তুমি নামক যন্ত্রণা পর্ব ১৩

0
366

#তুমি_নামক_যন্ত্রণা
#লেখনীতেঃ হৃদিতা ইসলাম কথা
পর্বঃ১৩

ঘরে এসে বিষ্ফোরিত নয়নে থমকে তাকিয়ে আছে স্রোত।তারই বিছানায় ঘুমন্ত এলোমেলো রুপসীর ঘুমন্ত মায়াবি মুখের দিকে।বিস্ফোরিত দৃষ্টি মুগ্ধতায় আটকে গেলো।ঠোটের কোনে মুচকি হাসিরা খেলা করতে লাগলো।মেয়েটা বড্ড অগোছালো আর একদমই বাচ্চাদের মত কাজকর্ম করে। হয়তো ওর এই বাচ্চামোতেই মন হারিয়েছে স্রোত।বারবার হারাতে চায়! হাজার বার! ওর অস্তিত্ব ওর নিজস্বতা সবকিছুকে ঘীরে শুধু ওই একটা নাম।ওই একটা মুখ।ওই একটা মানুষ।যার কাছে বারবার হেরে যেতে চায় প্রাপ্ত। যার অভিমানে হৃদয় পুড়ে।যার দুরে সরে থাকা তিল তিল করে যন্ত্রণা দেয়।অসম্ভব যন্ত্রণা! বলে বোঝানো দায়!
মৃদু হাসি ঠোঁটের কোনে ধরে রেখেই এক পা দুপা করে এগিয়ে এলো স্রোত।হাটু মুড়ে বিছানার পাশে মেঝেতে বসে পড়লো।কথার এলোমেলো কেশরাশি মুখের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।হাত দিয়ে না সরিয়ে মুখে ফু দিতেই তারা উড়ে গেল।মুচকি হাসি ফুটলো ঘুমের ঘোরে তার স্রোতস্বীনির ঠোঁট যুগলে।হ্যাঁ! স্রোতস্বীনি! স্রোতের স্রোতস্বীনি! যে স্রোতের প্রবাহে গা ভাসিয়েছে ও!ওর সেই চঞ্চলা, চটপটে রমনিকে একমনে দেখতে লাগলো! মুগ্ধতায় ঘেরা চাহনিতে তার ঘুমন্ত মায়াবীনিকে আরও মায়াবি লাগছে । যার মায়ার জালে আটকে গেছে ও! যেখান থেকে ছাড়া পাওয়া মুশকিল! পারবে না ও! আর না এখন থেকে চেষ্টা করবে! আটকে রাখবে! আগলে রাখবে! নিজের সাথে বেধে রাখবে! কখনোই ওর থেকে দুরত্ব রাখবে না! মন গহীনে বন্দী করে রাখবে।

হঠাৎ করেই ওই ঘন পাপড়ি বিশিষ্ট গভীর চোখের অধিকারিণীকে ছুয়ে দিতে ইচ্ছে হলো ওর।ও নিজের ইচ্ছেকে সংবরন করল না বরং ইচ্ছেকে পুর্নতা দিয়ে পরম আবেশে ভালোবাসার স্পর্শ দিল।ওই ঘুমন্ত এলোমেলো মায়াবী নারীর মায়াবি দু নয়নে।তার পর ললাটে তার উষ্ণ ঠোঁটের ছোয়া দিল।ঘুমের মাঝেই মৃদু কেঁপে উঠলাম আমি। শরীরে এক শীতল শিহরন বইলো।তবে চোখজুড়ে রাজ্যের ঘুম। খোলার সুযোগ নেই।ওর ঘুমন্ত মুখের উপর ঝুঁকে ওর নিশ্বাসের শব্দকে অনুভব করছিলো স্রোত। দেখতে দেখতে ভোর হয়ে গেল।তবে স্রোতের দৃষ্টি সরলো না।একভাবে সারারাত দেখেছিল ওর স্রোতস্বীনিকে।ওর স্রোতস্বীনি ও ওকে ভালোবাসতে চাইছে।ওর স্রোতেই গা ভাসাতে চলেছে ভাবতেই মনের ভিতর আনন্দের জোয়ার বইতে লাগলো।ঠোঁট যুগলের মুচকি হাসিটা প্রসারিত হলো।তবে নিশব্দ! হে হাসির কোন শব্দ নেই।না আছে কোন আওয়াজ।হুট করেই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো।কথাকে আরেকটু জ্বালানো যাবে।আজ ওর চোখে মুখে যে ভয় ছিল তা দেখে বেশ মজা পেয়েছি ও! তবে এ ভয় স্রোতের কাছে আসা নিয়ে নয়! স্রোতের সাথে নতুন এক সম্পর্কে আরো নিবিড়ভাবে জরিয়ে যাওয়ার। তাইতো ওকে বাধা দেয়নি কথা! তবে হুট করেই স্রোতের বদলে যাওয়া আচরনে অনেকটা হতবাক হয়েছিল তা ও বেশ বুঝতে পেরেছিল।

