#তুমি_আসবে_বলেছে_হৃদয়
#পর্ব-৭ + ৮
#মেঘলা_আহমেদ
চারদিকে নিরবতায় ঘেরা। দু’জনের মুখে ঝলমলে হাসি। একজনের মুখে রাজ্যের আঁধার। তার আঁধার মুখের জন্যে,বাতাসেও যেন দুঃখ দুঃখ ভাব। রিদিশা নিয়ম মাফিক ভদ্রভাবে দাঁড়িয়ে গেল। বিনম্র কন্ঠে হাসিমুখে নিরবতা ভেঙ্গে বলল-
-” স্যার কেমন আছেন?
দরজার ওপাশের ব্যক্তি প্রসন্ন হাসলো। তার ঠোঁটের কোণের হাসিটা কারো কাছে ভালো ঠেকলো না। ফেলিক্স স্ব-শব্দে নিঃশ্বাস ছাড়লো। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জবাব দিল-
-” আমি ভালো আছি। কিন্তু তুমি এখানে কেন? তুমি তো ইথানের কেবিনে ছিলে!
এরিক এতক্ষনে ক্ষে|পে গেলো। তাঁর বাবার অফিস। ভবিষ্যতে তাঁরই হবে। তার স্টাফ রা কে কোথায় থাকবে এটা জিজ্ঞেস করার উনি কে? নিজের রাগ কে সংযত করে যাচ্ছে এরিক। এতদিনের কষ্ট মাটিতে মিশিয়ে দিলে চলবেনা। তিল তিল করে সব সাজিয়েছে। মনের কুঠুরিতে পরম যত্নে ধীরে ধীরে একটি ছবি এঁকেছে। দুইজনে মিলে সবকিছু প্ল্যান করেছে। কত কষ্ট করেছে এই কটা বছর। এই দুইটা বছর কাছে থাকতেও সে মনমতো দেখতে পারেনি। ছুঁতে পারেনি। এই উটকো রাগের কাছে সেই সব কষ্ট বৃথা যেতে দিবে না সে। রিদিশা প্রশ্নটা শুনে ঘা|বড়ে গেছে। কি উত্তর দিবে। এরিক যে নিজের ইচ্ছেমত তাকে এখানে এনেছে, সেটা বলে দিবে? ফেলিক্স একটা চেয়ার টেনে আয়েশ করে বসলো। সে উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে। এরিক ঝলমলে একটা হাসি দিয়ে, চ|তুর ভাবে বলল-
-” আরে ব্রো তুমি কবে দেশে এলে? তুমি না বললে আর ফিরবে না। কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?
ফেলিক্স সন্দেহের দৃষ্টিতে এরিকের দিকে তাকালো। তার কথা এড়িয়ে গেল কেন? তাকে তো এরিক নিজেই জোড় করে পাঠিয়েছিল। এরিক নিজেই যখন অফিসে এলো, তাহলে তাঁর বাবা কেন আমায় এত অনুনয় বিনয় করে দেশে ফিরালো। কি চলছে এদের মাঝে। পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট চেঞ্জ করে ফেলেছে। রিদিশা মেয়েটা খারাপ নয়, যথেষ্ট দায়িত্ববান। তবুও কেন এই কদিনে এতকিছু উল্টোপাল্টা হলো। আমি কি কোন রহস্যে আটকে যাচ্ছি? ফেলিক্স কে চিন্তায় বুঁদ হতে দেখে, এরিক আবার শুধালো-
-” হেই ব্রো কি, কই হারালে?
