রোদ পোহাচ্ছেন খেয়াল আছে যে চুলে পিপঁড়া উঠছে? এরপর তো মাথায় উকুনের পরিবর্তে পিপঁড়া দেখতে পাবো যেটা রাতের বেলা বেরিয়ে এসে আমায় কামড়াবে কারণ আমি আপনার সঙ্গেই ঘুমোই।
ডাক্তার সাহেবের কথায় আমি কিছু বলার অবকাশই পেলাম না। সিরিয়াসলী! মাথায় উকুনের পরিবর্তে পিপঁড়া! ইয়াক ছিঃ….
বিয়ের পরেরদিনই নিজের স্বামী কে পরনারীর সঙ্গে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় দেখবো ভাবতেই পারিনি। গোসলে গিয়েছিলাম বাথরুমে কিন্তু বেরোতে বেরোতে দেখি আমারই ঘরে দাড়িয়ে এক অজ্ঞাত নারী আমার তাহরীম স্যার কে জড়িয়ে ধরে আছে।এরকম একটা দৃশ্য দেখার পর নিজেকে সামলানোর অনেকটা কষ্ট সাধ্য ব্যাপার। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
আমি খানিকক্ষণ দাড়িয়ে থেকে বললাম,
আফরিন: এক্সকিউজ মি….
আমার আওয়াজ পেতেই দুজনে ছিটকে সরে গেলো। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে মিষ্টি হেসে বললো,
মেয়েটা: ওহ ভাবি….আমি হলাম তোমার আদরের ননদিনী নিহারিকা নিহা।তুমি আমায় ভালোবেসে নিহাও বলতে পারো।তাহসান ভাই আর তাহরীম ভাইয়ের একমাত্র ছোটবোন।
নিহার কথা শুনে এবার মাথাটা দেওয়ালে বারি দিয়ে ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। সিরিয়াসলী!ভাই বোনের সম্পর্ককে কিনা আমি প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক বানিয়ে দিলাম। আফরিন তুই বড্ড কলুষিত হয়ে গেছিস।তোর চিন্তাধারা পাল্টানো উচিত।
আমি কথা বলছি না দেখে নিহা আমার সামনে তুরি বাজিয়ে বললো,
নিহা: কোথায় হারিয়ে গেলে ভাবী? আমি আর ভাই তো এখানে আছি তাহলে তুমি কার কথা ভাবছো এত?
‘ উনার আবার ভাবার জন্য কারোর উপস্থিতি লাগে নাকি।উনি তো কেউ পৃথিবীতে না থাকলেও তাকে নিয়ে ভাবতে পারবে। ‘ কথাগুলো খানিকটা বিরবিরিয়ে বললেন ডাক্তার সাহেব।
উনি বিড়বিড় করে বললেও কথাগুলো আমার কানে ঠিকই এলো।আমি উনার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালাম কিন্তু আমার বিরক্তি সূচক ভাব কে উনি বিশেষ পাত্তা দিলেন না। আমায় এড়িয়ে বললেন,
তাহরীম: নিহা তোর ভাবী কে বলে দে আজ বিয়ের প্রথম দিন বলে বাবা বা মা কেউই ওকে কলেজ যেতে দিবেনা ।তারমানে এই না যে ও ঘরে বসে বসে ঘোড়ার ঘাস কাটবে।আমি সব সাবজেক্টের কিছু রিসেন্ট টপিক মার্ক করে দিয়েছি তাই ওগুলো যেন পরে নেয়।আমি সন্ধ্যায় ফিরেই পড়া ধরবো।
এবার তাহরীমের কথা শুনে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো নিহা।ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে বললো,
নিহা: উফফ সবেমাত্র কাল বিয়ে হয়েছে তোমাদের আর তুমি আজই হসপিটাল চলে যাচ্ছ। তাও যদি তুমি একা কাজ করতে তাহলে তো ভালই হতো।তুমি তো ভাবী কেও পড়তে বসিয়ে দিচ্ছিলে।এখন মনে হচ্ছে দুই পড়ুয়া কে একসঙ্গে বিয়ে দিয়ে ভুল করেছি।
