তুমি নামক প্রশান্তি শেষ পর্ব

0
672

#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_ত্রিশ

সজোরে দুইটা থা°°/প্প/°°ড় খেয়ে নীলাভ্র গালে হাত দিয়ে চেয়ে আছে। চোখে লেগে আছে অসহায়ত্ব। যে মানুষটা ছোট বেলা থেকে মায়ের মতো আদর, স্নেহ দিয়ে বড় করে তুলেছে। আজ সেই মানুষটা গা°য়ে হাত তুলল! তাও বিনা দোষে! ভাবতেই অবাক লাগছে নীলাভ্রর। কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। রিতা রা°গান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তার সর্বাঙ্গে কাঁ°পুনি হচ্ছে। রাগে বশিভূত হয়ে তৃতীয় থা°°/প্প/°°ড়টা মা°°/রা/র জন্য হাত উঠাতেই, বেলী সাহস করে মায়ের হাতটা ধরে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে অনুরোধ বাক্যে বলে উঠল,
“মা! আর মা°°/র/°°বে না প্লিজ।”
বেলীর চোখ অশ্রুসিক্ত। নীলাভ্রর দৃষ্টিতে মেঝের সাদা ঝকঝকে টাইলসের উপর। চোখ দুটো যে, অশ্রুসিক্ত তা বুঝতে দেরি হলো না বেলীর। রিতা কিছু একটা ভাবল হয়তো? কিছু সময়ের ব্যবধানে গম্ভীর স্বরে বলল,
“এই ছেলেটা আমার বাসায় কী করছে? এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যেতে বল। নয়তো আমি ধা°°/ক্কা মে/°°রে বের করে দিব।”
রিতার এহেন কথা শুনে নীলাভ্রর চোখ জোড়া থেকে দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। শোকে নীলাভ্র স্তম্ভিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় কণ্ঠে বলে উঠল,
“ফুপ্পি! তুমি আমাকে এইভাবে বললে! ”
রিতা পুনরায় তাকাল। স্নেহ, মায়াহীন চোখে। যেই চোখে আগে নীলাভ্র ভালোবাসা, মায়া খুঁজে পেতো। আজ সেই চোখে কোনো স্নেহ, মায়া দেখতে পাচ্ছে না। কী অদ্ভুত! এই সাতদিনে কী সব পাল্টে গেলো? সবাই কী দূরে সরে গেলো? কে জানে? বুকের মধ্যে তীব্র হাহাকার যুক্ত কান্নারা দলবেঁধে আছে। যেকোনো মুহূর্তে সমুদ্রের পানির উপর তীরে উপচে পড়বে। রিতা কাঠকাঠ গলায় জবাব দিলো,
“তুই আমাকে আর ফুপ্পি বলে ডাকবি না। তুই কী করে পারলি আমাদের সবাইকে এভাবে কষ্ট দিতে? এবারও তোর বেলীর কথা মনে হলো না? মনে হলো না তোর মায়ের কথা, পরিবারের সবার কথা? সবাই কতটা দুশ্চিন্তায় দিন কা/°°টিয়েছে সেই ধারণা তোর আছে? কী এমন কাজে ছিলি তুই? বল কী কাজ ছিলো তোর?”
বলতে বলতে রিতা কান্নায় ভে°°/ঙে পড়ল। নিজের শক্ত আবরণটা ধরে রাখতে পারল না। মায়েরা যতই শক্ত হোক। সন্তানের কাছে বরাবরেই তারা খুব দূ°র্বল, নরম। নীলাভ্র কিছু বলল না। শুধু নিঃশব্দে রিতাকে জড়িয়ে ধরল। মেয়েদের মতো ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠল। রিতা দুই হাতে নীলাভ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। শান্ত, শীতল স্বরে বলল,
“তুই আমাকে সত্যি করে বল, তুই কোথায় ছিলি?”
