তুমি অপরূপা পর্ব ২৫

0
960

#তুমি_অপরূপা (২৫)
অনামিকা আসার পর থেকে সালমার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে লাগলো। সারাক্ষণ অনামিকা মা মা করে ব্যস্ত রাখে সালমাকে।প্রথম প্রথম সালমা লুকিয়ে যেতো, পালাতে চাইতো অনামিকার থেকে।কিন্তু মাতৃত্বের টান,বড় টান।
মা বলে ডাকার মধ্যে একটা অদ্ভুত শক্তি আছে।অনামিকা আর অনিতা দুজন মিলে যখন দুই পাশ থেকে ঝাপটে ধরে সালমা কে তখন অদৃশ্য কোনো বন্ধনে সালমা বাঁধা পড়ে যায় বুঝতে পারে না। তার মনে হয় এরা তার খুব আপন কেউ।

দিন যায় আর অনামিকার চিন্তা বাড়ে।সে যখন চলে যাবে মা’য়ের কাছে কে থাকবে তখন?

১ সপ্তাহ পর…….

শাহেদ ভিডিও কল দিলো বাবা মা’কে। গতমাসে বাবার জন্য একটা স্মার্ট ফোন পাঠিয়েছে শাহেদ।তারপর থেকে বাবা মায়ের সাথে ভিডিও কলে কথা হয়।ইতোমধ্যে শাহেদের ফুফাতো বোনকে ও নিয়ে আসা হয়েছে। রোজিনা বারবার ভিডিও কলে তাকে দেখায়।শাহেদ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলে।

কথা বলতে বলতে রোজিনা পুরনো কাসুন্দি ঘাটতে বসেছেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “বাবারে,কি কান্ড ঘটাইছে তোর বউ গেরামের সকল মানুষ সাক্ষী আছে। মিলনের লগে কেমন ঢলাঢলি তা সকলে জানে।আমাগো মান ইজ্জত আর নাই।বাপধন তুই ডিফোজ কইরা দে ওই মাইয়া আর আমরা ঘরে তুলমু না।
আযাব নামছে তোর কাঁধ থাইকা। ওই আযাব আর আনার দরকার নাই। ”

শাহেদ মুচকি হেসে বললো, “মা,আমার ক্যান জানি ওই আযাব কান্ধে তুলতে ইচ্ছা করে। এর লাইগা তো এখন ওই আযাব সৌদি আরব লইয়া আইছি।খারাও দেখাই তোমারে।”

অনামিকা বলে দুইবার ডাকতেই কিচেন থেকে ছুটে এলো অনামিকা। ভিডিও কলে রোজিনা কে দেখে সালাম দিয়ে বললো, “কেমন আছেন আম্মা?আব্বা কেমন আছে?”

রোজিনা থরথর করে কাঁপতে লাগলো অনামিকাকে দেখে।ভূত দেখলেও এরকম ভয় পেতেন না যতটা এখন অনামিকাকে দেখে পেয়েছেন।এরকম শক শাহেদ বিয়ে করার পরেও পান নাই তিনি।

শাহেদ হেসে বললো, “আসলে হইছে কি মা শুনো,মিলনরে আমিই পাঠাইতাম আমগো বাড়ি।অনামিকার লগে তো তুমি কথা কইতে দিতা না,তোমার ছোট্ট ছোট্ট কিউট কিউট মিথ্যা কথা আমি বুইঝা ফালাইতাম সহজে। মা’গো, এই অনামিকা আমার প্রাণ। আমার অনামিকা আমার লগে কথা কইতে চাইবো না এইটা তাইলে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হইবো বুঝলা।

তবে তুমি একখান ভালা কাম করতা,মিলন গেলে বাড়ি থাইকা বের হইয়া যাইতা।আমি শান্তি মতো অনামিকারে ভিডিও কলে দেখতাম।অপটু হাতে ও ঘরের সব কাম করতো।কিন্তু তোমার লগে কথা কওনের কালে তুমি সবসময় কইতা অনামিকা কোনো কাম করে না ঘরের।আমার খুব খারাপ লাগতো মা।আমার ইচ্ছা করতো আমার বউয়ের একটু প্রশংসা শুনতে। কিন্তু পারতাম না।তখনই বুঝলাম অনামিকারে তোমরা শান্তি দিবা না।মিলনের লগে আমি ওরে যাইতে কইছে সদরে।পাসপোর্ট, ভিসার সকল কিছু করনের লাইগা।আমার মালিক অনেক ভালা।আমি তারে অনামিকার কথা কওনের পরের দিনেই কইলো বউ নিয়া আইতে।এইখানে থাকার লাইগা মালিকে বাসা দিবো।
আমিও আর দেরি করি নাই। শুধু তোমাগোরে জানাই নাই।দুইদিন আগে অনামিকা এই দেশে আসছে।আর আরেকটা কথা কই মা,তোমরা দাদা দাদী হইবা।আমি বিদেশে আসার পর থাইকা অনামিকার শরীর খারাপ হওয়া বন্ধ হই গেছে। আরো ১ মাস আগেই টেস্ট করে জানছি আমরা। তোমরা জানলে যেকোনো ভাবে কিছু খাওয়াইয়া আমার সন্তানরে দুনিয়ায় আসতে দিতে না।

