গালে সজোরে থাপ্পড় পড়ার সাথে সাথে সব যেন ঝাপসা দেখলো হিমি। পানি টলমল চোখে তাকালো হিমি তার বাবা হাফিজ আলমের দিকে। হাফিজ আলম মেয়ের দিকে ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে আছে। তারই পাশে শহরের মেয়র শাহাদাত হোসেন অভিক বসে আছে। হাফিজ আলম নাক ছিটকে বলে,–” ছিহঃ এমন মেয়ে আমার কেন হলো এর থেকে নিঃসন্তান হয়ে থাকতাম ভালো হতো অন্তত পক্ষে মানসম্মান হারানোর ভয় থাকতো নাহ।”
বাবার এমন কথা শুনে হিমির বুকে তীরের মতো বিধলো। অভিক ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে আছে সেখানে। হাফিজ আলম অভিকের দিকে তাকিয়ে বলল,–” ক্ষমা করে দিও বাবা এই মেয়ের বাবা হয়ে আমি লজ্জিত।”
অভিক জলদি হাফিজ আলমের হাত ধরে বলে,–” আরে কি বলছেন এসব আপনি আমার বাবার বয়সি ক্ষমা চাচ্ছেন কেন?”
হাফিজ আলম কিছু বলে নাহ নিরবে চোখের জল ফেলতে থাকে। হিমি মাথা নিচু করে বসে আছে। তার পাথরের মতো হয়ে গেছে মনটা না কাঁদতে পারছে না হাসতে পারছে। অভিক আবারও বলে ওঠ,–” আঙ্কেল আমি বাবা মায়পর সাথে কথা বলেছি তারা বলল বিয়েটা কালকে করতে পরে ডেট অনুযায়ী অনুষ্ঠান করে ঘরে তুলে নিবে।”
হাফিজ আলম এতে অমত করলেন নাহ। কান্না ভেজা গলায় বলল,–” তোমাদের কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো এতো বড় অন্যায় করা সত্ত্বেও তোমার মা বাবা হিমিকে নিজেদের ঘরে তুলতে চায়।”
অভিক বলল,–” না না এর সাথে আমার মান সম্মান জুড়ে আছে। সবাই জানে হিমি মেয়র অভিকের হবু স্ত্রী এখন বিয়ের সময়ের কাছাকাছি এসে বিয়ে ভঙে গেলে আমারই মান সম্মান যাবে আপনাদের সাথে সাথে তাই সব দিক ভেবে কালকে কাবিন করে রাখবো।”
হাফিজ আলম সম্মতি দিলেন। অভিক বিদায় নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। হিমির দিকে ঘৃণার চোখ নিয়ে একবার তাকিয়ে ভিতরে চলে গেল। হিমি তখনও মাথা নিচু করে আছে। কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে কিন্তু সে প্রকাশ করতে পারছে না। কি ঘটেছে বুঝতে পারছেন নাহ তো। চলুন দেখে আসি কি ঘটেছিলো।
———-
রাত ১ টা বাজে হিমি তার প্রিয় মানুষটি রাজের হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। তার ছুটে চলছে। যত দ্রুত সম্ভব এই শহর ছাড়তে হবে তাদের নয়তো তাদের কখনো একসাথে থাকা হবে না। কারণ তার বাবা হাফিজ আলম তার বিয়ে শহরের মেয়র অভিকের সাথে ঠিক করেছে যে কিনা তার থেকে ১১ বছরের বড়। এছাড়া সে রাজকে ভালেবাসে বাবাকে বলেছে সে রাজের বিষয় কিন্তু তার বাবা রাজি হয় নি। অভিককেও বলেছিল কিন্তু সে পত্তায় দেয় নি। হঠাৎ ই কতো গুলো গাড়ি রাজ আর হিমিকে ঘিরে ফেলে।
গাড়ি গুলো থামতেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে অভিক। অভিককে দেখে থমকে যায় হিমি সে যেতে চায় নাহ। অভিক এসে সজোরে রাজের গালে থাপ্পড় মেরে বলে,–” শাহাদাত হোসেন অভিকের হবু বউকে নিয়ে পালাচ্ছিস দুই মিনিটের ভিতর তোকে এখানে যেন আর দেখতে না পাই।”