ফেলিক্স চমকে উঠলো। নিজের ভাবনা জগৎ থেকে ছিট|কে বেরিয়ে এলো। নিজেকে ধাতস্থ করে ফিচেল হাসি দিয়ে বলল-
-” কিছুনা। আর এরিক শোন তোর আর কষ্ট করে কাল থেকে অফিস আসতে হবেনা। আমিই কাল থেকে সব সামলাবো। আঙ্কেল আমাকে এত রিকোয়েস্ট করেছে, যে আমি না এসে থাকতেই পারলাম না। তুই নাকি কাজ ঠিকমত সামলাতে পারছিস না। তোর বাবা তোকে কত ভালোবাসেন। তোর সামান্য কষ্টও সহ্য হয়না তাঁর।
রিদিশা অবাক হলো ভীষণ। এরিক বলেছিল ফেলিক্স নিজেই চলে গেছে কম্পানি ছেড়ে। কিন্তু এখানে তো দেখা যাচ্ছে পুরোই উল্টো। এরিক নিজেই ফেলিক্স কে দেশের বাইরে পাঠিয়েছে। আবার তার বাবা কেন ফিরিয়ে আনলো ফেলিক্স কে। বড়সড় কিছু চলছে এদের মাঝে হয়তো। নাহলে নিজেরা এত ঝামেলা কেন করবে? ফেলিক্সের কথাগুলো শুনে প্রচন্ড মাত্রায় রাগ উঠছে এরিকের। তার বাবা এই কাজ করেছে। ফেলিক্স অফিসে থাকলে সে কিছুতেই সব ঠিকঠাক করতে পারবেনা। বাবা এত বড় সর্ব|না|শ কেন করলো? আমার অফিসে আসতেই হবে। না হলে আমার সব শেষ হয়ে যাবে। এরিক কি করবে কিছু ভাবতে পারছেনা। রিদিশার মুখের দিকে তাকালো এরিক। কি নির্মল কোমল একটা মুখ। মেয়েটা যেনো কি ভাবছে। সেও কি আমার মত এই রহস্যের সুরাহা করতে চাইছে। ফেলিক্সের হাবভাব ভালো ঠেকছে না। উত্তর না দিয়ে চুপ হয়ে যাচ্ছে কেন এরিক বারবার। ফেলিক্স একটু দেখার জন্য বলল-
-” আচ্ছা এরিক তোর রিদিশা আপির সাথে এই কদিন কেমন কাজ করলি?
এরিক উদ্ভট দৃষ্টিতে তাকালো ফেলিক্সের দিকে। ফেলিক্সের চোখে অসীম কৌতুহল। এরিক নিজের চিন্তিত ভাবটা প্রশ্রয় দিল না আর। মুখটা এবার স্বাভাবিক করে বলল-
-” ভালোই। রিদি অনেক ভালো মেয়ে। আর তার কাজের দক্ষতাও ভালো।
ফেলিক্স খোঁচা মে’রে বলে-
-” রিদি কেন বলছিস। তোর সিনিয়র হয়। আপু বলে ডাকবি।
রিদিশা আর চোখে এদের প্রশ্ন উত্তর দেখে যাচ্ছে। সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এরিক একবার রিদিশার মুখটার দিকে তাকায়। এই মুখে তাকালেই যেনো হাজার প্রশান্তি অনুভুত হয়। বাঁকা হাসিতে কথা ছো|ড়ে এরিক-
-” দেখো ব্রো। কম্পানিতে আমি পদে তার সিনিয়র। এখানে বয়সের ব্যাপার টা টানছো কেন তুমি? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি তার বস, সো তাকে আপু ডাকার প্রশ্নই আসেনা।
ফেলিক্স চোখজোড়া স্বাভাবিক ভাবে রিদিশার দিকে ঘুরালো। তার অনেক কিছুই বোঝা হয়ে গেছে। এতদিনে কোথার পানি কোথায় গিয়েছে। এর জন্যই আঙ্কেল এত আর্জেন্ট ডেকেছে। নাকি অন্য কোন কিছু আছে? ফেলিক্স উঠে দাঁড়ালো। এরিক আর রিদিশাকে উদ্দেশ্য করে বলল-
-” যাইহোক আমি আজকে রেষ্ট নেব। তোমরা থাকো। আর রিদিশা তুমি তো আমাকে চেনো। আই হোপ আমার সাথে কাজ করতে তোমার সমস্যা হবেনা। এরিক কাল থেকে তোর ছুটি। আমি আসি।
ফেলিক্স দরজাটা খুলে চলে গেল। এরিক অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফেলিক্সের যাওয়ার দিকে। রিদিশা এরিকের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলো। জিজ্ঞেস করবে কেন এমন হচ্ছে। চোখগুলো এত লাল কেন হয়ে আছে? এলার্জি সমস্যা আছে নাকি? রিদিশা ভয়ে তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করে-
-” স্যাআআর আপনার চোওওখ লাল হয়ে গেছে কককেন? এলার্জি সমস্যা আছে নাকি?
