তিক্ত বুকের বাঁ পাশ পর্ব ১১

0
825

#তিক্ত_বুকের_বাঁপাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_১১(অভিমানি দোলাচল)

১২.
আজ তিনদিন পর কলেজে এসেছে তোহা। এই কয়দিন নিজেকে সময় দিয়েছে। পরিবারের সাথে খুনসুটিময় কিছু সময় কাটিয়ে নিজেকে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। কখনও আবার একাকীত্ব সময়ে ভেবেছে নিজেকে নিয়ে। গুছানোর চেষ্টা করেছে অগোছালো ছন্নছাড়া মনকে। সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মেয়েদের মনের দোলাচল হয় ভিন্ন। এই তারা সুখের সাগরে ভাসে তো এই কান্নায় বুক ভেঙে আসে। হঠাৎ পথচলা কাউকে হুট করেই ভালো লাগে আবার চিরপরিচিত কাছের মানুষটার প্রতি অনুভূতিশূন্য লাগে। তোহাও তার ব্যাতিক্রম নয়। তবে রনকের ব্যবহার কিভাবে যেনো তার মনে গেঁথে গিয়েছে। মনেপ্রাণে সে চায় রনক আর তার সামনে না আসুক। তাকে অপমান করার কিংবা কিছু কথা শোনানোর সাধ থাকলেও সাধ্য যে তার নেই।

ক্যাম্পাসের দক্ষিণ দিকে কৃষ্ণচূড়া গাছ। তার সামনে ছোটো এক জলাশয়। জলাশয়টা বেশ খাইনকটা ছোটো আর ঘাটবিহীন হওয়ায় পুকুর ঠিক বলা চলে না। সুবিন্যস্ত কৃষ্ণচূড়া গাছের অসংখ্য ফুল পড়ে আছে জলাশয়ে। যেনো ঘোলাটে জলের উপর লাল আলতা বিছানো। গাছের নীচের দিকের মাটিতেও বেশ কিছু ফুল বিছিয়ে আছে স্তরের ন্যায়। যেনো রেড কার্পেট। তোহা খালি পায়ে হেঁটে বেড়ায় রেড কার্পেট এর উপর দিয়ে। মাঝে মাঝে কয়েকটা ফুল গাছ থেকে নিচে পড়ছে। তোহা তা লুফে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তোহাকে দুই হাত বিছিয়ে এভাবে উপভোগ করতে দেখে হাসে প্রীতি, নাফিসা। তারাও এগিয়ে যায় তোহার দিকে। পায়ের শব্দ অনুভূত হতেই ঝট করে চোখ খুলে ফেলে তোহা। আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বলে ওঠে,

“একদম জুতো পরে এদিকে পা বাড়াবি না কেউ। আস্তে ভাবে জুতো খুলে আয় আমার রাজ্যে।”

তোহার কথায় মুখ বেঁকিয়ে তাকায় নাফিসা। চোখ ছোটো ছোটো করে কোমরে দুই হাত গুঁজে বলে ওঠে,

“তোর রাজ্য? সিরিয়াসলি তোহা? এটা হলো প্রকৃতির সম্পদ। তাই এটা আমাদেরও রাজ্য।”

“সে তো ভালো কথা। কিন্তু জুতো পরে আসলে ফুলগুলো পিষে যাবে। তাই জুতো পরে আসতে পারবিনা।”

সানিয়া কিছু বলতে গেলে তাকে থামিয়ে দেয় প্রীতি। অতঃপর দুজনে জুতো খুলে তোহার কাছে যায়। তিন বান্ধবী একসঙ্গে ফুলের বিছানায় বসে পা ঝুলিয়ে দেয় জলাশয়ে। এরপর নানা কথা আলোচনা নিয়ে খোশগল্পে মেতে ওঠে।

“তোহা, জানিস কি হয়েছে?”

প্রীতির কথা শুনে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে সেদিকে তাকায় তোহা। যার অর্থ কি হয়েছে?

“আমাদের যে গেষ্ট টিচার আছে, রনক স্যার! উনি তোকে খুঁজছিলেন। কি যেনো একটা কাজ আছে বলছিলেন। কিছু কি হয়েছে?”

