#তীব্র_প্রেমের_নেশা (১৭)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________
(নোট পড়ার অনুরোধ রইলো)
নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ব্ল্যাঙ্কেট মুড়িয়ে শুয়ে রইলাম। কিছু চেঞ্জও করিনি। বিষয়টা অদ্ভুত ভাবেই মনে দাগ কেটে গেছে। চোখ বন্ধ করলেই জা’নো’য়া’রটার মুখ ভেসে আসছে। তখনকার সেই স্পর্শ গুলো মনে পড়তেই গা গুলিয়ে উঠছে। হুট করেই ব্ল্যাঙ্কেট টানায় মাথার ওপর থেকে সরে যায়। আমি চোখ মুখ কুঁচকে তাকালাম তীব্রর দিকে। তীব্র শান্ত কন্ঠে বললেন,
‘চেঞ্জ করবা না? এতো ভারী লেহেঙ্গা নিয়ে ঘুমাতে পারবে না তো। ওঠো!’
‘যান তো আপনি৷ আমাকে একা থাকতে দেন। বিরক্ত লাগছে।’
‘একা থাকতে চাও ভালো কথা। উঠে আগে চেঞ্জ করে এসো।’
আমি উত্তর না দিয়ে ব্ল্যাঙ্কেট আবার টেনে নিলাম। অন্যপাশ হয়ে শুতেই উনি ফের বললেন, ‘নিজে চেঞ্জ করবা নাকি করিয়ে দিবো?’
আমি তবুও উনার কথা পাত্তা দিলাম না। চুপচাপ শুয়ে রইলাম। মিনিট খানেক বাদেই উনি ঝড়ের গতিতে ব্ল্যাঙ্কেট সরিয়ে কোলে তুলে নিলেন৷ আতঙ্কে উনার টি-শার্ট আঁকড়ে ধরলাম। উনি বাঁকা হেঁসে বললেন, ‘আমাকে দিয়ে চেঞ্জ করিয়ে নিবে এটা বললেই তো পারো বউ। শুধু শুধু এতো আকার ইঙ্গিতের কোনো মানে আছে!’
‘আশ্চর্য তো! আমি কখন বললাম এসব? নামান আমাকে।’
‘উহু৷ একবার যখন আমি দায়িত্ব নিয়েছি তখন তো আর আমি ছাড়ছি না। বায় দ্যা ওয়ে যদি চেঞ্জ করাতে গিয়ে রোমান্সের ফিলিংস চলে আসে তাহলে কিন্তু সম্পূর্ণ দায় তোমার।’
আমি হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বললাম, ‘খবরদার না। নামান আমাকে!’
তীব্র নামিয়ে দিলো। কিন্তু দোপাট্টাই হাত দিতেই লাফিয়ে সরে আসলাম। উনার হাত থেকে শাড়ি নিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ছুটলাম ওয়াশরুমের দিকে। দাঁত কটমট করতে করতে বকা দিতে থাকলাম। এই সিরিয়াস সময়েও তার এমন করার কোনো মানে আছে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাড়ি পড়লাম। বের হয়ে এসে দেখি আমার রুমে তিহা আর মিলি বসে আছে। তীব্র আশে পাশে কোথাও নেই। তিহা আমার কাছে এসে বললো,
‘নিচে চলো ভাবী। নানাভাই সবাইকে নিচে ডেকেছে। ভাইয়াও ওখানে আছে।’
আমি কোনো জবাব না দিয়ে মাথা নাড়ালাম। শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় দিয়ে ওদের সাথেই নেমে আসলাম। নিচে নানাভাই, নানুমনি, বড় মামা, বড় মামি, ছোট মামা, ছোট মামি, বড় খালা, বড় আঙ্কেল, ছোট খালা, ছোট আঙ্কেল, আজাদ আঙ্কেল, তাফিয়া আন্টি, হাবিবের বাবা-মা, হাবিব, তানহা, মুন্না, বিপ্লব সবাই উপস্থিত। আমাকে দেখতেই কয়েকজন মুখ কুঁচকে নিলো। তীব্র হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বসে আছে। নানাভাই গম্ভীর স্বরে বললেন,
‘নাতবউ কি হয়ছিলো ওখানে?’
