তুমি আমার প্রেমবতী পর্ব ৫

0
516

#তুমি_আমার_প্রেমবতী
#পর্বঃ৫
#সানজিদা_খানম_স্বর্ণা

৯.
হৃদয়ের বেদনা স্মৃতিমুখর সন্ধায় বুক ভরে বেঁচে থাকে।সমস্ত আকাশ জুড়ে এমনই কালো মেঘ যেন এক্ষুণি ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হবে!এহেন বর্ষনের দিনে অনুভবের আস্বাধ প্রাণ ভরে গ্রহণ করা যায় মনের মনিকোঠায়, স্মৃতির বাসরে স্মরণীয় করে রাখা যায়,তবে সন্ধ্যার এই ক্ষণটির স্বরূপ ভাষায় প্রকাশ করা দু:সাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।তাতে কী!এমন প্রশান্তির ক্ষণ জীবনে ২য় আসবে কি না তার তো ঠিক নেই।
আড্ডা জমে গেছে।চায়ে’ চুমুক দিয়ে সাক্ষর গিটারে সুর তোলেছে।একই সুরে ফোক গান!হৈ–হুল্লোড় সময়টা বেশ ভালোই কাটছে।সাক্ষর আর তাওহিদ ছাড়াও আরও তিন জন এসেছে মূহুর্তটা ভাগাভাগি করতে।দুজন তাদের বন্ধু। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। একজন জুনিয়র। ২য় বর্ষের ছাত্র সে।যেকোনো আড্ডায় তাকে পাওয়া যায়।বেশ ভালো বন্ধুর মতো সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে ছেলেটার সাথে।বন্ধুত্বের এই কালজয়ী বন্ধন দেখতেও ভালো লাগে।একসাথে সবাই মিলে অতি সামান্য কোনো বিষয় নিয়ে ঝগড়া করা, আবার কথার পিঠে কথা তুলে মিলে যাওয়া।ফোক গানের সুরে একসাথে হেসে ওঠা।

একদফা চা’ শেষ করে আড্ডায় ক্ষাণিকটা বিরতি।আবার কিছুক্ষণ পরেই সবাই মিলে গান ধরা।সাক্ষর গিটারের তালে গান ধরলো, ‘ব্যাচেলার আমি ব্যাচেলার।’ছেলেটার কন্ঠ বেশ ভালো।চাইলে কোনো ব্যান্ডে যোগ দিতে পারে।কিন্তু সে সবে আগ্রহ খুঁজে পায় না সাক্ষর।গান শুধুই শখের বশে গাওয়া।যখন বড্ড একা একা লাগে নিজেকে গিটার তখন একমাত্র সঙ্গী।গিটারের এক অদ্ভুত জাদু আছে নয়তো কিভাবে দ্রুতই মন ভালো করে দেয় সাক্ষরের!
এসাইনমেন্ট শেষ না করেই আড্ডায় বসেছে সাক্ষর।সারা রাত আড্ডা দিয়ে সারাদিন ঘুমানোর আইডিয়াটা মন্দ নয়।ভার্সিটিতে যাওয়ার কোনো চাপ নেই।হোস্টেল সুপার সে সম্পর্কে বড় উদাসহীন।দুই তিন দিন পর পর একটু এসে পদধুলি দিয়ে যায়।বিষয়টা মন্দ নয়।মাঝে মাঝে ফাঁকিবাজির চিন্তা করলে হোস্টেল সুপারের এই দোষটাকে গুণ বলেই মনে হয়।সারা রাত শান্তিপূর্ণ ভাবে আড্ডা দিয়ে সময় কাটানোর আনন্দ কি প্রতিদিন আসবে নাকি?

১০.
‘তুই কি সত্যি এই বিয়েটা করবি?মোজাম্মেল সাহেবের ছোট ছেলেকে না জেনে না শুনে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলি?’
দরজায় তাকিয়ে মা মমতাজ বেগমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো স্নিগ্ধা।মায়ের কথায় ইষৎ চমকালো স্নিগ্ধা।ছোটবেলা থেকে এই মানুষটা তাকে অনেক বেশি বুঝে।হাত ধরে টেনে মা’কে বিছানায় বসিয়ে বলল,’কেন তুমি এই বিয়েতে খুশি নও?’

