তুমি অতঃপর তুমিই
পর্ব-১৭
#Taniya_Sheikh
আজকে দুপুরের খাবারে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে ইরার বর আরশাদ শিকদারকে। আরশাদ পেশায় একজন ব্যবসায়ী।আরশাদের বাবা আনিস শিকদারও ব্যবসায়ী। তাদের নিজস্ব কাপড়ের ব্যবসা। তবে আরশাদ ফ্যামিলি বিজনেস বাদ দিয়ে নিজের পছন্দের ভিন্ন বিজনেস গড়েছে। আরশাদের বিয়ে নিয়ে প্রথমে বাড়ির লোকের আপত্তি থাকলেও এখন তারা খুশি। এই খুশি হওয়ার অন্যতম কারণ ইরা। মেয়েটিকে দেখে প্রথমে অবাকই হয়েছিলেন আনিস শিকদার। তার ছেলের সুবুদ্ধি হয়েছে এ যেন চোখে না দেখলে তিনি বিশ্বাসই করতেন না। তাদের মনে আশা জেগেছে নতুন করে। তাদের বিশ্বাস এই মেয়েই আরশাদের বেপরোয়া জীবনে লাগাম টানবে। মানুষের আশা,স্বপ্ন মরিচিকা হয়ে ধরা দেয় মাঝে মাঝে। আনিস শিকদার ছেলেকে বুঝিয়েছে। বলেছেন,
” জীবন বদলানোর এই সুযোগ পায়ে ঠেলো না বাবা। এই মেয়ে লক্ষি। এর মনে কখনো কষ্ট দিও না। এই তোমার ভবিষ্যত সুন্দর করতে সাহায্য করবে।”
আরশাদ অদ্ভুত ভাবে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেঁসে বলেছিল,
” জি আব্বু।” আনিস শিকদার আল্লাহর কাছে শোকরিয়া করলেন। সেদিন রাতে বহুবছর পর ভালো ঘুমিয়েছিলেন তিনি।
আরশাদকে আকাশী রঙের শার্ট, কালো প্যান্টের ফর্মাল সাজে চমৎকার লাগছিল। এখনকার তাকে দেখে আনিস শিকদার কেন! যে কারোই ভ্রম হবে। বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের আড়ালে কতোটা কপটতা ধারণ করা যায়, কেবল আরশাদই জানে। গিরগিটি দেখেছেন কখনো আপনারা? এ হচ্ছে সেই গিরগিটি।
ইমা নিচতলায় এসে বসার ঘরে আরশাদকে দেখল। একমনে মোবাইল টিপছে। ইমা এদিক সেদিক চেয়ে মামিদের কাউকে না দেখে বসার ঘরে পা রাখল। সাবধানে ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়াল আরশাদের সামনে। আরশাদ মোবাইলে এতোটাই মগ্ন ছিল যে, ইমার উপস্থিতি সে টের পায় নি। ইমা গলা ঝাড়তেই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। মোবাইলটা দ্রুত পকেটে পুরে দাঁড়িয়ে যায়। ইমার কপাল কুঁচকে গেল আরশাদের ভয় পাওয়া দেখে। আরশাদ ইমার মুখের ভাব বুঝে নিজেকে সামলে বোকার মতো হাসল। বললো,
” আসসালামু আলাইকুম। আপনি নিশ্চয়ই ইমা আপু। আমি আরশাদ।”
ইমা কঠিন স্বরে বললো,
” ওয়ালাইকুম আসসালাম। বসেন।”
আরশাদ বসল। অনবরত ঢোক গিলছে, হাত কাঁপছে তার। সেটা লুকাতেও সফল একপ্রকার সে। ইমা টিস্যু বক্স টা সামনের সেন্টার টেবিলের উপর শব্দ করে রেখে বললো,
” আরশাদ সাহেব, আমি বাঘ, ভাল্লুক নয় যে এমন ভয় পাওয়া লাগবে। নাকি মনে চোরা বিড়াল নিয়ে ঘোরেন? ”
আরশাদ সোজাসুজি ইমার দিকে তাকাচ্ছিল না। ইমার কটাক্ষে নড়চড়ে বসল। মৃদু শব্দে গলা ঝেড়ে বললো,
” সরি আমি বুঝি নি আপনার কথার অর্থ?”