বিদিশার কথায় এরিকের রাগ তুঙ্গে উঠলো। এতক্ষনের জমিয়ে রাখা রাগ রিদিশার উপরেই ঝাড়বে। এরিক খুব জোড়ে রিদিশাকে ধমক দিলো-
-” এই আপনি বলছো কেন?
ভয়ে কেঁপে উঠলো রিদিশা। কেবিনের বাইরে এই শব্দ গেলে, সিউর সব স্টাফ রা এখানে ভীড় জমাতো। কোন কানা এই ধমক খেলে, কানে শুনতে পাবে সিউর। রিদিশা ভয়ে চুপ করে আছে। তা দেখে এরিক চিবিয়ে চিবিয়ে বলে –
-” খুব মজা লাগছে তাই না? আমাকে তো তোমার সহ্যই হয়না। সারাদিন ফেলিক্স স্যার ফেলিক্স স্যার করতে। নাও চলে এসেছে সে। এবার তোমার শান্তি। আমার এই দুই বছরের কাঠখড় পো|ড়ানো সবকিছুতে পানি ঢেলে দিলো বাবা। আজ বাসায় গিয়ে তার সাথে আমি কথা বলব। কেন নিজের ছেলে থাকতেও অন্যকে কম্পানিতে বসাবে। আমি কি অযোগ্য? এই তোমার কি আমাকে অযোগ্য মনে হয়। আমি একজনের জন্য এতকিছু করেছি। শুধুমাত্র একজনের জন্য। সে কেন আমাকে বুঝেনা? সে কেন অবুঝের মতো করে? কেন কেন? এই দুইটা বছর তার পিছনে পড়ে আছি। সে আমার দিকে ঘুরেও তাকায় না। কত মেয়ের প্রপোজাল আমি রিজেক্ট করেছি। চাইলে কত কত রিলেশন করতে পারতাম। কিন্তু আমি অপেক্ষা করেছি শুধু তার। তাকে আমি হালাল ভাবে চাই। অথচ তার সামনে গেলেই আমার হাত পা অবস হয়ে আসে। তার সাথে কেন আমি স্বাভাবিক হতে পারিনা। আমি তাকে কেন বলতে পারিনা? সে তো অবুঝ নয়। কেন বুঝবেনা আমাকে? এই রিদি বলোনা আমি কি দেখতে খারাপ?
রিদিশা হতবাক হয়ে গেছে। দিশেহারা লাগছে তার। এরিক কে এরকম করে কথা বলতে কখনো দেখেনি। কতটা ভালোবেসে এমন পাগলামো করছে ছেলেটা। রিদিশা কি না ভাবতো এরিক তার উপরে দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এরিক দু’বছর ধরে একজনকে ভালোবাসে। নিজের ভাবনার জন্য নিজেকেই গালমন্দ করে রিদিশা। এরিক কাঙ্ক্ষিত উত্তর না পেয়ে আবারো বেচেইন হয়ে প্রশ্ন করলো-
-” আমি কি সত্যিই দেখতে কুৎসিত? খুব বাজে চেহারা?
