তুমি অপরূপা পর্ব ১৩

0
1197

#তুমি_অপরূপা (১৩)

দুই তলার দক্ষিণের রুমের দরজা দুপুরের পর থেকে বন্ধ। রত্না,পান্না দুই বোনের মুখ শুকিয়ে একটুখানি হয়ে আছে। দাদা নির্ঘাত আজ খুব বকবে দুই বোনকে।
পান্না ফিসফিস করে বললো, “আপা চল মোনাজাত ধরি,আজকে যাতে দাদা আর না বের হয় রুম থেকে। ”

রত্না ছোট বোনের মাথায় মৃদু আঘাত করে বললো, “তুই কি চাস দাদা সারাদিন না খেয়ে রুমে বসে থাকুক?সব দোষ তোর।বলেছিলাম কোনো দরকার নেই এতো দূরে বান্ধবীদের সাথে যাওয়ার। তা না,নিজে তো গেলি সাথে আমাকে ও নিয়ে গেলি।দেখলি এখন কেমন হলো ব্যাপারটা? ”

পান্নার মুখ শুকিয়ে গেলো বোনের কথা শুনে। বান্ধবীদের কাছে সবসময় শুনেছে একটা জায়গায় নাকি ভীষণ ভালো মালাই চা পাওয়া যায়।আর সেই চা’য়ের নাকি একেবারে রাজকীয় স্বাদ,এক কাপ চা পান করলে পরপর আরো দু কাপ লাগবে যে কারো।কিন্তু সমস্যা একটাই চা বিক্রেতা খালা একজনকে এক কাপের বেশি চা দেয় না।
তার রুলস নাকি একেবারে কঠিন রুলস।

শুনেই পান্নার লোভ জাগলো। তিন ভাই বোন চা প্রেমি হওয়ায় চা’য়ের কথা শুনলে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। তাই বড় বোনকে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে নিয়ে গেলো সাথে করে চা খেতে।
ভাইয়ের আদর,শাসনে বেড়ে উঠা দুই বোনের কাছে ভাইয়ের আদেশ শিরোদার্য।যার কারণে কখনো স্কুল,কলেজ ছাড়া বান্ধবীদের সাথে ও কোথাও যায় না কেউ ভাইকে ছাড়া।

এই প্রথম বার দুই বোন চা’য়ের লোভে গেলো। কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয়,সেখানে সন্ধ্যা হয়
তেমনি হলো । গিয়ে দেখে রূপক বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। হাতে চায়ের কাপ।দুই বোনকে দেখে যেনো হতভম্ব হয়ে গেলো রূপক।
ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো দুই বোন দাদাকে দেখে।

রূপক বন্ধুদের পাশ থেকে উঠে গিয়ে বোনদের সামনে দাঁড়াতেই রত্না,পান্না দুজনেই ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো।
কিছু না বলে রূপক চায়ের অর্ডার দিলো।তারপর চা পান শেষ হতেই বাইক স্টার্ট দিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
কিছু বলতে হয় নি দুই বোনকে।দুজনেই সুড়সুড় করে দাদার বাইকে উঠে বসলো।
সেই যে বাসায় এসে রূপক রুমের দরজা বন্ধ করেছে এখনো সেই দরজা বন্ধ আছে।

রূপকদের পাঁচ তলা বাড়ির প্রতি তলাতে ৪ টি ফ্ল্যাট। দুই তলার দুইটা ফ্ল্যাটে রূপকেরা থাকে,বাকি পুরো বিল্ডিং এ ভাড়াটিয়া আছে।দুই তলার বাকি দুই ফ্ল্যাটে কয়েকটা মেয়ে ভাড়া থাকে।

আজকে 2C তে নতুন একটা মেয়ে উঠেছে। পান্না ফিসফিস করে রত্নাকে বললো,”আপা,নতুন উঠা ওই মেয়েটার কথা মনে আছে তোর?মনে হয় মেয়েটা…….

কথা শেষ করতে পারলো না পান্না,রত্না বিরক্ত হয়ে বললো, “বকবক করিস না পান্না,দাদা এখনো বের হচ্ছে না। মা ও এখনই চলে আসবে।আর এর পর বাবা মায়ের সাথে আবারও এক পালা ঝগড়া হবে দাদার।”

পান্না কি করবে ভেবে পেলো না। বোনকে রুমে রেখে দাদার রুমের দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে পান্না ভাইকে ডেকে বললো, “দাদা,ও দাদা।”

রূপক তখন ল্যাপটপে কাজ করছিলো। তাই আনমনা হয়ে জবাব দিলো, “হু।”

