তুমি আসবে বলেছে হৃদয় পর্ব ১১

0
550

#তুমি_আসবে_বলেছে_হৃদয়
#পর্ব-১১
#মেঘলা_আহমেদ(লেখিকা)

বিশ্বাস শব্দটা ভারী আজব। আমরা যাকে বিশ্বাস করি সেই বিশ্বাস নিয়ে খেলা করে। আর যে বিশ্বাসের যোগ্য, তার দিকে ঘুরেও তাকাই না। আমরা সবসময়েই প্রথমে ভূল সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তীতে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েও দ্বিধাগ্রস্ত থাকি‌। আমরা যে মানুষ টাকে বড্ড ভালোবাসি, তার থেকে পাওয়া প্রতারণায় আমাদের মনটা পাথর হয়ে যায়। পরবর্তীতে কাউকে ভালোবাসতে গেলেই মনে হয়, আবার ঠকবো না তো? এরিকের নিজের দু চোখ কে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। ভাই সমতুল্য প্রিয় মানুষটার থেকে প্রতারণা সে নিতে পারছে না। এভাবে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করে? পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই। কিন্তু এরিকের বাচ্চাদের মত কাঁদতে ইচ্ছে করছে। হামাগুড়ি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ইথান কে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে সে কেন এমন করলো? একটুও কি তার বুক কাঁপেনি? একবারো এই মানুষ গুলোর কথা কি ইথানের মানসপটে ভাসেনি। এরিক ছলছল চোখে ইথানের দিকে তাকালো। তার চোখে পানি চিকচিক করছে। কেবিনে অন্য সবাই নিরবতা পালন করছে। তারা এরিক কে সময় দিচ্ছে নিজেকে সামলানোর। এরিক ছোটবেলা থেকে ইথান কে বড় ভাইয়ের মত সম্মান করেছে। বিশ্বাস, ভরসা ও ভালোবাসায় এরিকের মনে সর্বদা ইথানের স্থান পরিপূর্ণ ছিল। এরিক বাচ্চাদের মত ঠোঁট ফুলিয়ে ইথানের হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে ভাঙ্গা গলায় বলল-

-” ব্রো!

এরিকের একটুখানি কথায় যেনো সবাই কেঁপে উঠলো। কিন্তু প্রতারক ইথানের তেমন কোন পরিবর্তন হলো না। সে বুঝতে পারলো না এরিকের মনের অবস্থা। সে কি আদৌও বুঝতে পারছেনা তার এই কাজে ছেলেটার মনে ভাঙচুর হচ্ছে? ফেলিক্স ও নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে ফিওনা আর ইথানের দিকে। সে কল্পনাতেও ভাবেনি তার ভালোবাসার প্রেয়শী এমন ধোঁকা দিবে। সে ভালোবাসার মানুষটির থেকে এত বড় প্রতারণা কোন ভাবেই মানতে পারছেনা। তবুও কাউকে কিছু বুঝতে দিচ্ছেনা। আর ইথান! সে তো ফেলিক্সের বেষ্টফ্রেন্ড ছিলো। সে কি করে পারলো এভাবে প্রিয় বন্ধুর পিঠ পিছে ছু|ড়ি মা|রতে? ফেলিক্স একটা ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করলো। সে দেখতে চায় এরিক কি করে? ইথানের থেকে কোন উত্তর না পেয়ে এরিক আবারো ইথানের হাত ধরে বলে-

-” ব্রো ওরা কি বলছে এসব? তুমি বলনা এসব মিথ্যা। ওরা সবাই ভুল বলছে তাইনা। আমি তো তোমাকে অনেক ভালোবাসি ব্রো। তুমি কেন আমাকে মা|রতে চাইবে? তুমি তো আমাকে অত ভালোবাসো। তুমি কেনই বা রিদিশা কে মা|রতে চাইবে? তুমি কি জানো আমি তোমাকে যেমন ভালোবাসি। আমি রিদিশা কেও অনেক ভালোবাসি। তুমি কেন আমার ভালোবাসা কে মা|রতে চাইবে। ওরা ভূল বলছে বলো তাইনা? তুমি কি আমাদের ক্ষতি চাইতে পারো? ও ব্রো বলনা ওরা সবাই তো মিথ্যা বলেছে তাই না?