রিদিশা তাৎক্ষণিক মাথা দু দিকে নাড়িয়ে না বুঝালো। গলা নরম করে শান্ত হয়ে বলল-
-” তুমি দেখতে খারাপ কেউ কি বলেছে? তুমি তো আমার চেয়েও কত সুন্দর। তুমি হলে সুদর্শন যুবক। আর ভালোবাসা কখনো সৌন্দর্য দেখে হয়না। সুন্দর কত মানুষ ও ভালোবাসা পায়না। আর কুৎসিত চেহারার মানুষের ও ভালোবাসার অভাব হয়না। ভালোবাসা তোমার ভাগ্যে থাকলে পাবে তুমি।
এরিকের চোখ চিকচিক করে উঠলো। রিদিশার হাত ধরে ঝা|কুনি দিয়ে বলল-
-” তাহলে আমাকে কি সে ভালোবাসবে? আমার ভালোবাসা কি সে গ্রহণ করবে? আমি এই কবছর ধরে তাকে দুর থেকে দেখেছি। কখনো সাহস করে কাছে যাইনি। যোগ্যতা অর্জন করেছি। যাতে সে আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করতে পারে। কিন্তু তবুও সে আমার অনুভূতি বোঝার চেষ্টাই করেনা।
রিদিশার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। এভাবে হাত ধরা তার সহ্য হচ্ছে না। রিদিশা হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে বলে-
-” তাকে বলে দাও সরাসরি। বুঝতেও পারে।
এরিক মুচকি হেসে বলে-
-” আচ্ছা তোমার কথাই শুনবো তাহলে। আমি তাকে বলব।
রিদিশা শান্ত হয়ে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা কতটা উদ্ভট। এও নাকি কাউকে পাগলের মত ভালোবাসে। মেয়েটা অনেক লাকি তাইনা? এরিকের মাথায় অন্য ভাবনা। ফেলিক্স কে কম্পানিতে বসতে দেয়া যাবেনা। আমার যায়গায় অন্তত নাই। বাবাকে কিভাবে বুঝাবো? এখন উপায় কি। শত ভাবনার মাঝেই এক বৃদ্ধার চেহারা মানসপটে ভেসে উঠলো। এরিকের চোখে মুখে খুশির জোয়ার বয়ে গেল। মৃদু হেসে বিরবির করে বলল-
-” গ্র্যান্ডমা!
#চলবে
( আসসালামুয়ালাইকুম পাঠকমহল। আপনাদের দোয়ায় আমি মোটামুটি সুস্থ আছি। হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়েছি। এখন ইনশাআল্লাহ নিয়মিত গল্প দেবো। ভুল ত্রুটি আল্লাহর দেয়া মহান গুণ ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আপনাদের মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।)
#তুমি_আসবে_বলেছে_হৃদয়
#পর্ব-৮
#মেঘলা_আহমেদ
কখন থেকে কলিংবেল বাজছে। অথচ কেউ দরজা খুলছে না। এই ভোর সকালে কে এলো। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে বিছানা থেকে উঠে রিদিশা। ছুটির দিনে একটু ঘুমাতেও পারবেনা শান্তি মত। গ্র্যান্ডমা আর গ্র্যান্ড পাপা হয়তো ঘুমোচ্ছে, তাই দরজা খোলা হয়নি। রিদিশা ঢুলতে ঢুলতে নামছে সিঁড়ি দিয়ে। দরজা খুলে একটা ছেলেকে দেখলো রিদিশা। ছেলেটা উল্টো ঘুরে আছে। তা দেখে রেগেমেগে রিদিশা বলল-
-” এই আপনার কি ম্যানার নেই? এত সকালে কেউ কারো বাসায় আসে? আসছেন ভালো কথা এতবার কলিংবেল দেয়া লাগবে কেন? আমার ঘুমের ১২টা বাজানো। আপনাকে তো..
