তারকারাজি- (০৮)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
|| দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ||
আমরা আমাদের ছাত্রজীবনে তখন-ই মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারি যখন আমরা সেভাবে বেঁচে থাকার মতো কাজ করতে থাকি।
ছোটবেলার একটা মজার খেলা ছিল— রেললাইনের পাতে হাঁটা। সেই খেলায় শুধু দেখা হতো যে, কার পা কখন পাতের বাহিরে ফসকে পড়ে যায়। অথচ খুব কম সংখ্যক মানুষ-ই খেয়াল করত যে, কে কতটা পথ হেঁটে এসে ব্যর্থ হয়েছে। এই মুহূর্তে চার দেয়ালের মধ্যখানের গমগম করতে থাকা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে ওই মাথা নিচু করে অশ্রু বিসর্জন দেওয়া মিশমির মনে হচ্ছে— তার পা ফসকে পড়ে যাওয়াটাই মানুষ দেখে নিল বেশ করে, পিছনের পথটা একবারও দেখছে না কেউ। মেয়েটি মনে মনে খুব করে চাচ্ছে যেন, ইহকালে তার মতো কোনো হতভাগী এমন আতঙ্কপ্রসূত… এমন লজ্জাজনক পরিস্থির মুখে ফসকে না পড়ে। না-হয় রেলগাড়িটাই ছিটকে ফেলে দিক তাকে! তবুও কারো পা ফসকে না পড়ুক সেই সরু পাত থেকে। ও যে ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি…!
মিশমি ত্রাসিত বক্ষেই এক ঝলক দেখে নিল ডিপার্টমেন্ট ডীন- আব্দুল মোতালেবের মুখোমুখি বসে থাকা পাঁচটি মানুষকে। তাদের ওমন পরিস্থিতিতে দেখে নেওয়া শিক্ষক নুরুল আলম ঘটনার বিশ্লেষণ করছেন আর ঝুমুর বেগম, মঈনুল হোসেন এবং তিহামের বাবা-মা মাথা নিচু করে বসে সবকিছু শুনছেন। মিশমি চোখ মেঝেতে রেখেই কান্নায় ঠোঁট কামড়ে ধরল। ছাত্রজীবনের আবেগী ছেলে-মেয়েরা নিজের সম্মানের আগে তাদের বাবা-মার সম্মানের কথা ভাবে, এটা নতুন নয়। তবে সে যে এমন একটা পরিস্থিতিতেই বাবা মায়ের মাথা নিচু করিয়ে দিবে তা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি মিশমি। সবারই ভিন্ন-ভিন্ন ধরণের যন্ত্রণা থাকে। এইযে, মেয়ের এমন অধঃপতন শুনে হয়তো বাবা-মায়েরও যন্ত্রণায় বুক ছিঁড়ে যাচ্ছে। অথচ তারা কি দেখতে পাচ্ছে মেয়ের যন্ত্রণা? মেয়েটা যে গলা ফাটিয়ে অন্তরে-অন্তরে প্রচণ্ড চিৎকার করে ডাকছে তাদের,
“ আব্বু? আম্মু? বিশ্বাস করো, আমি কিছুই করি নাই। আমি তো নিজের সর্বস্বটা দিয়ে চেষ্টা করেছিলাম তিহামকে আঁটকানোর৷ কিন্তু আমি যে ওর সাথে পারিনি গো! তোমরা স্যারের কথা শুনো না, আমার কথা শুনো। আব্বু? আম্মু? শুনতে পারছো? ”
সেই অনুচ্চারিত চিৎকার বোধহয় শ্রবণেন্দ্রিয় হয়না পিতা-মাতারও। তবে সেখানে মিশমির সকল বিশ্বাস ঠুনকো হলো তখন, যখন ভীষণ গাম্ভীর্যে প্রশ্ন করলেন আব্দুল মোতালেব,
“ মিশমি? তোমাদের লাইব্রেরিতে যাওয়ার বিষয়টা প্রি-প্ল্যান্ড ছিল? ”
মিশমি মাথা নিচু করেই রইল কয়েক মুহূর্ত। ওনার উচ্চারিত ‘যাওয়ার বিষয়টা’ যে ইঙ্গিতে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছিলো মিশমির মন, তার রেশ কাটিয়ে উত্তর দেওয়াটা মেয়েটির জন্য ভারীই ছিল বৈ অন্য কিছু নয়। ঠিক মিশমির এই চুপ থাকার মাঝেই তিহাম হুট করেই বিস্ফোরণ ঘটালো,
“ আমি কিছু জানতাম না, স্যার। আমাকে মিশমিই ‘কাজ আছে’ বলে ডাকছিল। আমার কাছে প্রমাণ আছে। ”
বয়োবৃদ্ধ সকলের দৃষ্টি মিশমিতে আঁটকালেও মিশমির দৃষ্টি থমকালো তিহামের উপর। তার এমন কথায় বোধহয় থমকালো মিশমির কান্নাটাও। এ-কেমন কথা বলছে সে? সে তো বলেছিল যে, সে যাবে না কোথাও। তবুও…?