নীলাভ্র কিছু সময় চুপ থাকল। খানিক সময় পর সবটা খুলে বলল। রিতার মন থেকে একটা ভারী পাথর নেমে গেলো। বেলীর থেকে সেদিন ওইসব রি°পোর্টের কথা শুনে দুশ্চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছিল। নীলাভ্র রিতার হাত দুটো শ°ক্ত করে আকঁড়ে ধরল। নরম স্বরে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও ফুপ্পি, প্লিজ। আমি আর কখনো তোমাদের সবাইকে ছেড়ে যাব না।”
রিতা কিছু বলল না। পরম আবেশে হাত বুলিয়ে দিলো নীলাভ্রর গালে। মাঝখান থেকে বেলী চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,
“কোনো ক্ষমা করা হবেনা আপনাকে। এক্ষুনি আমার বাসা থেকে বের হয়ে যান। আপনাকে দেখলেই আমার গা-পিত্তি জ্ব°°/লে যাচ্ছে।”
বেলীর কণ্ঠে তীব্র রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটল। রিতা হেসে উঠল হাহা করে। আর নীলাভ্রর মুখটা চু°পসে গেলো। রিতা ওদের দুজনকে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য, রুম থেকে বেরিয়ে গেলো৷ চা বানানোর বাহানায়। রিতা চলে যেতেই বেলীর রাগটা দ্বিগুণ হয়ে উঠল। কোমরে হাত রাখল। আঁখি জোড়ায় আ/°°গুন জ্ব°°/লে উঠল। বেলীর রাগান্বিত মুখটা দেখে নীলাভ্রর এবার হাসি পেলো। বেশ প্রফুল্ল মনে বলে উঠল,
“তোকে রাগলে কিন্তু বেশি সুন্দর লাগে, বেলীপ্রিয়া।”
বলে বেলীকে দ্বিতীয় বার কোনো শব্দ উচ্চারণ করার সুযোগ দিলো না। দুই হাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিলো। নরম, শান্ত, শীতল কণ্ঠে বলে উঠল,
“ভালোবাসি, বেলীপ্রিয়া।”
ব্যস! লাগে কী আর? বেলীর রাগ নিমিশেই উধাও। ছেলেটা জাদু জানে হয়ত? কী সুন্দর মুহূর্তেই রাগটাকে গ্রাস করে নিলো? শান্ত হয়ে গেলো বেলী। নড়াচড়ার মতো শ°ক্তি পেলো না। অশান্ত মনটা ছটফট করতে লাগল। কী এক অদ্ভুত শান্তি! আচ্ছা প্রিয় মানুষের বুকে কী এত শান্তি থাকে? না-কি প্রিয় মানুষ বলে এত শান্তি অনুভব হয়? কে জানে? উত্তর খুজে পেলো না। একদম লেপ্টে রইল নীলাভ্রর বুকে। দুজনের মাঝে পিনপতন নীরবতা। নীরবতা ভেঙে নীলাভ্র বলে উঠল,
“বেলীপ্রিয়া?”
বেলী নিচু স্বরে জবাব দিলো,
“হুম।”
নীলাভ্র সাথে সাথে বলল,
“আর মাত্র এক মাস। তারপর তুই আমার। সারাজীবনের জন্য। তোকে আগলে রাখব আমার বক্ষস্থলে। একদম ছেড়ে দিব না। শক্ত করে আকঁড়ে রাখব। প্রমিস।”
বেলী কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর আচমকা হুঁহুঁ করে কেঁদে উঠল। কান্নারত স্বরে বলল,
“আমাকে আপনার পায়ে হলেও একটু ঠাঁই দিয়েন। আমি সারাজীবন মাটি আঁকড়ে থাকব। তবুও ছেড়ে যাবেন না, প্লিজ।”
বেলীর কথায় নীলাভ্র থমকাল। ধমকের স্বরে বলল,
“আজেবাজে কথা বললে একটা সজোরে থা/প্প/ড় মা/র/ব।”
বলে থামল কিছুসময়। তারপর বেলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়ল। শান্ত কণ্ঠে বলতে লাগল,
“তোর জায়গা আমার পায়ে নয় রে, বেলীপ্রিয়া। তোর জায়গা আমার বক্ষস্থলে। তুই আমার এক প্রিয় অসুখ। মারাত্নক নে/শাধর অসুখ। যা দুনিয়ার কোনো ওষুধে কমবে না। বুঝলি, গা/ধি?”