অভিকের কথায় হিমি রাজের হাত শক্ত করে ধরে বলে– ” সে যাবে নাহ আমরা একে অপরকে ভালোবাসি।”
অভিক হালকা হাসলো হিমির কথায়। ঘাড় কাত করে হিমির দিকে তাকিয়ে বলল,–” তোমার ভালোবাসার আরেক রূপ দেখাই।”
হিমি ভ্রু কুচকে তাকালো। অভিক এক ব্যাগে কিছু টাকা দিয়ে বলে– ” যাহ ইয়াশ কর আর হিমিকে আমার হাতে দিয়ে যা।”
রাজ লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে টাকা গুলোর দিকে তাকায় তো একবার হিমির দিকে। হিমি তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাজ হিমির হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,–” স্যার আপনার বউ আপনি বুঝে নিন আমাকে টাকা গুলো দিয়ে দিন। ”
হিমি স্তব্ধ হয়ে যায়। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাজের দিকে। রাজ টাকা গুলো নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। রাজ চলে যেতেই অভিক উচ্চ স্বরে হেসে উঠে। হিমির মাথা নিচু হয়ে যায় এ কাকে ভালোবেসে পালাতে যাচ্ছিল যে কিনা কয়েকটা টাকার জন্য তাকে মাঝ পথে রেখে চলে গেছে। হিমি মাথা নিচু করে অভিকের সামনে দাড়িয়ে বলে, –” আমাকে বাসা অব্দি ছেড়ে দিবেন। ”
অভিক হালকা হাসে। হিমির হাত ধরে তাকে গাড়িতে উঠায়। এরপর যা হলো তা তো দেখলেনই।
———–
হিমি পাথরের ন্যায় দাড়িয়ে আছে। তার নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। তখনই তার ফোনে ফোন আসে মেয়র সাহেব নামটা ভেসে উঠেছে । সে ফোনটা তুলে নাহ। বারবার ফোন দেওয়ায় বাধ্য হয়ে ফোনটা ধরে। ফোন ধরার সাথে সাথে অভিক ঝাড়ি দিয়ে বলে– ” ফোন দিচ্ছি দেখতে পাচ্ছো নাহ। যাক মাথায় কোনো উল্টা পাল্টা চিন্তা যেন না আনা হয় চুপচাপ রুমে গিয়ে ঘুমাও।”
হিমি কিছু বলল না তার ইচ্ছে করছে না বলতে। ছোট করে একটা শব্দ উচ্চারণ করে হুম। অভিক আবারও হেসে বলে, –” গুড।”
অভিক কল কেটে দিল। হিমি তখনও সেখানে থম মেরে বসে আছে। জীবনের হিসেব মিলতাে ব্যস্ত। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে রাজ এমন। রাজ যদি টাকার প্রতি এতোই লোভী তাহলে এতোদিন কি সব অভিনয় ছিল। মিথ্যা ভালোবাসা মিথ্যা সমাজ সেবা। হিমি আর কিছু ভাবতে পারছে নাহ। মা মারা যাওয়ার পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে নি শুধু তার জন্য আজ সেই বাবার বুকে চুরি মেরে যার সাথে চলে যাচ্ছিল সেও তার বুকেই চুরি মেরেছে। নিজের উপর হাসলো হিমি।
—————–
অভিক মাত্রই বাড়ি ফিরেছে। বাড়ি ফিরতেই তার বাবা মা তিতাস হোসেন আর নয়না হোসেন। অভিক বাবা মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার নিজের জুতা খুলাই মন দিয়ে বলে– ” কিছু বলবে তোমরা?”
তিতাস হোসেন গলা ঝেড়ে বলেন– ” বিয়েটা ভেঙে দাও অভিক আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমার বিয়ে আয়রার সাথে হবে।”
অভিক নিজের কাজ বন্ধ করে বাবার দিকে তাকায়। তারপর আবার নিজের কাজে মন দিয়ে বলে– ” আমি যদি বলি তুমি মাকে ছেড়ে দাও তাহলে তুমি তাকে ছেড়ে দিবে?”
