#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_আঠারো
“সামান্য কয়টা টাকার লেইগা আমার বাপ-মা আমারে অন্য একটা পোলার কাছে বেইচা দিলো। আমার ভালোবাসারে কাইড়া নিলো। আমার সব স্বপ্ন শেষ কইরা দিলো। সেই বাপ-মা রে আমি কোনোদিন মাফ করুম না। কোনোদিন না। তোমরা আমার ভালো চাইতে গিয়া, আমার সব শেষ কইরা দিলা আব্বা-আম্মা। তোমাগো রে ক্যামনে মাফ করুম?”
তানিশা পাগলের মতো প্রলাপ করে কথাগুলো বললো। এর মধ্যে রুমে ঢুকলো শাকিল। তানিশাকে এমন করে কাঁদতে দেখে, অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো,
“কাঁদছো কেনো?”
প্রশ্নটা শুনে তানিশার শরীর রাগে তেতো হয়ে উঠলো। চোখের পানিটুকু তড়িঘড়ি করে মুছে নিতে নিতে বললো,
“কাঁদছি কেনো? আপনি জানেন না। নাকি জেনে বুঝে আমার কা’টা ঘা’য়ে নুনের ছিটে দিতে আসছেন?”
শাকিল তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে উঠলো,
“তুমি কেনো কাঁদছো? কি কারণ? এইসব জেনে আমার কাজ নেই। এখন তুমি আমার স্ত্রী, আমি তোমার স্বামী এইটাই সত্যি। এর বাইরে আর কিছু জানার ইচ্ছে নেই আমার। আর হ্যাঁ, এইসব ন্যাকামি অন্য কারোর সামনে দেখাবে, আমার সামনে না। বিরক্ত লাগে।”
বলে তানিশাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। তানিশা বুঝে গেছে এখানে ওর শান্তি নেই, শান্তি থাকবে কি করে এই ছেলেটাকে ও খুব ভালো করে চিনে। এই ছেলেটা কোনোদিন কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসতে পারেনা। একাধিক মেয়ের সাথে ওর সম্পর্ক আছে। বিয়ের পরেও পরকিয়া করে হাতেনাতে ধরা পড়ায়, আগের স্ত্রী ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে। সব জানা স্বত্তেও ওর বাবা-মা ওকে এই বিয়ে করতে বাধ্য করলো। কথাগুলো ভেবেই তানিশা পুনরায় ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলো। জীবনের সব শান্তি হয়তো আজকেই শেষ হয়ে যাবে।
—
রাত ১২টা। ইশু, মেরিনা, বেলী সবাই মিলে ড্রয়িং রুমে বসে হরর মুভী দেখছে। কিছুক্ষণ পর পর ভয়ে পেয়ে সবাই একসাথে জোরে চিৎকার করে উঠছে।অন্ধকার রুম, বাইরে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। এই অনুভূতিটা মন্দ লাগছেনা বেলীর। বিকেলে এসে সবাই মিলে হাতে হাতে সব গুছিয়ে নিয়েছে। রিতা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর ওরা তিনজন মিলে চানাচুর খেতে খেতে হরর মুভী দেখছে। খুবই ভয়ঙ্কর একটা সিন চলছে এই মুহূর্তে। ওরা তিনজন জোরাজুড়ি করে বসে আছে। হঠাৎ করে টিভির থেকে ভয়ঙ্কর শব্দ ভেসে আসতেই ওরা তিনজন, এবার আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠলো। ইশু আর মেরিনা বেলীকে এত জোরে জড়িয়ে ধরে আছে যে, বেলীর দম ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে। বেলীর কাঁধে মুখ গুঁজে ইশু ভয়ার্ত স্বরে বলতে লাগলো,
“আমি আর দেখবনা। বন্ধ কর প্লিজ, প্লিজ। ভয় লাগছে খুব।”
এবার মেরিনাও বললো,
“আমিও দেখবনা। অফ করে দে বেলী। খুব ভয় লাগছে। কি ভয়ঙ্কর চেহারাটা! ও মাগো বাঁচাও।”
ইশু এবার বিলাপ করে বলতে লাগলো,
“ও আম্মু, ও ভাইয়্যু, ও ফুপ্পি গো বাঁচাও। ”
ওদের দুজনের কান্ডে বেলী কি রিয়েকশন দিবে, ভুলে গেলো। এই সাহস নিয়ে ওরা নাকি হরর মুভী দেখতে বসেছে। ভাবা যায়? বেলী যে ভয় পাচ্ছেনা, তা না। কিন্তু প্রকাশ করছেনা। ওদের দুজনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে, ওদের ধমকে বলতে লাগলো,