আজানের ধ্বনি কানে বাজতেই নড়ে চড়ে উঠলো কথা।স্রোত দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো।এভাবে ওর সামনে পরতে চায় না ও।ওকে আরও কিছুদিন কথাকে ওর পিছনে ছুটাবে।যাতে করে ওদের ভালোবাসা আরও মজবুত।আসলে ভালোবাসায় ডত আঘাত যত যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা থাকবে তার ভালোবাসা ততটাই গভীর হবে।যেমনটা স্রোতের ক্ষেত্রে! কথার থেকে ওর এই দুরত্ব যেভাবে ওকে পুড়িয়েছে সেভাবেই আরও গভীর ভাবে কথাকে অনুভব করতে পেরেছে।স্রোত চায় ওর প্রেয়সীও যেন ওকে ততটাই গভীরভাবে ভালোবাসতে পারে! অনুভব করতে পারে! তবেই না ওদের ভালোবাসা স্বার্থক। একটা পুর্নাঙ্গ ভালোবাসাময় পৃথিবী গড়তে চাইলে ভালোবাসায় অনেক আঘাত সহ্য করতে হয়।আর প্রিয় মানুষটির থেকে দুরে থাকার তীব্রতর কষ্টগুলোই একসময় গভীরতম ভালোবাসায় রুপ নেয়।আর তখনই একটা ভালোবাসাময় পৃথিবী গড়ে ওঠে।যার স্থায়ীত্ব অনন্তকাল! মৃত্যু অবধি! প্রিয় মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও তার প্রতি ভালোবাসাটা কেড়ে নিতে পারে না।আমরা বেঁচে থাকি তার ভালোবাসায়! তারাই বাচিয়ে রাখে আমাদের এই বিশাল পৃথিবীতে! একাকিত্বে তার সাথে কাটানো সুমধুর স্মৃতিচারনে মনে প্রশান্তি অনুভব হয়।

স্রোত নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে এলো।বিশালতর আকাশের বুকে তার ভালোবাসার ক্ষতগুলোকে কর্পুরের ন্যায় বিলীন করে দিল।আজ তার হৃদয়ের সকল ক্ষত সেড়ে গেছে।তার মন খারাপগুলো কালো মেঘের মত ওই আবছা অন্ধকারে ঢাকা আকাশের বিশালতায় মিলিয়ে গেছে।কেন জানি আজ বড্ড খুশি লাগছে ওর! মুখে ভালোবাসার কথা না বলেও কথাকে ওকে ওর ভালোবাসা অনুভব করিয়েছে।ইচ্ছে করে নিজ থেকে ওর কাছে এসেছে! ধরা দিয়েছে! কিছু ঘন্টা আগেও এর বিপরীত চিন্তা ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো ওর মাথায়।তাই তো তখন বাসা থেকে বেরিয়ে গেছিল ও।প্রকৃতির কাছে গিয়ে প্রশ্ন করেছিল।তারা ওকে জবাব দিয়ে দিয়েছে।তাই এখন ও যা অনুভব করতে পারছে সেই অনুভুতিগুলোকে হারাতে চায় না।কথাকে আর কষ্ট দিতে চায় না! আধার আর আলোর মিলনমেলার এই অপুর্ব মুহুর্তের সাক্ষী হয়ে ওই নীল আকাশের আধারকে কাটিয়ে আলোর দিশা খুঁজে পাওয়ার মত সমীকরন পেল ও।ডুবে রইলো তাতে।স্মৃতিচারন করতে লাগলো সন্ধ্যে বেলার কথা বাচ্চামোগুলোকে।ওর ভয়ার্ত মুখটাকে।তখন কতটা স্নিগ্ধ লাগছিলো ওর স্নিগ্ধপরীকে।ওর মায়াবীনির নানা৷ রুপের বর্ননায় নানান নামের নামকরন করেছে ও।স্রোতস্বিনী, মায়াবীনি,স্নিগ্ধপরী আরও কত কি! ভাবতেই আবারো একগাল হাসলো ও। বিভোর রইলো ভাবনায়! যে ভাবনা! যার ভাবনা ওকে প্রশান্তি দেয়! ওর মনকে শান্ত করে! আজ দুবছর পর আবারও নিজেকে তার মাঝে ফিরে পেয়ে ভালো লাগছে ওর! ভিষন ভালো লাগছে!

