#তিক্ত_বুকের_বাঁপাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_১৪(দার্জিলিং এর পথে)
লাজুক হেসে আনোয়ারা খাতুনকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে নম্রমিতা। মনে পড়ে মায়ের কথা। কতোদিন কথা হয়না। আরুশির সাথে মাঝে মধ্যে কথা হলেও মায়ের সাথে কথা বলা হয়না নম্রমিতার। মন কেমনের ভার বইতে বইয়ে ক্লান্ত সে। এখন আর এসব নিয়ে ভাবেনা। জীবনকে বাঁধহীন নদীর মত ছেড়ে দিয়েছে সে। দেখা যাক কোন কূলে গিয়ে ঠেকে!
নম্রমিতার আহ্লাদি আদরে অভ্যস্ত আনোয়ারা খাতুন। নম্রমিতাকে এই বাড়ির বউ নয় বরং মেয়ের মতো করেই রাখার চেষ্টা করেন তিনি। এইযে নম্রমিতা কলেজে যায়, প্রায় অনেকটা কাজ সেরে রেখেই যায়। বাকিটা তিনি নিজেই দেখে নেন। যদিও বাড়ির যাবতীয় কাজের জন্য একজন খালা আছেন। তবুও এ বাড়ির রান্নার কাজটা নিজেরাই করে তারা। আনোয়ারা বেগম বেশ কয়েকটা কড়া নির্দেশ দিয়েও নম্রমিতাকে কিচেনের কাজ থেকে দূরে রাখতে পারেননি। সুনিপুণ হাতে রান্নার বেশিরভাগ কাজটা সে গুছিয়ে তবেই কলেজে যায়। আবার ফিরে সন্ধ্যার পর থেকে পড়াশোনা নিয়েই থাকে। এই বেলায় কোনরকম উঁকিঝুঁকিও করতে পারেনা সে রান্নাঘরে। রাফিদ আর আনোয়ারা খাতুনের কড়া নির্দেশে বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতে হয় তাকে।
ছুটির দিনে সন্ধ্যার নাস্তায় গরম গরম পকোড়া আর নুডলস। সেই সাথে চলছে ড্রয়িংরুমে নানা রকম আলোচনা। তোহা শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সবার দিকে। আজকাল যেনো কথা খুঁজে পায়না সে। বক্তার চেয়ে শ্রোতা হতে বেশি পছন্দ করে। ইদানিং তোহার চুপচাপ স্বভাব রাফিদেরও দৃষ্টি এড়ায়নি। চুপ করে বসে থাকতে থাকতে হুট করে তোহার মাথায় চাটি দেয় রাফিদ। অতঃপর, এমন এক ভাবভঙ্গি যেনো ভাজা মাছ উলটে খেতে জানেনা সে। কটমট চোখে তাকায় তোহা। রাফিদ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে পকোড়ায় কামড় দেয়। চেতে ওঠে তোহা। অভিমানি সুরে অভিযোগ তোলে আনোয়ারা খাতুনের কাছে।
“আম্মু, তোমার ছেলেকে কিছু বলবে? সবসময় আমার পিছনে লাগে কেনো সে?”
“তোর পিছনে মধু লেগে আছে নাকি! যেন আমি মৌমাছি, ঘুরবো তোর পিছে পিছে!”
“ভাইয়া, ভালো হচ্ছে না কিন্তু!”