‘তুই যদি বিয়েটা মন থেকে মেনে নিয়েই করিস তাহলে আমি কেন খুশি হবো না?কিন্তু ছেলেটা সম্পর্কে এখনো তেমন কিছুই জানিনা আমরা!তাই একটু মনটা উসখুস করছে।’

‘তুমি চিন্তা করো না আম্মু।জানিনা তো কি হয়েছে?জানতে কতক্ষণ!ছেলেটাকে দেখে কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখে তারপর না হয় বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করবে।’

‘ হ্যাঁ, তা তো করতেই হবে।কিন্তু তবুও আমার মনে কি একটা অস্বস্তি হচ্ছে।মায়ের মন তো! কিছু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়।’

‘তোমার কিসের এতো চিন্তা আম্মু?দেখো আব্বু তো মোজাম্মেল আংকেল’কে খুব ভালো করেই চিনেন।যদি ভালো না হবে তাহলে সেই বাড়িতে আমাকে নিশ্চয়ই বিয়ে দিতে চাইতেন না?তাহলে তোমার এতো দ্বিধা কিসের?’

‘এক ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে এসে আরেক ছেলের সাথে পাত্রীর বিয়ে দিচ্ছেন।উনার বড় ছেলে যেই ব্যাবহার করলো এর পর ঐ বাড়িতে নিজের মেয়েকে দিতে আমার মন সায় দেয় না।এতো অপমান করলো তবুও তুই কেন রাজি হলি?’

স্নিগ্ধা মুখে কিছু বললো না।মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো।মেয়ের কুটিল সেই হাসির মর্ম ধরতে পারলো না মমতাজ বেগম।মনে মনে বিষণ ভাবে জ্বলে ঊঠলো স্নিগ্ধা।রক্তে রাগের পরিমান খুব কম।তবে আত্নসম্মান অনেক বেশি।আজকের এই অপমানের শোধ নিতেই যে ঐ বাড়িতে বউ হয়ে প্রবেশ করতে চায় স্নিগ্ধা।তাইতো মোজাম্মেল সাহেবের প্রস্তাবে রাজি হলো।সে নিজেও দেখতে চায় অভি কেমন মেয়ে বিয়ে করবে?তার সৌন্দর্যই যদি অভির অপছন্দের কারণ হয়।তাহলে অভি কেমন কুৎসিত মেয়েকে বিয়ে করবে সেটা দেখার ইচ্ছে জেগেছে মনে।আর আজকের এই অপমান সহজে ভুলে যাবার পাত্রী স্নিগ্ধা নয়।

১১.
রাতের মধ্যভাগে বৃষ্টি থেমে গেছে।শান্ত শীতলতায় ভরে ওঠেছে গোটা ধরণী।নিশুতিরাতে ঝিম ধরা রেলগাড়ী সর্পিল গতিতে এগিয়ে যায় কোনো এক গন্তব্যে।রেলগাড়ীর ঝকঝকানো শব্দে এপাশ থেকে ওপাশ ঘুরে ঘুমন্ত প্রেমা।বার কয়েক ‘উঁহু’ শব্দে ঘুম পাতলা হয় প্রেমার।কান খাড়া করে খোঁজার চেষ্টা করে শব্দটির উৎস।মাথার কাছে থাকা বাটন ফোনটির টর্চ লাইট জ্বালিয়ে পাশের চৌকিতে ঘুমন্ত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে শব্দটি আদিলের থেকেই আসছে।ঘুম ছুটে যায় প্রেমার।আস্তে করে মায়ের পাশ কাটিয়ে বিছানা থেকে নামে প্রেমা।
ঘরে দুইটা চৌকি। প্রেমা আর সেলিনা পারভীন থাকে বড় চৌকিটাতে।আর অপর কোণের ছোট চৌকিটাতে থাকে আদিল।ঘরের এক কোনো একটা কাপড় রাখার আলনা।এর সর্বশেষ নিচের অংশটায় একটা রং উঠা ট্রাংক। তাছাড়া ঘরে একটা ছোট টেবিল,এর ওপর সাজানো পুরনো কিছু বই খাতা আর সেলিনা পারভীনের কিছু ওষুধ সাথে একটা ছোট ঝুড়িতে মেয়েদের নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র।এছাড়া ও কিছু টুকিটাকি জিনিস পত্র রয়েছে।খাওয়া দাওয়ার হাড়ি পাতিল সব কিছুই আদিলের ছোট চৌকির নিচে স্থান পেয়েছে।বড় চৌকির নিচে কিছু অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।ঘরে একটি মাত্র জানালা।জানালার ঠিক উর্ধ্বে ঘরের এপাশ থেকে পাশাপাশি একটা লম্বা দড়ি টানানো।দড়িতে ঝুলছে কিছু আধ ভেজা কাপড়।ঘর আলো বাতাসের দীনতায় ভরপুর।

