তুমি অতঃপর তুমিই পর্ব – ১১

0
3206

তুমি অতঃপর তুমিই
পর্ব – ১১
Writer Taniya Sheikh

ইমার মনের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ স্তিমিত এ ক্ষনে। এরজন্য একপ্রকার সাধনা করতে হয়েছে গত দু’চারদিন ধরে। দিবাস্বপ্ন হোক কিংবা নৈশস্বপ্ন, সবখানেই শানের অবাধ বিচরণ ছিল। কী যে মধুর যন্ত্রণা! তা যারা পড়ে নি প্রেমে, তারা বুঝবে কী করে? রাতের ঘুম নির্ঘুম করে,রোদনে রোদনে চোখ ফুলিয়ে মনকে শাসিয়েছে, বুঝিয়েছে। মন কী কভু সহজে মানে শাসন? ভ্রম! ভ্রম!এ যে কেবলই ইমার ভ্রম। নয়ত এখন আবার তার নাম শুনে মন আনচান করছে কেন? শরীর কাঁপছে। ঠক ঠক করে কাঁপছে। শীতের প্রকোপে নয়,প্রেমের প্রকোপে।

ইরার ছোট ভাইয়ের খৎনা উপলক্ষে গতকাল থেকেই অনুষ্ঠানের কাজে ব্যস্ত ইমা। আজ শ’খানেক লোকের খানাপিনার আয়োজনে বিশাল প্যান্ডেল টানানো হয়েছে বাড়ির পাশের খালি জায়গায়। মামাদের সাথে সাথে ইমাও তদারকি করছে। বাজারে বড় মুদি দোকান আছে ইমার বড় মামার। কর্মচারী বলতে একটা ছোট্ট ছেলে সবসময় থাকে ইমার মামার সাথে। ছোট ভাইয়ের ছেলের খৎনার অনুষ্ঠান দেখভাল করতে গিয়ে দোকান সামলাতে সমস্যা হচ্ছিল। অনন্যোপায় হয়ে ইরাকে দিয়ে সেখানে ইমাকে পাঠান তিনি। সকাল থেকে দোকানেই আছে ইমা। বারো বছরের বাবলুর সাথে দোকান সামলাচ্ছে। এখন আর ওসব অনুষ্ঠানে থাকতে ইচ্ছা করে না ইমার। তার উপর যখন শুনল শানও আসবে। ইমা কী আর সেখানে থাকে? ইচ্ছা করেই এখানে বসে আছে কোনোদিক না গিয়ে।

দুপুর গড়াতেই দোকানে ক্রেতাদের ভীর কিছুটা কমলো। বাবলুকে এককাপ চা আনতে পাঠিয়ে এক পা তুলে আয়েশ করে বসল গদিঁ আঁটা চেয়ারে ইমা। সামনের পানের পসরা থেকে পান তুলে মুখে পুরে গুনগুন করছে,

” পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম। বন্ধুর দেখা পাইলাম না,,,”

পানের বোটায় লাগানো চুন দাঁতে লাগিয়ে ফের গুনগুন করতে থাকল। মাথার উপর ফ্যানের বাতাসে এই ভর দুপুরে ঘুমঘুম বোধ হচ্ছে ওর। আচমকা কোথা থেকে দোকানে ছুটে আসে ইরা। হাঁফাতে হাঁফাতে বললো,

” আপু শান ভাইয়া তোমাকে খুঁজছে। ”

মুখে জমা পানের রস গলায় আঁটকে গেল ইমার। খুকখুক করে কাঁশতে লাগল বোনের দিকে চোখে পাকিয়ে। মাথা চাপড়ে ইরার কাছে পানি চাইল। ইরা ভয়ই পেল বোনকে এমন করে কাশতে দেখে। পানি এগিয়ে দিতেই জোরে সোরেই ইরার বাহুতে চড় মারে ইমা। কুলি করে গলা ঝেড়ে বললো,

” শান আইছে না এলাকায় ডাকাত পড়ছে তাই ক আগে? বলদির বলদি। বেকুবের বেকুব। এমনে আচমকা আইছোস কেন সামনে?”