মিশমি তখনও জানে না তিহামের ফোনে কী ছিল। তবে তিহামের ফোনের পর্দায় তাকিয়ে যখন আব্দুল মোতালেব বিড়বিড়িয়ে কিছু পড়ছিলেন তখন-ই সে বুঝতে পারল কীসের প্রমাণ দেখিয়েছে তিহাম। গত রাতেই মিশমি বার্তা প্রেরণ করেছিল যে, সে তার সাথে পাঠাগারে যেতে চায়। এর আগেও তারা সেখানে একসাথে গিয়েছে বহুবার। তারপরও তিহাম কারণ জিজ্ঞাসা করলে মিশমি অবাক হয়েছিল বেশ! পাঠাগারে যেতে চেয়েছে যখন তো নিশ্চয়ই বই সংক্রান্ত কোনো কাজ আছে? তাই মিশমি ক্ষীণ বিরক্তির সাথেই লিখেছিল,
“ তুমি জানো না— কেন? কাজ আছে তাই যাব, বুঝছো? ”
এই সামান্য দুটো কথার প্রেক্ষিতেই আব্দুল মোতালেবকে বলতে শোনা গেল,
“ আজকাল অনেক ছেলে-মেয়েই সম্পর্কে আছে। তাই বলে এমন ডেস্পারেটলি আচার-আচরণ করবে এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। যা শুনলাম তাতে তো মনে হলো— শী ইজ আ ব্রাইট স্টুডেন্ট। তিহামের একার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঘটলেও মানা যেত। কিন্তু আপনার মেয়ে তো…। না, না, মঈনুল সাহেব। আপনি একজন টিচার হয়েও মেয়েকে সঠিক-বেঠিক বুঝাতে পারেন নাই। ভার্সিটিতে এগুলা ব্যাপার না। তবে ছেলে-মেয়ে যা করছে তা আমাদের জন্যও অনেক লজ্জাজনক ব্যাপার। ওদের দেখাদেখি তো বাকি ছেলে-মেয়ের’ প্রশ্রয় পাবে। ওদের বুঝতে হবে ওরা এখন বড় হয়েছে। স্কুলে তো আর পড়ে না যে, ধরে-বেঁধে বোঝাতে হবে সবকিছু। সমাজে আপনি একজন সম্মানিত মানুষ, মঈনুল সাহেব। তাই আমি আপনাদের আগেই ডেকে নিয়েছি যাতে এমন কিছু আর ভবিষ্যতে না ঘটে। মেয়ে ট্যালেন্টেড, ব্রিলিয়ান্ট… আশা করি এটা বুঝবে— কীসে বাবা-মার সম্মান বাড়বে আর কীসে কমবে। ”
তিনি একটু থামলেন। অতঃপর তিহামের বাবার সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। কথায় কথায় নানান কথা-ই উঠল সেখানে। তবে ঘর ত্যাগ করার আগে মিশমির কানে এসেছিল শিক্ষক নুরুল আলমের বলা কিছু কথা,
“ তিন মাসও তো হলো না অন্য মেয়ের সাথে কাণ্ড করায় লাস্ট ওয়ার্নিং পাইছিলি। আর এখন আরেকজন? কী করতে চাচ্ছিস তুই? শুনছিলাম তোকে এর আগেও রাসটিক্যাট করা হইছিল, তিহাম। তাও কি তোর লজ্জা হয় না? রিলেশন সবাই-ই করে। তাই বলে তোর মতো আজকে একটা আর কালকে অন্যটা… এমন কিন্তু করে না। তুই… ”