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকালাম। এখন আবার এসব বলতে হবে আমাকে! এতোগুলো বয়সে বড় মানুষের সামনে এসব বলতে হবে! আমি চোখের পলক ফেললাম কয়েকবার। দৃষ্টি এদিক ওদিক করতেই হাবিব বললো,
‘নানাভাই ওই মেয়ে আর কি বলবে! আমারে উস্কাইয়া এসব করে আবার আমারেই মা’রছে। আপনি এসবের বিচার করেন!’
নানাভাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই হাবিব ফাঁকা ঢোক গিলে মাথা নত করে নিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে ফের নানাভাই বললেন, ‘কি হলো নাতবউ!’
আমি কিছু না বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। যখনই মুখ খুলতে যাবো তখনই তীব্র গম্ভীর স্বরে গটগট করে বললেন, ‘নানাভাই প্রানেশা একটা মেয়ে হয়ে নিশ্চয় তার সাথে হ্যা’রাজ’মেন্টের ঘটনাগুলো অনেক রঙচঙ নিয়ে বলতে পারবে না! তবে যে যায় বলুক আমি আমার স্ত্রীকে বিশ্বাস করি আর জানি সে কেমন! হাবিব নিজের দোষ যে আমার বউয়ের ওপর চাপাচ্ছে এটা নিশ্চয় আপনাকে আর বোঝাতে হবে না!’
তীব্রর কথা শেষ হতেই হাবিব বললো, ‘এটা তুমি বলতে পারো না তীব্র ভাই। তোমার বউয়ের চরিত্র কেমন তা তো নিজ চোখেই দেখলে! তানহাও দেখেছে। এরপরও তুমি তোমার ওই ন*ষ্টা বউয়ের হয়ে কথা বলতেছো!’
তীব্র ঝড়ের গতিতে উঠে দাঁড়ালো। হাবিবের কলার টেনে ওকে উঠিয়ে প্রথমেই কয়েকটা থা’প্প’ড় লাগিয়ে মা’রতে থাকে। আকস্মিক ঘটনায় সবাই চমকে যায়। একে একে বড়রা মিলে তীব্রকে থামানোর চেষ্টা করে। ততক্ষণে তীব্র হাবিবকে মে’রে ফ্লোরে শুইয়ে ফেলেছে। সমানে লা’থি দিচ্ছে। তীব্র মা’রছে আর উন্মাদের মতো একটাই কথা আওড়াচ্ছে, ‘আমার প্রাণকে ন*ষ্টা বলেছিস! তোর জিহ্বা টেনে ছি’ড়েই ফেলবো আজ আমি।’
অবাক হওয়ার সাথে সাথে আতঙ্কিতও হলাম। তীব্রকে সবাই মিলে কোনোমতে আটকালো। আমি ভয়ে তীব্রর কাছে যাচ্ছি না। তীব্রর এমন ভ’য়ং’কর রুপ এই প্রথম চোখের সামনে দেখলাম। সত্যি সত্যি হাবিবের জিহ্বা টেনে ধরেছিলো। একটুর জন্য সবাই ছাড়িয়েছে। নানাভাই বেশ কড়া গলায় বললেন,
‘এসব কি হচ্ছে তীব্র? বড়দের সামনে এসব কি ধরণের অসভ্যতা?’