“আল্লাহ গো! মা*ইরা ফেলবি নাকি আমারে? এমন জোরে কেউ ধরে! ম*ইরা যামু তো আমি। এই সাহস নিয়া হরর মুভী দেখতে বসছোস তোরা? ”
ইশু আর মেরিনা কিছু বলতে যাবে, তখনি রুমের দরজায় দিকে কারোর পায়ের শব্দ পেলো। এবার বেলীরও টনক নড়লো, ইশু আর মেরিনা দুজন দুজনকে ঝাপটে ধরে একসাথে চেঁচিয়ে উঠলো,
“ভূত, ভূত, ভূত”
মেরিনা বললো,
“জোরে জোরে সবাই পড়, ‘লা-ইলা-হা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতুম মিনায-যোয়ালিমিন’।”
মেরিনা আর বেলী জোরে জোরে দোয়া পড়তে লাগলো। আর ইশু জোরে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
“ও ফুপ্পি গো, বাঁচাও। ফুপ্পি গো, আমার বিয়ে হয়নাই। আমি এত তাড়াতাড়ি ম*রতে চাইনা। আমারে বাঁচাও ফুপ্পি। আমি আর জীবনে ভূ’তের মুভী দেখবনা ফুপ্পি, বাঁচাও।”
বেলীর মন চাচ্ছে নিজের মাথাটা দেয়ালে ঠুকে দিতে। এই মেয়ে ম-রতে ম-রতেও বিয়ের কথা চিন্তা করে। মেরিনা বিরক্তির স্বরে বলে উঠলো,
“থা-প্পড়াইয়া তোর বিয়ার ভূ’ত মাথার থেকে নামাব।”
ইশু ওরে পাল্টা ধমক দিয়ে বললো,
“তুই চুপ কর। তুই আমার কষ্ট কি বুঝবি? আমার কত শখ, কত স্বপ্ন জানস? আমি বিয়েতে লাল শাড়ি পড়ব, পার্লারে সাজবো, হাজারটা সেল্ফি তুলব, আর ‘মুঝে সাজান কে ঘার জানা হে’ গানে নাচবো। এখন যদি ম*ইরা যাই, তাইলে আমার সব স্বপ্ন ভেঙে ঠু-সঠা-স হয়ে যাবে। আ…।”
ইশু আর কিছু বলার আগেই লাইট জ্বলে উঠলো। হঠাৎ লাইট জ্বলে উঠায় ওরা তিনজনেই আবারো ভয় পেয়ে জড়োসড়ো হয়ে চিৎকার করে উঠলো। তখনি, ওদের কানে ভেসে আসলো,
“আরে আমি, ভয় পাচ্ছিস কেনো?”
পরিচিত কন্ঠশুনে ওরা তিনজনেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। সামনে তাকিয়ে দেখলো রিতা দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েগুলো ভূ’তের মুভী দেখতে বসে যে, এমন চিৎকার, চেঁচামেচি করবে তা সে আগের থেকেই জানতো। বেলী শান্ত স্বরেই বললো,
“মা, তুমি। আর এই ছা’গল দুইটা ভয় পেয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিলো।”
“এহহ, তুই যেমনে বলছিস। মনে হয়, তুই একদম ভয় পাসনি।”
ইশুর কথায় বেলীর মুখটা চুপসে গেলো। আমতা আমতা করতে লাগলো। ওদের কান্ড দেখে রিতা হাসতে লাগলো। একেকটা পুরো পাগল। মেরিনা ইশুর কানে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
“ইশু, এটা সত্যি ফুপ্পি তো? দেখ কেমন করে হাসছে। ভূ’ত আবার ফুপ্পি সেজে আসেনি তো ”
মেরিনার কথা শুনে ইশু ভয়ে বারকয়েক ঢোঁক গিললো। একবার ভয়ার্ত চোখে রিতার দিকে তাকালো। দেখলো, রিতা হাসছে। এবার ইশুর মাথায়ও উল্টা-পাল্টা চিন্তা আসতে লাগলো। ইশু আর মেরিনা দুজনে দুজনের হাত ধরে আছে। রিতা ওদের দিকে এগিয়ে আসার জন্য পা বাড়াতেই, ইশু জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“এই একদম কাছে আসবেনা। একদম আসবেনা। তুমি আমাদের ফুপ্পি না। তুমি ভূ.ভূ.ভূ.ভূ.ভূ…।”
শব্দ বের হচ্ছেনা ইশুর গলা থেকে। সে তোতলাতে তোতলাতে ভূ.ভূ করেই যাচ্ছে। তা দেখে মেরিনা ওর মাথায় গাট্টা মে*রে বলে উঠলো,
“ভূ.ভূ না গা-ধি বল ভূত।”
“ওই একি আমি ভুলে গেছিলাম।” ইশু মুখ বাঁকিয়ে বললো। তা দেখে মেরিনা ভেংচি কে’টে বললো,
“ভুলে যাসনি। বল যে ভয় পেয়ে তোতলাচ্ছিস।”
এদিকে ওদের দুজনের কথা শুনে বেলী আর রিতা অবাকের শেষ সীমানায়। মেয়েগুলো বলে কি? রিতা ধমকে বলে উঠলো,
“এই কি ফিসফিস করছিস তোরা দুইটায়?”