ছেলেটা এদিকে ঘুরতেই রিদিশার পকরপকর অফ হয়ে যায়। মুখটা হা করে তাকিয়ে আছে রিদিশা। এরিক এত সকালে? তার বাসায় কি করছে? সে স্বপ্ন দেখছে না তো? রিদিশার অবাক হওয়া চোখদুটো দেখে ভাবান্তর ঘটলো না এরিকের। সে যেনো জানতো রিদিশাই দরজা খুলবে। সে রিদিশাকে আগামাথা নিরীক্ষণ করলো। তারপর ভ্রু কুঁচকে বলল-
-” আমার ম্যানার আগে ছিলো। একটা মেয়ের জন্য ম্যানারলেস হয়ে গেছি। তা তো তুমি জানোই। বাই দা ওয়ে ইউ আর লুকিং সো হ|ট। এভাবে আমার সামনে এলে। অন্য কেউ হলে কি হতো? এভাবে কারো সামনে যেওনা রিদিমনি। বিনা বাক্যে হার্ট অ্যা|টাক হয়ে যাবে যে কারো। সবাই আমার মত কন্ট্রোল করতে পারবেনা।
এরিক চোখ টিপে দিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে। রিদিশার গা জ্বলে ওঠে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে টি শার্ট আর প্লাজু পড়া। রিদিশা উল্টো ঘুরে দেয় দৌড় উপরে। তাকে আর পায় কে। কি একটা বিব্রতকর অবস্থা। এরিক হাসতে হাসতে বাড়িতে ঢোকে। দরজা লক করে দিয়ে কাঙ্ক্ষিত রুমের দিকে আগাতে থাকে। রিদিশা নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। বুকের হৃদযন্ত্র টা ধ্রিম ধ্রিম শব্দ তুলে কাঁপছে। এই অবস্থায় এরিকের সামনে গিয়েছে ভাবতেই গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা কি না কি ভাবছে? আর যাইহোক এরিক এই বাসায় কেন? সে কি করে জানলো আমি এখানে থাকি। এরিক তো আমাকে দেখে একটু চমকায় নি। ও কি জানে আমি এখানে থাকি? আচ্ছা ও এখানে কেন এসেছে? রিদিশা সাতপাঁচ ভাবনা বাদ দিয়ে, তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে আসে। তারপর ড্রয়িংরুমের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এখন উদ্দেশ্য একটাই। এরিক কি আছে না নেই তা দেখা। থাকলে এখানে কেন এসেছে তার কারণ জিজ্ঞাসা করা। কিন্তু নিচে গিয়ে যা দেখলো তাতে রিদিশা বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। গ্র্যান্ডমা সোফায় বসে বসে কাঁদছে। এরিক নিচে বসে তার কোলে মাথা দিয়ে রেখেছে। মহিলার ফর্সা নাকটা লাল হয়ে গেছে কান্না করার জন্য। কান্নার হিরিকে কেঁপে কেঁপে উঠছে গ্র্যান্ডমা। এরিক নিজেও হালকা কাঁপছে, কিন্তু কোল থেকে মাথা তুলছে না। দৃশ্যটা দেখে রিদিশার নিজের চোখেও পানি এসে গেল কেন জানি। আচ্ছা এরিক গ্র্যান্ড মাকে ধরে এভাবে কাঁদছে কেন? মিসেস ময়ূরীর চোখ পরে রিদিশার দিকে। সে চোখ মুছে হাত বাড়িয়ে রিদিশাকে বাংলায় বলল-
-” এদিকে আয় রিদিশা। ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
এরিক ঝট করে কোলে থেকে মাথা তুলে ফেলে। নিজের চোখের পানি আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করে। যদিও দাদির বাংলা কথা সে বুঝতে পারেনি। তবুও আন্দাজ করা যায় সে রিদিশাকে এদিকে ডেকেছে হয়তো। কান্না করার জন্য চোখদুটো লাল হয়ে গেছে দুজনের। রিদিশা রোবটের মতো এগিয়ে যায় মিসেস ময়ূরীর কাছে। তার পাশে যেতেই তিনি হাত ধরে রিদিশা কে তার পাশে বসায়। এরিক উঠে সামনে পা বাড়ালেই মিসেস ময়ূরী খপ করে তার হাত ধরে ফেলে। এরিক হাতের দিকে তাকিয়ে বলে-
