তুমি অপরূপা পর্ব ১৫

0
1123

#তুমি_অপরূপা (১৫)

আগামীকাল শাহেদের ফ্লাইট, সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে।বিকেলে শাহেদ অনামিকাকে নিয়ে বের হলো। দুজনেই একটু সেজেগুজে বের হলো।
রোজিনা ঘরের বারান্দায় বসে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন।ভেতরে ভেতরে তার রাগে ক্ষোভে সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।
এতো রঙঢং কিসের এই মেয়ের!
ভ্যাপসা গরমে রোজিনার সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে, ঘামাচি হয়েছে গায়ে।ভেবেছিলেন অনামিকাকে দিয়ে একটা একটা করে ঘামাচি মারাবেন।
যেভাবেই হোক শাহেদ আর অনামিকাকে আলাদা রাখার প্ল্যান।
শেষ সময়ে এসে সব ভেস্তে যাবে এটা হাসানুজ্জামান, রোজিনা কারোরই কাম্য ছিলো না। প্রায় প্রতি রাতেই রোজিনা হাউমাউ করে কান্না করতেন হাটুতে ব্যাথা বলে। কান্না করতে করতে আজরাইল কে অভিশাপ দিতেন কেনো এতো দেরি করছে তার কাছে আসতে।এই কষ্ট তার সহ্য হয় না।

শাশুড়ীর আহাজারিতে অনামিকা রুমে থাকতে পারতো না। বসে বসে পায়ে মালিশ করতো। রুমে যেতে যেতে গভীর রাত হয়ে যেতো।
দিনে ব্যস্ত রাখতো বিভিন্ন কাজে,কথাবার্তায়।

অনামিকার দুচোখ ভীষণ জ্বালা করছে।বুকের ভেতর আছড়ে পড়ছে কষ্টের নীল ঢেউ।আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। তারপর!
তারপর শাহেদ চলে যাবে তাকে ছেড়ে হাজার মাইল দূরে। চাইলেই আর ছুঁতে পারবে না সে শাহেদকে।হুটহাট রুমে এসে অতর্কিত চুমু খাওয়া, বাহিরে বের হবার আগে হঠাৎ করে বুকে জড়িয়ে ধরা,কোনো কিছু নিয়ে মনমালিন্য হলে কথার মাঝখানে টেনে নিয়ে ঝাপটে ধরা এসব আর পাবে না।কিভাবে থাকবে অনামিকা তখন?
আফসোস হচ্ছে অনামিকার। ভীষণ ভীষণ আফসোস হচ্ছে। কেনো রাজি হলো সে শাশুড়ীর কথাতে শাহেদকে বিদেশে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে!
তার কি সত্যি অনেক টাকা দরকার ছিল?
না-কি শাহেদের সান্নিধ্য দরকার ছিল?

যাকে পাবার জন্য বাবা মা’কে কষ্ট দিতেও দ্বিতীয় বার ভাবে নি অনামিকা, আজ তাকেই কিভাবে দূরে যেতে দিচ্ছে?
ভাবনায় বিভোর হয়ে থাকায় অনামিকা টের পেলো না কখন যেনো নিজেদের বাড়ির সামনে চলে এসেছে রিকশা।
কতো দিন পর বাড়ির সামনে এসেছে অনামিকা। বুকের ভেতর কেমন কেঁপে উঠছে।হঠাৎ করেই নিজেকে ভীষণ স্বার্থপর মনে হলো অনামিকার।
এতোগুলো দিন কেটে গেলো অথচ একবার ও বাড়ির সবার সাথে দেখা করতে এলো না সে।
কেনো এলো না?
ভয়ে?
কিন্তু কার ভয়ে?এতোই যদি ভয় পেতো তবে কেনো বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল সেদিন?
আজ এতোদিন পরে কোন মুখে মা বাবার সামনে দাঁড়াবে?

