#তীব্র_প্রেমের_নেশা (১২)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। কাল থেকে শোভার বিয়ের সব অনুষ্ঠান শুরু হবে। তীব্র বেশির ভাগ টাইমই বাহিরে থাকে। তার নাকি কতশত কাজ! সেদিন রাতের পর আর আমাদের ঠিকমতো কোনো কথা-ই হয়নি। সেই রাতের কথা ভাবলেই আমার হৃদপিন্ড লাফাতে শুরু করে। শ্বাস আটকে যায় নিমিষেই। লজ্জায় নিজেকে আড়াল করে নিই সবসময়। সেদিন রাতে যতটুকু যা হয়েছে তার পুরোটাই যে ঝোকের মধ্যে হয়ে গেছে তা আমি আর তীব্র হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি পরেরদিন। দুজনের কেউই বুঝতে পারিনি এমনটা হবে! তীব্র এরপরের দুদিন গম্ভীর মুখে ছিলো যেনো সে বড়সড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছে৷ তার ওই মুখের দিকে তাকালেই যেনো বুকের বাম পাশে চিনচিনে ব্যাথা শুরু হয়। গত ৩ দিন থেকে তীব্র ঠিকমতো বাড়িতে থাকে না কিন্তু নানাভাই স্পষ্ট বলে দিয়েছেন আজ থেকে যেনো তীব্র বাড়িতেই থাকে। আর তীব্রও তা মেনে নিয়েছে। আজ ছোটরা সবাই শপিং এ যাবে। শোভার বিয়ে নিয়ে সবার উত্তেজনা থাকলেও আমি আর তীব্রই সবটা থেকে দুরে দুরে থাকছি। বড় মামা, বড় মামি, শোভা বা তানহা কেউই আমাকে তেমন একটা পছন্দ করে না তাই আমার এসবে জড়ানো ঠিক হবে বলে মনে হয়নি কিন্তু ছোট মামি, বড় খালা, ছোট খালা, মিলি, তিহা সবার জোড়াজুড়িতে বিয়েতে না মেতেও উপায় নেই। সবার হাতে হাতে টুকটাক সব কাজ করে যাচ্ছি আমি নিজেও। এসব ভাবতে ভাবতেই রেডি হয়ে নিলাম। পার্পল কালারের একটা শাড়ি পড়ে চুলগুলো বেঁধে নিয়েছি৷ তিহার পাগলামিতেই এসব। শাড়ির আঁচল ঠিকমতো টেনে নিতেই দরজা ঠেলে রুমে আসে তীব্র। আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড পলক না ফেলে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। গলা পরিষ্কার করে বলে,
‘হঠাৎ এতো সাজ?’
উনার কথায় ভ্রুদ্বয় কিঞ্চিত কুঁচকে গেলো। নিজের দিকে ভালো করে তাকালাম। এরপর বললাম, ‘সাজ কোথায়? সবাই শপিং এ যাবে বলে তিহা শাড়ি হাতে ধরিয়ে গেলো যেনো এটাই পড়ি।’
তীব্র মাথা তুলে তাকালেন আমার দিকে। চোখে মুখে গম্ভীরতা স্পষ্ট হয়ে গেলো। গুরুগম্ভীর কন্ঠে আওড়ালেন, ‘শপিং এ যাবে শাড়ি পড়ে? বোরকা কি হয়েছে তোমার?’
‘বোরকা তো আছে। তিহা ব…’
‘তিহা যায় বলুক তুমি এখনই শাড়ি চেঞ্জ করে বোরকা পড়ো নয়তো শপিংএ যাওয়ার দরকার নেই।’
আমি ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এতো কষ্ট করে শাড়ি পড়ে আবার চেঞ্জ করবো!’