যাওয়ার পথে মিশমি তার ক্রন্দনে সিক্ত আঁখি জোড়া মেলে ওই নতমুখী তিহামকে একবার দেখে নিল। কানে কোনো কথাই আর আসছে না। ঝিঁঝি পোকার ডাকে মাথা ধরিয়ে দেওয়ার মতো অনুভূতি হচ্ছে তার। অথচ মেয়েটি যে মানুষটাকে নিজের জীবনে এতোটা গুরুত্ব দিল আজ সে-ই কতোটা জঘন্যভাবে বলছে,
“এবার আমি তো কিছু করি নাই! আমাকে ডেকে নেওয়া হইছিল দেখেই আমি গেছি। আমি তো জানতাম না মিশমি কেন ডাকছে। দোষ যদি মেইনলি আমাকেই দেন তাহলে তো আমি মানব না স্যার। আমি অবশ্যই ওর সাথে দেখা করতে চাইনি। আর… ”
মিশমি আবারও শুনতে পেল না সেই সকল মিথ্যে অভিযোগ যা সত্য অর্থেই অনর্থক৷ সে বাহিরে এসে স্থির হয়ে দাঁড়াতেই বাবা মঈনুল হোসেন ধীর কণ্ঠে বললেন,
“ তোমার মা না চাইলেও আমি তোমাকে সেই সবকিছুই দিছি যা তুমি চাইছো আমার থেকে। তোমার থেকে কী চাইছিলাম আমরা? শুধু মানুষের মতো মানুষ হয়ে, জ্ঞান অর্জন করে নিজের জীবন নিজে গুছাবে… এটাই। এতেই আমাদের অনেক কিছু পাওনা ছিল। আর তুমি কী করলে? শোনো মিশমি, যা তুমি ঘটিয়েছো তা যদি আমার প্রতিষ্ঠানে ঘটতো তবে তোমাকে সেখান থেকে বের করে দেওয়াই আমি উত্তম মনে করতাম… অবশ্যই অ্যাজ আ টিচার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অসভ্যতা মেনে নেওয়া যায় না৷ তাও তুমি ছাড় পেয়েছো ভাগ্যের জোরে। পারলে কাজে লাগিয়ো। ”
উনি চলতে লাগলেন। নতমুখী মিশমিকে তার মা আর বকা-ঝকা করলেন না৷ তবুও মিশমিকে অসীম আত্মগ্লানিতে মৃদু কাঁপতে দেখা গেল। মায়ের সাথে কথা বলার মতোও সৎসাহস রইল না তার। তখন ঝুমুর বেগম বললেন,
“ তোমাকে কখনোই তোমার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করি নাই আর আজকেও করব না। তুমি না-হয় জেনে-বুঝেও ভুল করেছো। হ্যাঁ, ভুল মানুষই করে। কিন্তু তোমার বন্ধুরাও না-কি জানতো সবটা? তবুও তোমায় বোঝাতে পারল না যে, কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক। কাদের সাথে মিশছো তুমি, মিশমি? তুমি জানো তো— পাঁচটা পঁচা ফলে একটা ভালো ফলও দুর্গন্ধ ছড়ায়? আমি তো ওদেরও ভরসা করতাম খুব… ঠিক তোমার মতোই। ”