“যা ভাগ এখান থেকে। কতোদিন আর এই বাড়ির নুডলস ধ্বংস করবি! বিয়ে করে বরের ঘরের নুডলস খা।”
“তোর জিনিস খাইনা আমি বুঝলি! আমার আব্বু আনে আমার জন্য।”
“আম্মু এটাকে বিদায় করো তো জলদি। আজকাল বড্ডো জ্বালাচ্ছে।”
বিয়ের কথা শুনে চোখ ছলছল করে ওঠে তোহার। সে যে একজনকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে! তার গোটা রাজ্য জুড়েই যে সেই মানবের বিচরন! অন্য কারোর জন্য বিন্দুমাত্রও জায়গা অবশিষ্ট নেই সেখানে।
“আব্বু, আমি বিয়ে করবো না কখনও। তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাবনা আমি। একদম কেউ আমাকে জোর করবে না এসব বিয়ে টিয়ে নিয়ে।”
মেয়ের কথা শুনে হাসেন আরিয়ান চৌধুরী। আলতো পরশে হাত বোলান তোহার মাথায়। তোহাকে তিনি নিজেও বড্ডো বেশি ভালোবাসেন। রাফিদের জন্মের নয় বছর পর বহু কষ্টে তাদের কোল আলো করে এসেছিলো তোহা। মাঝে একের পর এক বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় প্রায়ই জায়নামাজে বসে কাঁদতেন আনোয়ারা খাতুন। আরিয়ান চৌধুরীও কম কষ্ট পাননি। বিভিন্ন জায়গায় মানত করেছিলেন একটা সন্তানের জন্য। তিনি যে একটা সন্তান নিয়ে অখুশি ছিলেন এমনটা নয়। বরং আনোয়ারার কান্না সহ্য করতে পারতেন না, সে কারণেই এত প্রয়াস। বড্ডো বেশি ভালোবাসেন যে স্ত্রীকে! অতি যত্নে গড়া একটুকরো সুখ যে তোহা! কিভাবে তা তুলে দেবেন অন্যের হাতে! যদি সে ঠিকমতো যত্ন করতে না পারে তাদের রত্নের! যদি অবহেলায় ফেলে রাখে! তবে যে সহ্য করতে পারবেন না তিনি।
“এসব কথা এখন থাক না তোহা। তোমার আব্বু তোমাদের জন্য একটা সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছেন। যেটাতে সবচেয়ে বেশি খুশি বোধহয় তোহাই হবে।”
মায়ের কথা শুনে খুশিতে চোখ চকচক করে ওঠে তোহার। আব্বুর সারপ্রাইজ মানেই বিশেষ কিছু, সে জানে। এজন্য আরো বেশি আগ্রহ তার। উৎসুক দৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে আছে আরিয়ান চৌধুরীর দিকে। যেনো তিনি বিশেষ কোনো বক্তব্য পেশ করতে চলেছেন।
“আগামি সপ্তাহে তোমরা তিনজন দার্জিলিং ট্যুরে যাচ্ছো। সমস্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছি আমি। হোটেলও বুক করা আছে। রাফিদ আগামী এক সপ্তাহের জন্য ছুটি নিয়ে নাও অফিস থেকে। এমনিতেও বিয়ের পর কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি তোমাদের। আপাতত একসাথে যাও, পরে নাহয় আলাদা করে দেশের বাইরে থেকে ঘুরে এসো।”
“ইয়াহু। আব্বু সত্যিই আমরা দার্জিলিং যাচ্ছি! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছেনা।”
মেয়ের উচ্ছ্বাস দেখে হাসেন আরিয়ান চৌধুরী। চোখাচোখি হয়ে আনোয়ারা খাতুনের সাথে। মাথা নেড়ে সম্মতি জানান তিনি। যার অর্থ তাদের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। মূলত তোহার মন খারাপ কাটানোর জন্য এই ব্যবস্থা করেন তারা। সেই সাথে নম্রমিতা আর রাফিদও একটু সময় কাটালো।
১৭.
দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো। দার্জিলিং যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের শপিং তোহা আর নম্রমিতাকে সাথে নিয়েই করেছে রাফিদ। শীতের পোশাক নিয়েছে বেশ কিছু। সেই সাথে আরও অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।আজ রাতের দিকে রওয়ানা দেবে তারা। সেই মতো প্যাকিংও শেষ। মনের মাঝে বাসা বেঁধে থাকা চিন্তাগুলোকে মুক্ত করে উড়াল জমায় অচেনা রাস্তায়। কিছু সুখের মুহূর্ত কুড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টায় বাক্স বন্দী করে দুশ্চিন্তাকে। কয়েকটা মুহূর্ত নাহয় চুরি করে নিলো সে! বাকি জীবনটা বাঁচার আশায়!
দার্জিলিং শহরটি ছাড়াও তার গন্তব্যে পৌঁছানোর যাত্রাপথ অতীব সুন্দর। যাত্রা শুরু হয় শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেনে করে। যেহেতু রাতের ট্রেন, তাই সারারাত ট্রেনে কাটিয়ে পরদিন সকালে ট্রেন পৌঁছাবে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। ট্রেনের সবাই মোটামুটি গভীর ঘুমে। তোহাও ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুম দিয়েছে। রাতও হয়েছে বেশ। রাফিদও কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়েছে। অথচ ঘুম নেই নম্রমিতার চোখে। দূরপাল্লার ট্রেনে যাত্রা তার এই প্রথম। বাবা কখনও দূরে ঘুরতে দেয়নি তাকে। ভীষণ আদরের ছিলো কিনা! কেবিনের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে নম্রমিতা। হাল্কা হাল্কা শীত করছে। নিশুতি রাতের আকাশ দেখতে দেখতে গেটের কাছে গিয়ে দাড়ায়। হাল্কা শীতের মাঝে দুরন্ত বাতাসের ঝাপটা, শিরশিরে অনুভূতিতে ছেয়ে যাচ্ছে মন। ঠাণ্ডায় কাঁটা দিয়ে উঠছে শরীর। তাও বেশ ভালো লাগছে তার। নতুন এক অভিজ্ঞতা। রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি। ট্রেনের গেটের দুই ধারের হাতল ধরে খানিকটা ঝুলে পড়লো সে বাইরের দিকে। নতুন উদ্যমে অনুভূতিরা ধরা দিচ্ছে। গা শিউর উঠছে। ইতিমধ্যে একজোড়া হাত তার কোমড় পেঁচিয়ে ভেতরে টেনে নিয়েছে। হাতের মালিকটাকে চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হলোনা নম্রমিতার।
“এতো রাতে না ঘুমিয়ে এখানে কি বউ?”
