#তুমি_আমার_প্রেমবতী
#পর্বঃ১১
#সানজিদা_খানম_স্বর্ণা
২৪.
নাস্তা করে ড্রয়িং রুমে বসে আছে সাক্ষর। শাহানাজ বেগম ও মোজাম্মেল সাহেবও আছেন।কালকের বিষয়টা নিয়ে তারা খুবই চিন্তিত।কাল হঠাৎ করে এতো রাতে চট্টগ্রাম থেকে নেশা করে সাক্ষরের ঘরে ফেরাটা এমদম মানতে পারেনি তারা।ক্ষণকাল নিরবতার পর মোজাম্মেল সাহেব কাঠ কাঠ গলায় বললেন,
‘সাক্ষর কাল রাতে হুট করে এই ভাবে আমাদের না জানিয়ে বাড়িতে ফেরার কি কারণ?তাছাড়া আবার নেশা করে!কি হয়েছিল?তোমার এই রূপ আমরা কখনো দেখবো ভাবতেই পারিনি কোনোদিন।কেন এমন ভাবে নেশা করে হুট করে চট্টগ্রাম থেকে বাড়ি ফিরে এলে?’
‘হ্যাঁ, সাক্ষর বাবা কি হয়েছে তোর?তোকে তো আমরা কখনো এমন রূপে দেখিনি!আমরা আশাও করতে পারি নি আমাদের ছেলে সাক্ষর এমন ভাবে নেশা করতে পারে!আমি এই সাক্ষরকে চিনি না।আমার ছেলে সাক্ষর তো এমন নয়।কি হয়েছে বাবা খুলে বল আমাকে।’
শাহানাজ বেগমের অনুরোধের সুর শুনে সাক্ষর নড়ে ওঠলো।পড়শীর সেই অপমান সে এখনো মানতে পারছে না।কিন্তু এখন বাবা মায়ের সামনে নিজেকে ভালো দেখাতে হবে।না হলে ব্যাপারটা আরও খারাপ হবে।অনেক প্রশ্ন করবে সবাই।
‘আসলে আব্বু আম্মু কালকে ভার্সিটিতে একটা প্রোগ্রাম ছিল সেখানেই সব ফেন্ডদের সাথে মিলে একটু ড্রিংক করে ফেলেছিলাম।আর হুট করে মন চাইল তোমাদের দেখতে চাই বাড়ি চলে আসলাম। সরি আম্মু আমি আর কখনো নেশা করবো না।আব্বু আমি এইসব ছাইপাঁশ আগে কখনো খাইনি।আর খাবো ও না।আমার ভুল হয়ে গেছে সরি!’
মোজাম্মেল সাহেব আর শাহানাজ বেগম দুজনেই জানেন সাক্ষর কেমন ছেলে।আর সে মিথ্যে বলবে না এটাও তাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
‘যা হয়েছে আর ভবিষ্যতে যাতে না হয়।আর একটা কথা, তুমি যেহেতু এসেছো ভালোই হয়েছে।তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।তুমি না আসলে আমিই তোমাকে আসতে বলতাম।এখন নিজেই এসেছো।শোনো সাক্ষর তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?’
‘হ্যাঁ আব্বু প্রশ্ন করবে তার জন্য আমার অনুমতি নেবার কি আছে?বলো কি প্রশ্ন?’
‘আচ্ছা আমরা যদি তোমার জন্য, তোমার ভবিষ্যতের জন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেই সেটা তোমার ভালোর কথা ভেবেই নেব এটা কি তুমি বিশ্বাস করো?’
‘হুম আব্বু। কেন বিশ্বাস করবো না।আমি মন থেকে বিশ্বাস করি তোমার আমার জন্য যা সিদ্ধান্ত নেবে আমার ভালোর জন্যই নেবে।’
‘তাহলে আজকে যদি তোমার ভালোর কথা ভেবে তোমার বিয়ের কথা বলি তুমি কি রাজি হবে?’
এই কথা শুনে সাক্ষর অবাকের সপ্তম পর্যায়ে পৌঁছায়। হা করে তাকিয়ে থাকে মোজাম্মেল সাহেব আর শাহানাজ বেগমের মুখের দিকে।মোজাম্মেল সাহেব আবার বলেন,’আমরা যা বলছি তোমার ভালোর কথা ভেবেই বলছি।আশা করি তুমি আমাদের মান ডুবাবে না।’
২৫.