‘আমাকে জিজ্ঞেস করে শাড়ি পড়ছো? এখন চুপচাপ চেঞ্জ করে বোরকা পড়ে হিজাব পড়ে নাও।’
গাল ফুলালাম আমি। কাবাড থেকে বোরকা বের করে তা নিয়ে তীব্রকে পাশ কাটিয়ে আসার সময় তীব্রর বিড়বিড় করা কয়েকটা বাক্য কানে আসে,
‘আমার বউকে আমি একা দেখবো বাকি সবার থেকে আড়ালে রাখবো। তাই শাড়ি পড়ে কোনোমতেই বের হতে দিবো না মানে না।’
যদিও উনাকে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছি কিন্তু উনার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি। মস্তিষ্ক পর্যন্ত কথাগুলো যেতেই ঠোঁট প্রসারিত হয়ে গেলো। ঠোঁট কামড়ে হেঁসে কয়েক পল তার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ ওয়াশরুমে ঢুকলাম।
আমাকে বোরকা পড়ে দেখে তিহা গাল ফুলালো। ওকে কতকিছু বুঝিয়ে শেষে শপিং এ যাওয়া হলো। যার যার মতো শপিং করলেও আমি আটকা পড়ে আছি তীব্রের কাছে। না সে নিজে শপিং করতেছে আর না আমাকে করতে দিচ্ছে। সবাইকে ভেতরে পাঠিয়ে এক হাতে আমার হাত চেপে আরেক হাতে নিজের ফোন স্ক্রল করছে। এভাবে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো! বিরক্তিতে আমার ইচ্ছে করছিলো লোকটার গলা টি’পে দেই কিন্তু সে ইচ্ছে দমিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
‘নিজে তো যাচ্ছেন-ই না আবার আমাকেও যেতে দিচ্ছেন না। আপনি না গেলে অন্তত আমারে যায়তে দেন। আর যদি শপিং না-ই করানোর হয় তাইলে আনলেন-ই বা কেন?’
তীব্র ফোনে মনোযোগ দিয়েই বললেন, ‘আমি কখন বললাম আমি তোমাকে শপিং করাবো না? বাড়িতে বিয়ে যখন তখন তোমাকেও শপিং অবশ্যই করাবো।’
‘তো এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শপিং করবো!’
তীব্র ফোন রেখে আমার দিকে তাকালেন। নিকাবের ওপর দিয়ে গাল টি’পে বললেন, ‘বাহ আমার বউয়ের তো দেখছি ভালোই রাগ! তাশজিদ শেখ তীব্রর বউ হয়ে এতো অধৈর্য হলে চলে? একদমই না।’
বলেই একটা টেডি স্মাইল দিলেন। আমি হা করে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই লোকটাকে কেনো বিয়ে করেছিলাম আমি! শপিং করাবো বলে পার্কিং এড়িয়াতে দাঁড়িয়ে আছে! নিজেই নিজের কপাল চাপড়ালাম। বিড়বিড় করে নিজেই নিজেকে বললাম,
‘পড়েছো কি’প্টার হাতে এবার তোমার শপিং জলভাতে।’
তীব্র মুহুর্তেই তাকালেন আমার দিকে। তার তাকানো দেখে খানিকটা চমকালাম। উনি ঠোঁট গোল করে বললেন, ‘আরেহ বাহ! তুমি দেখছি কবিতাও বানাতে পারো। গ্রেট গ্রেট।’
জিভ কামড়ালাম। লোকটা শুনে ফেলেছে! তীব্র ফোন নিয়ে টাইম দেখে আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে হাঁটা লাগালেন। গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘ওদের সাথে গেলে তানহা আর শোভা তোমাকে খোঁ’চা মে’রে কথা বলতো। আর আমার এতোও অকাল আসেনি যে সামান্য শপিং এর জন্য আমার বউকে যে কেউ যা তা বলবে আর আমি শুনবো! তাই তুমি আর আমি একসাথে যাবো কিন্তু একটু দেড়ি করে। আর ওদের যা রঙঢঙ তাতে তুমি আর আমি যদি লাস্ট ১০ মিনিটেও যাই তবুও ওদের শপিং করা হবে না।’