ইমার চড়া গলায় মুখ কাচুমাচু করে ইরা বলে,

” তো কী করতাম? শান ভাই ই বললো তোমারে ডাকতে।”

ইমা মুখ ভেংচে ইরার কথা পুনরায় ব্যঙ্গ করে বললো,
” শান ভাই ই বললো তোমাকে ডাকতে। শান ক্যাডা! ঐ ডা আমারে খুঁজে কেন?”

” তুমি শান ভাইকে ভুলে গেলে?” ইরার বিস্মিত চেহারা দেখে ইমা অবজ্ঞার সুরে বলে,

” ভোলাভুলির কী আছে? সে কী ভেরি ইম্পটেন্ট পার্সন? মনের মধ্যে, কইলজ্জার মধ্য গাইত্থা রাখন লাগব নি তারে? হু!” ইমা ঠোঁট বাঁকিয়ে ঘার নাড়ায়। ঠিক সে’সময় জাম রঙের শার্ট পরিহিত শান ঘাড় নিচু করে দোকানের ভেতর প্রবেশ করে। ফর্মাল পোষাকে শানকে দেখলেই ইমার চোখে ধাঁধাঁ লেগে যায়। অবশ্য বাসার ঐ সাদামাটা টিশার্টেও কম লাগে তা নয়।একহাতে সানগ্লাসের ডাটা ধরে তীক্ষ্ণ চোখে ইমার দিকে চেয়ে থামল সে। ইমা স্তব্ধ হয়ে বড়সড় একটা ঢোক গিললো। ইরা ঠোঁট টিপে হেঁসে বললো,

” ঐ দেখো ভাইয়া চলে আসছে। আচ্ছা তোমরা কথা বলো আমি যাই।”

ইমা হাত বাড়িয়ে থামানোর পূর্বেই ছুটে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায় ইরা। বোনকে ইমা মনে মনে বকা দিল। নখ কামড় মিনমিন করে বললো,

” আপনি কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন?”

” কষ্ট! নো ওয়ে। এটা কোনো কষ্টই না ওসব পীড়ার কাছে, যা প্রতিনিয়ত তুমি আমাকে দিয়ে যাচ্ছ।” স্থির কঠিন শানের চাহনি।

” অ্যাআআ। কিছু বললেন?”

শান দাঁত কামড়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অতি সন্তর্পণে। ইমার কৌতূহলি চোখজোড়া দেখে এগিয়ে বলে,

” বললেই বা কী? তোমার মতো মেয়ের মাথায় সেসব ঢুকবে না সহজে।”

” মানে?”

” তোমার মাথা। চুপ একদম।” ধমক খেয়ে চমকে ওঠে ইমা। গাল ফুলিয়ে বসতে গেলে শান পুনরায় আঙুল তুলে বলে,

” নো। দাঁড়িয়ে থাকো।”

” কেন? দাঁড়াব কেন? তোর মুল্লুকের দাসী নাকি যে বসো! দাঁড়াও! বললেই মানতে হবে, শুনতে হবে। খাটাশ, কাইষ্টা। হু! হু!” ঠোঁট জোড়া এপাশ ওপাশ করে দুইবার ভেংচি কেটে দাঁড়িয়ে রইল ইমা।

শান দোকান ঘুরে ঘুরে দেখছিল। যদিও তার দেখার চোখ ইমাতেই সীমাবদ্ধ। এসব তো ছুতামাত্র। ইতোমধ্যে বাবলু কড়া লিকারের এক কাপ দুধ চা নিয়ে এলো ইমার জন্য। দোকানে ঢুকামাত্রই তার চোখ শানের উপর পড়ে। চা হাতে ভ্যাবলার মতো চেয়ে একবার শানকে দেখছে, আরেকবার ইমাকে। বাবলুর মনে হলো ইমা ইমা নয় বরং একটা ভীরু খরগোশ। শান ঘুরে বাবলুর সামনে ঝুকে দাঁড়ায়। পাঁচ’শ টাকার একটা নোট বাবলুর পকেটে গুঁজে গালে হাত রেখে বললো,

” যাও হোটেল থেকে কিছু খেয়ে আসো।”

বাবলু দাঁত বের করে হাসল। চকচকে পাঁচশ টাকা হাতে নাড়াচাড়া করে ঘাড় বাঁকিয়ে ইমাকে বললো,

” আফা যামু?”

