তারকারাজি- (০৭)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
|| দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ||
পৃথিবীতে সময়ের মতো শিষ্টাচারপূর্ণ ও সক্রিয় সত্যটা হয়তো সবার জীবনেই সুখানুভবের জন্ম দেয় না। কেউ একজন বলেছিলেন— যায় দিন ভালো আর আসে দিন খারাপ। তখন নামী-দামী সোশ্যাল প্লাটফর্ম না থাকলেও কথাটা ভাইরাল হয়েছিল বেশ। এইতো এখনকার মানুষ কথায়-কথায় সেই বাক্যটি বলে ঠিকি প্রকাশ করে দিচ্ছে যে, ইহজীবনের প্লাটফর্ম হতে তার যা ইতোমধ্যেই ছুটে গিয়েছে অতীত নামক রেলগাড়িতে করে, তা ব্যাখ্যার্থে ভীষণ প্রিয়দর্শন সময় ছিল তার জন্য। সেই অদৃশ্য কিন্তু প্রিয়দর্শন সময়টাকে খুঁজে নিতে মানুষ বড্ড বেশিই অলস। তারা জানে— যা যায় অতীত হয়ে তা কখনোই ফিরে আসে না এই বর্তমানের প্লাটফর্মে। কিন্তু তবুও এই লোক-সমাজের মাঝে কল্পনায় নিজের রাজ্য সাজানো রাজকন্যা নীলাশা আজও বেশ পিপাসু হয়ে ভাবে যে, এখন থেকে এক বছর আগের শারদীয় গোধূলিটা ফিরে আসুক পৃথিবীতে। যেখানে টিএসসিতে আড্ডা দেওয়া একদল তারকা মিটমিটিয়ে শখ করেছিল হাসিখুশিতে মেতে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে যাবার। সেই পাঁচ তারকার সাথে এবার না-হয় থাকুক সানাম নামের অত্যন্ত চটপটে তারকাটাও। গল্প হোক, আড্ডা হোক… হোক নীলাশাকে ব্রিটিইশ্শা বলে ক্ষেপিয়ে তোলা অথবা মিশমির অত্যন্ত ও অতিরিক্ত ভদ্র কথা শুনে তাকে ঝাণ্ডুবাম বলে সম্বোধন করা। হোক না-হয় অত্যন্ত জরুরি বৈঠকেও পিহুর নাটকীয়তার জন্য বড়সড় বাগবিতণ্ডা অথবা কথার স্ফুলিঙ্গ দ্বারা মানুষকে জ্বালিয়ে মারার জন্য ‘ঠোঁটপালিশ’ নাম প্রাপ্ত সানামকে ইচ্ছামতো কথা শোনানোর ধান্দা। আরেকটু থাকুক না-হয় নিশানের ছন্নছাড়া উদ্ভট সব কথা বার্তা। বা থাকুক অত্যন্ত কৌশলে প্রেমিকা সোহা ও বন্ধুদেরকে একসাথে সময় দেওয়ার মতো রিশানের গা জ্বালানো কিছু কাজকারবার। কিন্তু নীলাশার দেখা সুমধুর কল্পনাটি কল্পনাই থেকে গেল তার বুকে। পৃথিবীর বুকে ফিরে আসলো না সেই কল্পিত বন্ধুমহলের হট্টগোল, কিছু বিরহ বা অনেক অনেক ভালোবাসা। ফিরে এলো না সীমাহীন অনুভূতিতে পটে আঁকা প্রাণোচ্ছল বন্ধুমহলের ছবিটি…! চির পরিচিত ঝলমলিয়ে ওঠা তারকারাজির সেই মহলটি…!