ওনার বুক চিড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসটা স্পষ্ট অনুভব করতে পারল মিশমি। শরীরের কম্পনে এলো ক্ষিপ্রতা। নতমুখেই অনুভব করল যে, সেই কষ্টে জর্জরিত ভারী কণ্ঠের নারীটি বিপরীতে চলন্ত অবস্থায়-ই মাতৃবৎ অধিকারে বলতে লাগল,
“ সন্ধ্যার আগে যেন তোমাকে বাসায় পাই। পারলে এই মুহূর্ত থেকেই সেই থার্ডক্লাস ছেলেটার থেকে দূরে থাকতে শেখো। ওই ছেলের না-হয় স্বভাব খারাপ। আমি নিশ্চয়ই ধরে নেব না তোমারও স্বভাবটা খারাপ হয়ে গিয়েছে, মিশমি? ”
মিশমি তাকালো সেই পানে। মা হেঁটে চলে যাচ্ছেন। অথচ মিশমির পা দুটো শেকড়ের মতো গেঁথে গেছে সেখানে। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য মেয়েটি হঠাৎই কারো পিছু ডাকে সাড়া দিয়ে বিস্মিত হলো। রুকাবকে এখানে আশা করাটা বোধহয় অবাস্তব-ই হতো তার জন্য। তবে তা বাস্তব হয়েছে! রুকাব কেমন অস্বস্তিপূর্ণ চাহনিতে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলে উঠল,
“ আসলে মিশমি… আসলে তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমাকে আর মিথ্যাটা বলতে পারছি না। তোমার সম্পর্কে খবরা-খবর নিয়ে তিহাম-ই আমাকে বলেছিল যেন তোমাকে ইমপ্রেস করতে হেল্প করি। ও ওর-ই একটা সিম আমাকে দিয়েছিল আর বলেছিল মেসেজিং করতে। তাই ওই একবার-ই তোমার সাথে আমার কথা হয়েছিল আর… আর তাই-ই ওই নাম্বারটা সব-সময় অফ থাকতো৷ আই’ম সরি ফর দ্যাট। পারলে মাফ করো আমায়। জাস্ট এইটুকু বলার জন্যই আমি ওয়েট করছিলাম তোমার জন্য। ওকে সায় দিয়ে হয়তো তোমার সাথেই ছলনা করেছি অনেক। আমি যদি এমনটা না করতাম তাহলে হয়তো আজকে এমন কিছুই হতো না। মাফ করো… তোমার মাফটা আমার ভীষণ দরকার। ”
রুকাব বেশ উপরুদ্ধের স্বরে কথা বলে উধাও হলো সেখান থেকে। একের পর এক খরশান বাতাসের দাপটে মেয়েটির ক্রন্দনে ব্যাঘাত ঘটল। হঠাৎই যেন বিশাল এক পাথর এসে পড়ল মিশমির বুকে। কী তীক্ষ্ণ সেই ব্যথা… আঁহ্…! অথচ রুকাব বলেছিল— তাকে তিহাম এতটাই ভালোবাসে যে, তার ও তিহামের প্রথম দেখা হবার কথাটি তিহাম যে কতবার তার বন্ধুদের শুনিয়েছে তার কোনো হিসাব নেই!