তাহরীম: বেশি কথা না বলে যা বলেছি তাই কর আর নিচে খেতে আয় বলেই উনি বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।উনার পিছন পিছন আমি আর নিহাও এলাম।ডাইনিং রুমে যেতেই দেখলাম খাওয়ার টেবিল ভরে উঠেছে বাহারি খাবারে।টেবিলের এক পাশ রিমা ভাবী আর তাহসান ভাইয়া।আরেক পাশে মা আর বাবা এবং বাবার পাশের চেয়ার খালি।আর আরেক পাশে আরও দুটো চেয়ার। নিহা গিয়ে বাবার পাশের চেয়ারে বসলো আর ডাক্তার সাহেব গিয়ে বাকি খালি দুটো চেয়ারের একটা তে বসলেন।অগত্যা উনার পাশে খালি থাকা চেয়ারে আমিও বসলাম।
সবাই খাওয়া শুরু করতেই আমিও রুটি আর ভাজি নিলাম।তারপর খেতে শুরু করলাম।বাবা খেতে খেতে তাহরীম স্যার কে বললেন,
বাবা: তা তাহরীম বিয়ে তো করলে এখন রিসেপশন করবে না? রিসেপশন তো করা দরকার।
বাবার কথা শুনে স্যার নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে খেতে খেতে বললেন,
তাহরীম: বিয়ে করেছি এটাই তো বেশি আবার অনুষ্ঠান করার কি আছে?বাবা আমি এখন কাউকে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে জানাতে চাচ্ছি না।
ডাক্তার সাহেব এর কথা শুনে এবার সকলে অবাক চোখে উনার দিকে তাকাল।তাহসান ভাইয়া বললেন,
তাহসান: জানাতে চাচ্ছিস না মানে?
তাহরীম: চাচ্ছি না মানে চাচ্ছি না। আফরিন এর এখন এমবিবিএস বাকি আছে আর ওর ফুল লাইফ পরে আছে।এখনই সবাই কে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে জানিয়ে আসান এর এবিলিটির উপর প্রশ্ন তুলতে চাচ্ছি না।এতে করে ও যদি ভালো রেজাল্ট করে এমবিবিএস শেষও করে তবুও ওর দক্ষতার উপর প্রশ্ন উঠবে।লাইফে তো পড়েই আছে।বিয়ের অনুষ্ঠান আর দেড় বছর পরে করলে কিইবা হবে…বলেই উনি খাওয়ায় মন দিলেন।
সকলে উনার কথায় গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন।উনি আমার পড়াশুনার কথা বললেও আমি জানি সেটা শুধুমাত্র একটা অজুহাত বৈকি আর কিছু নয়।তারপর সকলে আবার খাওয়ায় মন দিল।খাওয়া শেষে তাহরীম স্যার উঠে গিয়ে হাত ধুতে ধুতে বলেন,
তাহরীম: মা আমার আজ আসতে দেরি হবে।এক দিনের ছুটি নিয়েছিলাম যেটার প্রেসার পড়বে আজ।তাই আর ওয়েট করো না।
স্যারের কথার জবাবে মা কিছু বললেন না। স্যারও আর কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন।
আমি খাওয়া শেষ করে রান্নাঘরে গিয়ে সব এটো থালাবাসন ধুচ্ছিলাম কারণ মা আর ভাবি ডাইনিং টেবিল গুছাচ্ছেন।মা রান্নাঘরে এসে আমায় থালাবাসন ধুতে দেখে বলেন,
মা: রিমা তাহরীমের বউ কে বলে দাও তার বর যা বলেছে তাই যেন করে, সে যেন তার পড়াশুনায় মন দেয়। সংসার করার জন্য পুরো জীবন পড়ে আছে।
আমি আরেকটা লাস্ট প্লেট ধুতে ধুতে বললাম,
আফরিন: মা শুধু পড়াশুনা,খাওয়া দাওয়া আর ঘুম দিলে তো মোটা হয়ে যাবো।তখন সবাই দেড় বছর পর এটাই বলবে যে তাহরীম মেহমাদের বউ মোটা।তাই একটু আধটু কাজ করলে ক্ষতি নেই।