শাহেদ অনামিকার হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলো। বাড়িতে ঢুকে অনামিকা চমকে গেলো।
সারা বাড়ি কেমন অপরিষ্কার হয়ে আছে। জায়গায় জায়গায় ময়লা জমে আছে, গাছের পাতায় উঠোন ভরে আছে।
মা ঠিক আছে তো!
মা তো এরকম অপরিষ্কার থাকা পছন্দ করে না।

শুকনো পাতার মর্মর শব্দে সালমা চমকে উঠলো। আজকাল দিনের বেলাটা বড্ড ভয়ংকর লাগে তার কাছে,তীব্র আলোতে বড্ড বুক কাঁপে।শান্ত বিকেলের, সুনসান নীরবতা কে যেনো তীক্ষ্ণ শব্দে ভেঙে দিচ্ছে। সালমার মাথার ভেতর সেই শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

ঘরের দরজায় কড়া নাড়লো শাহেদ।সালমা ভয়ে গুটিসুটি মেরে টেবিলের নিচে বসে রইলো দুই হাতে মাথা চেপে ধরে। মাথার ভেতর যেনো কোনো পোকা অনবরত চিৎকার করে যাচ্ছে।
কি যে যন্ত্রণা হচ্ছে!

আলতো ছোঁয়া লাগতেই ভেজানো দরজা খুলে গেলো। অনামিকা ভেতরে প্রবেশ করলো। ভেতরে এসে কাউকেই খুঁজে পেলো না।
বাহিরে গিয়ে দাদীর ঘরের দরজায় কড়া নাড়লো।

অলস দুপুরে সবাই ঘুমাচ্ছে।দুপুর গড়িয়ে যে বিকেল হয়েছে এখনো কারো খেয়াল নেই।শব্দ শুনে অনামিকার ফুফু সুরভি বের হলো ঘর থেকে। আড়মোড়া ভেঙে সামনে তাকাতেই অনামিকাকে দেখে হতবাক হয়ে গেলো সুরভি। তারপর চিৎকার করে অনামিকার দাদীকে ডাকতে লাগলো।

সুরাইয়া বেগম অনামিকাকে দেখে যেমন অবাক হলেন তেমনি কিছুটা রাগ ও হলেন।চলে গেছে তো গেছেই,আবার ফিরলো কেনো।
অনামিকা আর শাহেদ দুজনেই দাদী আর ফুফুকে সালাম করলো।

সুরাইয়া বেগম জিজ্ঞেস করলেন, “এতো দিন পরে কি মনে কইরা আসলি?জামাইয়ের বাড়ির শখ মিটছে বুঝি?আর থাকতে দেয় না?বাইর কইরা দিছে?আবারও আমার পোলার ঘাড়ে আইসা বসতে চাস?”

“না দাদী,এগুলো কি কন আপনে?আমি তো আসছি সবার সাথে একবার দেখা করতে।আপনের নাতজামাই আগামীকাল সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে বাইর হইয়া যাইবো। তাই সবার লগে দেখা করতে আসছে।কিন্তু আম্মা,অপরূপা,অনিতা সবাই কই?আব্বা কি দোকানে গেছে? ”

সুরভি জবাব দিলো, “এতো দিন পরে বাড়িতে আসার কথা মনে পড়লো?
মা যেমন মাইয়া কি ভালো হইবো নি!তোর মা ও তো সেই যে তোর বাপের লগে এই বাড়ি আইসা উঠছে আর যায় নাই নিজের বাপ মা’র বাড়ি।তোরা ও তেমনই হইবি।”

অনামিকার এসব কথা শুনতে ভালো লাগছিলো না তাই আবারও জিজ্ঞেস করলো, “আম্মা কই ফুফু?”

“আমরা কেমনে কমু হেই পাগল কই,তার কি মাথার ঠিক আছে?
কে জানে কই বইসা আছে? ‘

অনামিকা ভ্রু কুঁচকে তাকালো ফুফুর দিকে,শান্ত দিঘির মতো মেয়েটার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো মা’কে পাগল বলে সম্বোধন করায়।কঠোর স্বরে বললো, ” ফুফু,সুন্দর ব্যবহার করতে না পারলে কথা বইলেন না,কিন্তু আমার আম্মারে নিয়া যদি খারাপ কথা কন,তবে আমি ও আপনেরে সম্মান দিয়া কথা কমু না।”

সুরভি রাগে ক্ষুব্ধ হয়ে বললো, “খবরদার অনামিকা, আমার লগে ত্যাজ দেখাবি না,তোগো ত্যাজের ধার ধারি না আমি । আইজ মা’য়ের লাইগা আদর বাইয়া বাইয়া পড়তাছে।সেদিন মা বাপের কথা মনে ছিলো না যেদিনে আরেক নাগরের হাত ধইরা বাপ মায়ের বুকে লাথি মাইরা পালাইয়া গেছস?
আইজ শোকে শোকে যখন পাগল হইছে তোড় মা,তারে পাগল কমু না তো কমু কি?”