শারদীয় পলকা মেঘে পরিপূর্ণ নীল আকাশটির দিকে বেশ উদাসীনতা নিয়ে তাকিয়ে আছে সানাম। তার অর্ধচন্দ্রাকারে প্রসারিত ঠোঁট জোড়ায় মুচকি হাসার বিন্দুমাত্র চেষ্টা কেবল। সেই চেষ্টা অবশ্য সকল মানবজাতির চোখে লুকায়িত থাকলেও তার বান্ধবী নীলাশার চোখে কখনোই লুকায়িত থাকে না। অনেক কথার উদাহরণে অনেককে বলতে শোনা যায়— এক অমুক আরেক অমুককে চেনে। হয়তো নীলাশাকে উদ্দেশ্য করে এখানে বলা যেতে পারে— এক বিষাদে জর্জরিত মানুষ আরেক বিষাদে জর্জরিত মানুষকে চেনে। সকলের ক্ষেত্রে এই বিষাদের কারণ থাকলেও নীলাশার যে কীসের এতো বিষাদ-মাখা অনুভূতি তা ধরতে পারার সৌভাগ্য হয়নি কারোর। অবাক করা বিষয় হলো এই-ই যে, এককালে নীলাশার মন পড়তে চাওয়া চার-পাঁচেক মনোচিকিৎসকও পরিপূর্ণ অর্থে পড়তে পারেনি নীলাশার মন। উদাসীন সানামের কাঁধে হাত রেখে যখন নীলাশা বেশ আদুরে স্বরে ডেকে বলল,
“ সানাম? মুড অফ কেন তোর? ”
তখন সানাম বেশ হেসে মিথ্যার আশ্রয়ে বলে উঠল,
“ হ, তোর চোখ অফ আর তাই তুই আমার মুডরেও অফ দেখতাছোস। বলি চোখ থাকতে চোখের মর্যাদা দেস না ক্যান? একটু সুন্দর সুন্দর জিনিস দেখবি আর তা না… বরং দেখিস খালি কে দুঃখে আছে, কে কষ্টে আছে, কার মুড অফ, হ্যান-ত্যান কতো কিছু! তোর মতো আজাইরা কাম তো আমাদের বাঙালিদেরও নাই। ”
নিশান তেতে উঠল, “ কী কইলি? আমাদের বাঙালি জাতিরে এত্তো বড় অফমান! ”
সানামেরও পালটা উত্তর, “ তুই কী কইলি? আমি অপমান করতাছি? ক্যান রে ভাই, ক্লাস সিক্স-সেভেনে যে পড়ে আসলি ‘বাঙালি আরামপ্রিয় অলস জাতি’ তখন তো ছ্যাত করে উঠোস নাই। আর আমি কইলেই দোষ? তারা কি অপমান করছে? আমি কি আমার জাতিরে অপমান করে কিছু বলছি? ”
নিশান উত্তর দেওয়ার আগেই পিহু বলল, “ সেইটাই তো! ও অপমান করল কখন? এটা সত্যি কথা যে, বাঙালি আরামপ্রিয় জাতি। গুগলে সার্চ করলেই তো পাওয়ায় যায়। তাও তোরা ঝগড়া লাগাচ্ছিস ক্যান? এমবি নাই ফোনে? গুগলে দেখলেই তো পারিস। তা না-করে হুদাই লাগতে আসলে তো অলস-ই বলবে। আসলে তোদের মতো কিছু কিছু মানুষের জন্যই আমাদের নামের আগে ‘অলস’ টাইটেলটা জুটছে। তা নাহলে দেখ— দিনমজুর, রিকশাচালক বা এই-যে ভার্সিটির টিচার; যাদের ছাত্ররা মাথা ব্যথায় ক্লাস বাদ দিলেও তারা তাদের মাথা ব্যথায় ক্লাস বাদ দিতে পারে না। অথচ এদের কি-না বলে অলস! বিষয়টা দুঃখজনক আমাদের জন্য। ”
নীলাশা গালে হাত দিয়ে নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করা তিন বন্ধুকেই দেখে নিল একবার। অতঃপর বলল,
“ দোস্তস্, কই থেকে কই চলে যাচ্ছিস তোরা? তোদের গবেষণাটা একটু থামা এবার। ভারত টু পাকিস্তান করার দরকার আছে কোনো? আমরা আমাদের কাজটাই না-হয় করি? ”
