#তুমি_আমার_প্রেমবতী
#পর্বঃ৬
#সানজিদা_খানম_স্বর্ণা
১২.
রাতের অন্ধকার কাটিয়ে আগমন ঘটেছে এক নতুন সূর্যের।ঝকঝকে চকচকে সূর্যের আলো দেখে বোঝার উপায় নেই,কাল মধ্যরাত অবধি মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছিল।যদিও মাটিতে ভেজা গন্ধ।প্রকৃতি যে কী আশ্চর্য সুন্দর,কী অপরূপ রূপশোভা,কী অফুরন্ত লীলাবৈচিত্র্য, কী সুন্দর ও অনুপম।ব্যাস্ত শহরে প্রকৃতি নিয়ে এতো কিছু ভাবার লোকজন অতি নগন্য। সকাল সকাল কর্মব্যস্ত মানুষের ছুটাছুটি শুরু হয়।
ঘুম থেকে দ্রুত উঠে ফ্রেশ হয়ে অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে অভি।রাতে খাবার টেবিলে সকলের সাথে সময়টা খুব ভালোই কেটেছে।মোজাম্মেল সাহেব ছিলেন না আড্ডায়।বৃষ্টির মাঝেই অফিসের কি একটা দরকারী কাজের জন্য তিনি আড্ডায় থাকতে পারেনি।বেশ রাত করেই বাড়ি ফিরেছেন।তিনি না গিয়ে অভিকে পাঠালেও হতো কিন্তু অভির কালকের ব্যাবহারের পর উনার একদম ইচ্ছে করেনি কাজের দায়িত্বটা অভিকে দেওয়ার।কালকের পর এখনো অভি আর তিনি মুখোমুখি হন নি।
সকাল সকাল ড্রয়িংরুমে বসে খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছেন মোজাম্মেল সাহেব ।শাহানাজ বেগম রান্না ঘরে।রান্না ঘর থেকে চায়ের কাপের টুংটাং আওয়াজ আসছে।শাহানাজ বেগম এক কাপ চা’ সাথীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন মোজাম্মেল সাহেবের কাছে।
হাতে ঘড়ি পরতে পরতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে অভি।ড্রয়িংরুমে বসার সময় ওর হাতে নেই।অভিকে নিচে আসতে দেখে রান্না ঘর থেকে দ্রুত পদে বেরিয়ে আসেন শাহানাজ বেগম।অভি উনার দিকে তাকিয়ে, ‘আম্মু আসছি’ বলে বেরিয়ে যেতে নিলে আটকে দেন মোজাম্মেল সাহেব।শাহানাজ বেগম অভিকে খেয়ে যেতে বলতে উদ্যত হয়েও থেমে যান মোজাম্মেল সাহেবের কান্ডে।মোজাম্মেল সাহেব খুব গম্ভীর গলায় অভিকে ডেকে বলেন,’অভি,কোথায় যাচ্ছো?’
বাবার এই প্রশ্নে বেশ অবাক সাথে বিরক্ত হয় অভি।মুখে বিরক্তির রেশ রেখেই জবাব দেয়,’এটা কেমন প্রশ্ন আব্বু?আশ্চর্য! রোজ যেখানে যাই সেখানেই যাচ্ছি, অফিসে।’
‘কালকের ঘটনার পরেও এমন স্বাভাবিক কিভাবে আছো তুমি?এতটুকু অনুশোচনা নেই তোমার মাঝে?মেয়েটার সাথে যেই অন্যায় তুমি করেছো, তার জন্য?’