এমন সরল স্বীকারোক্তিতে বেলীর মনটা গলে গেল। অশান্তটা মনটা শান্ত হয়ে গেলো। হাসল বোধহয়? কে/টে গেলো এভাবেই। মুহূর্তটা সুন্দর! ভীষণ সুন্দর! ভালোবাসাও সুন্দর!


তানিশার শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। কেমন যেন সারাক্ষণ ঝিমাতে থাকে মেয়েটা! মুখটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মো°টাসো°টা মেয়েটা শুকিয়ে গেছে। একদম লা/°°ঠির মতো! দূর্বলতা গ্রা°স করে নিয়েছে শরীর। বিছানায় শ°রীর রাখলে আর উঠাতে মন চায়না। এই শরীর নিয়েও সুয়ে থাকার সময় নেই। সারাদিন গা/°°ধার মতো খা°°টুনি খে°°টে যায় মেয়েটা। চু°লায় ভাত বসিয়ে দিয়ে নিচে বসে পড়ল ধপ করে। চলছে না শরীর টা। দুই হা°টুর ভাঁজ করে মুখ লুকাল সেখানটায়। গা গু°লিয়ে আসছে বার বার। ব°মির বেগ আসতেই দৌড়ে গেলো ওয়াশরুমে। ওয়াশরুমের সাদা টাইলসটা মুহূর্তেই র°°ক্তে ভেসে গেলো। গলগল করে মুখ দিয়ে র°°ক্ত বেরিয়ে আসতে লাগল। ভ°য়ে বুকটা কেঁ°পে উঠল তানিশার। শরীর যেন অ°বশ হয়ে আসতে লাগল। হাত-পা সারা শরীর কাঁ°পা-কাঁ°পি শুরু হয়ে গেলো। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসল মুহূর্তেই। ফ্লোরে পড়ে গেলো চোখের পলকেই। ধ°পাস করে কিছু প°ড়ার শব্দ তানিশার শাশুড়ী দৌড়ে এলো রুম থেকে। রান্নাঘরে তানিশাকে খুঁজে না পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে আবার অন্যদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। রান্না ঘরের সোজাসুজি ওয়াশরুমে চোখ যেতেই আঁত°কে উঠল। তানিশার পড়নের শাড়িটা র°°ক্তে মাখা। চিৎকার করে ডাকতে লাগল সবাইকে। দৌড়ে গিয়ে তানিশার মা°থাটা নিজের কোলে নিয়ে বসল। তানিশার ঠোঁ°টের কোণে এখনো র°°ক্তের ছড়াছড়ি। এইসব দেখে ভয়ে তার কলিজা শুকিয়ে আসতে লাগল। বাসায় তখন শাকিল ছিলো না। পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এলো শাকিলের বাবা। ছেলের বউয়ের এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলো। দুজনের পা°-গলের মতো অবস্থা হয়ে পড়ল। তাড়াতাড়ি এ°ম্বুল্যান্স খবর দিলো। প্রায় আধা ঘন্টা পর এ°ম্বুল্যান্স আসল। তোলা হলো তানিশাকে এ°ম্বুল্যান্সে। এই আধাঘন্টা অনেক চেষ্টা করেও তানিশার জ্ঞা°ন ফেরানো যায়নি। এ°ম্বুল্যান্সে যেতে যেতে তারা দুজন সবাইকে ফোন করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দ্রুত একটা ভালো হসপিটালে ভর্তি করানো হলো। শাকিল প্রথমবার ফোনটা রিসিভ করেছিল, ঠিকি। কিন্তু তারপর থেকে ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে। তানিশার বাবা-মা প্রায় ঘন্টাখানেকের মা°থায় হসপিটালে এসে উপস্থিত হলেন। মেয়ের অবস্থা দেখে কান্নায় ভে°ঙে পড়ল। হসপিটাল জুড়ে সাহেলা বেগমের কান্নার শব্দ। রতন চুপচাপ বসে আছে। চোখের কোনে অশ্রুরা জমাট বেঁধে আছে। বুকটা কষ্টে ফে°-টে যাচ্ছে। কিছু সময় পর ডাক্তার বেরিয়ে আসতেই সবাই মিলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। একের পর এক প্রশ্ন ছু°ড়ে মা°র°ল সবাই। ডাক্তার বেশ শান্ত স্বরেই জবাব দিলো,
“এইটুকু একটা মেয়ের এত চা°প কিসের বলুন তো? যে সে অতিরিক্ত চা°পে ব্রে°ন স্ট্রো°ক করে ফেলল?”