রিশান নাটকীয় ভঙ্গিমায় চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“ দেখছোস, দেখছোস, দেখছোস! বাঙালির নাম শুনলেই ওর গায়ে ফোস্কা পড়ে। শালা ব্রিটিশ কোম্পানি! তোরে দেশ থেকে বাইর করে দেওয়া উচিত। ”
নীলাশা বিরক্ত হয়ে বসেই রইল শুধু… উত্তর দিল না কোনো। তবে এতক্ষণ চুপচাপ বসে থেকেও মিশমি ধমকে উঠল তার নরম কণ্ঠে,
“ কী বাচ্চা পোলাপানদের মতো লাগালাগি করতেছিস তোরা? দেখতাছিস-ই তো আন্সার মিলতেছে না। তাও কি তোদের কোনো টেনশন বলতে কিছুই হচ্ছে না? তোরা একেকটা আজব প্রাণি, ধুর! ”
নিশান তার স্বভাবসুলভ শার্টের কলারটা ঝেড়ে বলল,
“ তোর মতো এতো পড়াকু না দেইখা আজকে টেনশন করতে পারলাম না। বিষয়টা হাইস্যকর! ”
সানামও হেসে উত্তর দিল, “ বোইন, তুই আন্সার মিলায়ে কী গুপ্তধনটা উদ্ধার করতে চাইতাছোস একটু বলবি? যা লিখে আসলি তা কি পাল্টাইতে পারবি এই আন্সার মিলায়ে? এর থেকে চিল কর শুধু। আব্বে ইয়ার, আজকে আমাদের ফাইনাল এক্সাম ছিল। আমরা এখন ফুড়ুৎ করে সেকেণ্ড ইয়ারে উঠে যাব, বুঝলি? সো তুই তোর টেনশন বাড়িত গিয়েও করতে পারবি। এখন মুডটা আর খারাপ করিস না তো! ফাস্ট ইয়ারের লাস্ট দিনের হাওয়া নে। ”
মিশমি মানল না সেই উপদেশ। অত্যন্ত মনোযোগী চোখ দুটো স্থির করেই বসে রইল সেই পাতলা প্রশ্নমালার কাগজে। এদিকে উপস্থিতি ঘটল আরাভ, শিহাব ও তনয়ের। আর সাইফদের দেখা গেল এদিকেই আসতে… তবে সায়ানকে ধরে-বেঁধে আনতে। সায়ানের এমন করার পিছনেও অবশ্য একটা সূক্ষ্মতম কারণ আছে। সেদিনকার রাতের ঘটনাটি যখন মিশমি এসে নীলাশাদের বলেছিল তখন মিশমির সরল মস্তিষ্ক এটা উপলব্ধি করতে পারেনি যে, তার ওই তাম্রবর্ণ পুরুষের অনুভূতি সম্পর্কে জেনে যাওয়ার কথাটি তার বন্ধুরা সায়ানদের জানিয়ে দিবে। মিশমি আজও জানে না সেই কথা। তবুও সে সবটা আগের মতো রাখতেই চুপচাপ বসে রয়েছে। আজকাল মানুষটার সাথে কথা না বললেও তীব্র ধুকপুকানির তালে বক্ষস্থল কেঁপে উঠছে মিশমির। বরাবর-ই হয় আর আজও তাই হলো। জোরপূর্বক প্রশ্নপত্রে মনোনিবেশের যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তা সকলের সামনে লুকায়িত রইল না। পিহু তো দু’হাতে মুখ চেপে ধরে নিজের হাসি আঁটকানোর চেষ্টা করতে লাগল। কান্না আঁটকে রাখার চেয়ে অত্যধিক কষ্টকর যে হাসি আঁটকে রাখা, তা পিহু ইতোমধ্যেই টের পেয়ে গিয়েছে। তখন তনয়কে বেশ আফসোসের স্বরে বলতে শোনা গেল,
“ আমার কপালে ফাঁটা বাঁশ নিশ্চিত লেখা আছে! ”
সে যে তাদের গত হওয়া পরীক্ষা সম্পর্কিত কথা বলছে তা সবাই-ই বুঝতে পেরেছে বেশ। মিশমিকে মিনমিনে গলায় বলতে শোনা গেল,