গা ছাড়া ভাব নিয়ে পানিতে পা দিয়ে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে তোহা। উৎসুক জনতার ন্যায় উত্তরের অপেক্ষায় তোহার দিকে তাকিয়ে থাকে প্রীতি আর সানিয়া। কিন্তু বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গেলেও তোহা কিছু বলেনা। বিরক্ত হয় তারা।

“ধ্যাত, খালি চুপ করে থাকে। কিছু জিজ্ঞাসা করলেও যে মানুষ এমন চুপ করে থাকে তোকে না দেখলে জানতাম না। বলদ একটা। ভালো মুড নষ্ট করে দিলো।”

ফিক করে হেসে ওঠে তোহা। প্রীতি মেয়েটা তাকে যে ঠিক কতখানি ভালোবাসে, সে জানে। একেবারে বোনের প্রতিচ্ছবি যেনো। কলেজ জীবনে যেখানে সবাই নিজেদেরকে নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত, সেখানে এই মেয়েটা সর্বদা তাকে নিয়ে ভাবে। অনেকটা বেশি বোঝে। এইযে কথায় কথায় রাগ দেখানো, এটাও ভালোবাসারই এক প্রতিচ্ছবি।

“কিছু হওয়ার ছিলো কি আমাদের মাঝে? স্যার এর সাথে একটা স্টুডেন্টের নিশ্চয়ই প্রেম হতে পারেনা? আবার বন্ধুত্ত্বও হওয়াটা অস্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে কিছু হওয়ার লক্ষণ তো আমি দেখছিনা।”

তোহার কথা শুনে বাঁকা চোখে তাকায় সানিয়া। উৎসাহ নিয়ে বলে ওঠে,

“বাই এনি চান্স, তুই কি স্যারকে ভালোবেসে ফেলেছিস তোহা?”

বিস্ময়ে হতবাক তোহা। ধুক করে উঠলো বুকের ভেতর। কেমন যেনো আনচান করছে শরীর। উস্কখুস্ক লাগছে নিজেকে। সানিয়ার বলা কথাটা যেনো তার সহ্য হলোনা। অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ। সত্যিই কি সে ভালোবেসে ফেলেছে ওই খারাপ মানুষটাকে! যে কিনা বিনা অপরাধে, কোনো আগাম বার্তা বিহীন আচমকাই তাকে এতো কষ্ট দিয়ে গেলো! কই সে যেতে গেলে একটা বারও তো আটকালো না! নাহ সে ভালোবাসেনা ওই লোককে। বাসেনা, বাসেনা, বাসেনা। একদমই ভালোবাসেনা।

ক্যাম্পাস বিল্ডিং এর কাছাকাছি আসতেই তোহার চোখ পড়ে। খানিকটা দূরে দাড়ানো সিনিয়রদের দলের উপর। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে গেলেই কারোর কণ্ঠ শুনে থেমে যায় তোহা। সানিয়া আর প্রীতি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ব্যাক্তিটার দিকে। রুহেল এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। ভয় পায় প্রীতি। কারণ সিনিয়ররা শাস্তি ছাড়া এভাবে যেতে দেবেন না। এদিকে মনে মনে বেশ খুশি হয় সানিয়া। রুহেল ছেলেটাকে সে প্রথম দিন থেকেই বেশ পছন্দ করে। পুরোই চকলেট বয়। কলেজের অধিকাংশ মেয়েই এই ছেলেকে দেখে একবার না একবার হলেও ক্রাশ খায় নিশ্চিত। রুহেল যতো এগিয়ে আসে সানিয়ার মুখে লজ্জার আভা ফুটে ওঠে। অথচ সানিয়াকে বিস্ময়ে ডুবিয়ে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে রুহেল তোহার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

“কেমন আছো তোহা?”

“জ্বী ভাইয়া ভালো।”

“কিছু কথা বলার আছে। আসতে পারবে একটু?”

