তুমি অপরূপা পর্ব ১৭

0
988

#তুমি_অপরূপা (১৭)

ছাদের এক কোণে মন খারাপ করে বসে আছে রূপক। একটু একটু করে কখন যেনো ২ বছর কেটে গেলো। এক সময় যার সাথে আড্ডা না দিলে সময় কাটতো না আজ তার সাথে কথা নেই ২ বছর। যার সব বিপদ নিজের মাথায় তুলে নিতো নির্দ্বিধায়, তাকেই এখন সবচেয়ে বেশি অপছন্দ।
বুক ফুলিয়ে যাকে বলতো, “ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নয় শুধু,ও আমার ভাই হয় ভাই।আমাদের দুই দেহ,এক প্রাণ। ”
কে জানতো,কোনো দিন সেই কঠিন বন্ধুত্বের সম্পর্কে ও ফাটল ধরবে?
দুই দেহ,এক প্রাণের যে আত্মার বন্ধন ছিলো তা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে,একে অপরের ছায়া ও মাড়াবে না কখনো!
কে ভেবেছে কোনো দিন এমন কিছু হবে!

রূপকের দুই চোখ জ্বালা করছে ভীষণ। রূপক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে কিছুতেই কাঁদবে না।সে তো ওর মতো নয় যে অল্পতেই ভেঙে পড়বে,ঝরঝর করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলবে।

মন খারাপের মাঝে ও হাসি পেলো রূপকের।আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, “এখনো ও কি অল্পতেই ভেঙে পড়িস ?এখন তো অবশ্য নতুন নতুন অনেক বন্ধু আছে।তাদের কাঁধে মাথা রাখিস নিশ্চয়। আমার কাঁধ না পেলেও অনায়াসেই চলে যায় তোর।শুধু আমার চলে না,আমি পারি নি কখনো কারো কাঁধে মাথা রাখতে অথবা কাউকে নিজের কাঁধে মাথা রাখতে দিতে।”

ছাদে কাপড় দিতে এসে অপরূপা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেলো। পুরুষ মানুষকে এভাবে কাঁদতে কখনো দেখে নি সে,অথচ রূপক কেমন নিঃশব্দে কান্না করে যাচ্ছে। কোনো শব্দ নেই অথচ দুই চোখে তার সমুদ্র হয়ে গেছে।

পরক্ষণেই রূপার মনে পড়লো এই লোকটা একটা যাচ্ছেতাই, ওর আরো কষ্ট পাওয়া উচিত। এক প্রকার জোর গলায় বললো রূপা,”মা’গো, পুরুষ মানুষ যে কাঁদতে কাঁদতে সমুদ্র বানিয়ে ফেলতে পারে তা আজ প্রথম দেখলাম।”

রূপকের খেয়াল হলো কাঁদবে না বলে ও সে কাঁদছে, এবং তা একটা মেয়ের সামনে। কি লজ্জাজনক ব্যাপার!

কিন্তু মেয়েটা কি বললো এটা!
সমুদ্র!

চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো রূপকের।এগিয়ে গিয়ে বললো, “পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট শব্দ সমুদ্র। আই হেইট ইট।”

রূপাকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে গটগট করে নেমে গেলো সিড়ি দিয়ে।

রূপা বিড়বিড় করে বললো, “প্রথমে তো মনে হয়েছিল আধা পাগল,এখন তো দেখছি পুরোই।”

নিচে এসে রুমে যেতেই মাহি আপার মুখোমুখি হলো রূপা। এই মেয়েটাকে রূপার তেমন একটা পছন্দ নয়।কেমন যেনো কর্তৃত্ব ফলাতে চায় সবার উপর।
এক জীবন দেখে এসেছে দাদী আর ফুফু মায়ের উপর কর্তৃত্ব দেখিয়ে মা’কে সবসময় দমিয়ে রেখেছে। সবসময় মা বাবার ভয়ে তাই তারাও মুখবন্ধ করে থেকেছে, কখনো প্রতিবাদ করতে পারে নি তবে এটুকু শিক্ষা নিয়েছে রূপা,অন্তত কখনো নিজের উপর কাউকে ছড়ি ঘোরাতে দিবে না,কাউকে ভয় পেয়ে চলবে না।নয়তো মায়ের মতো যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে।
আর ঢাকা শহরে এসে সেই প্রতিজ্ঞা আরো দৃঢ় হয়েছে।

মাহি রূপার হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলো, “কই ছিলি এতোক্ষণ তুই?ছাদে ছিলি?”