“ পরীক্ষার আগে ঘুরে বেড়ানো বাদ দিয়ে পড়লেই পারতেন! ফাঁটা বাঁশ, আস্ত বাঁশ কোনোটাই লেখা থাকতো না। ”
তনয় তেতো মুখে বলল, “ উহ…! নিজে ভালো ছাত্রী দেখে এখন আমি সিনিয়র হওয়ার পরেও আমারে খোঁটা দিচ্ছে! সাধে কি আর বলে— হাতি কাঁদায় পড়লে চামচিকাও লাথি মারে? ”
মিশমি যেন থতমত খেয়ে গেল তার কথা শুনে৷ স্পষ্ট করে বলল, “ আপনার মনে হলো আমি আপনাকে লাথি… না মানে খোঁটা দিচ্ছি? ”
তনয় ভ্রু কুঁচকে তাকাল। সে কিছু বলার আগেই সানাম বলল,
“ আরেহ মশারি, বাদ দে তনয় ভাইয়ের কথা। তুই এতো মিষ্টি করে বললেই সে বুঝে যাবে তোর কথা, তার কোনো মানে আছে? যারা মিষ্টিপ্রিয়, মিষ্টির স্বাদ বুঝে তাদের সাথে মিষ্টি-মিষ্টি করে কথা বলবি। এই যেমন আমাদের সায়ান ভাই! তোর মিষ্টি-মিষ্টি, অতি ভদ্র, সভ্য কথাগুলো কী সুন্দর করে গিলে খেয়ে ফেলে। আহা্…! আমারই পেট ভরে যায় সায়ান ভাইয়ের ধৈর্য্য দেখলে। ”
পিহু আসন কাঁপানো হাসিতে ফেটে পড়ল এবার। মিশমির সারা গা থেকে-থেকেই কেঁপে উঠতে লাগল দু’পক্ষের বন্ধুদের হাসির ঝঙ্কারে। প্রশ্নপত্রটা ছুটে গেল হাত থেকে। অদ্ভুত এক আড়ষ্টতায় মাথা তুলে তাকাতে পারল না সে। মিশমির মনে প্রশ্ন জাগল— সায়ান কি কিছু বুঝে ফেলল? সানামের কথাটা কি ধরে ফেলল? না, মিশমি উত্তর খুঁজে পেল না এই প্রশ্নের। যদি জানতো যে, সায়ান সবটা জেনে গিয়েছে তাহলে তার কী অনুভূত হতো তখন? মিশমিকে অদ্ভুত এক শিহরণে কাঁপতে দেখেই সাহেল পিহুর দিকে কড়া চোখে তাকাল। ঠোঁটের উপর আঙুল তুলে আদেশ করল যাতে সবাই তাদের এই অট্টহাসিটা থামায়। সেই আদেশ অবশ্য মানা-ও হলো।
আড্ডা চলল মিনিট কয়েক। অতঃপর রিশানকে ভীষণ তাড়া নিয়ে দাঁড়াতে দেখে পিহু প্রশ্ন করল,
“ কই যাস? ”
“ পড়ানি আছে আধাঘন্টা পর। যাওয়া লাগবে। ”
রোহানকে বেশ ভাবুক স্বভাবে প্রশ্ন করতে শোনা গেল,
“ বুঝলাম না, হঠাৎ করে হোস্টেলে থাকা শুরু করলি আবার এত্তোগুলা করে স্টুডেন্ট পড়াইতেছিস। হঠাৎ নিজের পায়ে দাঁড়ানির এতো চুলকানি উঠল কেন তোদের? ”
রিশান কোনো উত্তর-ই দিতে পারল না এই প্রশ্নের। মুচকি হেসে শুধু একটা কথাই বলল,
“ আমাকে যেতে হবে স্টুডেন্টের বাসায়। নিউ তো! তোমরা গল্প করো। ”
নীলাশা বাঁধা দিল, “ আজকে এক্সাম দেওয়া শেষ হলো আর আজকেই পড়াতে যাচ্ছিস? ফোন করে জানিয়ে দে না— আজ যেতে পারবি না! সিঙ্গেল-ই তো পড়াস। ”