অভির মুখের ভাব পরিবর্তন হলো।বাবার এই কথায় সে মহা বিরক্ত।এই ব্যাপার নিয়ে সে কোনো কথা বলতে ইচ্ছুক নয়।কথায় কথা বাড়বে!প্রশ্ন উঠবে কেন সে সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে চায় না।এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে কোনো মতেই আগ্রহী নয় অভি।সোজা-সাপটা জবাব দেয়,’আমি এই বিষয় নিয়ে আপনাদের সাথে কোনো কথা বলতে চাই না,প্লিজ আব্বু আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।’
‘তুমি বললেই আমরা জিজ্ঞেস করবো না! এমনটা কিভাবে ভাবলে তুমি?কাল যেই বিষয়টা নিয়ে এতো অশান্তি করলে, আমাদের মান ডুবালে, সেই বিষয় নিয়ে কথা না বললে তো হবে না?তুমি কাল যা করেছো তার পর তো তোমাকে জবাবদিহি করতেই হবে।’
‘আমি কোনো কিছু জবাবদিহি করতে বাধ্য নই।আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আপনারা আমার বিয়ে দিতে পারেন না।তাছাড়া আমি উনাকে বিয়ে করে সুখী হতে পারতাম না।এরচেয়ে এটাই ভালো হলো আমি বিয়েটা করতে না’ করে দিয়েছি।’
‘তুমি কি জানো সাক্ষরের সাথে স্নিগ্ধার বিয়ে ঠিক করেছি আমি?অতি শীগ্রই সাক্ষরের সাথে স্নিগ্ধার বিয়ে হবে।তাছাড়া তুমি কি কারণে স্নিগ্ধাকে বিয়ে করতে রাজি ইচ্ছুক নয়,সেটা বলো।’
সাক্ষরের সাথে স্নিগ্ধার বিয়ের কথা শুনে চমকে উঠলো অভি।চোখে মুখে ফুটে ওঠেছে বিস্ময়।তার ভাইটা এখনো ছোট! অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে আইনজীবী হবার স্বপ্ন বুনছে সাক্ষর।সেই সাক্ষরকে এক্ষুনি বিয়ে করানোর চিন্তা কিভাবে এলো মোজাম্মেল সাহেবের মাথায়?অভি অবাকতার সুরেই বললো,’কি???সাক্ষরের সাথে স্নিগ্ধার বিয়ে?কিন্তু আব্বু সাক্ষর তো…’
কথা শেষ করতে পারে না অভি।তার আগেই মোজাম্মেল সাহেব বলেন,’সাক্ষরের ভালো মন্দের চিন্তা তোমার করার প্রয়োজন নেই।সেটা ভাবার জন্য আমরা আছি।তুমি তো কোনো এক অজানা কারণে বিয়ে করবে না বলে জেদ করে বসে আছো।ভালোর জন্য তোমার আম্মু কত জোরাজোরি করে পাত্রী দেখাতে নিয়ে গেল।কিন্তু সেখানে গিয়েও মেয়ে সুন্দরী বলে একটা ঝামেলা পাকিয়ে চলে এলে।বলি নিজের ভালো তো পাগলেও বুঝে, তুমি কেন বুঝো না?আর যে নিজের ভালো বুঝে না সে অন্যের ভালো কি করে বুঝবে? সাক্ষরের জন্য যা ভালো হবে সেই সিদ্ধান্তই আমরা নিয়েছি।’
বাবার কথায় আঘাত পেল অভি।সাক্ষর তো তার নিজেরও ভাই।বাবা এতো দুরত্ব বাড়িয়ে কথা কেন বললো!পরিবারের কারো কাছে কোনো গুরুত্বই নাই তার, থাকলে তো কোনো সিদ্ধান্ত নেবার আগে তাকে অন্তত জানাতো।এর মাঝেই অভির মাথায় প্রশ্ন এলো,সাক্ষর নিজে জানে তো?নাকি বাবা সাক্ষরকে না জানিয়েই বিয়ে ঠিক করেছে?প্রশ্নটা মাথায় আসতেই মোজাম্মেল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো অভি।
‘আচ্ছা আব্বু,বিয়ে তো ঠিক করলেন।তা সাক্ষর রাজি আছে এই বিয়েতে?সে জানে পুরো বিষয়টা?
‘সাক্ষর তোমার মতো এতোটা উচ্ছনে চলে যায় নি!বাবা মায়ের মুখের ওপর কথা বলবে।আমরা যা সিদ্ধান্ত নিবো সেটা তার ভালোর কথা ভেবেই নিবো সে সেটা জানে ।’
বাবার কথায় আবারো আহত হলো অভি।যদিও মোজাম্মেল সাহেব অভিকে সাক্ষরের থেকে একটু বেশিই ভালোবাসে।তবুও কালকের ঘটনার ক্ষোভ থেকে আজকে অভির সাথে এই দুর্বোধ্য ব্যবহার করেছেন তিনি। অভি কিছু না বলে শাহানাজ বেগমের দিকে তাকালো।শাহানাজ বেগম নিরব দর্শকের মতোই বাবা ছেলের কথোপকথন শুনছে।চাইলেও কিছু বলতে পারছে না।তবে অভির দৃষ্টি উনার দিকে নিক্ষেপ হওয়ার পরেই উনি সচেতন মা হয়ে উঠলেন।শান্ত সুরে মোজাম্মেল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলেন,’সকাল সকাল ছেলেটার সাথে কি শুরু করছো বলতো?ছেলেটা কাজে যাচ্ছে পথিমধ্যে বাধা না দিলে হয় না তোমার।’
অভির দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলে, ‘অভি বাবার কথায় রাগ করিস না।জানিস তো তোর বাবা মানুষটাই এরকম। রাগ হলে কাকে কি বলে বসে তার ঠিক নেই।সে সব কথা ছেড়ে নাস্তা দিচ্ছি খেয়ে তারপর বের হবি।’
অভি মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু প্রশান্তিতে হাসে।যতই হোক সন্তানকে সবথেকে বেশি একজন মা’ বুঝতে পারে।মোজাম্মেল সাহেব পুনরায় বসে খবরের কাগজের পাতায় চোখ রেখে বলেন,’এই তোমার আশকারা পেয়ে পেয়ে ছেলে মেয়েগুলো একদম বখে গেছে। আমি কিছু বলতে এলেই দোষ! ‘
সাথী আর স্মৃতি দুজন মিলে স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে দ্রুত খাবার টেবিলে আসে।অভিকে উদ্দেশ্য করে স্মৃতি বলে,’ভাইয়া তুমি কি অফিসে যাচ্ছো?’