তীব্র যেনো দ্বিগুণ রেগে গেলো। সামনে থাকা টি-টেবিলে লা’থি দিতেই তা বিকট শব্দে ভেঙে গুড়িয়ে গেলো। রাগে চিৎকার করে বললো, ‘হাবিবের সাহস কি করে হয় আমার প্রাণকে নিয়ে বাজে কথা বলার! ওকে এতো বড় কলিজা কে দিয়েছে? আপনার বাড়িতে আমার বউয়ের সম্মানে হাত দেওয়ার সাহস করার পরও ওর সাথে ভদ্রতা নিয়ে কথা বলতেছেন আপনি! আপনারা ভদ্র হলেও আমি ভদ্র নই। ওর এই কাজের জন্য ওর শিরায় শিরায় আমি বি’ষ ঢালবো। যদি ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমি আ’গুন না জ্বা’লিয়েছি তবে আমি তাশজিদ শেখ তীব্র নই।’
কথাটা শেষ হতেই সবাই আতঙ্কিত হলো। এতোটা সময় তীব্রর শান্ত রুপ কারোরই হজম হয়নি। সবাই জানে তীব্র সম্পর্কে। হাবিবের বাবা মা তীব্রর সামনে বসে পড়ে। আর্তনাদ করে বলে,
‘বাবা আমার ছেলের ভুল হয়ে গেছে। তুমি এতো কঠিন হইয়ো না বাবা। আমাদের সন্তানহারা করো না।’
তীব্র রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করেই সরে এলেন। সরাসরি আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘যে বাড়িতে আমার প্রাণকে অপবাদ সহ্য করতে হয়! আমার প্রাণের গায়ে ক’ল’ঙ্ক লেপ্টে দেওয়া হয়! যে বাড়িতে আমার প্রাণের দিকে হা’য়নার মতো তাকানো হয় সে বাড়িতে আমরা আর এক মুহুর্তও থাকবো না।’
পুরোটা সময় আমি নির্বাক। আমি কল্পনাও করিনি তীব্র এমন কিছু করবে বা বলবে! নানাভাই বাদে সবাই তীব্র ভাইকে ভয়ে ভয়ে থাকতে বললেন। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তা কাল সকালে নিতে বললেন। কিন্তু সে তা কানে তুললেন না। আমার হাত টেনে সদর দরজা পর্যন্ত আসতেই তানহা ছুটে আসলো। দুহাতে পথ আগলে ধরে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো,
‘তুমি এই মেয়েটার জন্য চলে যাচ্ছো তীব্র! তুমি তো ওকে ছেড়ে..’
এটুকু বলতেই যেনো তীব্রর হিং’স্রতা বাড়লো। হুট করেই তানহার গলা চে’পে ধ’রলো। তানহা বিস্ময়ে, শ্বাস আটকে যাওয়ায় চোখ বড় বড় করে ফেলেছে। আমি দ্রুত তীব্রর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই তীব্রর বলা কয়েকটা কথা কানে আসে,
‘তোর জন্য আজ এসব কিছু হয়েছে। আমি ভালো মতোই বুঝেছি হাবিবের এতো সাহস নেই যে তীব্রর আত্মায় হাত দিবে! তোকে আমার এখনি মে’রে ঝু’লিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ছাঁদে বলা কথাগুলো মাথায় ঢোকেনি তোর? কান খুলে শুনে রাখ! প্রাণ আমার বউ। ও শুধুই আমার। ওকে এই জন্মে কেন পরেরজন্মেও আমি ছাড়বো না।’
তানহাকে ঝাটকা মে’রে ছেড়ে দেয়। আমি ড্যাবড্যাব করে তাকালাম তীব্রর দিকে। তীব্র আমার হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। পিছন থেকে বড় মামির কান্নার শব্দ পেলাম। আমার তখনও ঘোর কাটেনি। কি হলো সবটাই যেনো মাথার ওপর দিয়ে গেলো। তীব্র কি বললো এগুলো! তীব্রর হিং’স্রতার কথা ভাবলেই আমার শিরা উপশিরা কাঁপছে। তীব্র আমাকে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও বসে পড়লো। শীতের রাত। তীব্র টেনে আনায় শীতের কিছু পড়াও হয়নি। তীব্রর গায়ে জ্যাকেট। গাড়ি ছাড়তেই আমি শীতে কুঁকড়ে উঠলাম। হাবিবের বিষয়টা মাথা থেকে বেড়িয়ে এখন তীব্রর কথাগুলো চেপে বসেছে। এতো শীতের মধ্যে কাঁপতে থাকা স্বত্বেও আমি তীব্রর বলা কথাগুলোই বার বার ভাবছিলাম। ধ্যান ভাঙলো গাড়ি থামার শব্দে। আমি উনার দিকে তাকাতেই উনি বললেন,
‘তুমি বসো! আমি আসছি।’
আমি মাথা নাড়ালাম। উনি গাড়ি লক করে কোথায় যেনো গেলেন। আমি মাথাটা এলিয়ে দিয়ে বসে রইলাম। মানুষটাকে আমার গোলকধাঁধার মতো মনে হয়। যেনো পুরোটাই রহস্যের একটা বস্তা। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বেশ অনেকক্ষণ পর উনি আসলেন। হাতে একটা শপিং ব্যাগ। ব্যাগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ঠান্ডা লাগছে এটা মুখে বলতে কি কষ্ট হয়!’