ইথান নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারলো না। ঝাড়ি দিয়ে এরিকের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। এরিক কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো‌। উপস্থিত সবাই আঁতকে উঠলো। ফেলিক্স ছুটে গিয়ে জাপটে ধরলো এরিক কে। ইথান রেগে গিয়ে বলে-

-” না না সব সত্য। কিছুই মিথ্যা না সব সত্য। আমি তোকে আর রিদিশা কে দুইটাকেই মা|রবো। এরপর ফেলিক্স বাঁধা হলে তাকেও সরিয়ে দেবো। যেমন সরিয়েছি লিও আর পেটার কে। এত বছর ধরে অপেক্ষা করেছি এই প্রপার্টির জন্য। আমি আর নাটক করতে পারছিলাম না। ভেবেছিলাম ফিওনা কে দিয়ে তোকে হাত করে প্রপার্টি ওর নামে লিখিয়ে নেবো। এরপর ওর থেকে প্রোপার্টি নেয়া কোন ব্যাপারই না। যদি ভালোয় ভালোয় না দিতো মে|রে দিতাম। প্রথমে ছোট ঝামেলা দুটোকে সরিয়েছি, এখন বড় গুলো কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এরিক সহ উপস্থিত সবাই যেনো বাকহারা হয়ে গেলো। মিসেস এলিজার বুকটা হাহাকার করে উঠলো। তার আদরের ছোট ছেলে লিও কে এই ইথান খু|ন করেছে! এটা মানতে তার কষ্ট হচ্ছে। নিজের প্রিয় বান্ধবীর ছেলেকে নিজের ছেলেদের মতোই ভালোবাসতো সবসময়। আর সেই কিনা লোভে পড়ে এত ক্ষতি করলো! ফেলিক্স আর পারলো না নিজেকে সামলাতে। ছোট ভাই হারানোর কষ্টটা যেন তাজা হয়ে উঠলো আবারো। সে এরিক কে ছেড়ে গিয়ে ইথানের কলার চেপে ধরলো। মুখ বরাবর একটা ঘু|ষি দিয়ে বলল-

-” তোর এত লোভ ইথান! তুই আমার ভাইটাকেও ছাড়লি না। পেটার আমার ছোট ভাইটা কি দোষ করেছিলো। যে তুই ওকে মে|রে দিলি। যখন মম চিৎকার করে পেটারের জন্য কাঁদছিল, গিয়ে কত নাটক টাই না করলি। আর লিও তো এরিকের ছোট ভাই ছিলো। ঐ ছেলেটা কেও ছাড়লি না। তুই মানুষ না তুই একটা জানোয়ার। তোকে আমি মে|রেই ফেলবো বাস্টার্ড। তোর জন্য আজও আমার মামিমা আর মা শান্তিতে একটু ঘুমাতে পারেনা। তাদের ছোট ছেলে হারানোর কষ্টটা আজো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তুই কি করে আমাদের ফুলের মত ভাই দুটোকে মা|রলি। তুই কোন সুস্থ মানুষ না।

ফেলিক্স নাক বরাবর ঘু|ষি মা|রে আবারো। ইথান ছিটকে পড়ে। এরিক গিয়ে ফেলিক্স কে ধরে। ফেলিক্স কে কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। সে আজ হিং|স্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু ইথান প্রতিঘাত করছে না কেন? এরিক ফিওনার দিকে তাকায়। ফিওনা এরিকের তাকানো দেখে ভয়ে সিটিয়ে গেলো। চোখদুটো বন্ধ করে সে গড কে স্মরণ করে। এরিক ঠান্ডা কন্ঠে বলে-