অভি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।স্মৃতি সাথীর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তাহলে আমাকে আর সাথীকে একটু স্কুলে পৌঁছে দিতে পারবে?’
অভি উঠতে উঠতে বলে, ‘আচ্ছা তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে আয়। আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।’
১৩.
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই ব্যাস্ত হয়ে ওঠল প্রেমা।সর্বপ্রথম আদিলের গায়ে হাত দিয়ে তাপমাত্রা পরিমাপ করার চেষ্টা করল।না’ জ্বর একটুও কমেনি।সেলিনা পারভীন ঘুম জড়িত গলায় বললেন,’ছেলেটা এখনো শুয়ে আছে কেন?আদিলকে ডেকে উঠতে বল প্রেমা।’
প্রেমা মায়ের কথায় না’ সূচক মাথা নেড়ে বলে, ‘কাল বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর হয়েছে তোমার ছেলের।এক্ষুণি উঠার দরকার নেই।আজ ও বাড়িতেই থাকুক।আমি একা’ই যাবো।’
জ্বরের কথা শুনে আঁতকে ওঠেন সেলিনা পারভীন। ছেলেটা কোনো কথা শোনে না। কে বলেছিল এই চৈত্র মাসের বৃষ্টিতে ভিজতে!বিছনা থেকে জীর্ণশীর্ণ শরীর নিয়ে নামেন তিনি।
প্রেমা সকালের কাজ গুছিয়ে ফুল বিক্রি করতে বেরিয়ে যাবে।অন্য দিন দুই ভাই বোন মিলে যায়,আজ একাই যেতে হবে।সেলিনা পারভীন ছেলের কপালে হাত দিয়ে মনে মনে ব্যাথিত হয়।ক্ষীন কন্ঠে ডেকে বলে,’আদিল,বাবা আমার!উঠে হালকা কিছু খেয়ে তারপর ওষুধ খাও।পরে শুয়ে থাকতে পারবে।’
আদিলের কোনো হেলদোল নেই।সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।সেলিনা পারভীন ছেলেকে আর ডাকলেন না।বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রেমাকে ডাকেন।প্রেমা পানি আনতে গিয়েছে।বস্তিতে একটা মাত্র পানি সাপ্লাইয়ের লাইন।দিনে দুবেলা পানি আনা যায়।মানুষের ভীরের মাঝেই দ্রুততার সাথে কয়েক বালতি পানি ভর্তি করে প্রেমা।দ্রুতই আবার সেই পানি নিয়ে ফিরে আসে বাড়িতে।
সেলিনা পারভীন রান্নার ব্যাবস্থা করছেন।প্রেমা শত চেষ্টা করেও তাকে আটকাতে পারে না।উনি অন্য কাজ করতে না পারুক, বসে বসে রান্নাটা তো করতেই পারেন।এ যুক্তিতে রান্নাটা তিনি নিজেই করেন।
আদিলকে ডেকে নিজের হাতে খাইয়ে দেয় প্রেমা।ওষুধ খাওয়াতেও ভুল হয় না তার।অত:পর সেলিনা পারভীন আর প্রেমা একসাথে খেয়ে নেয়।সেলিনা পারভীনকে আদিলের খেয়াল রাখতে বলে বেরিয়ে যায় প্রেমা।
চলবে, ইনশাআল্লাহ ✨
(আসসালামু আলাইকুম। ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।🙏 হ্যাপি রিডিং।)