মেরিনা রিতার কন্ঠশুনে আরো ভয় পেয়ে বলে উঠলো,
“তুমি আমাদের ফুপ্পি না আমি জানি, তুমি আমাদের ভয় দেখাতে আসছো ফুপ্পি সেজে।”
বেলী এবার বিরক্তির স্বরে বললো,
“কি উল্টাপাল্টা কথা বলছিস? ”
বেলীর কথা শুনে মেরিনা আবার বলে উঠলো,
“সত্যি বেলী, তুই জানস না? ভূ’তেরা ভয় দেখাতে একেকসময়, একেক জন সাজে। ফুপ্পি তো ঘুমিয়ে আছে, তাহলে এখানে কি করে আসবে?”
রিতা এবার ওদের দুজনকেই রাগান্বিত কন্ঠে বললো,
“একটা থা’প্পড় মা*রব। ফা*জিল মেয়ে কোথাকার। আমি ভূ’ত! আমি ভূত সেজে এসেছি, তোদের ভ’য় দেখাতে? কিসব কথা! আজকের পর তোদের সবার হরর মুভী দেখা বন্ধ। ঘুমাতে যা এবার, নয়তো সবগুলার কপালে শনি আছে। এই বলে দিয়ে গেলাম।”
বলে বেরিয়ে গেলো। রিতা চলে যেতেই মেরিনা অবাক স্বরে আনমনেই বললো,
“এটা তাহলে, সত্যিকারের ফুপ্পি ছিলো। ”
ওর কথায় বেলী আর ইশু একসাথে জোরে চেঁচিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, এটা সত্যিকারের ফুপ্পি।”
ওদের দুজনের চেঁচানোতে মেরিনা কেঁপে উঠলো। আর বেলী আর ইশু হাসতে লাগলো। আর মেরিনা মুখ গুমড়া করে রইলো। ইশু আর বেলী মেরিনাকে দুইদিক থেকে জড়িয়ে ধরে ছন্দে ছন্দে বলতে লাগলো,
“মুখ ভার করোনা,
একটুখানি হাসোনা
এমনে থাকলে দিব কি’ল,
তুমি নেবে ঝাকানাকা ফিল….”