” না বুঝলে সমস্যা নাই মাগার বেশি বুঝলে সমস্যা প্রকট। আশা করব বোধবুদ্ধি বুঝে শুনে খাটাবেন।”
” আপনি কী আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? ”
” ভয়! আপনাকে ভয় কেন দেখাব? আমার ইরার বর আপনি। ভয় আমি দেখাই না জনাব। তবে মনে চোর থাকলে মানুষ এমনিই ভয় পায়।”
” মানে!”
ইমার মুখের কাঠিন্য সাথে সাথে হাসির ঢেউয়ে মুছে যায়। শব্দ করে হেঁসে দু’টো টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলে,
” মানে মোবাইলে মনোযোগ কম দিয়ে আমার বোনের দিকে মনোযোগ বাড়ান। নতুন নতুন বিয়ে অথচ মোবাইল নিয়ে পড়ে আছেন। খুবই খারাপ।”
আরশাদ টিস্যু হাতে নিয়ে ঢোক গিলে ফের হাসল,
” ওহ! আমি ভেবেছি।”
” কী ভেবেছিলেন?”
” না! তেমন কিছুই না। আপনি বেশ মজার। পরিচিত হয়ে ভালো লাগল। বসুন না।”
” না থাক। আপনি নাস্তা খান আমি দেখি ইরা কী করছে?”
আরেকবার হাসি বিনিময় করে ইমা বেরিয়ে যায়। আরশাদ লম্বা করে শ্বাস ছেড়ে আনমনে হাসে। হাতের টিস্যু দিয়ে কপাল মুছতে মুছতে তাকিয়ে রইল ইমার যাওয়ার পথে।
বিকেলে খাওয়া দাওয়া শেষে আরশাদের অনুরোধে ইরা লং ড্রাইভে যেতে রাজি হয়। ওদের আকদ হয়েছে একদিনও হয়নি এরমধ্যেই আরশাদকে মনে ধরেছে ইরার। বিয়ে নামক সম্পর্ক বুঝি একেই বলে। অচেনা,অজানা মানুষও একরাতের ব্যবধানে কতো জনমের আপন হয়ে যায়। আরশাদ বেশ খোশমেজাজে,রোমান্টিক। গতকাল রাতে তো ঘুমাতেই দেয়নি ওকে। সারারাত মোবাইলে গল্প করে কাটিয়েছে দু’জন। জীবনটা স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর মনে হচ্ছে এখন ইরার। মনে হচ্ছে দারুন ভালোলাগার একটা ঘোরের মধ্যে আছে সে। ইরার মনে বিয়ে নিয়ে যত কষ্ট, অভিমান,অভিযোগ ছিল। সব দূর হয়ে গেছে আরশাদের সান্নিধ্য পেয়ে। ড্রাইভে যাওয়ার আগে বাড়ির সবার সাথে হেঁসে কথা বলেছে ও। গাড়িতে ওঠার আগে ইমাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিয়ে বলেছে,
” অনেক গল্প করব আজ তোমার সাথে। যতরাতই হোক ঘুমাবা না কিন্তু।”
ইমা বোনের কপালে চুমু দিয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলেছিল। যাওয়ার সময় কড়িডোরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে বিদায় দিয়েছিল ইরাকে। ইমার মনটা আজ খুব ভালো। ইরাকে খুশি দেখে মনের সব শঙ্কা,বেদনা দূর হয়েছে। হালকা লাগছে ভেতরে ভেতরে। ইরার যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পর