কথাটা সবার কানে যেতেই যেন, সবাই পা°থরে পরিনত হলো। ঠিকি তো? তানিশার এত কিসের চা°প? প্রশ্নটা হা°না দিলো সবার মনে। এত উত্তর খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

#চলবে

#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_একত্রিশ (প্রথম খন্ডের সমাপ্তি)

বিয়ের আসরে কোনো মেয়ের ভালোবাসার মানুষটা পালিয়ে গেলে ঠিক কতটা কষ্ট হয়? কতটা সম্মানহানি হয়? ভাবতে পারছেন একবার? যেই মানুষটাকে বেলী নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসল। সেই মানুষটা আজ ঠকাল! বিশ্বাস হচ্ছেনা। আচ্ছা মানুষটার কী কোনো বিপদ হলো? মনটা এমন ছট°ফট করছে কেন? সব কিছু এত ঘোলাটে লাগছে কেন? দ°ম আটকে আসছে কেমন যেন? এই বুঝি বেলীর নিশ্বাস ফুরিয়ে গেলো? বিভ°ৎস এক যন্ত্র°ণা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে ‘মা’ বলে ডেকে উঠল বেলী। ধড়°ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠে বসে পড়ল বিছানায়। হাত-পা সমানে কেঁ°পে একাকার অবস্থা। শরীর থেকে পানির ন্যায় ঘাম ঝড়ছে। কী একটা অবস্থা! বু°কের ভেতরটা ধুকপুক করছে। বেলীর চিৎকারে রিতা অন্য রুম থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। বেলীর রুমে প্রবেশ করে বেলীকে এই অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে গেলো। বেলী কাঁপছে এখনো। থামার নাম নেই। চোখ দুটো থেকে ভয়ের রাশ যেন কমার নাম নেই? রিতা বেলীর পাশে বসতেই বেলীর যেন হুশ এলো। বিশ্বস্ত, ভরসাযোগ্য ব্যক্তিকে পেয়ে হামলে পড়ল তার বুকে। জোরে কান্নায় মত্ত হয়ে পড়ল৷ রিতা যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে? কথা বলতে পারছেনা। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠল,
“কী হয়েছে মা? স্বপ্ন দেখেছিস কোনো?”
বেলী উত্তর দিলো না। ওইভাবেই কাঁদতে লাগল। রিতার ভয়টা দ্বিগুণ হলো। পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
“বল কী হয়েছে? এমন লাগছে কেনো তোকে?”
বেলী এবার একটু সময় নিলো। ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে সবটা অগোছালো ভাবে বলল। রিতা এবার সব বুঝতে পারল। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চি°রে। রাতের নিরবতার মাঝে বেলীর ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ভয়ং°কর শুনাচ্ছে। কিছু সময়ের ব্যবধানে রিতা স্বান্তনা দিয়ে বলে উঠল,
“দেখ মা, স্বপ্ন কোনোদিন সত্যি হয় না। এইতো আর মাত্র কয়েকদিন তারপর তোদের বিয়ে। দেখবি, এইসব কিছু হবেনা। নীলাভ্র তোকে কত ভালোবাসে, বল তো? কোনোদিন তোকে ছেড়ে যাবে না।”
এবার বেলী একটু শান্ত হলো। বাচ্চাদের মতো কান্নামিশ্রিত স্বরে বলল,
“সত্যি বলছো, মা? নীলাভ্র ভাই, আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?”