.
আমার ঘুম ভাঙতেই আড়মোড়া ভেঙে অলস ভঙিতে উঠে বসলাম আমি।মুলত নামাজ আদায়ের জন্যই ওঠা।তবে এখনো চোখে ঘুম ঘুম ভাব বিদ্যমান। ঘুম ঘুম ভাবটা কাটাতেই চোখদুটো ভালো করে ডলে তাকালো ও চারদিকে। প্রথমত ঘরের পরিবেশ দেখে কপালের বলিরেখায় ভাজ পড়লো ওর।এটা তো ওর রুম নয় তবে কোথায় ও।ও জেগে গেলেই ওর অলস মস্তিষ্কটা জাগতে একটু সময় নিল।ও একটু ঝাড়া মাড়তেই সে যেন বিরক্ত ভঙ্গিতে আড়মোড় ভেঙ্গে বলে উঠলো,

— আরে মাইয়্যা! একটু শান্তিতে ঘুমায় ছিলাম সমস্যা কি তোর! একটু শান্তি তো দিবি!রহম তো করবি! সারাদিন খাটাছ আমারে! এখনো এত কিসের চিন্তাভাবনা তোর! আর চিন্তাভাবনা থাকলেও চিন্তাভাবনা ভাবার মত সময় তো দিবি! কাল রাত যে অধিকার অধিকার করে ভয়ানক আন্দোলন জুড়ে দিল তারই পরিনামের ফল।এর বেশি তোরে বুঝ দেওয়ার সাধ্য আমার নাই। বাকিটা বুঝে নে।

আমার বুঝতে সময় লাগলো না যে আমি কার ঘরেই কাল সারারাত ঘুমিয়েছিলাম। বুঝে ওঠার সাথে সাথেই চমকে উঠলাম আমি। আমি যদি এই ঘরেই ঘুমিয়েছে তবে সে কোথায়?ঘুমিয়েছে নাকি ঘুমোয়নি? ঘুমিয়ে যদি থাকে তবে কোথায়? সবাই তো সবার ঘরে! গেস্ট রুম ফাকা আছে। ওইখানে ঘুমিয়েছে।চটপট করে উঠে পড়ে গেস্ট রুমে খুঁজে এলাম।কিন্তু না মহারাজ তো সেখানেও নেই।তবে কোথায় গেল।বাইরে ছিল সারারাত।ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজকাল ওনার অভিমান ভাঙাতে গিয়ে আরও বেশি আঘাত করে ফেলছি নাতো! কষ্ট দিচ্ছি নাতো! বিষন্নতায় ভরা মন নিয়েই পা বাড়ালাম নিজের ঘরে। নামাজ আদায় করে আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম আমাদরের আগামী ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য। তাড়াতাড়ি যেন তার মান ভাঙাতে পারি আমি।সে দোয়া ও করলাম। অতঃপর চলে এলাম বেলকনিতে। ভোরের শীতল হাওয়া গায়ে মাখলাম।শরীর মন সতেজ হয়ে উঠলো।কিছুক্ষণ একমনে অনুভব করলাম।এই ভোরের স্নিগ্ধতাকে।পাখির কলকাকলীতে মুখরিত পরিবেশকে।পাখিরা নিজ নিজ গন্তব্যে ছুটে চলছে।আহারের খোঁজে! প্রিয় মানুষগুলোর মুখে আহার তুলে দিতে তারাও পরিশ্রম করে।আম্তে আস্তে পুরো আকাশ পরিষ্কার হলো।অন্ধকার কেটে নতুন সুর্য উঁকি দিল মেদিনীতে।তারই মিষ্টি আলো ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। লালাভ সেই আলো প্রকৃতিকে করে তুললো আরো মোহনীয়। মুগ্ধ নয়নে কিছুক্ষন সেখানে তাকিয়ে থেকে গেলাম দিদুনের রুমের দিকে।দিদুনের ঘুম মাত্রই ভাঙলো।আমি উনার ঘরে উঁকি দিয়ে মিষ্টি সুরে বললাম,