ইমা মাথা নাড়িয়ে না ইশারা করতেই শান ওর দিকে ঘুরে তাকায়। শান ভ্রু কুচকে তাকালে ইমা অনিচ্ছা পূর্বক হেঁসে বলে,

” যা!”

বাবলু ঝড়ের বেগে ছুটে চলে যায়। ইমা অসহায়ের মতো চেয়ে আছে সেদিকে। চোখ ঘুরিয়ে শানকে দেখে হাত মুচরায়। সে যতোবার চেষ্টা করছে এই লোকের মোহ কাটাতে, ততোবার দ্বিগুনভাবে মোহে জরিয়ে যাচ্ছে। এমন চলতে থাকলে তো দুইদিন পর রাস্তায় রাস্তায় দোতরা নিয়ে নামবে গাইতে গাইতে,

” পরাণের বন্ধুরে পাগলি হইলাম তোর কারণে। ধ্যাৎ!”

” কী হলো বিরবির করছ কেন?”

” তো কী করব? আপনিই তো বলেছেন চুপ! একদম চুপ।” ইমা মুখ ভেংচায় আবার।

” আমার সব কথা শোনো কেন? ভয় পাও আমাকে?” শান এগিয়ে ইমার দিকে ঝুকে বলে।

ইমা চোখ বন্ধ করে, ঠোঁট চেপে মাথা নাড়ায়। শান ইমাকে মূকাভিনয় করতে দেখে রেগে বললো,

” এমন করছ কেন? চোখ খোলো। খোলো চোখ।”

ইমা খুলবে না বলে মাথা নাড়ায় ফের। শান রাগত স্বরে বলে,

” না খুললে কিন্তু খারাপ কিছু ঘটে যাবে। আমাকে দোষ দিতে পারবে না তখন।”

ইমা পেছনের দেয়াল ঘেঁষে সরে দাঁড়িয়ে দম ছাড়ে। বুকে হাত রেখে বলে,

” এতো কাছে আসেন কেন? আপনি এতো কাছে আসলে দমবন্ধ হয়ে যায়, টাইফয়েডের রোগীর মতো শরীরে টেম্পারেচার বাড়ে, কাঁপে। এই দেখুন এখনও কাঁপছে।” ইমা নিজের কম্পনরত হাতদুটো শানের দিকে মেলে দেখায়। শান চট করে ইমার একটা হাত ধরে বুকের বা’পাশে রেখে বলে,

” আমার কী হয় বুঝতে পারছ?” ইমা চকিত নয়নে শানের ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকিয়ে, আবার শানের চোখের দিকে তাকায়। ইমার মাথা ভনভন করছে,পায়ের তলে সুরিসুরি অনুভব হচ্ছে, সমস্ত শরীরে ঝিনঝিম ভাব আসে। অবনত মুখে হাত টানছে প্রানপণে। একসময় ইমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে শান দোকানের পণ্যসামগ্রী দেখতে লাগল। অভিব্যক্তির রেশমাত্র নেই তার মুখে। ছেড়ে দেওয়া হাতটা ইমা অন্যহাতে নিয়ে বুকে ঠেসে ধরে। নাক ফুলিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,

” আপনি আমার কাছে কী চান বলুন তো? কেন এমন করছেন আমার সাথে? আমাকে শিক্ষা দেওয়ার মনোবাসনায় যদি এমন করেন তো শুনুন, শিক্ষা আমার ঐদিন রাতেই হয়ে গেছে। এখন আমি আগের মতো চলি না। আমার চরম শিক্ষা হয়েছে ঐদিন। এবার আমাকে ক্ষমা করুন। আমার পিছু ছাড়ুন। আমি আর নিতে পারছি না এসব।”

শান হ্যাঁচকা টানে দোকানের সেলফের আড়ালে নিয়ে দু’হাতে ইমার বাহুধরে বলে,

” এতো সহজ সব হলে তো আজ আমার এই হাল হতো না। আমাকে আগুনে জ্বালিয়ে তুমি আনন্দে থাকবে, শান্তিতে থাকবে তাই কী হয় বলো? একই বৃন্তের ফুল দু’জন। একই ভুবনের জোড়া কোকিল। আমাকে কাঁদিয়ে হাসবে তুমি, এ যে ভীষন অন্যায়। আমাকে শান্তি দাও! সুখ দাও। কথা দিচ্ছি এ মুখো হব না। কোনোদিন না।”