মিশমি এক মুহূর্তেই তিহামের কথা ভুলে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠছে নতমুখী বাবা-মার মুখ দু’খানা। সব অপমান-ই কি দৃশ্যমান হয়? সে তো স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে— মঈনুল হোসেন নিজে শিক্ষক হওয়ার সত্ত্বেও মেয়েকে যথাযথ শিক্ষাদানে নিজেকে ব্যর্থ মনে করে, প্রচণ্ড অপমানে মাথা নুইয়ে রেখেছিলেন তিনি। সেই কি হৃদয় ভঙ্গের করুণ দৃশ্য! নিজের ভুলের যে যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতির মুঠোয় বাবা-মাকে চলে যেতে দেখেছে মিশমি, সেই আড়ষ্টতা কাটিয়ে বন্ধুদের এতো-এতো আক্রোশ, স্বান্তনা, চিন্তা বা নিজেকে ঘিরে কেঁদে ওঠাটাও নাড়াতে পারছে না মিশমিকে। কেটে যায় মিনিট দুয়েক। বাবা-মায়ের নিদারুণ অপমানে অশ্মরী মিশমি প্রথম বারের মতো নীলাশার চোখ মুছে দিয়ে বলে,
“ কাঁদছিস কেন? ”
নীলাশা বোধহয় উত্তর দেওয়ার মতো কোনো কথাই খুঁজে পেল না। সানামের চোখটাও ভেজা। সেও কেঁদেছে না-কি? মিশমি হাসতে চেয়েও হাসতে পারল না। তবে বাকি দুই বন্ধুর অনুপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করতেই নীলাশা জানালো— পিহু, নিশান ও আরাভরা সবাই নিচে অপেক্ষা করছে তার জন্য। সে যেন একটা বার গিয়ে দেখা করে তাদের সাথে। এই কথা শুনতে পেয়ে বোধহয় অন্তরেই কেঁপে উঠল মিশমি৷ কথা বাড়লো আরো অনেক৷ শুরু থেকে শেষ অবধি ঘটে যাওয়া সকল কিছুই বন্ধু তিনজনের সামনে উন্মুক্ত করল মিশমি। তখন রিশানকে বলতে শোনা গেল,
“ দেখ মিশু, ভুল মানুষই করে। তাই এটা নিয়ে এতো ডিপ্রেশনে চলে না গিয়ে তুই ভাব যে, আঙ্কেল-আন্টিকে কীভাবে সামলাবি। আন্টি কিন্তু কেঁদে-কেঁদে চলে গেল মিশু। সো তিহামকে নিয়ে দয়া করে আর পড়ে থাকিস না বোন। তুই নিজেই বলতেছিস যে, তুই ওর ব্যাপারে এতোগুলা কথা শুনে আসলি। তার উপর তিহাম নিজের বাপ-মায়ের সামনে সাধু সাজতে তোরে তোর বাপ-মায়ের কাছে কালার করার ট্রাই করছে সেইটা পারুক আর নাই-বা পারুক। এরপর তো বলবি না যে, তুই ওরে ভালোবাসোস? তুই এক্ষুনি আমাদের সাথে চল মিশু। সবাই জানে তুই কী আর তিহাম কী। ডীন বললেই হলো— একহাতে তালি বাজে না? ”
নীলাশা মিশমির হাত টেনে ধরল৷ ভীষণ সাহস জুগিয়ে বলল,
“ উই অল ট্রাস্ট ইউ, মিশা। আর এর উপর কোনো কথা থাকতেই পারে না। তিহামের কী ব্যবস্থা করা হয় তা আমরা সবাই মিলে বুঝে নিব। তুই ভয় পাস না৷ বাবা-মা কখনোই তার সন্তানকে ভুল বুঝে থাকতে পারে না। সেইটা শুধুই অস্থায়ী। আমরা আছি তো, মিশা! একসাথে সবকিছুই সল্ভ করে নেয়ার ট্রাই করব। তুই শুধু চল আমাদের সাথে। ”
এই কথাগুলো মিশমিকে ঠিক কতটা প্রভাবিত করল তা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হলো বন্ধুদের। মেয়েটা কেমন কাষ্ঠ হয়ে গেছে! না তো হাসছে আর না তো কাঁদছে। হুবহু যেন ঝড় আগমনের পূর্বাভাস! অবশ্য মিশমিকে মলিন মুখেই আশ্বাস দিতে দেখা গেল,
“ তোরা যেতে থাক। আমি একটু ওয়াশরুমে যাব। ”
এই কথা শুনে রিশান চলে গেলেও বাকি দুজন রাজি হলো না। অতঃপর মিশমির জোরাজুরিতে নীলাশা বলেই উঠল,