কাঁদোকাঁদো হয়ে রত্না বললো, “আপার কোনো দোষ নেই দাদা,আমি আপাকে জোর করে নিয়ে গেছি ওখানে।তুমি আমাদের উপর রাগ করো না দাদা।আর কখনো এরকম হবে না।তোমার কথার অবাধ্য আর কখনো হবো না আমরা। প্লিজ দাদা দরজা খোলো,আমরাও এখনো কিছু খাই নি।তুমি না খেলে আমরা ও খাবো না।”

ছোট বোনের কথা শুনে রূপকের ভীষণ হাসি পেলো। রূপক জবাব দেওয়ার আগেই রূপকের মা তানিয়া জবাব দিলো, “কি হয়েছে এখানে?তোমার দাদা আজকে আবার কিসের রংতামাশা দেখাচ্ছে? ”

মায়ের কথা শুনে রূপকের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু টগবগিয়ে উঠলো। বিড়বিড় করে রূপক বললো, “আমি তোমাকে ঘৃণা করি মা।জাস্ট হেইট ইউ এন্ড ইওর ফ্যামিলি। ”

মুখে কিছু না বলে রূপক দরজা খুললো। তারপর মায়ের সামনেই পান্নাকে বললো, “নেক্সট টাইম যদি দেখেছি অথবা শুনেছি এরকম সাহস দেখিয়েছিস দুজনের একজন, তবে মনে রাখিস সেদিনই তোদের শেষ দিন।খান বাড়ির মেয়েদের এসব ছ্যাচড়ামি মানায় না পান্না।খান বাড়ির রক্তে এসব নেই অন্য বাড়ির মেয়েদের মতো। ”

ছেলের করা সুক্ষ্ম অপমান তানিয়া তীব্রভাবে অনুভব করলো। রূপক কি তাকে,তার বোন মুনিয়াকে,তাদের ফ্যামিলিকে উদ্দেশ্য করে এসব বললো?
প্রচন্ড রাগে তানিয়ার হিতাহিতজ্ঞান লোপ পেলো। পান্নাকে কষে এক থাপ্পড় মেরে বললেন, “নিজেদের রক্ত কতটা বিশুদ্ধ সেটা আমার জানা আছে। এজন্যই তো এখনো এক মেয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে আছে।তারা আবার বড়াই করে। ”

রূপক সদর দরজায় এক লা/থি দিয়ে বললো, “পান্না,ওনাকে নিষেধ কর কথা যাতে না বাড়ায়।তা না হলে আমি এখন যে কি করবো তা আমি নিজেও জানি না।”

ভয়ে পান্নার হাত পা কাঁপতে লাগলো মায়ের আর দাদার এসব কথা কাটাকাটি শুনে ।
কবে যে এরা দুজন এক হবে কে জানে!

বাহিরে এতো জোরে শব্দ শুনে রূপা চমকে উঠলো। বের হতে যেতেই সহপাঠী নিপা বললো, “আজকে নতুন তো তুই, তাই অবাক হচ্ছিস।বাড়িয়ালাদের বাসায় এসব নিত্যদিনের কাহিনী। হিরো আর হিরোর মা’য়ের মধ্যে আবারও লেগে গেছে মনে হয়। ”

কিছু বুঝতে না পেরে রূপা দরজা খুলে বের হলো। রূপাকে দাঁড়িয়ে মজা নিতে দেখে রূপকের মেজাজ সপ্তমে উঠে গেলো। ঝাঁজালো কণ্ঠে বললো, ” নাটক দেখতে এসেছেন এখানে?মঞ্চ নাটক হচ্ছে, যান এবার আর কেউ থাকলে সবাইকে নিয়ে আসেন।”

রূপা হতভম্ব হয়ে গেলো রূপকের কথায়।সেই সাথে ভীষণ অপমানিত ও বোধ করলো। রূপা যেতে যেতে শুনতে পেলো রূপক বলছে,”যতোসব ফালতু লোকজন। ”

রূপার ভীষণ গায়ে লাগলো রূপকের কথা।ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, “কি বললেন আপনি? কাকে ফালতু বললেন আপনি? আপনি নিজেই ফালতু,অসভ্য লোক।মেয়েদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেই ম্যানার ও জানেন না আপনি। ”

রূপককে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রূপা দরজা বন্ধ করে দিলো।

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে রূপক বিড়বিড় করে বললো, “আশ্চর্য! এই মেয়েটা আমাকে এসব বললো কেনো?আমি তো এই মেয়েটাকে কিছু বলি নি।যা বলার আমার নানার বাড়ির লোকদের উদ্দেশ্য করে বলেছি।তাহলে মেয়েটা ভুল বুঝলো কেনো আমাকে? ”