— সুপ্রভাত দিদুন।

— সুপ্রভাত বুড়ি।

— কি করছো?

— এইতো নামাজ পড়লাম। বসে আছি। তজবি গুনছি।

— আচ্ছা চল।একটু হেঁটে আসি।তোমার শরীরের জন্য উপযোগী আর মনটাও সতেজ হবে।

— আচ্ছা চল বুড়ি।

আমি মিষ্টি করে হেসে দিদুনকে নিয়ে বেরোলাম।সেদিন আমাদের বিয়ের পর থেকেই তার সুস্থতা ব্যাপক হারে বাড়ছে।মাত্র দু দিনেই তিনি প্রায় পুরো সুস্থ। বাসায় আসার পর আমি তার সাথেই বেশি সময় কাটাই।তিনি আমাকে নানান বুদ্ধি দেন।তবে তিনি নিজের সকল কাজ নিজে করতেই পছন্দ করেন।আমরা হাটতে হাটতে প্রায় বিশ মিনিট এসেছি।ভোর হওয়াতে রাস্তা প্রায় ফাকা।লোকজন তেমন নেই।দু – চারজনকে দেখা যাচ্ছে। তারা নিজ কর্মস্থলে যেতে উদ্যত বোঝাই যাচ্ছে।একটু নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ আমার আর দিদুন দুজনেরই বেশ পছন্দ। তাই আমরা নির্জন কোলাহল নেই এমন রাস্তায় চলতে শুরু করলাম।

— একটা গল্প শুনবি বুড়ি।( দিদুন সবসময় আমাকে বুড়ি বলেই ডাকে। মাঝেমধ্যে নাম ধরে বলে)

— শোনাও দিদুন।অনেকদিন হয় তোমার কাছে গল্প শুনি না।

— আজকের গল্প বাস্তবিক! প্রেমের গল্প! প্রেমে আচ্ছাদিত দুটি মনের গল্প! ওই তোরা কি যেন বলিস না ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ওইটা!

— ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কোথায় ঘটলো দিদুন?

— কেন তোর আর স্রোতের মাঝে।

আমি অবুঝের মতো তাকিয়ে বললাম,

— মানে!…

— মানে! তোর আর স্রোতের প্রেমকাহিনী আমার আর তোর দাদুর প্রেমকাহিনীর পুনরাবৃত্তি ঘটালো যে!

আমি উৎসাহিত হয়ে বললাম,

— কি বলছো দিদুন। সত্যি!

— হুম। সত্যি!

— কিভাবে দিদুন? আর আগে কেন বলো নাই তোমার আর দাদুর প্রেমকাহিনী? তোমরা প্রেম করে বিয়ে করেছিলে মানে তোমাদের প্রেমের বিয়ে ছিল।

— হুম।

— তাহলে আগে কখনো বলোনি কেন?

— কারন কখনো এই বিষয়ে তোর আর আমার কথা হয়নি তাই।তুই তো কখনো প্রেম ভালোবাসা নিয়ে কথা বলিসনি।কিছু জানতেও চাসনি।তাই বলা হয়নি।

— ঠিকাছে এখন বলো তো কিভাবে কি?