ইমা সিক্ত চোখে থতমত খেয়ে তাকিয়ে আছে শানের চোখে দিকে। কী আছে হেতায় সে জানে না। দুঃখের অতল গহ্বর নাকি ছল? সে কেন তার সুখ, দুঃখের কারন হতে যাবে? সে তো ভালো করে চেনেও না, জানেও না। তবে মানুষটা তার পোড়া মনে গেঁথে গেছে, চোখের তারায় বসে গেছে এই যা। তা তো কেবল তার মন এই লোকের জন্য পাগল হয়েছে বলে। না জেনে, না চিনেই। কিন্তু এই লোক কেন এসব বলছে? ইমা তার কী করেছে? ইমা রাগে ভেতরে ভেতরে জ্বলে ওঠে৷ তার শিখা বাইরে বেরোতেই ইমা গলা উঁচিয়ে বলে,

” আপনি কী বলতে চাইছেন?”

শান ইমার বাহুদ্বয় ছাড়ে। দু কদম সরে কোমরে হাত রেখে দাঁড়ায়। ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেঁসে বলে,

” সব বলার, বোঝোনোর ভার আমারই কেন হবে? বুঝে নাও, খুঁজে নাও এসবের অর্থ। চলি।”

শান সানগ্লাস চোখে দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায় দোকান থেকে। ইমা কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে সামনে রাখা টিনের ক্যানটায় লাত্থি মেরে বসে পড়ে সেখানেই৷ করতলে মুখ ঢেকে শব্দ করে কেঁদে বিরবির করে,

” অভিনয়, সব অভিনয়। আমাকে নিয়ে খেলো,ভাঙো। যা খুশি মন চাই করো। মন তো দিয়েই দিয়েছি। এখন কী’ইবা করার আছে। যতো পারো খেলো আমার অনুভূতি, আবেগ নিয়ে। কিছু বলবো না, কিছুই না। তোমাকে ভালোবেসে মরে যাব তবুও প্রকাশ করব না, কোনোদিন করব না।”

বিকেলে কয়েকবার নক করার পরও ইমা দরজা খোলে নি। বিভার এবার বেশ চিন্তা হচ্ছে। তার মেয়ে বদলে যাচ্ছে। কম কথা বলছে ইদানিং। বাইরেও তেমন যাচ্ছে না। কথায় কথায় বিরক্ত হচ্ছে, রেগে চেঁচামেচি জুড়ে দিচ্ছে। কিছুসময় পার হতেই থমথমে মুখে বিছানায় শুয়ে পড়ছে আবার। দুপুরেও কিছু খেল না। বাড়িভর্তি আত্মীয় স্বজন। সবাই ইমা! ইমা করছে অথচ ইমা টু শব্দটিও করছে না রুমে ছেড়ে বেরিয়ে। বিভা দরজায় দাঁড়িয়ে আরও কয়েকবার মেয়েকে ডেকে হতাশ হয়ে নিচে নেমে গেল।

ইমার মনে পোক্তভাবেই স্থান করে নিয়েছে শান। সে যতোই চাচ্ছে অপছন্দ করবে বলে, ততোই তাকে সম্মানের শিখরে চড়িয়ে মনের সিংহাসনে বসিয়ে রাখছে। এতোকিছুর মাঝে আজকাল ইমার ঐ বিয়ের ঘটনাও স্মরণ হতে লাগল। শানের আগমন তার জীবনে ঝড় তুলেছে। ধিক্কারে ধিক্কারে নিজের মনকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করছে তবুও শান! শান! এই একটা নামই উচ্চারিত হচ্ছে বারবার। এতোদিন যে বিয়েকে বিয়ে বলে মনে রাখে নি। আজকাল কিন্তু অহরহ উপলব্ধি করছে সে বিবাহিতা নারী। তার উচিত নয় ভিন্ন পুরুষকে নিয়ে এমন ভাবনা আনা। আচ্ছা ভাবনা কী কেউ স্বেচ্ছায় আনে? ইমার দিবারাত্র যন্ত্রণাময় হতে লাগল। কিছুই ভালো লাগছে না। খেতে মন চাই না,ঘুম আসে না,শুধু কান্না পায়। বিভা নুসরাতকে গোপনে ইমার এমন পরিবর্তনের কথা জানাল। বেশ চিন্তিত দেখাল নুসরাতকে। তথাপি সে বিভার হাতটা ধরে আশ্বস্ত করলো নিশ্চিন্ত থাকার। নুসরাত গিয়েছিল কয়েকবার কথা বলবে বলে। ইমা বার বার প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলেছে। নিজের গোপন যন্ত্রণা সে উন্মোচন করবে না কারো সামনে।