“আমার ক্লাস আছে ভাইয়া।”

“ভাইয়া! আর একবার ভাইয়া ডাক শুনলে সোজা তোমার বাড়ীতে গিয়ে সম্পত্তিতে ভাগ বসাবো।”

নিজের অজান্তেই ফিক করে হেসে দেয় তোহা। তোহাকে হাসতে দেখে নিজেও হাসে রুহেল।

“ক্লাস শেষে লাইব্রেরীতে অপেক্ষা করবো।” কথাটা বলে এক মুহুর্তও দাড়ায়না তোহা। পিছন ফিরে তাকালে হয়তো দেখতো তার ফিরতি পথের অপেক্ষায় কেউ প্রাণভরে শ্বাস টেনে নিলো। হাসলোও বটে।

ক্লাস নেওয়ার মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছে রনক তোহার দিকে। কিন্তু তোহা একবারের জন্যও তাকায়না সেদিকে। তবুও রনক তাকাচ্ছে। বারবার তাকাচ্ছে। একটু পর পরই তাকাচ্ছে। একবার চোখাচোখি হবে সেই আশায়। সে কেনো চাইছে এমনটা, কারনটা নিজেরও অজানা। ফাঁকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রনক আবারো মনোযোগ দেয় পড়ানোতে।

ক্লাসরুমের কর্নারের দিক থেকে ফিসফিস করে কথা বলার আওয়াজ আসছে। পড়ানো রেখে সেদিকে তাকায় রনক। তোহার পাশের মেয়েটা কথা বলছে। তোহার সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজে পায় রনক। জোর করেই তোহাকে ডেকে দাঁড় করায় সে।

“ক্লাসরুমে এতো কথা কিসের?”

হতভম্ব হয়ে যায় তোহা। ক্লাসের এতগুলো স্টুডেন্টের সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে অস্বস্তি লাগছে তার। কিন্তু কিছু করার নেই। রনক যে ইচ্ছে করেই এমনটা করছে, তা আর বুঝতে বাকি নেই তার। ভরাক্রান্ত হয় মন।

“আমি কথা বল…..”

তোহার কথা মাঝপথেই থামিয়ে দেয় রনক। গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,

“ক্লাসের মাঝে অরাজকতা সৃষ্টি করোনা। ক্লাস শেষে দেখা করবে আমার সাথে।”

বেঞ্চে মাথা ঠেকিয়ে বসে পড়ে তোহা। চোখের কার্নিশ উপচে গড়িয়ে পড়ে কয়েকফোঁটা অশ্রুকনা। অকারনেই পুরো ক্লাসের মাঝে করা এই অপমান ভীষণ মানে লেগেছে তার। সে তো কিছু করেনি! তবে কি ইচ্ছে করেই রনক তাকে অপমান করলো! মনে মনে অভিযোগের সুর তুললেও মুখে প্রকাশ করলোনা। অভিযোগগুলো সযত্নে একের পর জমা হতে থাকলো মনের কোনো এক কোনায়। যা কখনো প্রকাশ পাবে কিনা জানা নেই। তবে সে চায়না প্রকাশ করতে। অভিযোগ হোক কিংবা অভিমান, তা তো তার একান্ত ব্যাক্তিগত সম্পত্তি। তার ভাগ সে কাউকে দেবেনা। কখনও কেউ মনের দুয়ারে প্রবেশ করে একে একে সেগুলো মুছতে পারবে কিনা জানা নেই। তবে যতদিন না কেউ এসে এগুলো মুছে ফেলে ততদিন সযত্নে রাখবে। প্রিয় কারোর অবহেলা কিংবা অপমানগুলোও বুঝি এতো প্রিয় হয়! মানুষটার উপরে যতোই রাগ, অভিমান কিংবা অভিযোগ থাকুক না কেনো, তার সবকিছুই বোধহয় এভাবেই বিশেষ হয়ে থেকে যায় আজীবন। নিজের ভাবনায় নিজেই চমকে ওঠে তোহা। প্রিয় মানুষ, বিশেষ মানুষ! এসব কি ভাবছে সে! নাহ। জেনেবুঝে গভীর সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার কোনো মানে হয়না। তলিয়ে যাবে তবে অনিমেষেই।

#চলবে!

রাতে মাত্র কিছুটা লিখেই ঘুমিয়ে গেছিলাম কখন যেনো। সকালে উঠে দেখি ফোনের চার্জ শেষ। সেই সাথে যেটুকু লিখেছিলাম তাও। এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। পরের পর্ব কাল সকালে দেবো। হ্যাপি রিডিং।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here