#তিক্ত_বুকের_বাঁপাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_২০(প্রেমঘন মুহূর্ত)
২২.
হোটেলের নীচের রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে রাফিদ, নম্রমিতা, তোহা আর তারিন। বেশ কিছুক্ষনের মাঝেই সেখানে উপস্থিত হয় রনক। হাত পা রীতিমত কাঁপছে তোহার। অল্প সময়ের মাঝে হুট করে এভাবে ডেকে পাঠানোর কারণ বোধগম্য হচ্ছে না তার। যদি তারিন আর রাফিদের ব্যাপারে কোনো কথা থাকে তবে তাদেরকে ডেকেছে কেনো! অস্থিরতা খানিকটা তারিনের মাঝেও। হুট করেই কিছুদিন আগে রাফিদের সাথে বড়োরকম ঝামেলা হয়েছে তার। অকারনেই বেশ দোষারোপ আর চিল্লাচিল্লি করে দুজনের বন্ধুত্বের ভাঙ্গন ঘটেছে। তবে আজ হুট করেই এভাবে জরুরি তলবে ডেকে পাঠানোর মানে কী!
“তারিন, কিছু ভুল বোঝাবুঝি আমাদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে। মূলত কেউ খুব সুক্ষভাবে এই কাজটা করেছে। আমাদের তিনজনের মাঝের সম্পর্কে ভাঙ্গন ঘটাতে চেয়েছে। সেই বিষয়েই কিছু বলার জন্য এখানে ডেকেছি তোকে।”
রাফিদের কথা শুনে হতভম্ভ দৃষ্টিতে তাকায় তারিন। যেনো কোনো কিছুই বোধগম্য হচ্ছেনা তার। রাফিদ নম্রমিতার ফোন থেকে সেদিনের পিকগুলো বের করে দেখায় তারিনকে। অতঃপর জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বলা শুরু করে,
“মনে আছে এই পিকগুলোর কথা?”
“এগুলো তো একটা সাজানো নাটক ছিলো। নম্রমিতাকে দেখানোর জন্য তোলা হয়েছিলো।”
“হ্যা। কিছুদিন আগে আমার অফিসের অ্যাড্রেসে একটা পার্সেল আসে। খুব অবাক হই। পার্সেলটা খুলে এই পিকগুলোর সাথে একটা চিঠি পাই। যেখানে তোর নাম করে কেউ আমাকে ওগুলো পাঠায়। সাথে লেখে, নম্রমিতাকে এই পিকগুলো পাঠাবে। যদি না তার শর্ত আমি শুনি।”
“কী শর্ত!”
“নম্রর সাথে একমাস অতিরিক্ত রাগারাগি, ঝগড়া ঝামেলা করতে হবে। একমাস পর ডিভোর্স দিয়ে দিয়ে হবে। তা নাহলে সে নম্রকে পিকগুলো পাঠিয়ে আমাদের মাঝে বাজে রকম ভাবে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করবে। এরপর নম্রর কিছু বলে সব দোষ আমার ঘাড়ে পড়বে।”
“কিন্তু আমি তো এসবের কিছু জানিনা।”
“সেজন্যই আজ তোকে এখানে ডাকা। সেদিন তোকে অনেক কথা শুনিয়ে বন্ধুত্ত্ব শেষ করে দিয়ে এসেছিলাম। একবারও তোর কথা শোনার চেষ্টা করিনি। অথচ আমার সবচেয়ে খারাপ সময়ে একমাত্র তুই আমার পাশে ছিলি। আই অ্যাম সরি তারিন। সত্যিই অনেক বড়ো ভুল হয়ে গেছে। প্লীজ ভুলে যা সবকিছু।”
“আমি তোকে নিজের বেষ্ট ফ্রেণ্ড কম, ভাই বেশি মনে করি রাফিদ। ভাইয়ার কিছু হলে আমার যেমন কষ্ট হয়, তোর কারনেও একই অনুভূতি হয়। হ্যা, সেদিন অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম। আমরা যাদের মন থেকে ভালোবাসি, তাদের কাছ থেকে পাওয়া সামান্য আঘাতও ছিন্নভিন্ন করে দেয় আমাদের। একটু আঘাতও যেনো অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে যায়। ভেঙ্গে পড়েছিলাম অনেক। বিশেষত আমার মন ভালো করার জন্যই আমাদের এই দার্জিলিং ট্রিপ। তবে এখানে এসে যে এতো ভালো কিছু হবে আমার জানা ছিলো না। আমি সব ভুলে গেছি রাফিদ। জীবনে সবকিছু ধরে রাখতে নেই। কিছু জিনিস ছেড়ে দিলেই ভালো থাকা যায়।”
তারিনের প্রতিটা কথায় মুগ্ধ হয় নম্রমিতা। কী দারুণ ভঙ্গিমায় প্রতিটা কথা গুছিয়ে বলে মেয়েটা। আবার তার ভালবাসার গভীরতাও বেশ। কেউ কাউকে এতটাও ভালোবাসতে পারে! ক্রমাগত মুগ্ধ হয়ে হচ্ছে নম্রমিতা তারিনকে দেখে। সাধারণের মাঝে অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বের অধিকারীনি। নম্রমিতার নিজেরও অনুতাপ হচ্ছে তারিন সম্পর্কে এতো খারাপ কিছু ভাবার কারণে।
“শোন রাফিদ, আমি কিন্তু তোকে এখনও পুরোপুরি মাফ করিনি।”
“মানে? এই না বললি মাফ করেছিস!”