তিতাস হোসেন ছেলের কথায় রাগ দেখিয়ে বলেন,–” কি বলছো এসব ও আমার স্ত্রী। ”
নয়না হোসেন তেজী গলায় বলল,–” বেয়াদব হয়ে গেছো তুমি।”
অভিক হাসে মায়ের কথায় তাদের দিকে তাকিয়ে বলে– ” বাবা তুমি যেমন মাকে ছাড়তে পারবে না তেমনি আমিও হিমিকে ছাড়তে পারবো নাহ কারণ আমি তাকে ভালোবাসি। ”
নয়না হোসেন কঠোর গলায় বললেন,–” ঐ মেয়ে এই বাড়ির বউ হবে না যেই মেয়ে নিজের বাবার মান সম্মানের কথা চিন্তা করে নাহ সেই মেয়ে আমাদের কথা কি ভাববে?”
অভিকের মুখে গম্ভীর ভাব তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। সে তর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে– ” আমি ঐখানে বলে এসেছি তোমরা বলেছো কালকে কাবিন করিয়ে ফেলবা পরে অনুষ্ঠান করে উঠিয়ে আনবো। এছাড়া ভুল মানুষ জীবনে একবার করেই থাকে হিমিও করেছে শোধরেও নিবে।”
নয়না হোসেন কিছু বলেন নাহ আর এখানে বলেও কোনো লাভ নেই। অভিক মুখ দিয়ে যেহেতু বলে দিয়েছে সে এখানে বিয়ে করবে তো করবেই। নয়না হোসেন ভালোই বুঝতে পারেন যে সে চরম বেয়াদবের মা। তিতাস হোসেন স্ত্রীর কাঁধে হাত দিয়ে তাকে শান্ত হতে বলে। নয়না হোসেন আর কিছু না বলে চলে যায়। তিতাস হোসেন ছেলের মুখপানে তাকিয়ে চলে যান। তারা চলে যেতেই শস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে অভিক।
———————
নিজের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে হিমি। চারদিকের সব কিছু বিষাদ লাগছে। চোখ দুটো প্রচন্ড জ্বালা করছে। সে একবার পিছন ঘুরে তার বাবার রুমের দিকে তাকায়। এবার খুব সাহস করে সে বাবার রুমের দিকে এগিয়ে যায়। দরজায় টুকা দিয়ে বলে– ” বাবা।”
হিমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে কোনো উত্তর আসে নাহ। হিমি তার বাবার দরজার সামনেই বসে পড়ে কান্না করতে করতে বলে,–” বাবা ক্ষমা করে দাও আর হবে না এই ভুল তুমি যা বলবে তাই শুনবো। ”
তবুও দরজা খুলে নাহ। হিমি সেখানে বসেই কাঁদতে কাঁদতে থাকে। দরজার অপর প্রান্তে হাফিজ আলম ও কাঁদছেন। প্রাণ প্রিয় মেয়েকে মেরে সেও শান্তি পাচ্ছেন নাহ। কিন্তু হিমি যে ভুল করেছে তার জন্য এতটুকু শাস্তি তো তার প্রাপ্য।
হিমি সেখানে বসেই ঘুমিয়ে যায়। হিমি ঘুমিয়ে যাওয়ার পর হাফিজ আলম দরজা খুলেন মেয়ের শরীরে চাদর জড়িয়ে দেয় মাথার নিচে বালিশ দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলে,–” কেন করলি এমন মা আমি কি কোনোদিন তোর কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ রেখেছি ছেলেটা ভালো নাহ দেখেই আমি দিতে চাই নি তোকে ঐ ছেলের হাতে তুলে দিতে। ”
হাফিজ আলম মেয়ের মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে যান।
চলবে
কেমন হয়েছে সবাই জানাবেন
#তুমি_আমার_প্রেয়সী
পর্ব ১
#মৌমিতা_শবনাম