-” গ্র্যান্ড মা আজকে যাই। অন্যদিন আসবো। তোমাকে যা বলেছি ব্যাপারটা দেখবে ভালো করে।
মিসেস ময়ূরী ফোকলা দাঁতে হেঁসে ইংরেজি তে বলে-
-” বিপদে পড়লেই বুঝি দাদিকে মনে পড়ে? তখন গ্র্যান্ডমা গ্র্যান্ডমা করে ছুটে আসো। তার আগে আমার সাথে ফোনেও যোগাযোগ করো না ভাই! একটু থাকনা। তোর দাদুর শরীর টা ভালো না ওনাকে একটু দেখে যা। উনি তোর কথা বলে শুধু। বাবা মায়ের মতো হলি একেবারে। তোর ছোট বোনটা আমাদের কথা মনেই করেনা দেখছি। তুই একটু থাক না হয় আজ। বিকেলে চলে যাবি না হয়।
এরিক দাদির মিনতি আর ফেলতে পারলো না। সত্যিই তো কতশত অযুহাতে এই মানুষ দুটোকে সময় দেয়া হয়নি। অথচ এই মানুষ দুটো না থাকলে হয়তো এই পৃথিবীর আলো দেখা হতো না।এরিক দাদির পাশে গিয়ে বসে। রিদিশার দিকে একবার তাকিয়ে চোখজোড়া ফ্লোরে নিবদ্ধ করে। রিদিশা এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। কথা শুনে তো মনে হচ্ছে এই ভদ্রমহিলাই এরিকের গ্র্যান্ডমা। মিসেস ময়ূরী এবার রিদিশার মাথায় হাত রাখলো। রিদিশার ভাবনার এখানেই সমাপ্তি ঘটে। মিসেস ময়ূরী মিষ্টি হেসে বাংলায় রিদিশাকে বলে-
-” তোকে বলতাম না আমার একটা নাতি আছে। এই যে এরিক তাহসান! ও হচ্ছে আমার সেই আদরের নাতি। আর ওর একটা ছোট বোন আছে এলিনা তাহসান। আমার এই নাতিকে আমি বড্ড ভালোবাসি। তুই ওর সাথে কথা বল আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।
মিসেস ময়ূরী তাহসান কিচেনের দিকে চলে গেল। এই বয়সে এসেও সে নাস্তা নিজে তৈরি করবে। তেজ আছে বলতে গেলে এখনো। এরিক নিজের মধ্যকার দুরত্ব একটু ঘুচিয়ে দিয়ে রিদিশাকে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে-
-” গ্র্যান্ডমা তোমাকে বাংলায় কি বলেছে? আমি না বুঝতে পারিনি। যাষ্ট এলিনার নামটা বুঝেছি! এলিনা আমার ছোট বোন, অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে। তোমাকে একটুও জ্বালাবে না। তোমার সাথে অনেক সুন্দর ব্যবহার করবে দেখো।
রিদিশা চমকে এরিকের দিকে তাকায়। কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে –
-” তোমার বোন আমাকে জ্বালাবে কেন? আমি কি ওর কাছে গিয়ে বসে থাকবো?
এরিক নিজের চোখদুটো বন্ধ করে ফেলে। শীট আবারো ভুল জায়গায় সে ভুল কথা বলছিলো। কন্ট্রোল হারাচ্ছে কেন বারবার। রিদিশা কি কিছু বুঝে ফেলেছে? রিদিশা হা করে এরিকের বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘন পাপড়ি বিশিষ্ট চোখদুটো এত সুন্দর লাগছে। বদ্ধ চোখদুটো খুব করে টানছে রিদিশাকে। ঐ চোখে অধর ছুঁয়ে দিলে কি হবে? ধুর কি উল্টাপাল্টা ভাবছি আমি। ও আমার ছোট ভাইয়ের মত। হুহ। এরিক পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায়। রিদিশা ভ্রু নাচিয়ে বলে-
-” কি বলছো না কেন? তোমার বোন আমাকে জ্বালাবে কেন?