বিদ্যুৎ এসেছে কখন তা ঠিক আন্দাজ করতে পারে না প্রেমা।লাইট জালিয়ে প্রেমা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল আদিলের চৌকির পাশে।গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠলো সে।জ্বরে গা’ পুড়ে যাচ্ছে।ঘুমন্ত আদিলের মুখ দিয়ে যন্ত্রণায় ‘উঁহ’ শব্দ বেরুচ্ছে।প্রেমার ঠান্ডা হাত আদিলের শরীরে পরতেই ইষৎ কেঁপে ওঠে আদিল।হঠাৎ করে এই চৈত্র মাসের বৃষ্টিতে ভিজার ফলশ্রুতিতে জ্বর এসেছে। সন্ধ্যার পর যখন বাড়িতে ফিরেছিল তখন ছেলেটাকে না মা*র*লে ও হতো।অনুশোচনায় পুড়ে প্রেমার অন্তর।ছেলেটার গায়ে পাতলা একটা কাঁথা।গোটানো আরেকটা কাঁথা টেনে আদিলের গায়ে দেয় প্রেমা।
টেবিলের কাছে এসে এতো ওষুধের ভীরে জ্বরের একটা ট্যাবলেট খুঁজতে থাকে প্রেমা।পেয়েও যায়। সরকারি হাসপাতালের নাপা ট্যাবলেট। ভাগ্যিস এনে রেখেছিল।একটা ট্যাবলেট সহ এক গ্লাস পানি নিয়ে ঘুমন্ত আদিলের পাশে বসে গায়ে হালকা ঝাঁকুনি দেয় প্রেমা।আদিল নড়ে ওঠে।প্রেমা আবার আহত গলায় শোধায়,’এই ভাই?তোর জ্বর হয়েছে একটু উঠে ট্যাবলেট খেয়ে তার পর ঘুমিয়ে যা।’
আদিল জেগে ওঠে।দুর্বল কন্ঠে বলে, ‘কি হয়েছে আপু ডাকছিস কেন?’
প্রেমা আদিলকে বলে,’কথা না বলে ওষুধ খেয়ে নে!বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়েছিস।এখন ওষুধ খেয়ে আমাকে উদ্ধার করে তারপর ঘুমাও। ‘
মধুর হেসে আস্তে আস্তে মাথা দুলায় আদিল।বোন তাকে যতোই বকুক না কেন,তাকে খুব ভালোবাসে।ওষুধ খেয়ে পুনরায় শুয়ে পরে আদিল।সেলিনা পারভীন তখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
লাইট বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করে প্রেমা।নিষ্পলক দৃষ্টিতে অন্ধকারে ঘরের ওপরে চালের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।লম্বা শ্বাস নেয়।ভাইটার জ্বর হয়েছে,মা ক্যান্সারের রোগী।কাল সকালে তাকে একাই বেরুতে হবে।রাস্তায় ফুল আর পানি বিক্রি করে যা টাকা উপার্জন করতে পারে তাই তাদের সম্বল।প্রেমা ফুল আর আদিল পানি বিক্রি করে।

প্রেমার বিশ্বাস একদিন তাদের এই দুর্দিন ঘুচবে।কত রাত জেগে বুকের ভেতর সেই আশা পূষন করেছে প্রেমা।খুব কি ক্ষতি হতো তাদের বাবা মা সহ একটা সুখের সংসার হলে?বাবা তো রোড এক্সিডেন্টে কবেই গত হয়েছে।তখন আদিলের বয়স ছিল মাত্র ছয় মাস।বাবার মৃত্যুর পরে মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে তাদের বড় করছিল।কিন্তু বছর খানেক আগেই মায়ের ক্যান্সার ধরা পরে।সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের শরীরের যত্ন নিতেই ভুলে গেছিলেন সেলিনা পারভীন। ভাবতে ভাবতে চোখে তন্দ্রা লেগে যায়।জ্বালাময়ী এক আশা বুকে লালন করে ঘুমিয়ে পরে প্রেমা।

চলবে,ইনশাআল্লাহ✨

(আসসালামু আলাইকুম। আমরা যারা গল্প লিখি তারা কয়েক ঘন্টা চিন্তা করে কষ্ট করে একেকটা পর্ব লিখি।আর আপনারা মিনিট দুয়েক ব্যয় করে গল্পটা পড়েন।কিন্তু একটু সময় ব্যয় করে দু লাইনের ছোট্ট একটা কমেন্ট করতে আপনাদের কষ্ট হয়।এসব দেখলে সত্যি খারাপ লাগে😔।সবার গঠন মূলক মন্তব্য আশা করি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here