অনামিকা কিছু বুঝতে পারলো না ফুফুর কথা। কি বলছে এসব ফুফু?
অনামিকার মাথার ভেতর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে,মাথা কাজ করছে না।

অনিতা স্কুল থেকে ফিরে বাহিরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো দাদীর ঘরের সামনে কারা দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে তাকিয়ে অনামিকা ছোট বোনকে দেখে দৌড়ে বোনের কাছে ছুটে এলো।
অনিতাও অবাক হলো আপাকে দেখে।একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো । শাহেদ সবকিছুতে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।

কাঁদতে কাঁদতে অনিতা বললো, “আপা,তুই কই চলে গেলি আপা?সবাই চলে গেছে আমারে রাইখা। সেজো আপা ও চইলা গেছে শহরে পড়ার লাইগা,মা ও কেমন হইয়া গেছে। সবাই কয় মা পাগল হইয়া গেছে। কারো লগে কথা কয় না মা।কাউরে চিনে না এখন আর। সারাদিন ঘরে থাকে,রাইত হইলে বাইর হয়। আমার অনেক ডর করে আপা।আমার লগে এখন আর কেউ ঘুমায় না।”

অনামিকার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এসব কি শুনছে সে!

বিকেলের দিকে দোকান বন্ধ করে দেয় সিরাজ হায়দার। বাড়িতে এসে দু মুঠো রান্না বসায় বাপ মেয়ে মিলে।সন্ধ্যায় আবার দোকানে গিয়ে বসে।তেমনি আজও বাড়ি এলো । উঠোনে এসে দাড়াতেই দেখে অনামিকা এসেছে।

বাবাকে দেখে অনামিকার গলা শুকিয়ে গেলো ভয়ে।এতোক্ষণ মনে ছিলো না আব্বার মুখোমুখি হতে হবে সেই কথা। অনামিকার মনে হতে লাগলো তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, সেই কোনো গহীনে তলিয়ে যাচ্ছে। কেমন সারা পৃথিবী দুলে উঠলো হঠাৎ করেই, অনামিকার ও মাথা ঘুরতে লাগলো।

শাহেদ এগিয়ে এসে অনামিকার হাত ধরলো। তারপর সিরাজ হায়দারের সামনে এসে তাকে সালাম করলো।

সিরাজ হায়দার সালামের জবাব দিলেন

————–

অন্তরা চুলায় ভাত বসিয়ে আলু কা/টতে বসেছে।সেই সময় দরজায় নক করলো কেউ।একটা পুরনো ন্যাকড়ায় হাত মুছে অন্তরা দরজা খুলে দিলো। একজন অচেনা মহিলা বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলো। অন্তরা চিনতে না পারায় জিজ্ঞেস করলো, “কে আপনি? কার কাছে এসেছেন? ”

ভেতরে উঁকিঝুঁকি মেরে মহিলাটি কোমল গলায় বললো, “রানাবাবু,রানাবাবু কই রে?”

রানা বসে বসে একটা গাড়ি দিয়ে খেলছিলো। মায়ের গলার স্বর শুনতে পেয়ে দৌড়ে বের হয়ে এলো। তারপর রেশমাকে দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো রানা।আকুল হয়ে মা মা বলে কাঁদতে লাগলো রানা।

রানা মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। বড় আকুল হয়ে কাঁদছে।ভীষণ আমধুর একটা দৃশ্য, অথচ এই দৃশ্য দেখে অন্তরা খুশি হতে পারলো না।
অন্তরার গলা শুকিয়ে গেলো রেশমাকে দেখে। কেনো এসেছে রেশমা!

চলবে……

রাজিয়া রহমান

[কেনো যানি ভীষণ আলসেমি ধরে গেছে। লিখতেই পারি না।লিখতে গেলে বারবার কা\টা\কু\টি করি।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here