সাক্ষর এবার মুখ খোলে।
‘মানে? কি বলছেন কি এইসব? আম্মু এইসব কি বলতেছে আব্বু?তুমি আব্বুকে বোঝাও।এখন আমার বিয়ে মানে?’
শাহানাজ বেগম আতঙ্কিত গলায় বলেন,’শান্ত হও সাক্ষর।।তোমার আব্বু ১মেই বলেছে তিনি যা সিধান্ত নিবেন তোমার ভালোর কথা ভেবেই নিবেন।’
‘কিন্তু আম্মু তাই বলে আমার বিয়ে?কি বলছো কি তোমরা?তোমাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে এখনো তো ভাইয়া নিজেই বিয়ে করেননি।আমার বিয়ে দেবার ভূত কেন চাপল তোমাদের মাথায়?তাছাড়া আমার পড়াশোনাটা এখনো কমপ্লিট হয়নি।এর মাঝেই তোমরা আমার বিয়ে দিতে চাইছো?আচ্ছা আব্বু আমি কি মেয়ে নাকি যে বিয়ে দিয়ে শশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিবে?বিয়ে মানে দায়িত্ব নেওয়া যেখানে আমি নিজেই এখনো প্রতিষ্ঠিত বা সেখানে আমি অন্য একটা মেয়ের দায়িত্ব কিভাবে নিবো?’
‘সাক্ষর তোমাকে কেউ কি কোনোদিন বলেছে নিজে রোজগার করো?কোনো দিন কি কেউ তোমাকে বলেছে এই ধরনের কিছু?বিয়ে করলে আমরা দেখে নেব।তোমাকে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে করতে হবে না।আমরা পাত্রী ঠিক করেছি। তুমি তাকেই বিয়ে করবে।’
‘আমাকে ক্ষমা করো আব্বু।আমি এখন বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত নয়।তাছাড়া আমাকে না জিজ্ঞেস করে তোমরা পাত্রী ঠিক করে ফেললে?আমার পছন্দ অপছন্দ বলেও তো একটা কথা আছে। আমাকে কেন বিয়ে দিতে চাইছো?ভাইয়াকে বিয়ে দাও আগে।’
‘সে বিয়ে করবে না।আমরা যেই মেয়েকে পছন্দ করেছি আশা করি তুমি তাকে বিয়ে করতে রাজি হবে।আর মনে রেখো আমরা কখনোই তোমার ক্ষতি চাইবো না।মেয়েটার নাম স্নিগ্ধা। আর যথেষ্ট সুন্দরী। তাকে অপছন্দ হবার কোনো কারণ আমি দেখছি না।’
‘আমি কিভাবে বিয়ে করবো আব্বু?আমি তো….’
বলতে গিয়েও থমকে যায় সাক্ষর।মনে মনে ভীষণ রকম কষ্ট পায়।পড়শীর অপমানের কথা মনে হলেই বুকে চিনচিন ব্যাথা হয়।অনেক ভাবে সাক্ষর।হুট করেই মনে হয় বাবা মা আমার ভালোই ভাববে।যার কথা ভেবে আমি বিয়েতে না করবো, বাবা মায়ের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করব সে নিজেই আমাকে ভালোবাসে না।আমি আব্বু আম্মুর পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করব।
‘কি এতো ভাবছো সাক্ষর?কি হয়েছে?আমি যা বলেছি বুঝত্ব পেরেছো তো?’