দিনরাত মনের সাথে যুদ্ধ করে একসময় নিজের মনকে কিছুটা শক্ত করে ইমা। পার্শ্ববর্তী ডেইরি ফার্মে ছোটমোটো একটা কাজ জুটিয়ে নেয়। সামান্য বেতন, তবুও ইমা তাতেই খুশি। সকাল সন্ধ্যা সেখানেই ব্যস্ত থেকে মনকে শান্ত করছে। এরমধ্যে কয়েকবার শানের কল এলো, দেখা করবে বলে খুঁজল ইমাকে সে। ইমা কৌশলে লুকিয়ে পড়ত যেন দেখা না হয় এবং সাথে সাথে নিজের মোবাইলটাও বন্ধ করে ঘরের ড্রয়ারে ফেলে রেখেছে। প্রায় সাতদিন চললো এমন করে।

সেদিন সন্ধ্যার পর কাজ শেষে ডেইরির সামনের আবছা অন্ধকার গলি দিয়ে আনমনে হেঁটে ফিরছিল ইমা। মনে বারবারই একটা চিন্তা। যাকে বিয়ের আসরে ফেলে এসেছিল, সে বেচারা কী এখনও মনে রেখেছে তার পলাতক বউকে? ভুলে গেলেই ইমা খুশি হবে। সম্পর্কে জড়াতে ইমার ভয় করে। তার পিতা নাই, ভাই নাই। সে চলে গেলে মায়ের কী হবে? মাকে ফেলে সুখে স্বামী সংসার করা তার হবে না। তাছাড়া কেন যেন ভয় হয় স্থায়ী সম্পর্কে জড়াতে। পিতা আর ভাইয়ের অপমৃত্যু সে আজও ভুলতে পারে নি। চোখের সামনে যখন তাদের গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া রক্তাক্ত দেহ ভাসে। ইমার রূহ কেঁপে ওঠে। পৃথিবীটা নিষ্ঠুর, নির্মম মনে হয় এক মুহূর্তে। ইমা ভাবতে ভাবতে কখন যে গলির মুখে এসে পড়েছে খেয়াল নাই। হুশ ফিরল পাশে দাঁড়ানো গাড়ির হেডলাইটের আলো চোখে পড়তেই। একহাত চোখের উপর রেখে সরে দাঁড়াতেই থমকে যায় ইমা। গাড়ি থেকে নেমে তার দিকেই এগিয়ে আসছে শান। রাস্তার আধো আলোয় শানের মুখখানা দেখে বুকটায় চিনচিন করে ব্যথা ওঠে। শুকনো, পাংশু মুখ, নিষ্প্রভ চোখের চাহনী। সামনে এসে ইমার হাতটা ধরে বললো,

” চলো!”

” আমি কোথাও যাব না। ছাড়ুন আমার হাত।” ইমা হাত ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। শান আরও জোরে ওর হাতের কব্জি চেপে ধরেছে। ব্যথায় কাতর ইমা তবুও মুখ শক্ত, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। শান মুখটা ইমার কানের কাছে এনে চাপা স্বরে বললো,

” তুমি কী চাও, এতো লোকের মধ্যে তোমাকে কোলে তুলি?”