“তাতে কী হয়েছে? এখন বলছি করিনি। তবে পুরোপুরি মাফ করতে পারি একটা শর্তে।”
“কী?”
“আমার ভাইয়ার বয়স হচ্ছে। আর কতদিন সিঙ্গেল থাকবে! তাই ভাবছি, ভাবি হিসেবে তোহা কিন্তু মন্দ নয়!”
চকিতে চোখ তুলে তাকায় তোহা। হতভম্বের মতো একবার তারিনের দিকে তো একবার রাফিদের দিকে তাকায়। রাফিদ যদি বারণ করে দেয়! উৎকণ্ঠায় গলা শুকিয়ে খা খা করছে তার। রাফিদ আড়মোড়া ভাঙ্গে। হাই তোলার ভঙ্গিমায় মুখে হাত দেয়। অতঃপর আরচোখে তোহার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“সংসার যে করবে সেই যখন মন দিয়ে বসে আছে, আমি আর আপত্তি করে কী করবো! তবে পরিবার নিয়ে বাড়িতে আসিস। বাবা মাও অমত করবেন বলে মনে হয়না।”
চমকায় তোহা। বিস্ময়ে কিংক্তব্যবিমূঢ় সে। রাফিদ কীভাবে জানলো তার মনের খবর! হুট করে রনকের সাথে চোখাচোখি হতেই ঠোঁট কামড়ে হাসে সে। অতঃপর সকলের আড়ালে চোখ টিপ দেয়। লজ্জায় লজ্জাবতী লতার ন্যায় নুইয়ে যায় তোহা। চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায়না আর।
২৩.
দার্জিলিং শহরে ভারতের একটি অন্যতম পুরনো চিড়িয়াখানা রয়েছে। যার নাম ” পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিকাল পার্ক”সেই চিড়িয়াখানা ভ্রমনে বের হলো দুই দল। তারিন, রনক নম্রমিতা আর তোহার পরিচয় করিয়ে দেয় বাবা মায়ের সাথে। ফলস্বরূপ দুই পরিবার একসাথে বের হয়েছে দার্জিলিং পরিদর্শনে। গোটা দেশ থেকে কত রকমের নাম না জানা পাখি এনে রাখা হয়েছে এখানকার চিড়িয়াখানাটিতে। আর রয়েছে বেশ কিছু বাঘ ভাল্লুক চমরি গাই। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভাবে রয়েছে পাহাড়ি লাল পান্ডার দল।
এই চিড়িয়াখানাটির অন্যতম আকর্ষণ হলো এখানকার স্নেক গার্ডেন। স্নেক গার্ডেন বিভিন্ন প্রকারের সাপ দেখতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে কোনটি দেশি কোনটি আবার বিদেশী। পাহাড়ে বেড়াতে এসে চিড়িয়াখানার দর্শন পাওয়া আমাদের কাছে এক পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। এই চিড়িয়াখানাটির বৈশিষ্ট্য হল এখানে বহু হিমালয়ান প্রজাতির দেখা মিলবে। এটি বিশ্বের একমাত্র চিড়িয়াখানা যেখানে রেড পান্ডা এর সংরক্ষণ ও প্রজনন করানো হয়। এই আন্তর্জাতিক মানের চিড়িয়াখানাতে অতি সুপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে প্রাণীদের খাঁচাগুলি তৈরী হয়। কখনো মাথা তুলে দেখলেন একটা লোমষ কালো ভাল্লুক পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে নেমে আসছে যেনো হাগ করতে আবার নীচের দিকে তাকালে দেখা যায় একটা জিরাফ গলা বাড়িয়ে আদর খেতে চাইছে। এছাড়াও লিওপার্ড, তিবেতিয়ান উলফ প্রভৃতি দুর্লভ প্রাণীরও দেখা মিলবে এখানে।