রূপা ঝাটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে বললো, “হ্যাঁ ছাদে ছিলাম,কোনো অসুবিধা আছে আপনার তাতে?”

মাহি অবাক হলো রূপার এরকম কড়া জবাব শুনে।এই বাসার প্রত্যেকটা মেয়ে তাকে সমঝে চলে। আর এই গেঁয়ো মেয়ে কি-না তার সাথে গলা চড়িয়ে কথা বলছে!

কিছুটা অপমানিত বোধ করলো মাহি,সেটা রূপাকে বুঝতে না দিয়ে বললো, “রূপকের আশেপাশে যাতে তোকে আর না দেখি আমি,রূপকের আশেপাশে যাবার চেষ্টা করবি না।নাহলে দুই লাথি মেরে বাসা থেকে নামিয়ে দিবো।”

রূপা দমলো না,সাথেসাথে জবাব দিলো, “রূপা এখানে পড়ালেখা করার স্বপ্ন নিয়ে এসেছে, ছেলেদের সাথে লাইন মারার স্বপ্ন নিয়ে নয়।আর আমাকে শাসন করতে আসবেন না,তারচেয়ে আপনার রূপককে ভালো করে বুঝিয়ে দিন অপরূপার আশেপাশে যাতে না আসে।

আরেকটা কথা, এই বাসায় আমি আপনার কথা মতো উঠি নি,তাই নিজের ব্যবহার সংযত করে কথা বলবেন আমার সাথে। পরেরবার এরকম উল্টোপাল্টা শব্দ যাতে বের না হয় আপনার মুখ দিয়ে। ”

রূপা চলে যেতে নিতেই রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে মাহি বললো, “বের হলে কি করবি তুই?”

রূপা মুচকি হেসে বললো, “আপনার হিরোর তো নাক ফাটাবোই সেই সাথে আপনার ঠোঁটে সুপার গ্লু লাগিয়ে দিবো। ”

বাকি মেয়েরা সবাই হা হয়ে তাকিয়ে আছে রূপার মুখের দিকে। রূপা রুমে যেতেই রুমমেট নিপা রূপাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “উফ দোস্ত,তুই তো একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছিস আজকে।এই মাহি আপার ভীষণ অহংকার। নিজেদের বাড়ি থাকা সত্ত্বেও এখানে থাকছে তার হিরোর জন্য। কতো মেয়েকে যে নামিয়ে দিলো বাসা থেকে অযথা সন্দেহ করে। ”

রূপার নিজের ও কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে। এতোটা স্বাভাবিকভাবে জবাব দিতে পারবে তা তার ভাবনাতেও ছিলো না।

সন্ধ্যা বেলায় চা খেতে খেতে রত্না,পান্না গল্প করছিলো দাদাকে নিয়ে। পান্না হাসতে হাসতে বললো, “আপা জানিস তো,2c তে তো দাদাকে নিয়ে ঝগড়াঝাটি হয়ে গেছে এক দফা।আমার ফ্রেন্ড তমা আমাকে বললো। নতুন যেই মেয়েটা এসেছে, ওর সাথে মাহি আপার এক দফা হয়ে গেছে ঝগড়া। ”

পান্না হাসতে হাসতে বোনকে সব কিছু বললো। নিজের রুমে বসে রূপক সবটা শুনতে পেলো বোনদের কথা।

পরদিন সকালে রূপক রত্না পান্নাকে কলেজে দিয়ে আসার সময় আবারও দেখতে পেলো অপরূপা কলেজে যাচ্ছে। বোনদের দ্রুত নামিয়ে দিয়ে এসে রূপক রূপার পিছু নিলো।রূপার পিছু পিছু হাটতে হাটতে বললো, “এই যে মিস তেলতেলে বিনুনি, আপনি নাকি বলেছেন আমার নাক ফাটিয়ে দিবেন?মার্শাল আর্ট শিখেই বলেছেন না-কি না শিখে?
আপনার অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি আমি কিন্তু আরো ৭ বছর আগেই মার্শাল আর্ট শিখেছি। ”