রিতা বোধহয় খানিকটা হাসল। মেয়ের এহেন কান্ডে। হাসিটা ঠোঁটের কোনে চে°পে বলল,
“ছেড়ে যাবে না। আমার এই রাজকন্যাকে ছেড়ে যাওয়ার সাধ্য আছে না-কি?”
মায়ের এমন কথায় বেলী একটু লজ্জা পেলো। হাসি ফুটল ঠোঁটদ্বয়ে। বুকের ভেতরের ভা°রী পা°থরটা নেমে গেলো। কিছুক্ষণ মায়ের বুকে এভাবেই রইল।
রিতা বেশ শান্ত ভাবে বলতে লাগল,
“এখন ঝটপট উঠে নফল নামাজ আদায় করে নে। আমার কাছে কেঁদে যেইটুকু সময় নষ্ট করলি, সেটুকু সময় উপরওয়ালার কাছে কাঁদলে শান্তি পাওয়া যেত। মনে রাখিস, জীবনে কেউ তোর পাশে না থাকলেও আল্লাহ তোর পাশে আছেন। আমি মানে একটা মা তার সন্তানকে যতটা ভালোবাসি। তিনি তার চেয়েও দ্বিগুণ ভালোবাসে তার বান্দাকে। তাই মনের মধ্যে ভয়, হতাশা পুষে না রেখে সেজদায় গিয়ে সব ঝেড়ে ফেল। নিমিশেই সব হাওয়া হয়ে যাবে।
বলে মেয়ের মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেল। রিতা চলে যেতেই বেলী জোরে নিশ্বাস ফেলল। মায়ের কথাগুলো অদ্ভুত শান্তি দিচ্ছে। কিছুসময়ের জন্য ধড়াম করে বিছানায় সুয়ে পড়ল। ফোনটা তুলে নিতেই সময় চোখে পড়ল। সাড়ে চারটা বাজে। ভোর হতে বেশিক্ষণ নেই! কথাটা মনে উঠতেই আবার ভয়ে আঁতকে উঠল। ভোরের স্বপ্ন না-কি সত্যি হয়? তারপর নিজে নিজেই দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠল,
“এইসব কিছু হবেনা। আর যদিও হয় তাহলে আমি মেনে নিব। কারণ আমার আল্লাহ আমার জন্য যা করবেন, তা নিশ্চয়ই ভালো হবে।”
বলে উঠে পড়ল নামাজ আদায়ের তাগিদে।

২৪ঘন্টা হয়ে গেছে। তানিশার জ্ঞান ফিরেনি এখনো। চিন্তায় সবার অবস্থা এই মুহূর্তে পা°গল পা°গল। হসপিটালের করিডোরে তানিশার বাবা-মা পা°গলের মতো কেঁদে চলেছে সারাক্ষণ। এখন সকাল সাতটা বেজে দশ মিনিট। এর মধ্যেই একজন নার্স এসে বলতে লাগল,
“তানিশার বাড়ির লোক কে আছেন? তার জ্ঞান ফিরেছে। আপনারা চাইলে দেখা করতে পারেন।”
বলে সে চলে গেলো। মনে হলো উপস্থিত সবার বুকের উপর থেকে ভা°রী বোঝা নেমে গেলো। তানিশার মা সময় না নিয়ে দৌড়ে কেবিনের ভেতর ঢুকে গেলো। তানিশা চোখ বন্ধ করে ছিল, রুমের মধ্যে কারোর প্রবেশ করার শব্দ পেয়ে চোখ খুলে তাকাল। চোখের সামনে ‘মা’ নামক ব্যক্তিটাকে দেখে অভিমান গুলো উপচে পড়ল। মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো মুহূর্তেই। সাহেলা বেগম চোখের জলটুকু মুছতে মুছতে তানিশার মাথার সামনে বসল। মাথায় হাত রেখে বলে উঠলেন,
“আমার লগে কথা কবি না, মা?”