আমার কথার প্রতি উত্তরে মা কিছু বললেন না।আমি থালাবাসন ধুয়ে হাত টা কিচেন টিসু দিয়ে মুছে বেরিয়ে এলাম। হাঁটা দিলাম আমার ঘরের দিকে।ঘরে ঢুকতে ঢুকতে খেয়াল করলাম ডাক্তার সাহেবের ঘরের পাশে আরেকটা ঘর আছে।আমি সেই ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম।
ঘরের দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই চোখ আমার কপালে উঠে গেলো।পুরো ঘর জুড়ে শুধু বই আর বই।বাবা এত বই….ডাক্তার সাহেব মনে হয় বই পড়তে অনেক পছন্দ করেন। তারমানে এটা উনার স্টাডি রুম।আমি ঘুরে ঘুরে পুরো স্টাডি রুম দেখতে লাগলাম। স্টাডি রুমটা অনেকটা একটা লাইব্রেরির মত করে সাজানো। হঠাৎ দেখতে দেখতে একটা বইয়ের তাকে আমার চোখ আটকে গেলো।বইটার নাম ‘ দা জার্নি অফ অ্যাডভেঞ্চার ‘।
এতগুলো বড় বড় বইয়ের ভিড়ে একটা ছোটো বই দেখে আমি অবাক হলাম।এগিয়ে গিয়ে বইটা হাতে নিলাম। বইটা হাতে নিতেই বইয়ের তাকগুলো আওয়াজ করে মাঝ থেকে দুই ভাগ হয়ে পাশে সরে গেলো।
বইয়ের তাক সরে যেতেই এই স্টাডি রুমেই আমি আরেকটা ঘর আবিষ্কার করলাম।একটা ঘরের ভিতর আরেকটা ঘর।কিন্তু একটা রুম কে এভাবে লুকিয়ে রাখার মানে কি? ডাক্তার সাহেবের কী এমন অমূল্য সম্পদ আছে যা উনি এই ঘরে বইয়ের তাকের পিছনের ঘরটা তে লুকিয়ে রেখেছেন।উম্ম ব্যপারটা দেখতে হবে ভেবেই আমি আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে ঘর টাতে ঢুকলাম। ঘরে ঢুকতেই কেউ যেন আমার হাত চেপে ধরলো।
আমার যেন আত্মারাম খাঁচছাড়া হওয়ার জোগাড়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম তাহরীম স্যার থুক্কু ডাক্তার সাহেব আমার দিকে অগ্নি বর্ষিত চোখে তাকিয়ে আছেন।মনে হচ্ছে এখনই উনার এই চোখ দিয়ে জ্বালিয়ে দেবেন।আমার দিকে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বললেন,
তাহরীম: তোমার এই ঘরে আসার সাহস কি করে হলো? কারোর ঘরে ঢুকতে হলে যে তার পারমিশন লাগে জানোনা?
উনার কথায় আমি ধীর গলায় খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,
আফরিন: না আসলে স্টাডি রুমে এসেছিলাম। হঠাৎ একটা বই চোখে পড়লো আর ওটা হাতে নিতেই এই ঘরটা খুলে গেলো বলেই আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম তবে ডাক্তার সাহেব আমার হাত ছেড়ে উনার দুই হাত দিয়ে আমার মুখটা ধরে উনার মুখোমুখি দাড় করালেন যাতে আশেপাশে কিছু না দেখতে পারি আর ধীর গলায় বললেন,
তাহরীম: আজ যেটা করেছ সেটা যেন দ্বিতীয়বার না হয়। আইন্দা আমার ব্যাপারে নাক গলানোর চেষ্টা করবে না।আমার ওয়াইফ তুমি শুধু নামে কাজে নও।এখন এই ঘর থেকে যাও।
ডাক্তার সাহেবের কথাগুলো যেন মনে গভীর দাগ কেটে গেলো।একদিকে এই ঘরে কি আছে সেই চিন্তা আরেক দিকে উনার অপমান মূলক কথাবার্তা।দুটোই যেন একসঙ্গে মিলে জ্বালিয়ে খাচ্ছে।চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগ মুহূর্তে হনহন করে বেরিয়ে গেলাম নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে।
~ চলবে ইনশাল্লাহ্
শব্দসংখ্যা:২১০০