নীলাশার মতো করেই মানা করে উঠল সবাই। রিশান যাবে-যাবে করেও আর গেল না। এমন জমজমাট আড্ডার সময়টা… না, জুনিয়র-সিনিয়রদের শেষ কিছু আড্ডার সময়টা ছেড়ে যেতে কার-ই বা ইচ্ছা করে? এইতো সেপ্টেম্বর মাসেই আরাভরা পরীক্ষা দিয়ে ভার্সিটির ছাত্রজীবন হতে আরেক নতুন অধ্যায়ে পা রাখবে। তখনও হয়তো তারকারাজির মহলে তুমুল আড্ডা চলবে। কিন্তু থাকবে না সেই হুট করেই বনে যাওয়া এক দৃঢ় সম্পর্কের জুনিয়র-সিনিয়রদের আড্ডাটা। কী নিষ্ঠুর নিয়ম! পটে আঁকা ছবিতে যদি ওই প্রাণোচ্ছল সাত যুবককেই না রাখা হয় তবে কি সেই ছবি দেখে তারকাদের বুক ভরে কান্না আসবে? নীলাশার মনটা হুহু করে উঠল। সকলের চোখের অগোচরেই আরাভের আঙুল ছুঁয়ে, ফিসফিসিয়ে বলল,
“ জানেন? আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আপনি সত্যিই আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন? আমি পারব না। ”
আরাভ গভীর চোখে দেখল মেয়েটির স্বচ্ছ দুটো চোখ। ওর মতো আবেগী কথা বললে যে সে এক্ষুনি কেঁদে ভাসাবে, তা বোধহয় আরাভের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক চট করেই ধরে ফেলেছে। আরাভ নীলাশার আঙুলের উপর ভীষণ আদর মাখা স্পর্শ আঁকতে লাগল তার বুড়ো আঙুল দিয়ে। কোমলতায় হেসে ব্যক্ত করল,
“ সমস্যা নেই। আমাদের দুজনের লিগ্যাল শ্বশুর দুজনা তো মেনেই নিছে রিলেশনটা। যখন-তখন বাসায় গিয়ে অ্যাডভান্স জামাই আদর নিয়ে আসা যাবে। ”
অতঃপর নীলাশার দিকে আরও কিছুটা ঝুঁকে, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বলল,
“ আর আমার লিগ্যাল বউয়েরও। ”
আরাভের এহেন কথা শুনে নীলাশা ছিটকে সরে গেল অপর পার্শ্বে বসে থাকা সানামের উপর। সানাম ব্যথা পেল না ঠিকি। তবুও অযথাই ব্যথিত আর্তনাদ করে বলল,
“ উফ রে! তুই এতো গায়ে পড়া মেয়ে ক্যান, নীল-ইলিশ! ”
আবারও সানামের সৃষ্টি করা উদ্ভট সকল নাম! নীলাশাও বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল,
“ আমি গায়ে পড়া মেয়ে? আচ্ছা, দুনিয়ার সবাই তোর উপর-ই পড়ে কেন? আসলে তোর মধ্যেই সমস্যা। যার মাইন্ড খারাপ তার চিন্তা-ভাবনাও খারাপ। ব্রেনের কথা তো দূরেই থাকল! কী বিশ্রী গন্ধ আসে তোর ব্রেন থেকে… ইয়াক! ভালো করে শ্যাম্পুটা করলেও তো মাথাটা একটু ক্লিয়ার থাকে? আমার তো বমি পায় তোর কাছে যেতে। ”
সানাম বোকা বনে যেতেই সাইফ হইহই করে উঠল,
“ আরেহ আমাদের ইংলিশ ভাবী? সানামকে বাংলার চরম ঝাল খাইয়ে দিলা যে! এর জন্যই তো আমি তোমাদের বিয়ের সাক্ষী হইছি। এতো ভালো ভাবী আর কই পাব জীবনে? ”
সানাম রাগে ফুঁসে উঠল নীলাশাকে বাহবা জানানোয়। আর ব্যক্তিটি যখন সাইফ তখন সেও আর কথা না বলে থাকতে পারল না। সাধে কি আর নাম তার— ঠোঁটপালিশ? কথায় কথা বাড়লো। তাদের এমন বিতণ্ডার মাঝেই কোথা থেকে যেন হাজির হলো তিহাম। প্রথমে বড়ভাইদের সালাম জানিয়েই মিশমিকে ডেকে উঠল দৃঢ় স্বরে,
“ মিশমি? তোমার সাথে আমার কথা আছে। শুনে যাও। ”