আমি উত্তর না দিয়ে ব্যাগের মধ্যে তাকালাম। লেডিস জ্যাকেট, শাল এগুলোই রাখা। আমি লেডিস জ্যাকেটটা হাতে নিতে নিতে বললাম, ‘এতোই যখন বউয়ের ঠান্ডা লাগাটা চোখে পড়ছিলো তখন হিরোদের মতো নিজের জ্যাকেটটা দিয়ে দিলেই পারতেন।’
তীব্র মুখটা গম্ভীর রেখেই বললেন, ‘হ্যাঁ হিরোর মতো ঢঙ করে জ্যাকেট দিয়ে পরে আমি শীতে ম’রি!’
‘ওমা! ছেলেদের নাকি শীত লাগে না! তাদের নাকি রক্তের তেজ বেশি তাই নাকি শীত লাগে না। তাহলে আপনার কেনো লাগবে? আপনি ছেলে না?’
তীব্র চোখ ঘুরিয়ে তাকালো আমার দিকে। ঠোঁট কামড়ে বললো, ‘এখন কি তোমাকে প্রুফ দিতে হবে আমি ছেলে নাকি না? বাই দ্যা ওয়ে সেদিন রাতের পর তো তোমার সন্দেহ করা উচিতই না।’
আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম। বিড়বিড় করে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ‘বে’হায়া, নি’র্লজ্জ! এক কথা সারাদিন বলে কি মজা পায়!’
তীব্র আমার বিড়বিড় করা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলেন। আমি আড়চোখে তা দেখেও ঠোঁট ফুলালাম। বাহিরে তাকিয়ে রইলাম। উনি নিজের কন্ঠস্বর স্বাভাবিক করে বললেন,
‘মুভির হিরোরা ছাড়া যে আর কেউ ওসব আজগুবি কথা বলে না তা তুমিও জানো আর আমিও। আর আমি কোনো হিরো না এটা কোনো মুভিও না মাই মিসেস।’
উনার মুখে ‘মাই মিসেস’ শুনে খানিকটা চমকে উঠলাম৷ কয়েক বার ফাঁকা ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করে নিলাম। ফিসফিস করে বললাম, ‘আজ যা করছেন তা মুভির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমার এখনো মনে হচ্ছে আমি কোনো মুভি কিংবা স্বপ্নে আছি।’
এরপর দুজনের মধ্যে আর কোনো কথা হলো না। গাড়ি চলতে থাকলো। আমি অবশ্য ততক্ষণে জ্যাকেট পড়ে নিয়েছি। রাত বাড়ার সাথে সাথে নিজের ক্লান্তিও টের পেলাম। ঘুমে চোখ দুটো বুজে আসছে। বার কয়েক হাই তুলে তীব্রকে বললাম,
‘আমরা কি সরাসরি ঢাকাতে ফিরবো?’
তীব্র ড্রাইভিং-এ মন দিয়ে বললো, ‘নাহ। আমরা এখন একটা হোটেলে থাকবো। এখানে কিছু কাজ বাকি তা শেষ করে বাড়ি ফিরবো।’
আমি ঘুমের জন্য কোনো প্রশ্ন করলাম না। তীব্র আমার অবস্থা বুঝে বললো, ‘ঘুম পেলে ঘুমোও। এখান থেকে যেতে আরো অনেকটা সময় লাগবে।’
উনার বলার সাথে সাথেই আমি ঘুমে ঢলে পড়লাম। টের পেলাম উনি টেনে নিলেন বুকে। এক হাতে জাপ্টে ধরে অন্যহাতে ড্রাইভিং করছেন। তার বুক পেয়ে আমি গুটিশুটি মে’রে ঘুমিয়ে পড়লাম। পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়ার আগে তার কন্ঠের দু’লাইন গান এসে কানে বাজলো,
‘তুমি আকাশের বুকে বিশালতার উপমা
তুমি আমার চোখেতে সরলতার প্রতীমা,
আমি তোমাকে গড়ি ভেঙেচুরে শতবার
রয়েছো তুমি বহুদুরে..’
চলবে..