রূপা বিরক্ত হলো রূপকের কথা শুনে।রূপকের কথা থেকে বাঁচতেই রিকশায় উঠে গেলো।

সমুদ্র দাঁড়িয়ে ছিলো একই সময়ে সেই জায়গায় যেখানে সেদিন সে কপালকুণ্ডলাকে দেখেছিলো।দাঁড়িয়ে থেকেই বুঝতে পারলো কপালকুণ্ডলা রূপকদের বাসায় থাকছে।মনটা খারাপ হয়ে গেলো মুহুর্তেই সমুদ্রের।
ঠিক করলো, দুপুরে সে দেখা করবে তার সাথে। কলেজের ড্রেস দেখেই বুঝেছে কপালকুণ্ডলা কোন কলেজে পড়ে।

দুপুরে কলেজ থেকে ফেরার সময় রূপার দেখা হয়ে গেলো গ্রামে দেখা হওয়া সেই ছেলেটার সাথে। দেখা হওয়া মাত্রই রূপা মনে মনে ভাবলো, পৃথিবীটা আসলেই গোল।নয়তো আবারও এই ছেলের সাথে দেখা হবে তা কে ভেবেছে!

সমুদ্র এগিয়ে গিয়ে রূপার পাশাপাশি হাটতে হাটতে বললো, “হাই!আমাকে চিনতে পেরেছেন?ওই যে আপনাদের গ্রামে দেখা হয়েছিলো। আপনি আমাকে সাহায্য করেছিলেন।”

রূপা বিরক্ত বোধ করলো। শহরের মানুষ এরকম গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে কেনো!

সমুদ্র বুঝতে পারলো রূপা বিরক্ত হচ্ছে। ইতস্তত করে বললো, “আপনি মনে হয় বিরক্ত হচ্ছেন। আসলে আমি এরপরে ও কয়েকবার আপনাদের গ্রামে গিয়েছি আপনাকে খুঁজতে। কিন্তু পাই নি,আর যেহেতু আপনার নাম ও জানি না তাই খুঁজে বের করা সম্ভব হয় নি।
এজন্য আপনাকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে পড়ি।”

রূপা শান্ত স্বরে বললো, “অতি উত্তেজনা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না।কিছু মনে না করলে আপনি এবার যেতে পারেন।”

রূপার এরকম রূঢ় ব্যবহার সমুদ্রের মন ছুঁয়ে গেলো । এমন কাউকেই তো সে খুঁজছে এতো দিন,যে বজ্রকঠিন মনের অধিকারী হবে। পরম তপস্যা করে যার মনে সমুদ্রের জন্য ভালোবাসা আনবে সমুদ্র। যে হবে ভীষণ রিজার্ভড।

রূপা খুব রাগ হলো সমুদ্রের এরকম পিছু পিছু আসা দেখে। বোনদেরকে নিয়ে যাওয়ার সময় রূপক খেয়াল করে সমুদ্র রূপার সাথে হেসে হেসে কথা বলার চেষ্টা করছে।সামনেই একটা দোকান দেখে রূপক বাইক ব্রেক করে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে খেয়াল করলো, মেয়েটা সমুদ্রকে তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছে না মনে হয়।

রূপকের ব্যাপারটা হজম হলো না। সমুদ্র এভাবে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করবে এটা রূপকের ভাবনার বাহিরে ছিলো।
রূপার বিরক্ত মুখ,কুঁচকানো ভ্রু সাক্ষ্য দিচ্ছে সমুদ্রের এই পাশাপাশি আসা সে পছন্দ করছে না।

অতি কষ্টে রূপকের হাসি পেলো। এই দিন ও তার দেখা লাগবে কখনো কি ভেবেছে!
যার সাথে এক সময় আত্মার বন্ধন ছিলো, সে ও কোনো মেয়ের কাছে এভাবে ধরাশায়ী হবে এটা ও সম্ভব!
অথচ দুই বন্ধুর পেছনে কতো মেয়েই তো ঘুরেছে,কখনো পাত্তা পায় নি।