শানের কল আসে। অবশেষে শান ফিরছে আগামীকাল। মোবারকের স্ত্রী এখন অনেকটাই সুস্থ। ইমার বুক দুরুদুরু করছে। শান কুমিল্লা থেকে সোজা এখানেই আসবে। আর তারপর কী হবে! ইমা ভাবতে পারছে না। এসব ভাবনা চিন্তা থেকে নিস্কৃতি পেতে সাজ্জাদ কে নিয়ে বাড়ির পাশের মাঠে চলে আসে। অনেকদিন বাদে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্রিকেট খেলে পাড়ার ছেলেপেলের সাথে। সন্ধ্যার পর সাজ্জাদকে নিয়ে মাঠের পাশের খালপাড়ে বসে। সন্ধ্যার পর খালপাড়ের পরিবেশ মনোরম হয়ে ওঠে। বেশিভাগ বড়রাই নামাজ শেষে এখানকার খোলা বাতাসে বসে গল্পে মেতে ওঠে। মাঠের পাশের হেডলাইটের আলোও কিছুটা এখানে পড়ে। খালপাড়ের এককোনে অনেক কচুরিপানা জমেছে। ইমারা বসেছে উল্টো দিকে। এদিকটার পানি টলমলে। উপরে যতোই টলমলে দেখাক এই পানিতে রয়েছে হাজার হাজার জীবাণু। পুরো এলাকার ময়লা এর পুব পাশে ফেলা হয়। ওদিকটাই কেউ তেমন যায় না। এদিকের পরিষ্কার দিকটার দেয়ালের উপরই সবাই বসে আড্ডা দেয়। আর মধ্যে রাতে চলে মদ জুয়ার আসর। অদূরে বাদাম ভাঁজা হচ্ছে ভ্যানের উপর, ঝালমুড়িওয়ালা বসেছে। যারা আড্ডা দেয় তাদেরই বেশিরভাগ ক্রেতা।
ইমা সাজ্জাদকে দিয়ে বাদাম, ঝালমুড়ি এনে খেতে খেত গল্প করছে। গল্প করতে করতে সাজ্জাদ মুখ ফসকে বলে দেয় শান এবং তার গোপন কথা। সেদিন শানের সাথে সাজ্জাদ ইমাকে নিয়েই কথা বলছিল। শানের নিষেধ থাকায় ইমাকে সেদিন বলতে পারেনি। সাজ্জাদই শানকে বলেছে ইসরাত জাহান ইমার সার্টিফিকেটের নাম। বেচারা ইমার সামনে এসব বেফাঁস করে দেওয়ার পর মুখ কাচুমাচু করে ফেলে। সাজ্জাদের ওমন ভীতু চেহারা দেখে হাসতে লাগল ইমা। সাজ্জাদের গলা একহাতে পেঁচিয়ে ধরে বললো,
” তোকে তো অস্কার না হয় নোবেল দেওয়া উচিত। ইশ! আজ যদি আলফ্রেড নোবেল হতে পারতাম। আচ্ছা যা, আলফ্রেড নোবেল না হয়েছি তো কী? ইমা তো! তোকে একটা নতুন সাইকেল কিনে দেব।”
সাজ্জাদ চোখ কপালে তুলে বললো,
” সাইকেল!”
” হ্যাঁ। কাজই করেছিস এমন যে আরও বড় কিছু দিতে ইচ্ছা করছে তোকে।”
সাজ্জাদ ভাবতে লাগল কী এমন মহৎ কাজ করেছে সে। ভেবে ভেবেও কূলকিনারা পেল না। তবে শানকে ইমার নাম বলাতেই যে বিশেষ কিছু হয়েছে, সেটা বুঝে ইমার দিকে ভ্রুকুটি করে বললো,
” তুমি শান ভাইকে লাইক করো?”
ইমার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সাজ্জাদের মুখ চেপে এদিক সেদিক তাকিয়ে বললো,
” হুশ!”