-” ফিওনা! তুমি কেন আমার ভাই কে ঠকালে? তুমি তো এমন ছিলেনা? এত লোভী কি করে হলে? ইথানের ছলনায় পড়ে তুমি ফেলিক্স ভাইয়ার সাথে ছলনা করলে। আমি কখনো ফেলিক্স ভাইয়া কে অতটা সম্মান করিনি, যতটা আমি ইথান কে করেছি। ফেলিক্স আমার নিজের ফুফাতো ভাই, কিন্তু আমি তাকে অতটাও ভালোবাসিনা যতটা আমি র|ক্তের সম্পর্ক ছাড়াও ইথান ভাইকে ভালোবাসি। ইথান ভাইয়া তুমি এই প্রতিদান দিলে? ফেলিক্স ভাইয়া তো সবসময় আমার ভালো চেয়ে এসেছে। অথচ আমি তাকেই সহ্য করতে পারতাম না লিওর মৃত্যুর পর থেকে। আমি ভাবতাম লিওর মৃত্যুর পেছনে ফেলিক্সের হাত আছে। কিন্তু কেই বা জানতো আমি দুধ দিয়ে কাল সাপ পুষেছি। ফেলিক্স ভাইয়া আমার আসল শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল কিন্তু আমি ইথানের মত ঠকবাজ কে বিশ্বাস করেছি। ফিওনা তুমি এত নিচ, ভালোবাসা কিভাবে ভুলে গেলে। ফেলিক্স ভাইয়ার ভালোবাসায় কোন খাদ ছিলো না। কথা ছিলো ফেলিক্স ভাইয়া আমেরিকা থেকে ফিরে এলে বিয়ে করবে তোমরা। অথচ তুমি দুদিনেই এই মানুষটার ভালোবাসা ভুলে বসলে। আসলেই কি দুদিনে ভুলেছো? নাকি তাকে ভালোবাসাটাই তোমার অভিনয়ের একটা অংশ।

ফিওনা কেঁপে উঠলো। সে তো আসলেই কখনো ফেলিক্স কে ভালোবাসেনি। সে ইথানের কথাতেই নেচেছে সবসময়। ফিওনা ফেলিক্সের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। হাজারো অভিযোগ তার চোখে। মিসেস এলিজা সেন্সলেস হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে এলেন, ময়ূরী বাসায় চলে গিয়েছে। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছে ইথান আর ফিওনা কে পুলিশে দিতে। এরিকের বাবা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তার কলিজার টুক|রা ছেলেটাও ছাড় পায়নি ইথানের লোভ থেকে। ফেলিক্স যদি না থাকতো তাহলে হয়তো এরিক কেও অকালে হারাতে হতো‌। ইথানের নিরবতা ভাবিয়ে তুলছে এরিক কে। এরিক ঘড়িতে টাইম দেখলো। অফিস টাইম কবেই পেরিয়ে গেছে রিদিশা এখনো অফিসে আসেনি কেন? এরিক কে চিন্তিত দেখছ নিরব ইথানের মুখে পৈশাচিক হাসি ফোটে। এরিক ফেলিক্স কে চিন্তিত গলায় বলল-

-” ফেলিক্স ব্রো রিদিশা এখনো অফিসে আসেনি আমার চিন্তা হচ্ছে।

ইথান নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে শব্দ করে হেসে ওঠে। ফেলিক্স আর এরিক তীক্ষ্ণ চোখে ইথানের দিকে তাকায়। ফেলিক্সের বিচক্ষন মস্তিষ্ক অনেক কিছুই বুঝে ফেলে। সে ক্ষেপে গিয়ে ইথানের কলার আবারো চেপে ধরে। রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞাসা করে-

-” বল রিদিশার সাথে কি করেছিস? ওকে কোথায় রেখেছিস? ওর কোন ক্ষতি করবিনা। তোকে জানে মেরে দেবো।

ইথান হাসিমুখেই বলল-

-” যা পারলে বাঁচা ওকে। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের কাছাকাছি আছে কোথাও। লোকেশন ও বলে দিলাম। তোদের জন্য বাচ্চা মেয়েটাকে না জীবন দিতে হয়। ভাবতেই আমার কষ্ট হচ্ছে।

ইথান মুখ দিয়ে চু চু জাতীয় শব্দ করলো। এরিক আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না। রেগে গিয়ে ইথানের পেটে লা|থি দিলো। চেঁচিয়ে বলল-

-” তুই কারো ক্ষমা পাবারো যোগ্য না। আমাদের মধ্যে ভীনদেশী একটা মেয়েকে টেনে বড্ড ভুল করেছিস। তোকে এর মাসুল দিতে হবে। বাবা ওকে পুলিশের কাছে দিবে না। ওকে আর ঐ ফিওনাকে আমার ভ্যালিতে নিয়ে যাও। ওখানেই সব বোঝাপড়া করবো। ফেলিক্স ভাইয়া তুমি আমার সাথে যাবে।

ফেলিক্স দ্রুত মাথা দুলিয়ে সায় দিলো। এত মিষ্টি একটা মেয়েকে না জানি ওরা কি অবস্থা করেছে। দুজনে দ্রুত জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। ইথান ক্রুর চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here