তার এমন কথায় যেখানে লজ্জায় মরিয়া হলো মিশমি সেখানে আরাভরা ভ্রু কুঁচকে তাকাল তার দিকে। ওই অনার্স পড়ুয়া ছাত্রটিকে এতো সাহস কে দিল যে— নিজের প্রেমিকাকে এমন নির্লজ্জের মতো সবার মাঝে থেকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে? মিশমি জবুথবু হয়েই মাথা নত করে শুধালো,
“ কী কথা? ”
তিহাম বলল, “ সেইটাই বলার জন্য ডাকছি। শুনে যাও এসে। ”
“ বাসায় গিয়ে শুনবো… ফোনে। এখন যেতে পারব না। ”
মিশমি মিনমিনে গলায়-ই উত্তর দিল। সে তিহামকে এর আগেও সতর্ক করেছে যে, আরাভদের সামনে যেন তাকে এভাবে না ডাকে সে। আর এখন সায়ানের জন্য অস্বস্তির মাত্রাটা যেন বেড়েই চলেছে তার। এভাবে কেউ সকলের সামনে ডাকে না-কি? কী লজ্জার কথা! কিন্তু তিহাম পরাস্ত হলো না। সে কিছু বলতে নিতেই সানাম এক অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করে ধমকে উঠল, “ ছেই! ”
তার উদ্দেশ্য সর্বপ্রথমে বুঝতে পেরে পিহু যখন হেসে উঠল তখন একে-একে হাসতে দেখা গেল সাহেল, শিহাব, আরাভ, সাইফ ও নিশান-রিশানকে। তবুও নীলাশা না বুঝে প্রশ্ন করতেই উত্তর দিল সানাম,
“ আমাদের সবার একটা ছবি আছে না? ওখানে একটা কুত্তা ঢুকে গেছে। তাই-ই বললাম…! ”
সানামের কথা না-বুঝলেও পিহু যখন তিহামের দিকে ইশারা করল তখন নীলাশাও পিহুর মতো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। মিশমিটা বোধহয় বুঝেনি কী হচ্ছে! আর না তিহাম। সে আরেকবার মিশমিকে ডাকতেই মিশমি বেশ বিব্রত বোধ করল। সে না যাওয়া পর্যন্ত ছেলেটা যে তার নির্লজ্জতার বহিঃপ্রকাশ করতেই থাকবে, তা আর বুঝতে বাকি নেই তার। বিনম্র স্বরে বিরতি নিয়েই স্থান ত্যাগ করল তারা। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতেই কথোপকথন চলল তাদের,
“ তোমাকে বলছিলাম না— সবার মাঝখান থেকে আমাকে এভাবে ডাকবা না? আর কোথায় যাচ্ছি আমরা? ”
তিহামের স্পষ্ট উত্তর, “ লাইব্রেরিতে। তুমি না যেতে চাইছিলা আমার সাথে? ”
“ এটার জন্য তুমি এভাবে ডেকে আনলা আমাকে? ”
মিশমি অবাক না হয়ে পারল না। তবে তিহাম তার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতেই বলল,
“ উহু, কথা আছে। তুমি জানো সায়ান ভাই তোমাকে পছন্দ করে? ”
মিশমির অন্তর কেঁপে উঠল। পা দুটো থেমে গেল মুহূর্তেই। ও কী-করে জানলো এই কথা? হাওয়ায় ছড়িয়েছে না-কি? অবশ্য মিশমির এই সন্দেহটাই সত্য বলে জানালো তিহাম। মিশমিও বাধ্য মেয়ের মতো উত্তর দিল যে, সে জানে। তিহাম প্রশ্ন করল,
“ তুমি কী করতে চাচ্ছো, মিশমি? এটা জানার পরও তুমি ওর সাথে কথা বলছো কী-করে? তুমি কি তাহলে আমাকে ভালোবাসো না? ”