“এইতো একটু রাতের আকাশ দেখছিলাম।”
“তুমি একা কেনো? আমাকেও তো ডাকতে পারতে!”
“তুমি ঘুমাচ্ছিলে। তাই আর ডাকিনি।”
“আচ্ছা চলো এখন দুজনে একসাথে দেখবো, রাতের আকাশ।”
নম্রমিতার হাত ধরে রাফিদ বসে পড়ে ট্রেনের গেটে। পা ঝুলিয়ে দেয় বাইরে। নম্রমিতা বেশ ভয় পাচ্ছে দেখে একহাতে কোমর জড়িয়ে ধরে রাফিদ। অতঃপর দুজনে ডুব দেয় প্রশান্তিময় একটা সময়ে।
সকাল দশটার দিকে তারা পৌঁছে যায় নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে মোটামুটি সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ দার্জিলিং। গাড়িতে ওঠার আগে হাল্কা কিছু নাস্তা করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ষ্টেশনের পাশে একটা ছোট্ট হোটেলে ঢোকে তারা। পরোটা, অমলেট আর আলুভাজা দিয়ে হাল্কা নাস্তা সেরে নেয়। এরপর দোকান থেকে পানির বোতল কিনে নিয়ে তারা চলে আসে বড়ো রাস্তার দিকে। রাফিদ দরদাম করে একটা গাড়ি ভাড়া করে নেয়। গাড়িতে উঠে বসে তিনজনে। ঘন্টাখানেক পর থেকেই বাইরের প্রকৃতির চেহারা মুহুর্মুহু বদলে যেতে শুরু করে। জলপাইগুড়ির চেনা শহরের রূপ ছাড়িয়ে এগিয়ে যায় গাড়ি। দুপাশে পাইন গাছের বনকে পিছনে ফেলে গাড়ি ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে পাহাড়ের পথে। এতক্ষন সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও সমস্যা শুরু হয় এর পরেই। কিছুক্ষণ পর থেকেই শুরু হয় চড়াই-উৎরাই পাহাড়ের রাস্তা। তোহা উৎফুল্লতার সাথে এতক্ষন মুহূর্তগুলো এনজয় করলেও, এবার ভয় পেয়ে যায় খানিকটা। পাশে বসা নম্রমিতার হাত চেপে ধরে ভয়ে। নম্রমিতা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, দেখতে থাকে পাহাড়ের কোলে মেঘেদের খেলা। অপরদিকে ড্রাইভারের পাশে বসা রাফিদ ফ্রন্ট মিররে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আলগোছে ছাড়িয়ে পড়া একগোছা চুলের অধিকারিণী তার প্রিয়তমাকে। দৃষ্টি ফেরানো যেনো দায়।
মাথার উপর পাহাড়ের আকাশ নীলিমায় নীল হয়ে রয়েছে। পাহাড়ের রাস্তায় অগ্রসর হবার খানিকক্ষণ পর থেকেই মৃদু শীত করতে থাকে তাদের। অগত্যা সকলের গায়ে উঠল গরম কাপড়। পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য চোখের সামনে উন্মোচিত করতে করতে গাড়ি ছুঁতে চলেছে দার্জিলিং-এর পথে। অবশেষে যাত্রা শুরুর ঘণ্টা তিনেক পর তারা পৌঁছালো তাদের গন্তব্য দার্জিলিং এ ।
#চলবে!
Nice, next লিখবেন না কেউ একদম। নিজেদের অনুভূতি ব্যাক্ত করুন গল্পটা নিয়ে। এটুকুই তো আমাদের লেখালেখির অনুপ্রেরণা।