— তোর দাদু আর আমি সম্পর্কে ভাই বোন ছিলাম। আপন না।আমি সম্পর্কে উনার ফুফাতো বোন ছিলাম।তার বাবা আর আমার মা দু ভাই বোন। তবে আমরা দুবোন ছিলাম।তোর দাদু একাই ছিল। ছেলের ঘরের একমাত্র ছেলে হওয়ায় বড় আদরের ছিল সে। বাবা যখনই অকালেই গত হয় আমার জন্মের পাঁচ বছরে। তখন থেকেই আমরা এ বাড়িতে থাকি। আমাদের কোন ভাই ছিল না।তবে আমি তাকে কখনো ভাই মনে করিনি।তার সাথে ভিষন ঝগড়া হতো আমার।দুচোখে সহ্য করতে পারতাম না।অনেক রাগী ছিল তোর দাদু।তবে আমার উপর কখনো দেখাতো না।ভিষন আদুরে ছিলাম তার কাছে। সব আবদার সেই পুরন করত আমার অজান্তে।আমাদের মধ্যে সাপে নেউলের সম্পর্ক ছিল।

বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো দিদুন।আমার বেশ ভালো লাগছে শুনতে।আমি আগ্রহ ভরে বললাম,

— তারপর!

— তারপর।এভাবেই বড় হলাম দুজন।তিনি আমার চেয়ে আট বছরের বড় হওয়ার পরও।পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করত।বড় আপুকে অনেক সম্মান করত।তবে আমাকে সবকিছুতেই খেপাতো।ভালো লেখাপড়ার জন্য মামা তাকে দুরে পাঠিয়ে দেয়।তখন থেকে তার প্রতি শুন্যতা অনুভব করি।ভিষন মন খারাপ থাকতো।কিছুই ভালো লাগতো না।দুরত্ব বাড়ার সাথে সাথে মনের কোথাও অন্যকিছু অনুভব করতে শুরু করি।তখন ও বুঝিনি আসলে আমি তাকে ভালোবাসি।আসলে আমাদের সময়ে এসব ভালোবাসা ছিল না।পরিবার দেখে শুনে বিয়ে দিত আর সেখানেই মেয়েরা মানিয়ে নিত।তবে তোর দাদু যখনই ছুটিতে বাড়িতে আসতো আমার মনটা আনন্দে ভরে উঠতো।আমাদের মাঝে ঝগড়া তখনো হতো তাতেই যেন শান্তি মিলতো।এর মাঝে আপার বিয়ে হয়।মামাই সব দেখে শুনে ভালো ছেলের কাছে বিয়ে দেয়।সবকিছু ভালোই ছিল।হঠাৎ একদিন মামা আম্মারে বললো আমারে বিয়ে দিবে।কোথাকার কোন বনেদি ঘরের পাত্রর নাকি আমাকে পছন্দ হইছে।আমি আবার উড়নচণ্ডী ধরনের মেয়ে ছিলাম কিনা।সারাক্ষণ বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলায় মেতে থাকতাম।সময় কাটাতাম।জানিস তোর দাদুর ভাষ্যমতে আমাকে নাকি আমার বাচ্চা বাচ্চা স্বভাবের জন্যই এত ভালোবাসত সে।

— তারপর!

— তারপর। তখন তোর দাদুর পড়ালেখা শেষে খুব ভালো চাকরি হইছে।তাও আবার সরকারি।সে খুশির খবর সবাইরে দিতে বাড়িতে আসছে। যখনই জানতে পারছে তখন বাড়ির পরিস্থিতি গমগমে।আমার আম্মা তার ভাতিজারে ভিষন ভালোবাসতো।ছেলে ছিল না বলেই হইতো।পরিবারের সবার কাছেই সে বড্ড আদুরে।তার জেদ সে আমাকেই বিয়ে করবে।সবাই মেনে নিল।কারন মামি সহ সবার ভিষন আদুরে ছিলাম।তাই কেউ অমত করেনি হয়তো তারাও এটাই চাইতো।আমিও খুশি ছিলাম কারন তাকে ভালোবাসতাম।ভালোবাসা কি না বুঝলেও তার প্রতি গভীর টান ছিল, মায়া ছিল।সেবারই আমাদের বিয়ে হয়।আর বিয়ের পর আমাকে সাথে করেই নিয়ে আসেন তিনি আর তার কাজে যোগ দেন।এইভাবে ঝগড়া, খুনসুটি আর ভালোবাসায় সংসার করছিলাম আমরা।

আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সবটা শুনলাম।সত্যি অসাধারণ প্রেমকাহিনী ভালোবাসা না বুঝে ও একে অপরের প্রতি এত টান এত মায়া তাদের একটা সুন্দর সম্পর্কে জরিয়েছে। দিদুন না বুঝলেও দাদু নিশ্চয় বুঝতো সবটা।তাইতো ভালোবাসার মানুষটাকে হারাতে চায়নি।বেধে নিয়েছে নিজের সাথে। আগলে রেখেছে এতটা বছর।আসলেই ভালোবাসা মরে না।সে প্রেমিক হৃদয়ে বেঁচে থাকে হাজারো বছর।আজও দিদুনকে হুটহাট হাসতে দেখি, একা একাই বিড়বিড় করতে দেখি।আবার কখনো বিষন্ন মনে নেত্রকোনের অশ্রুও দেখা যায়। হয়তো প্রিয় মানুষটার শুন্যতা কাঁদায়। যে কান্নায় শব্দ নেই।যে কান্না ভিতরটাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে না।নিঃশব্দে কান্না অনেক যন্ত্রণার হয়।সবাই অনুভব করতে পারে না।শুধু তারাই পারে যারা সে যন্ত্রণার অনলে প্রতিনিয়ত পুড়ছে।প্রিয় মানুষটির অনুপস্থিতি যাকে কাঁদায়।এক তরফা ভালোবাসায় মগ্ন মানুষের কান্না সে নিরব নিস্তব্ধতায় দগ্ধ হৃদয়ের আর্তনাত।সে আর্তনাত কেউ শুনতে পায় না,কাউকে বোঝানো যায় না।শুধুই পোড়ায়! অনেক পোড়ায়!

আমার ভাবনার মাঝেই দিদুন ঝাকি দিলো আমায়।

— কিরে বুড়ি কোন ভাবনায় ডুবে গেলি? আমার আদরের নাতিটারে নিয়ে ভাবিস বুঝি।

আমি কপালে ভাজ ফেলে বললাম,

— তোমার ওই গোমরামুখো,পাঙসুটে, ঢেড়স মার্কা নাতনির ভাবনায় আমি বিভোর হমু।মোটেও না।হুহ! ব্যাটা উজবুক কি মনে করে নিজেরে? আমারে পাত্তা দেয় না।আমি দেখবো কি করে পাত্তা না দিয়ে থাকে। আমিও ছাড়ছি না ব্যাটা খাটাশকে।আমারে ভয় দেখায় বলে কি….

— কি বলে?

— আরে ওই যে বলে আগে আমি আমার অধ্….

— কি হলো বল না বুড়ি কি বলছে তোরে? আদর করছে মনে হয়? চুমু খাইছে নাকি!

আমার আটকে থাকা কথা আর বেরোলো না। তার আগে এই পাকনা বুড়িটার এসব অদ্ভুত আর লজ্জাজনক কথা শুনে পা দুটো যেন জমে গেল।মস্তিষ্ক সেখানেই আটকে আচে। টাস্কি খেয়ে চোখ বড়বড় করে রোবটের মত অনুভুতিশুন্য হয়ে ফিরলাম তার দিকে।বিষ্ফোরিত চোখে তাকালাম তার দিকে।তার কোন ভাবান্তর নেই।মানে লজ্জা পাবে বুড়ি।তার ছিটে ফোটাও নেই।মানে! এত ভয়ংকর কথা এক লহমায় সে কি করে গড়গড় করে বলে দিল।সে ভাবনায় টাস্কি খাওয়া ভাবটা এড়ালো না আমার।আমি যেন জমে গেছি। এমন কথায়।এই মুহুর্তে কথাটা ঝংকারের ন্যায় কানে বাজছে আমার।রিপিট হয়ে বারবারই বেজে চলছে।” আদর করছে মনে হয়।চুমু খাইছে নাকি!”
এই মুহূর্তে আমার কাছে পৃথিবীর সবথেকে অশ্লীল কথা বলে মনে হচ্ছে এটা।আমি স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকাতে দিদুন কপালে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,

— কিরে বুড়ি কি হইছে তোর? জ্বিনে টিনে ধরলো নাকি।নড়ছ না ক্যান!

#চলবে…..
(দেরি হওয়ার জন্য দুঃখিত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here