সাজ্জাদের চোখ দু’টো চকচক করে ওঠে। কোনোমতে ইমার হাতটা মুখ থেকে সরিয়ে দৌড়ে দূরে গিয়ে বললো,
” হে!হে! শুধু সাইকেলে হবে না। আরও কিছু নেব আমি।”
” তবে রে বজ্জাত। দাঁড়া তুই।”
ওরা দৌড়ে মাঠে চলে এলো। ক্লান্ত হয়ে ইমা হাঁটু ভর দিয়ে নুয়ে থামলেও সাজ্জাদ দৌড়ে মাঠের বাইরে যেতে যেতে বললো,
” ইমাপু, আমি যা চাইব না দিলে কিন্তু সব ভাইরাল।”
ইমা পা গুটিয়ে বালুর মধ্যে বসে লাজুক হাসি হাসতে থাকে। সে জানে সাজ্জাদ বলবে না। তবুও ছোট তো! মুখ ফসকে যদি বের হয়? হোক! কালই তো সবাই জানবে। কী জানবে! জানবে ইমার শানের বউ! ইমা লজ্জা রাঙা হয়ে ওড়না কামড়ে উঠে দাঁড়ায়।
রাত একটা হয়ে গেলেও ইরা ফিরল না। ইমার ছোট মামা,বড় মামা কল করে বন্ধ পাচ্ছে আরশাদ, ইরার নাম্বার। মামাদের সাথে ইমাও চিন্তিত। ইরার মা,চাচি ওদের এমন বার বার কল করতে দেখে ভৎসর্না করল। নতুন বর বউকে এমন বিরক্ত করাটা পছন্দ হলো না তাদের। যদিও মনে মনে তারাও চিন্তিত। ইমার কথামত ইমার বড় মামা আরশাদের বাবাকেও কল করে। দু একবার রিং হতে তিনি রিসিভ করেন। সব শুনে অভয় দেন ইমাদের। কিন্তু কেন যেন ভীত ইমার মন। শানকে জানাতেই শান ইমাকে সান্ত্বনা দিয়ে খোঁজ খবর শুরু করে।
মধ্যরাতে ইমার মামার মোবাইলে আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। জানানো হয় যত তাড়াতাড়ি তারা যেন মিটফোর্ড হসপিটালে পৌঁছে যায়। কেন তার কারন তাদের বলা হলো না। পুরো বাড়িতে হুলস্থূল লেগে গেল। ইমা মামাদের সাথে গেল হসপিটালে। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ভয়ংকর হৃদয়বিদারক এক দৃশ্য। রিশিপসনিস্টের ইশারায় একজন ওয়ার্ড বয় এসে ওদের মর্গে নিয়ে এলো। ইমার হাত পা কাঁপছিল মর্গ দেখে। ছোট মামার মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না কিছুতেই। কেন যেন ভয় ইরাকে ঘিরেই ওদের। সেই ভয় সত্যি হলো ইরার লাশের উপর থেকে সাদা কাপড় সরাতেই। ইমার মনে হলো পায়ে কেউ পেরেক ঠুকে দিয়েছে। একচুল নড়তে পারল না ও। আশেপাশে কী হলো কিছুই বুঝতে পারল না সেই মুহুর্তে। ইরা যখন বাসা থেকে বের হচ্ছিল, তখন নীল শাড়ি পড়ে খুব সুন্দর সেঁজেছিল। মুখে ছিল চিরচেনা মিষ্টি হাসি। এখন তার লেশমাত্র নেই। রক্তে সারা শরীর ভেজা। চুলগুলো উশকোখুষকো। ইমার ছোট মামা বাকরুদ্ধ। তাকে সামলানোর মতো অবস্থা ইমা কিংবা ইমার বড় মামার রইল না। তবুও ইমার বড় মামা নিজেকে সামলে চিৎকার করে ওয়ার্ড বয়কে জিজ্ঞেস করলেন,
” কেমনে হলো এই সর্বনাশ। আমার পুতুল মা’টা এমন করে শেষ হয়ে গেল কেমনে?”
ওয়ার্ড বয় শান্ত গলায় জবাব দিল,
” রোড এক্সিডেন্ট। সন্ধ্যায় যখন উনাদের নিয়ে আসা হয়েছিল তখনই মেয়েটা মারা গেছে। তার স্বামী আইসিইউতে আছে।”
চলবে,,,,