ইমা ভ্রু তুলে বড় বড় চোখে তাকাতেই শান ঠোট বাঁকিয়ে রুক্ষ হাসি হাসল। হাত টেনে এগোতেই ইমা বললো,

” দেখুন এসব ঠিক না। আপনি যা করছেন ঠিক হচ্ছে না। হাত ছাড়ুন।”

” আরেকটা কথা বললে এখানে সবার সামনে কোলে তুলে নেব। শান যা বলে তাই করে। ডেমো দেখতে চাইলে বলো?” কঠিন গলার স্বর শানের।

ইমা কী বলবে এখন আর? এই লোককে যতদূর জানার, বোঝার বুঝে গেছে সে। সত্যিই যদি কথামতো করে তবে লজ্জায় তার মাটিতে মিশে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। ইমা চুপ রইল।

গাড়ি চলছে কোন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ইমা জানে না। মুখ ঘুরিয়ে বাইরে চেয়ে আছে সে। শানকে নিয়ে তার ভাবনাগুলো যন্ত্রণা হয়ে ধিকি ধিকি পুড়ছে ছাইচাপা আগুনের মতো। গাড়ি জ্যামের কারনে থামতেই ইমা সোজা হয়ে ঘুরে বসল শানের দিকে। সে এভাবে ভেতরে ভেতরে পুড়তে নারাজ। একটা বিহিত করতেই হবে তাকে। শান এক ঝলক ইমার রাগী চেহারায় দৃষ্টিপাত করে সামনে তাকিয়ে বললো,

” নিজেকে কী ভাবো তুমি? রাণী ভিক্টোরিয়া না ডায়না?”

” আমার ইচ্ছা আমি যা খুশি ভাববো। আপনার সমস্যা কোথায় বলুন? কেন আমার সাথে এমন করছেন? কেন শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেন না?”

ইমা চেঁচিয়ে বলতেই শান চোয়াল শক্ত করে ঝুঁকে পড়ে ইমার দিকে। ইমা সরতে চাইলে কোমর টেনে কাছে এনে বলে,

” বোঝো না কেন? বাচ্চা তুমি? অ,আ, ক,খ করে বোঝাতে হবে তোমায়? ওকে তাই হবে।”

গাড়ির গ্লাস বা’হাতে উঠিয়ে আলো বন্ধ করে দেয় শান। ইমা ঠোঁট শক্ত করে চেপে, চোখ ছোট করে সেসব দেখে ভয়ে ছুটতে চাইছে শানের হাতের বেষ্টনি ছেড়ে। শান আরও কাছে টেনে আনল। গালে গাল লাগিয়ে চাপাস্বরে বললো,

” ভালোবাসা বোঝো তুমি? ওটাই হয়েছে আমার। নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি তোমার মাঝে। কতোটা হারিয়েছি জানো?”

ইমা স্ট্যাচু হয়ে বসে আছে। নড়নচড়নহীন দেহ, বিস্ফোরিত চোখ। শান তৃষ্ণিত চোখে ইমার মুখখানি দেখল কিছুক্ষণ। ইমার গালে হাত রেখে ওর কম্পিত ঠোঁটে গভীর চুম্বন করতেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে ইমা। পরিণয় অতঃপর প্রণয়। প্রণয়ের প্রথম চুম্বন। শান চোখ মেলে ইমার বন্ধ চোখের পত্রপল্লবে চেয়ে আবার বন্ধ করল চোখ।

স্তব্ধ হল দশ দিক নত করি আঁখি—
বন্ধ করি দিল গান যত ছিল পাখি।
শান্ত হয়ে গেল বায়ু, জলকলস্বর
মুহূর্তে থামিয়া গেল, বনের মর্মর
বনের মর্মের মাঝে মিলাইল ধীরে।
নিস্তরঙ্গ তটিনীর জনশূন্য তীরে
নিঃশব্দে নামিল আসি সায়াহ্নচ্ছায়ায়
নিস্তব্ধ গগনপ্রান্ত নির্বাক্‌ ধরায়।
সেইক্ষণে বাতায়নে নীরব নির্জন
আমাদের দুজনের প্রথম চুম্বন।
দিক্‌-দিগন্তরে বাজি উঠিল তখনি
দেবালয়ে আরতির শঙ্খঘণ্টাধ্বনি।
অনন্ত নক্ষত্রলোক উঠিল শিহরি,
আমাদের চক্ষে এল অশ্রুজল ভরি। -(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here