রূপক ঠিক করলো ব্যাপারটা নজরে রাখতে হবে। যদি রূপক যা ভবছে তা হয়ে থাকে তবে কাবাবের হাড্ডি রূপক নিশ্চয় হবে।
মনের মধ্যে প্রতিশোধের এক অদম্য নেশা জেগে উঠলো রূপকের।
বোনদের রিকশায় তুলে দিয়ে রূপক বাইক রেখে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে সমুদ্রের পিছু নিলো।

প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে রূপা বললো, “আপনার ধন্যবাদ জানানো তো হয়েছে, এখনো পিছনে আসছেন কেনো?
আমি বিরক্ত হচ্ছি আপনার এরকম ব্যবহারে।”

বেশ উচ্চস্বরে কথাগুলো বললো রূপা,রূপক ও শুনতে পেলো।
মুচকি হেসে রূপক মনে মনে বললো, “বাহ,তেলতেলে বিনুনি তো একেবারে ধানিলঙ্কা। ”

সমুদ্র কিছু বলার আগেই রূপা লাফিয়ে একটা রিকশায় উঠে গেলো। রিকশায় বসে রূপা হিসেব কষতে লাগলো। সকালে যেতে ৩০ টাকা,এখন আবার ৩০ টাকা রিকশা ভাড়া একেবারে অযথাই খরচ করতে হচ্ছে। এই ছেলেগুলো এতো অভদ্র কেনো!
৬০ টাকা রূপার জন্য অনেক কিছু।

মাঝ রাস্তায় হা করে সমুদ্র তাকিয়ে রইলো রূপার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।
এতোটাই নিমগ্ন হয়ে ছিলো যে কখন যে একটা কার তাকে ধাক্কা দিতে যাচ্ছিলো সেটাই তার খেয়ালে ছিলো না।
রূপক ঝাপিয়ে পড়ে সমুদ্রকে রক্ষা করলো দুর্ঘটনার হাত থেকে। সমুদ্রকে সরাতে গিয়ে নিজে রাস্তায় পড়ে গিয়ে হাটুর অনেকটা কে/টে যায় প্যান্ট ছিড়ে গিয়ে। কনুইয়ের চামড়া অনেকখানি উঠে গিয়ে রক্তক্ষরণ হতে লাগলো। ডান হাতের তালুর চামড়া রাস্তায় ঘষা লেগে উঠে গেছে অনেকখানি।

মুহূর্তেই অনেক মানুষ জমে গেলো সেখানে। সমুদ্র নিজেও বুঝতে পারলো না কে তাকে বাঁচিয়েছে।ভীড়ের ভেতর ঢুকে দেখতে গিয়ে দেখলো রূপক।

সমুদ্র এগিয়ে আসার আগেই রূপক উঠে দাঁড়ালো। তারপর একটা রিকশা থামিয়েয় উঠে চলে গেলো।

সমুদ্রের চোখ ভিজে গেলো হঠাৎ করেই। ভীষণ নরম মনের মানুষ হওয়ায় অল্পতেই সমুদ্রের মন খারাপ হয়ে যায়। এই যে কতগুলো দিন দুজন দু’জনকে এড়িয়ে চলছে,একে অন্যকে শত্রু ভাবছে,অথচ দুজনের মধ্যকার বন্ধুত্ব কি আদৌ নষ্ট হয়েছে!
যদি নষ্ট হতো তবে কেনো রূপক এভাবে তাকে রক্ষা করলো!
ঠিক ছোট বেলার মতো করে।
ছোট থেকেই রূপক ভীষণ ডানপিটে।মারপিট করার সময় সবার আগে তাকে দেখা যেতো যেমন, তেমন কারো বিপদেও তাকেই আগে পাওয়া যেতো।
স্বভাবে কিছুটা শান্ত, নির্ভেজাল সমুদ্রর সাথে মহল্লায় যার-ই একটু কথা কাটাকাটি হতো, রূপক আগে গিয়ে তার কলার চেপে ধরতো।
সমুদ্র যতটা মারামারি, ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে চাইতো,রূপক ততটাই জড়িয়ে যেতো।
যখন বন্ধুত্ব ছিলো, কোথাও ঝামেলার কথা শুনলেই সমুদ্র রূপককে এটা সেটার বাহানায় সেই জায়গা থেকে অনেক দূরে নিয়ে যেতো।

সেই প্রাণের বন্ধুই কিভাবে জানের শত্রু হয়ে গেলো!

চলবে….!

রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here