তানিশা নিশ্চুপ। কথা বলার জন্য বেশি শক্তিটুকু ওর শরীরে নেই। তবুও আজ অনেক অভিযোগ দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছেনা। সাহেলা বেগম পুনরায় বলে উঠলেন,
“একবার আমার দিকে চাইয়া দেখ। আমি তোর মা হইয়া তোর কাছে মাফ চাইতাছি। আমারে মাফ কইরা দে। টাকার লেইগা আমরা অন্ধ হইয়া গেছিলাম। বুঝিনাই তোর দুঃখ। আমাগোরে এমনে শাস্তি দিস না, মা।”
বলে কান্না করে উঠলেন তিনি। তানিশার চোখ বেয়েও পানি গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। বার বার মস্তিস্ক প্রশ্ন করছে,
” সত্যিই এবার তাহলে এই জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে?”


নীলাভ্র আর বেলী পাশাপাশি বসে আছে। বেলীর মুখে রাজ্যের বিষন্নতা। বার বার তানিশাকে ফোন করে যাচ্ছে কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ রিসিভ করছে না। মেয়েটার কী হলো কে জানে? এই চিন্তায় কাল থেকে শেষ বেলী। এবার বেশ অধৈর্য হয়ে বেলী বলে উঠল,
“আমার এবার খুব বেশি চিন্তা হচ্ছে, নীলাভ্র। তানিশা তো কখনো এমন করে না। তাহলে কী ওর কোনো বিপদ হলো?”
মনের মধ্যে ভয়টা যেন ঝেঁকে বসছে ওর। নীলাভ্র কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। তানিশার জন্য ওর নিজেরও চিন্তা হচ্ছে। তিনদিন ধরে মেয়েটার কোনো খোঁজ নেই৷ তবুও বেলীকে শান্ত রাখার জন্য বলল,
“আরে হয়ত ও ব্যস্ত। আবার এমনও হতে পারে ওর ফোন নষ্ট হয়ে গেছে। তুই এক কাজ তানিশার মায়ের কাছে ফোন দে।”
বেলী তানিশার মায়ের কাছে ফোন দেওয়ার জন্য ডায়াল করবে, এমন সময় রাকিব ফোন দিল। তড়িঘড়ি করে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই, ওপাশ থেকে রাকিব শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“তানিশা ঠিক আছে। তুই চিন্তা করিস না। সামান্য জ্বর ছিল তাই শাকিল ফোন রিসিভ করতে দেয়নি। ভাবতে পারছিস, কী ভালোবাসা?”
বলে একটু হাসল। বেলী স্পষ্ট বুঝতে পারছে এই হাসির মানে? তাচ্ছিল্যের হাসি। ভালোবাসার মানুষটাকে অন্য একজন এতটা যত্নে রেখেছে তা সহ্য হচ্ছে না রাকিবের। রাকিব ফোনটা কে°টে দিল। বেলীকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। বেলীর মুখটা চুপসে আছে। রাকিবের কষ্টের কথা মনে উঠতে মনটা আগের তুলনায় দ্বিগুণ বি°শিয়ে গেল। নীলাভ্রর দিকে করুণ চোখে তাকাল। বলল,
“ভালোবাসা অসহায় তাইনা?”
নীলাভ্র একটু হাসল। বেলীর গালে সযত্নে হাত রাখল। আদুরে স্বরে বলল,
“ভালোবাসা সুন্দর। আবার ভালোবাসা অসহায়। ভিন্নতা শুধু পরিস্থিতির। বুঝলি, পা°গলি?”
বেলী অশ্রুসিক্ত চোখে খানিক হাসল। নীলাভ্রর বুকে লেপ্টে যেতে যেতে বলে উঠল,
“আপনি আমাকে কোনোদিন ছেড়ে যাবেন না তো নীলাভ্র?”