ভেতরে যেতেই নিপা বললো, “হিরোকে দেখলি তো?ক্রাশ খেয়ে বসিস না আবার।অলরেডি মাহি আপা ক্রাশ খেয়ে হিরোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। মাহি আপা যদি জানতে পারে কেউ তার হিরোর দিকে নজর দিয়েছে তবে তাকে এই মেস থেকে বের করে দেয় বুঝলি।তাই সাবধান। ”

রূপা ভ্রু কুঁচকে বললো, “রূপা এখানে বাবার স্বপ্ন পূর্ণ করতে এসেছে নিপা,কারো প্রেমে হাবুডুবু খেতে নয়। ওসব ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমার একটাই লক্ষ্য আমাকে বাবার সব ইচ্ছের মূল্য দিতেই হবে।”

মোবাইল বের করে রূপা বাবাকে কল দিলো। সিরাজ হায়দার তখন দোকানে বসে ছিলেন।মেয়ের কল পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে রিসিভ করলেন।

বাবার সাথে কথা বলে রূপার মন কিছুটা হালকা হলো।
আজ প্রায় এক মাস হলো রূপা ঢাকা এসেছে। প্রথমে একটা লেডিস্ হোস্টেলে বাবা তাকে তুলে দিয়ে গিয়েছিলো। হোস্টেলের চাইতে এখানে খরচ কম হওয়ায় রূপা বাবার সাথে কথা বলে এই বাসায় এসে উঠে। রূপা জানে না হোস্টেল পরিবর্তনের সাথে সাথে তার জীবনে আর কি কি পরিবর্তন ঘটতে চলেছে।

————–

অনেক বুঝানোর পর অনামিকা শাহেদকে রাজি করাতে পারলো বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে। অবশেষে শাহেদের সৌদির ভিসা এলো। একটা দোকানের সেলসম্যানের চাকরি।মাসে বেতন ২ হাজার রিয়াল।
যেদিন ভিসা পেলো সেদিন রাতেও শাহেদ অনামিকাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমার মন টানতাছে না অনামিকা। আমি তোমারে ছাইড়া যাইতে চাই না।আমার বেশি টাকা পয়সা কামানোর শখের চাইতে তোমার কাছে থাকনের শখ বড় বেশি। আমারে এমনে দূরে পাঠাই দিও না।”

অনামিকার ও কি ইচ্ছে করে শাহেদকে ছেড়ে থাকতে? কিন্তু কি করবে সে।শ্বশুর, শাশুড়ী নয়তো মনে কষ্ট পাবে।শেষ বয়সে তাদের অনেক কিছুরই শখ আহ্লাদ,অনেক টাকা ইনকাম করতে না পারলে সেই শখ শাহেদ পূর্ণ করতে পারবে না।তাই নিজের আবেগকে দমিয়ে রেখে অনামিকা বললো, “আপনি এরকম করলে হইবো! আপনার কি আর ভাই আছে যে আব্বা আম্মার শখ তারা পূর্ণ করবো। তাছাড়া ভবিষ্যতে দেখবেন আমাগো নিজেগো জন্যও টাকা পয়সা দরকার অনেক।”

শাহেদ অনামিকার বুকে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে বললো, “তাহলে চলো,আমার টাকা পয়সা খরচ করার লাইগা একজনরে দিয়া যাই তোমারে।”

অনামিকা আৎকে উঠে ছিটকে সরে গেলো শাহেদের আলিঙ্গণ থেকে। তারপর বললো, “এতো তাড়াহুড়া ক্যান!
আপনি একবার ঘুরে আসেন ওই দ্যাশ থাইকা।তারপর এসব ভাবনা চিন্তা করমু।”

শাহেদ মুচকি হেসে বললো, “এখন বুঝতাছো না অনামিকা। আমি চইলা গেলে বুঝবা।তখন কইবা যদি একটা বাবু থাকতো তাইলে সময় কাইটা যাইতো আনন্দে। আমারে ও পাইবা না,বাবু নাই,একলা একলা খুব যন্ত্রণা পাইবা।আমার কথা শুনো অনামিকা,পিল খাইও না এই কয়টা দিন।”

অনামিকা ভেংচি কেটে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। কি করবে অনামিকা, শাহেদকে তো সে বলতে পারবে না শাহেদের মা অনামিকাকে বলেছিলো এতো তাড়াতাড়ি যাতে বাচ্চার চিন্তা না করে। তার ছেলেই নাকি এখনো ছোট। এখন বাচ্চা নিলে লোকে হাসাহাসি করবে। শাহেদ ও ওই দেশে থাকতে চাইবে না।একটা উছিলায় দেশে চলে আসবে।

বোকা অনামিকা বুঝলো না শ্বশুর শাশুড়ির উদ্দেশ্য।

চলবে…..

রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here