আমি পিটপিট করে তাকালাম। মুচকি হেঁসে তীব্রর পায়ে পা মিলিয়ে শপিং মলে ঢুকলাম। সব শপিং তীব্রর পছন্দ মতোই নিলাম। লেহেঙ্গা, শাড়ি, জুতো শেষ করে এবার পালা জুয়েলারির। দুজনে জুয়েলারি শপে ঢুকতেই চোখ আটকে গেলো একটা পেনডেন্ট এ। ভীষণ পছন্দ হলেও আমি তীব্রকে তা বললাম না। শাড়ি আর লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং করেই সব গহণা নিলাম। সবশেষে যখন তীব্র বিল পেমেন্ট করতে গেছে তখন চোখ পড়লো দরজার বাহিরে। মুখটা জিনিয়ার মতো মনে হতেই যেনো শক খেলাম। সব শপিং সেখানেই ফেলে ছুট লাগালাম দরজার দিকে। দরজা থেকে বাহিরে এসে আশে পাশে কিছুটা দৌড়ানোর পরও জিনিয়াকে আর দেখলাম না। ভীড়ের মাঝে যেনো হারিয়ে গেলো সহজেই। আমি কনফিউজড হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সত্যিই কি জিনিয়াকে দেখেছি! নাকি চোখের ভুল! এরমধ্যেই তীব্র দৌড়ে আসে। তড়িঘড়ি করে আমাকে ধরে বলে,
‘পাগল নাকি? এভাবে কেউ ছুটে আসে! আমি কতটা ভয় পেয়ে গেছি জানো? কি হয়েছে? এমন করে ছুটে আসলে কেনো?’
আমি রোবটের মতো হাত দিয়ে সামনে ঈশারা করে বললাম, ‘জিনিয়া!’
তীব্র চমকে তাকায় সেদিকে কিন্তু জিনিয়াকে না দেখে বলে, ‘কোথায় দেখেছো? এখানে!’
আমি মাথা নাড়লাম। উনি আমাকে ছেড়ে রেলিং য়ের কাছে গিয়ে পুরোটা পর্যবেক্ষণ করলেন। কিন্তু জিনিয়াকে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসলেন। আমি তীব্রর শার্টের এক কোণা চেপে ধরে বললাম,
‘জিনিয়া সত্যিই বেঁচে আছে তীব্র? তাহলে সেদিন!’
তীব্র গম্ভীর হয়ে গেলেন। নিজের শার্টের কোণা ছাড়িয়ে নিয়ে আমার এক হাত চেপে হাঁটা লাগালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘বাড়ি চলো!’
জুয়েলারি দোকান থেকে সব ব্যাগ নিয়ে চলে আসলাম। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে জিনিয়ার মুখ। ‘ও’ যদি সত্যিই বেঁচে থাকে তাহলে সেদিন মা’রা গেলো কে? কেনোই বা সেদিন সব দোষ তীব্রকে দিয়েছিলো! জিনিয়া বেঁচে থাকলে কেনো জানালো না আমাকে? আন্টি তো বলেছিলেন জিনিয়াকে দাফন করানো হয়েছে তাহলে জিনিয়া বেঁচে আছে কিভাবে! এতো এতো প্রশ্নের দরুণ মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। পরপর কয়েকটা ঢোক গিললাম। তীব্র চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ঠিক আছো প্রাণ? শরীর খারাপ লাগছে?’
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই তিহারা সবাই চলে আসে। একে অপরের শপিংয়ের কথায় বলছিলো নিজেরা নিজেরা। তারপর যে যার মতো জায়গায় বসে পড়লো। তানহা আমাকে আর তীব্রকে গাড়ির মধ্যে দেখে ঠেস দিয়ে বলে,
‘তীব্র প্রানেশাকে শপিং করিয়ে দাওনি! দিবেই বা কেনো? যাকে বিয়েই করেছো একটা…’
তীব্র পেছনে তাকিয়ে চোখ গরম করে বললেন, ‘তোর না ভাবলেও চলবে আমি ওকে শপিং করিয়েছি কি না! নিজের চরকায় তেল দে।’
তানহার মুখটা একটুখানি হয়ে গেলো। শোভা জ্বলে উঠে বললো, ‘তীব্র ভাই তুমি এই মেয়েটার জন্য তানহার সাথে এমন ব্যবহার কেনো করো?’