একটা কথা মনে রাইখো মা আমি এই জীবনে আর বউ,সন্তান লইয়া বাড়ি যামু না।আমার বউরে যেই অপমান কইরা বাড়ি থেকে বাইর করছো তা শুধু আমার বউয়ের অপমান না,আমার অনাগত সন্তানের ও অপমান।
তোমরা আমার বাবা মা তোমাগো সব দায়িত্ব আমার। আমি তা পালন করমু।তবে এক সাথে তোমাগোরে লইয়া আর থাকমু না।”

শাহেদের কল কাটার পর পরই রোজিনা অজ্ঞান হয়ে গেলো।

————–

রেশমা মোটামুটি স্থায়ী হয়ে গেলো বাসায়।অন্তরা ও মেনে নিলো বাধ্য হয়ে। সে জানে জুয়েলের অবস্থার কথা। কাবিনের টাকা দেওয়ার মতো অবস্থা জুয়েলের নেই।তাই এক প্রকার বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হলো অন্তরাকে।

ইদানীং রেশমা রান্নাবান্না করা ও শুরু করে দিয়েছে বাসায়।প্রথম প্রথম জুয়েল অকথ্য ভাষায় গালাগালি করার পরেও রেশমা দমে যায় নি।অন্তরা অবাক হয়ে দেখতে লাগলো একটা মানুষের কি পরিমাণ গন্ডারের চমড়া হতে পারে গায়ে।এতো গালাগালি যেনো তাকে ছুঁতে ও পারে না।

অন্তরার দিন দিন মনে হয় সংসার যেনো রেশমার,সে এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এমন কিছু।রেশমার ভাবভঙ্গি তেমনই মনে হয়।
জুয়েলের প্রতি এক প্রকার মতো মনঃকষ্ট নিয়ে অন্তরা দিন দিন সব কিছু থেকে হাত গুটিয়ে নিতে শুরু করে।
বুকের ভেতর অভিমানের পাল্লা ভারী হতে থাকে দিন দিন।
কি পেলো জীবনে?
সুখ পাখি কি কখনোই ধরা দেবে না তার কাছে?
আজীবন কি এভাবে মানিয়ে নিতে নিতেই কাটাতে হবে?
সবকিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিলো অন্তরা।

আজ অন্তরা সাতসকালে ঘুম থেকে উঠেছে। জুয়েল তখনো বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। বাহিরে বের হতেই দেখলো রেশমা থম মেরে বসে আছে বিছানায়। অন্তরা পরোটা বানানোর জন্য রান্নাঘরে ঢুকলো। কিছুক্ষণ পর বাহিরে এসে দেখে রেশমা গোসল করে বের হয়েছে। ভেজা চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।
অন্তরার বুকের ভেতর কেমন ছ্যাৎ করে উঠে। তবে কি জুয়েল…..

রেশমা অন্তরার দিকে তাকিয়ে কেমন লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো। তাড়াহুড়ো করে মাথায় গামছা পেছিয়ে ঘোমটা টেনে দিলো।
অন্তরার সারা শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগলো। হাত পা ঠান্ডা হয়ে অন্তরার মাথা ঝিমঝিম করছে।
এতো দিন অন্তরা বুঝতে পারে নি সতীনের সাথে সংসার কেমন হয়।এতো দিন ধরে রেশমা আছে এতোটা কষ্ট লাগে নি অন্তরার।তবে আজ কেনো বুকের ভেতর ব্যথার ঢেউ আছড়ে পড়ছে!
কিসের শূন্যতা, কিসের এতো হাহাকার!
তাকে ডিঙিয়ে রাতে জুয়েলের রেশমার কাছে যেতে হয়েছে!
কিছুতেই মানতে পারছে না অন্তরা।

শেষ এটুকুই তো ওর সম্বল ছিলো। সেটুকুও বুঝি আজ রেশমার হাতে চলে গেলো। সতীনের সংসার মানুষ কেনো করতে চায় না আজ ভীষণ ভাবে বুঝতে পারছে অন্তরা।
এই মানুষটা তার বদলে অন্য কাউকে ভীষণ গভীরভাবে আদর করছে এর চাইতে যন্ত্রণা মনে হয় আর কিছুতে নেই।