এরিক ঠোঁট কামড়ে কথা সাজিয়ে নেয়। রিদিশার দিকে তাকিয়ে বলে-
-” আসলে কথাটা ওভাবে বলিনি। বলেছি যে আমার বোন এতই ভদ্র যে। যে কেউ তার কাছে গেলে তাকে একটুও জ্বালাবে না। ওটাই তোমাকে উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছি। আচ্ছা গ্র্যান্ড মা তোমাকে তখন কি বলেছে?
রিদিশার এরিকের কথা কতটুকু বিশ্বাস হলো সে জানেনা। তবুও উদাসীন হয়ে ইংরেজি তে বলল-
-” তোমার গ্র্যান্ড মা বলেছে তোমার সাথে কথা বলতে সে নাস্তা নিয়ে আসছে।
এরিক মুচকি হেসে বলল-
-” আওও মাই ডিয়ার সুইট গ্র্যান্ড মা।
মিসেস ময়ূরী একটা ট্রে তে করে কিছু খাবার এনে টেবিলে রাখে। তারপর মুচকি হেসে বলে-
-” হ কাজের সময়েই সুইট গ্র্যান্ডমা তাইনা? আর এমনিতে বুড়ি গ্র্যান্ড মা।
এরিক উঠে তার দাদিকে জড়িয়ে ধরে পেছন থেকে। দাদির গালে একটা চুমু দিয়ে বলে-
-” আরে গ্র্যান্ড মা তুমি সবসময়েই সুইট। গ্র্যান্ডপাপা তোমাকে বিয়ে না করলে আমি নিজেই বিয়ে করতাম তোমাকে। এত সুইট একটা বউ থাকলে আর কি লাগে?
রিদিশা মুখ টিপে হাসছে এরিকের কথা শুনে। মিসেস ময়ূরী তখন মুচকি হেসে বলে-
-” রিদিশাও কিন্তু অনেক সুইট। আমরা বাংলাদেশের সব মেয়েরাই সুইট।
এরিক থতমত খেয়ে গেল দাদির কথায়। দাদির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল –
-” তুমি কি আমাকে মা|রার প্ল্যান করছো গ্র্যান্ডমা? এই মেয়ে এসব শুনলে আমাকে বৃন্দাবন পাঠাবে। তুমি যত মজা করো যাই করো আমারদের দু বছরের কষ্ট মাটিতে মিশিয়ে দিও না প্লিজ।
রিদিশা হাসি থামিয়ে সিআইডির মতো তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। এরা দাদি নাতি কি ফুসুরফুসুর করছে কে জানে? এরিকের কথায় মিসেস ময়ূরী খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে-
-” চিন্তা কইরো না নাতি তীরে এসে তরী ডুবতো না। আমি তরীর রশি ধরে বসে থাকবো।
রিদিশা কথার আগামাথা কিছু না বুঝে, পরীক্ষার খাতার ৭ নং সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর “ঘ” এর হাতের লেখার মতো তাকিয়ে রইলো। তাকে এখানে কমেডি সো দেখাতে বসানো হয়েছে নাকি কে জানে। কতক্ষন তার প্রশংসা করছে। কতক্ষন ফুসুরফুসুর করছে। এরিক মাথা চুলকে একটা হাসি দিয়ে মনে মনে বলল-
-” আমার এই গ্র্যান্ড মাই এখন সব ঠিক করতে পারবে। কিন্তু সে খুশির ঠ্যালায় আমাকে নদীতে ফেলে নিজে নৌকাভ্রমণ না করলে বাঁচি। ফেলিক্স অপেক্ষা করো বাবা তোমার খেল এবার শেষ করবে আমার গ্র্যান্ডমা।
#চলবে