বলেই ওরা দুজন মেরিনার পিঠে ধুম করে কি*ল বসিয়ে দিলো। এই অদ্ভুত লাইনগুলো ওরা নিজেরাই বানিয়েছিলো। যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে তখন। লাইনগুলোর আগামাথা নেই ঠিকি, কিন্তু ওদের কাছে খুব প্রিয়। যখনি এই তিনজনের কেউ একজন মুখ ভার করে, তখনি তাকে হাসানোর জন্য এই লাইনগুলো ছন্দে ছন্দে বলে। ওদের দুজনের কি*ল খেয়ে মেরিনা ওদেরকে বালিশ দিয়ে মা-রতে লাগলো। অতঃপর তিনজনে মিলে শুরু করে দিলো বালিশ দিয়ে মা*রামা*রি। প্রায় অনেকক্ষণ পর ইশু ক্লান্ত হয়ে বললো,
“আর পারবনা। ক্লান্ত হয়ে গেছি। ঘুমে ধরছে বহুত।”
“হ্যাঁ, আমারও ঘুম পাচ্ছে।” মেরিনাও ইশুর তালে তালে বললো। তারপর তিনজনে মিলে একসাথে জোড়াজুড়ি করে ঘুমিয়ে পড়লো। আসলে কাজিনদের আড্ডার মতো সুন্দর আর কিছু হয়না। একসাথে সব কাজিন একত্রিত হওয়া মানে পুরো বাড়ি মাথায় করে রাখা। ওরা দুজন ঠিকি কয়েক মিনিটের মাথায় ঘুমিয়ে গেলো। কিন্তু বেলীর ঘুম আসছে না। একদিকে তানিশার জন্য অনেক চিন্তা হচ্ছে। আরেকদিকে, নীলাভ্রকে বড্ড মিস করছে। ফোনটা বেডসাইডের টেবিলের উপর থেকে নিয়ে, হোয়াটস অ্যাপে ঢুকলো। নীলাভ্রর অনেকগুলো ম্যাসেজ ভেসে উঠলো। ম্যাসেজগুলো পড়ে হাসি ফুটলো বেলীর মুখে। বেলী ম্যাসেজ দিলো,
“মিস করছেন খুব?”
সাথে সাথে ম্যাসেজটা সিন হয়ে গেলো, দেখে বেলীর মুখ ‘হা’। এখন প্রায় একটা বাজে। ছেলেটা এখনো জেগে আছে? সাথে সাথে ম্যাসেজ আসলো,
“এখন আসার সময় হলো তোর? এ বাড়ি থেকে গিয়ে, বেশি সাহস হয়ে গেছে তাইনা।”
লেখার শেষে দুইটা রাগের ইমুজি দেওয়া, তা দেখে বেলীর বুঝতে দেরি হলোনা, নীলাভ্র রেগে আছে। বেলী উত্তর দিলো,
“রাগ করছেন কেনো?”
“তাহলে কি নাঁচবো?” নীলাভ্রর ঝটপট উত্তর।
“এখনো জেগে আছেন কেনো?”
বেলীর প্রশ্নে হয়তো নীলাভ্রর রাগটা ধুয়ে গেলো। ওপাশ থেকে উত্তর আসলো,
“তোকে খুব মিস করছি বেলীপ্রিয়া। আমার বাড়িটা শূন্য লাগছে। চারদিকটা তোর শূন্যতায় খাখা করছে। তোকে ছাড়া কেমন বিদঘুটে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।”
নীলাভ্রর উত্তর শুনে বেলীর মুখে অজানা কারণে হাসি ফুটলো। উত্তর দিলো,
” বেলীপ্রিয়া তার নীলাভ্রকে খুব মিস করছে, জানেন আপনি?”
নীলাভ্রর উত্তর আসলো,
“আর বেশিদিন মিস করতে হবেনা। খুব শিঘ্রই নিয়ে আসব তোকে। একদম বউ করে, লাল টুকটুকে পুতুল সাজিয়ে নিয়ে আসব। তারপর তোকে বুকে জড়িয়ে শান্তিতে ঘুমাব। পৃথিবীর সব বিষাদ ভুলে গিয়ে শুধু তোকে অনুভব করব সারাক্ষণ। ”
বেলীর মুখটা লজ্জায় ভরে উঠলো। উত্তর দিলোনা। বেলীকে চুপ থাকতে দেখে নীলাভ্র হুট করে ম্যাসেজ দিলো,
“ভালোবাসি বেলীপ্রিয়া।”
“আমিও” বেলীর ছোট্ট উত্তর দেখে। নীলাভ্রর উত্তর আসলো,
“আমিও কি?”
“ভালোবাসি” কথাটা খুব কষ্টে লিখলো বেলী। অনুভূতিতে হাত পা কাঁপছে। নীলাভ্রর পাল্টা প্রশ্ন,
“কাকে ভালোবাসিস।”
“আপনাকে। বেলীপ্রিয়া তার নীলাভ্রকে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে।
বেলীর সোজা, শান্ত স্বীকারোক্তি। ভালোবাসা সুন্দর। যে ভালোবাসতে জানে, সে দূর থেকেও ভালোবাসতে জানে।
#চলবে
[গল্পটা তো সুখ দুঃখ মিলিয়েই। প্রথম থেকেই বলছি। অথচ, আপনারা শুধু দুঃখটাই দেখছেন। আমার উপর আস্থা রাখুন। ভালো কিছু হবে।]