টলতে টলতে অন্তরা রুমে গেলো।তারপর কোনো কথা না বলে চুপ করে শুয়ে পড়লো।
জুয়েক উঠলো কিছুক্ষণ পরে। অন্তরার দিকে তাকিয়ে দেখলো অন্তরা ঘুমে।অপলক অন্তরাকে দেখে জুয়েল উঠে গেলো হাত মুখ ধোয়ার জন্য।
রেশমা পরোটা বানিয়ে, ডিম চা দিয়ে জুয়েলকে খেতে দিলো।জুয়েলের মাথায় অনেক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। রেশমার দেওয়া নাশতা খেয়ে রুমে গিয়ে দেখলো অন্তরা একই ভঙ্গিতে এখনো শুয়ে আছে।

অন্তরার গায়ে হাত রাখতেই অন্তরা হাত সরিয়ে দিলো।জুয়েল বুঝতে না পেরে আবারও হাত রাখলো।অন্তরা আবারও সরিয়ে দিলো। জুয়েল বুঝতে পারলো অন্তরা কোনো কারণে রেগে আছে। রুমের দরজা বন্ধ করে জুয়েল শক্ত করে অন্তরাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “কি হইছে বউ?
আমারে কও।মন খারাপ তোমার? ”

অন্তরার কেমন অভিনয় মনে হলো আজ জুয়েলের এরকম আদুরে কথা। ধাক্কা দিয়ে জুয়েলকে সরিয়ে দিয়ে বললো, “খবরদার, আমাকে ছোঁবেন না।সারা রাত যার সাথে ছিলেন তার কাছে যান।”

জুয়েল হেসে বললো, “কি বলো এসব পাগলের মতো কথা?
আমি তো তোমার সাথেই ছিলাম।”

অন্তরার তখন মাথা ঠিক নেই।চিৎকার করে বললো, “হ্যাঁ, আছিলেন তো আমার কাছে। লজ্জা লাগে নাই আমার পাশ থেকে উঠে গিয়ে অন্য কারো সাথে থেকে আসতে!
এতো অভিনয় কিভাবে করেন?

ভেতরে চিৎকার শুনে রেশমা দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কান পাতলো। মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই হাসি মিলিয়ে যেতে লাগলো।

জুয়েলের ভীষণ রাগ হলো। অন্তরা কিছুতেই বুঝতে চাইছে না।রেগে গিয়ে জুয়েল রুমের লাইট অফ করে দিয়ে অন্তরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অন্তরার মুখ চেপে ধরে বললো, ” বলেছি না আমি কারো কাছে যাই নি।আমার কারোর প্রতি আকর্ষণ নেই। অন্য কেউ যেভাবেই আমাকে প্ররোচিত করতে চায় অন্তত এই অন্তরঙ্গতা তার সাথে আমার হয় নি অন্তরা।আর হবে ও না।আমার শুধু তুমি আছো।”

প্রবল আদরে অন্তরাকে ভাসিয়ে দিলো জুয়েল।দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে রেশমার দুই চোখ ভিজে উঠতে লাগলো।
এতো পরিকল্পনা সব বৃথা গেলো!

সেই মুহুর্তে জুয়েল সিদ্ধান্ত নিলো এভাবে আর চলতে পারে না। এক মাসের মধ্যে রেশমাকে ডিভোর্স দিবে সে।দরকার হলে গ্রামের জমি বিক্রি করে ডিভোর্স দিবে।তবুও এই মেয়েটাকে সে আর ঠকাবে না।এই মেয়েটা তাকে ভরসা করে সব ছেড়ে এসেছে তার ভরসা ভাঙ্গবে না।কিছুতেই না।

————–

বারান্দায় একটা ঢিল এসে পড়লো। একটু পর আরেকটা।
নিপা বারান্দায় গিয়ে দেখলো দুইটা কাগজ জড়িয়ে ইটের টুকরোতে।কাগজ খুলে দেখলো রূপার নাম লিখা।রূপা বসে পড়ছে।নিপা গিয়ে রূপার হাতে দিলো।রূপা দেখলো লিখা আছে, “মানুষ এমন কেনো অপরূপা!
নিজেকে উজাড় করে দিয়ে তাকেই ভালোবাসে, যাকে সে সাত জনমেও পাবে না।
ভীষণ অদ্ভুত মানব মন।পাথরে ফুল ফোটানোর জন্য চেষ্টা করে যায়।”

অন্য কাগজে লিখা,” পর জন্মে তুমি ও কারো প্রেমে পড়িও,তারপর তাকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় তিলে তিলে কষ্ট পেও।যেভাবে আমি পাচ্ছি। ”

এক কোণে ছোট্ট করে সমুদ্র লিখা।রূপা ভেবে পেলো না এরা কি পাগল না-কি!
কেনো এমন করছে!
রূপা বিরক্ত হয়ে কাগজ দুটো ছিড়ে ফেলে দিলো। ভাবলো আরেকটা বাসা খুঁজে নিবে।এসব পাগলের সংস্পর্শে থাকা যাবে না আর।

চলবে….

রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here