“ জলদি আসবি, প্রমিস? ”
মিশমি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালে তারাও নিচে ফিরে এলো সবার মাঝে। পিহু কেমন দৌড়ে এসে শুধালো,
“ ও কই? ওরে রেখে আসছোস না-কি? ”
সানাম ছোট করে উত্তর দিল, “ ওয়াশরুমে। চলে আসবে এক্ষুনি। ”
কিন্তু পিহু মানল না সেই কথা। তার মনটা প্রচণ্ড খচখচ করছে। না-জানি কেন! সে ঘোর প্রতিবাদ জানিয়ে বলল যে, মিশমিকে একা ফেলে আসাটা একদমই উচিত হয়নি তাদের। কিন্তু নীলাশা ছিল একদম স্বাভাবিক। সবাই তো আর জানে না যে, মিশমি তাদের কথা দিয়েছে জলদি চলে আসার। মেয়েটি কথা দিয়ে কথা রাখতে জানে। তবে সে যে এভাবে কথা রাখবে তা কেই-বা উপলব্ধি করেছিল অতীতে? অতীতের রেলগাড়িটা বড্ড বেশিই তরান্বিত। তাকে যদি ফিরিয়ে আনা যেত তবে নীলাশা ও সানাম কখনোই মিশমিকে রেখে এসে, মিশমির খুশির জন্যই এতো আয়োজন-বিয়োজনে অংশ নিত না।
কথায় আছে— অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। অপ্রত্যাশিতভাবে খুব সমীপেই যখন মিশমির দেহটা উপর থেকে ছিটকে পড়ল তখন নীলাশাসহ বাকি সদস্যরাও যেন নিশ্চল এক পাথরে রূপান্তরিত হলো। মস্তিষ্কের সচল সুতোগুলো নিমিষেই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে ঝিম ধরিয়ে দিল মাথাটা। চোখ দুটো আঁটকে গেল ওই নিথর শরীরের দিকে, যা আত্মহত্যার লক্ষ্য নিয়ে দালানের কোনো এক জায়গা থেকে পড়ে মৃদু নড়েচড়ে উঠল। নীলাশা চিৎকার করল। দৌড়ে মিশমির স্পর্শে যেতেই একে একে ছুটে গেল সবাই। নীলাশা ডাকল। ভয়ানক কম্পনে ওঠা-নামা করতে থাকা হৃদয়টায় অহেতুক আশা নিয়েই ডাকতে থাকল মেয়েটি। কিন্তু যা অহেতুক তা তো অহেতুক-ই…! ওদিকে সায়ানের মস্তিষ্ক যেন এখনও অচল-ই আছে৷ অনুভূতি নেই কোনো। অস্পষ্ট স্বরে আম্মু-আম্মু ডেকে যে মেয়েটি একদম নিস্তেজ হয়ে পড়ল সেই মেয়েটির হাতটা খুব শক্ত করে ধরে রাখল সায়ান। তাদের না কথা ছিল— মিশমি যতবার পড়ে যাবে সায়ান ততোবারই আগলে রাখবে তাকে? তবে কেন বহাল রইল না এই নিয়ম? আশেপাশে হইচই পড়ল। কান্নায় ডুকরে উঠল নিশান-রিশানসহ তারকামহলটা। তবুও মিশমির সাড়া পাওয়া গেল না একটুকুও। ওর চোখের থলেতে জমা জলগুলো মুহূর্তেই বিকেলের হলুদ রোদে চিকচিক করে উঠল। যেই চোখে বাবা-মার নতমুখ দেখে মেয়েটা তার শরীর ছেড়ে দিল মৃত্যুর উদ্দেশ্যে, সেই আগ্নেয়গিরির অনলে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া মেয়েটি কি আদৌ দেখতে পাবে… তার কাছের মানুষগুলোর লক্ষ্য-কোটি আহাজারি? তার কি সত্যিই সুযোগ মিলবে… ভয়ঙ্করভাবে কেঁদে পাগলপ্রায় হওয়া বন্ধুদের মুখগুলো দেখার?
সত্যিই কি ফের চোখ মেলে দেখতে পাবে তার পাগল প্রেমিককে?
#চলবে ইন শা আল্লাহ!
(#বিঃদ্রঃ ভার্সিটির রীতিনীতি বিশেষ করে এখানে যা বর্ণনা করা হয়েছে, সেই সম্পর্কে আমার অতোটাও জ্ঞান নেই। থিমটা লিখে ফেলার পর বুঝতে পারলাম যে, ব্যাপারটা আমার জন্য জটিল। তাই এক আপুর সাহায্যে যতটা পারি লিখেছি। ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ।)