নীলাভ্র পরম যত্নে চু°মু খেলো বেলীর কপালে। দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে কেমন শীতল স্বরে উত্তর দিলো,
“কখনো ছেড়ে যাব না। ভালোবাসি বেলীপ্রিয়া।”
বেলীও খুব সযত্নে উত্তর দিলো,
“আমিও আপনাকে ভালোবাসি, নীলাভ্র।”


সময় চলে যায় সময়ের গতিতে। যত সময় যাচ্ছে তত যেন বেলী আর নীলাভ্রর বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে। এই তো কে°টে গেলো সাতদিন। আর বাকি কিছুদিন। কত স্বপ্ন, কত আশা? কাল প্রায় ঘন্টা খানেক বেলী আর তানিশা মিলে কত শত প্লানিং করল। ভরদুপুর। ঘড়ির কা°টায় বারোটা। ভার্সিটি থেকে এসে বেলী সবেমাত্র ব্যাগটা খাটের উপর রাখল। পানির গ্লাসটা হাতে নিতেই ফোনটা বেজে উঠল। ফোন স্ক্রিনে রাকিবের নামটা দেখে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। ছেলেটা রাগ হয়ে এই কয়েকদিন কথা বলেনি। আজ তবে অভিমান ভাঙল। ফোন রিসিভ করেই বেলী বলে উঠল,
“কিরে, তোর রাগ ভাঙল অবশেষে।”
কথাটা বলেই বেলী থেমে গেলো। ওপাশ থেকে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আসছে। রাকিব কাঁদছে? কিন্ত কেনো? আতঙ্কিত স্বরে বেলী প্রশ্ন করল,
“কাঁদছিস কেনো? কী হয়েছে? রাকিব ভাই আমার কাঁদছিস কেনো? কী হয়েছে?”
রাকিব তবুও কেঁদে চলেছে। বেলী এবার অধৈর্য হয়ে ধমকে জিজ্ঞেস করল,
“বলবি, কী হয়েছে তোর? মাথাটা খারাপ হচ্ছে আমার। আন্টি, আংকেল ঠিক আছে?”
ওপাশ থেকে রাকিব জোরে চিৎকার করে বলে উঠল,
“তানিশা আর নেই দোস্ত। তানিশা আমাদের উপর অভিমান করে চলে গেছে। না ফেরার দেশে চলে গেছে। আমার তানিশা ম°রে। আমার তানিশা আমাকে একা করে দিয়ে গেছে।”
কথাগুলো বেলীর কান অব্দি পৌছাল না। তার আগেই বেলী দ্বিগুণ জোরে চিৎকার করে বলে উঠল,
“রাকিব। একদম মজা করবি না। থা°প্পড় দিয়ে সব দাঁ°ত ফে°লে দিব।”
বলে কে°টে দিলো ফোন টা৷ তড়িঘড়ি করে ফোন দিলো তানিশার ফোনে। কিন্তু রিসিচ হলো না। এতে যেন ভয়টা পুরো শরীরে ঝেঁকে বসল। এবার আর উপায়ন্তর না পেয়ে তানিশার মায়ের ফোনে ফোন দিলো৷ দুইবার রিং হতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন ফোনটা রিসিভ করল। বেলী ঠিক চিনল না গলার স্বরটা। তবুও অন্য কিছু না জিজ্ঞেস করে সোজা জিজ্ঞেস করল,
“তানিশা। তানিশা কই? তানিশাকে একটু দিবেন প্লিজ।”
কিন্তু পাল্টা উত্তরে ভেসে আসল। এক দুঃসংবাদ। যা সহ্য করার ক্ষমতা বেলীর নেই। দুই মিনিট নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারল না। ঘুরে পড়ে গেলো নিচে। শুরু হলো এক নতুন লড়াই। মেয়েটা কী পারবে সব সামলে নিতে?

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here