এবার উত্তরটা তিহা-ই দিলো। হেঁসে বললো, ‘তোমার বোনকে বলো আমার ভাবির সাথে ঠিক করে কথা বলতে তাহলেই তো ভাইয়া আর কিছু বলে না। আর তাছাড়া আপু ভাবিকে ‘এই মেয়ে’ না বলে ভাবি ডাকতে শিখো কারণ ওটা তোমারও ভাবি হয়। তানহা আপু তোমারও কিন্তু ভাবিই হয়।’
তানহা আর শোভা জ্বলে ওঠে। তীব্র বাঁকা হেঁসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। ওদের এতো কথোপকথনে আমার বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা নেই। আমার মন আর মস্তিষ্ক পুরোটাই এখনো পড়ে আছে জিনিয়ার কাছে। কি থেকে কি হয়েছে সবটা ভেবেই কুল কিনারা পাচ্ছি না।
আমার ভাবনার মাঝেই বাড়ি চলে আসলাম। বাড়িতে আসার পরও আমি বিষয়টা ভুলতে পারলাম না। তীব্র আমার অমনোযোগীতা খেয়াল করে বলে, ‘জিনিয়ার কথা ভাবছো?’
আমি তাকালাম উনার দিকে। খুঁটে খুঁটে দেখলাম উনাকে। চোখ দুটোর গভীরতা ভীষণ বেশি তাই তো কখনোই ওই চোখের দিকে তাকানোর সাহস পাই না। তাকালেই মনে হয় তারা আমাকে তাচ্ছিল্য করে বলছে, ‘যাকে ভালোবাসো তার চোখের ভাষা বুঝো না। তাকে বুঝো না। কত সহজেই ভুল বুঝে বসো! তুমি কি আদৌও এই মানুষটাকে ভালোবাসার যোগ্য! তুমি কি আদৌও এই চোখের ভাষা বুঝার যোগ্য!’ বিষয়গুলো ভাবতেই যেনো আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তীব্র খানিকটা এগিয়ে আসে আমার কাছে। এলোমেলো হওয়া চুলগুলোকে কানের পৃষ্ঠে গুঁজে দিয়ে বলে,
‘এতো বেশি ভেবো না। যা হওয়ার তা হবেই। প্রকৃতি নিজেই সবটা তোমার সামনে এনে দিবে তাই এতো ভেবে শুধু শুধু নিজের মাথাটা এলোমেলো করো না। এমনিও তোমার মাথায় ম’গজের বদলে গো’বর রাখা।’
তীব্র ঠোঁট চেপে হাসলেন। আমি অপলক চেয়ে রইলাম তার হাসির দিকে। সে হয়তো আশা করেছিলো আমি রেগে যাবো কিন্তু হলো তার বিপরীত। রোবটের মতো তাকে হুট করেই জড়িয়ে ধরলাম। আনমনে বললাম,
‘যত সত্যর কাছে যাচ্ছি ততটাই আপনাকে করা ঘৃ’ণা গুলো আমার নিজের দিকে ফিরিয়ে আনছি। আপনার কথামতো সত্যিই আমার নিজের প্রতি ঘৃ’ণার সৃষ্টি হচ্ছে। আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না তীব্র। আমি ভালোবাসি আপনাকে। কবে, কখন, কিভাবে জানা নেই শুধু জানি তীব্র প্রেমের নেশায় আমি ডুবে গেছি। প্রতি মুহুর্তে পু’ড়ে যাচ্ছি এই প্রেম নেশায়।’
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)