ভারতীয় রেল হল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রেল নেটওয়ার্ক, যেখানে বিশ্বের দীর্ঘতম ট্রেন লাইন থেকে শুরু করে দেশের ক্ষুদ্রতম রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম সবই মেলে। এরমধ্যে সর্বোচ্চ স্টেশনের নাম ঘুম। স্টেশনে রেল চলাচল শুরু হয়েছিল ১৮৮১ সালে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ঘুম স্টেশনের উচ্চতা ২,২৫৮ মিটার। দার্জিলিং থেকে মাত্র ঘুমের দূরত্ব মাত্র ৮ কিলোমিটার। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় স্থানপ্রাপ্ত টয় ট্রেনটিও এই স্টেশন দিয়ে চলে। পথের মাঝে নির্মিত এই স্টেশনে দেশ বিদেশের পর্যটকরা বেড়াতে আসেন। এই স্টেশনে দাঁড়িয়েই সেখানকার অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এখান থেকে মেঘের দল এমনভাবে ভেসে যায় যে মনে হয় এখুনি হাত দিয়ে ছোঁয়া যাবে। একমুঠো মেঘ নিয়ে ব্যাগে পুরে পাখলেই হয়। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার টয় ট্রেনটি ঘুমের মধ্য দিয়ে যায়। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার পথটি বেশ দীর্ঘ। তাই বেশিরভাগ পর্যটকই ঘুম স্টেশন থেকে দার্জিলিং যাওয়ার টয় ট্রেনে যান। রেলস্টেশন সংলগ্ন ঘুম শহরে একটি রেলওয়ে জাদুঘরও রয়েছে। এই জাদুঘরে ঘুম রেলওয়ে স্টেশনের ২০০ বছরের পুরানো নানা তথ্য পাওয়া যায়।
ঘুম স্টেশন থেকে ঘোরাঘুরি করে তারা সোজা চলে আসে রক গার্ডেনে। পুরোটা রাস্তা তোহাকে অসম্ভব রকম জ্বালিয়েছে রনক। কখনও সকলের অগোচরে কোমর চেপে ধরে তো কখনো পায়ের সাথে পা ঘষে সুড়সুড়ি দেয়। ব্যাপারটাতে বেহা মজা পাচ্ছে সে। তোহার চোখ লাল করে তাকানোকে পাত্তা না দিয়ে সে নিজের মতো ব্যাস্ত বিরক্ত করতে। মাঝে মাঝে মিটিমিটি করে হাসছে রনক। যা দেখে আর রাগ ধরে রাখতে না পেরে নিজেও হেসে দেয় তোহা।
সাইট সিইং গুলির মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ও অন্যতম জায়গাটি দার্জিলিং থেকে ১০ কিমি নীচে পাহাড়ী ঝর্ণা ও রংবেরঙের ফুলে সজ্জিত পাহাড়ের ঢালে তৈরী বাগান রক গার্ডেন। এখানে পৌঁছাবার পাহাড়ী রাস্তা খুবই ভয়াবহ কারণ রাস্তার টার্নগুলো খুবই ভায়াবহ। কিন্তু দুপাশের অপরূপ সৌন্দর্য্য যেনো সব ভয় গায়েব করে দেয়। গাঢ় সবুজ পাহাড়ের কোলে ছোটো ছোটো জোনাকির মত বাড়ি পাহাড়ের ঢালে জমে থাকা পেঁজা তুলোর মত মেঘ দেখে নম্রমিতার মনে পড়ে বেলভা প্লেইন নামক আমেরিকান কবির সেই উক্তি “ইন ডেঞ্জার”।
“ডেঞ্জার হাইডস ইন বিউটি এন্ড বিউটি হাইডস ইন ডেঞ্জার (বিপদ লুকিয়ে থাকে সৌন্দর্যে আর সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে বিপদে।)”
#চলবে!
যে দার্জিলিং সম্পর্কে এতকিছু বলার কী প্রয়োজন! তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, যেহেতু তারা যেখানে ভ্রমণে গেছে তাই অল্প বিস্তর সেখানকার বিষয় না আসলে বরং বেমানান লাগবে গল্পটা। তবে আগামী পর্ব থেকে আর দার্জিলিং থাকছে না।