‘হ্যাঁ আব্বু বুঝতে পেরেছি।আমি আপনাদের ঠিক করা পাত্রীকে বিয়ে করতে রাজি আছি।’
‘কালকে মেয়ের বাড়িতে তোমাকে নিয়ে যাবো।মেয়েকে একবার সামনে থেকে দেখবে।’
‘প্রয়োজন নেই আব্বু।আমি মেয়েকে দেখতে চাই না।আমি আপনাদের ওপর বিশ্বাস করি।আমি বিয়েটা করব।’
বলেই আবার নিজের ঘরে চলে যায় সাক্ষর।শাহানাজ বেগম এগিয়ে এসে মোজাম্মেল সাহেব কে বলেন,’এই ভাবে অন্যের ছেলেকে তুমি বিয়ে দিতে পারো না।ওর মা বেঁচে না থাকুক বাবা তো বেঁচে আছে।আমার বোন মরার আগে তিন মাসের সাক্ষরকে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল যাতে কোনো দিন তাকে কষ্ট পেতে না দেই।নিজের সন্তানের মতো করে যাতে বড় করি।আর আজকে সেই ছোট্ট সাক্ষর বড় হয়েছে।কোনো দিন তাকে বুঝতে দেই নি আমরা তার বাবা মা নই।তার বাবা আরেকটা বিয়ে করে স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখে আছে।উনি তো চেয়েছিলেন সাক্ষরকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু আমি আমার সাক্ষরকে উনার কাছে পাঠিয়ে সৎ মায়ের অত্যাচারের স্বীকার হতে দিতে চাই নি।আজকে অন্তত এই সিদ্ধান্ত নেবার আগে ওর বাবার সাথে যোগাযোগ করা উচিত।’
‘কোনো প্রয়োজন নেই।আমরা ওর বাবা মা।আমি কখনোই চাইনা সাক্ষর সত্যিটা জানুক।আর কষ্ট পাক।তাই এই বিষয় নিয়ে আর কোনো কথা বলবে না।আমি চাইনা এই সত্যি আর কেউ জানুক। দেয়ালেরও কান আছে।’
আর কেউ না শুনলেও দূর থেকে পুরো সত্যি শুনে স্মৃতি। এমন একটা সত্যি জানতে পেরে সে অবাক হয়।দাঁড়ানো থেকে বসে পরে সে।অস্ফুট সুরে বলে,’সাক্ষর ভাইয়া আমাদের নিজের ভাই নয়!’
২৬.
একা একা ঘরের ভেতর জীবন যুদ্ধে মেতে উঠেছেন সেলিনা পারভীন।প্রেমা আদিলকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছে।একা সেলিনা পারভীন বাড়িতে ছিলেন।জীবনের শেষ সময়টাতে সন্তানদের মুখটুকু বোধ হয় দেখা হলো না।এই ভেবেই ডুকরে কেঁদে ওঠে মন।প্রেমা বাড়ি থেকে বের হবার পর পরেই ঊনার এমন শরীর খারাপ হয়েছে।ঘন্টা খানেক হলো এমন ভাবে শুয়ে শুয়ে কাঁতরাচ্ছেন তিনি।
উনার আর্তনাতে দু একজন মহিলা এসেছে।কয়েকজন মিলে ঘর থেকে বের করে বারান্দায় একটা পাটি বিছিয়ে শুয়িয়ে দিলেন সেলিনা পারভীনকে ।কয়েকজন মুখে একটু আধটু পানি দিচ্ছে।একজন ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বললে,’ঘরে এমন অসুস্থ মা রেখে এতো বড় মেয়ে কোথায় গেছে?বলি প্রেমার কি একটু আক্কেল নেই?’
সেলিনা পারপভীন শেষ সময়ে এসে একটু কথা বলেন।’আমার সন্তান গুলোকে দেখে রাখবেন আপনারা।ওদের বাবা ছিল না আমিই তাদের ছায়া ছিলাম।আজকে আমি চলে গেলে আপনারা তাদের দেখে রাখবেন।আপনাদের হাতে আমি আমার সন্তানদের রেখে গেলাম।’
বার কিচ্ছুক্ষণ জোরে নাভিশ্বাস ওঠলো উনার। তার পরেই সব শেষ। শান্ত!কয়েকজন মহিলা কেঁদে ওঠলেন।
আদিলকে ডাক্তার দেখানোর পর অভি সেচ্ছায় তাদের বড়িতে পৌছে দিতে চাইল।সে হিসাবেই প্রেমা আর আদিলকে নিয়ে বস্তির কাছে এসে গাড়ি থামায় অভি।বাড়িতে চিৎকার চেচামেচির শব্দ শুনে বুল মোচড় দিয়ে ওঠে প্রেমার।দ্রুত বাড়িতে ঢুকে মায়ের এই অবস্থা দেখে গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে প্রেমা।আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে প্রেমার কান্নায়।প্রেমা মায়ের শিউরে বসে বলে,’কি হয়েছে আমার মায়ের?মা কথা বলছে না কেন?ও মা! মা! মা গো!’
চলবে, ইনশাআল্লাহ✨
(আসসালামু আলাইকুম।ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা করবেন।হ্যাপি রিডিং)