“ না তিহাম, এমন কিছুই না। আমি যে বিষয়টা জানি তা উনি জানেন না। তাই সবকিছু আগের মতোই রাখার চেষ্টা করছি। মিছেমিছি দূরত্ব বাড়িয়ে সকলের মন নষ্ট করা কী দরকার? আর আমি তো ওনার সাথে কথা বলি না তেমন। সায়ান ভাইয়া খুব ভালো মানুষ। তোমার আর আমার রিলেশন নষ্ট করার মতো ছেলে না ভাইয়া। ”
কিন্তু তিহাম সেই কথা মানল বলে মনে হলো না। ভীষণ নম্র কণ্ঠেই দুজন-দুজনকে বুঝিয়ে গেল দুজনের মনের কথা। সায়ানকে নিয়ে যেখানে মিশমির যথার্থ বক্তব্য থাকল, সেখানে তিহামের বক্তব্য নঞর্থক-ই হলো।
তাদের এই কথোপকথনেই পৌঁছে যাওয়া হলো পাঠাগারে। পাঠাগারের এক সারিতে দাঁড়িয়ে খুঁজতে না খুঁজতেই মিশমি দেখতে পেল তার কাঙ্ক্ষিত এক বই। বইটা হাতে নিয়ে পড়ল একটি পাতা। সে জানে— তার চোখ দুটো বইয়ের পাতায় থাকলেও তার প্রিয়র চোখ দুটো স্থির আছে শুধুমাত্র তাতেই। মিশমি হাসিমুখেই তাকাল সেই পানে,
“ কী দেখতেছো এতো? ”
মিশমির ভীষণ আকস্মিকতায়-ই কাছে এগিয়ে এলো তিহাম। তিহামের এই অতিরিক্ত কাছে আসাটা বরাবরের মতোই অপ্রস্তুত করল মিশমিকে। ছেলেটা যে নিখুঁত কৌশলে অঙ্গনার কোমড় পেঁচিয়ে ধরেছে তা ছাড়ানোর ব্যাখ্যার্থেই মিশমিকে ব্যর্থ হতে হলো। সে ভীত হলো খুব। এ যে মানুষে গিজগিজ করা পাঠাগার! এটা ঠিক এখানে তাদের আশেপাশে কেউ নেই। কিন্তু চলে আসতে কতক্ষণ? মিশমির চোখে হঠাৎই পানি চলে আসলো। সে কম্পমান কণ্ঠেই বলতে লাগল,
“ তিহাম, ছাড়ো আমাকে। তুমি জানোই আমি এইসব লাইক করি না৷ তাও এমন… তাও আবার এখানে…? প্লিজ, ছাড়ো তিহাম। ”
তিহাম ছাড়ল না। তার মোহাবিষ্ট চোখ দুটো স্থির থাকল মিশমির ওষ্ঠধরে। কী ভীষণ নেশালো কণ্ঠে বলল,
“ এটাই শেষ, মিশমি। ছোট্ট একটা কিস করব শুধু। তুমি আঁটকাবা না, প্লিজ। ”
মিশমি তাকে দু’হাতে সরিয়ে দিল ঠিকি তবে বেশিক্ষণ লাগল না তিহামের ফের কাছে চলে আসতে। যেখানে তিহামকে সরিয়ে দিয়ে বেঁচে যাওয়ার তৃপ্তিদায়ক শ্বাস নিচ্ছিল মেয়েটি, সেখানে সে মোটেও বুঝতে পারেনি যে— তিহাম কোনো কথা ছাড়াই তার ঠোঁটে গভীর চুমু এঁকে দিবে। ‘ছোট্ট’ বলেও কাছে না-আসার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে, এভাবে শুষে নিবে অঙ্গনার শারীরিক ক্ষমতা। তিহামের নির্লজ্জ হাত দুটোয় বোধহয় নুইয়েই পড়তে চাইছে মিশমির নিষ্ক্রিয় দেহখানা। আচমকা এই বিশ্রী স্পর্শে মেয়েটা জ্ঞান হারালো না-কি? খেয়াল নেই তিহামের। তাদের এ-ও খেয়াল নেই যে, এই মুহূর্তে তারা দুজন ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। তারা তো এই ভয়ঙ্কর বিষয়টি তখন উপলব্ধি পারল যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের-ই এক শিক্ষক ভীষণ ধমকের সুরে চেঁচিয়ে উঠল,
“ অ্যাই কে? কে তোমরা? ”
#চলবে ইন শা আল্লাহ!
( #বিঃদ্রঃ এটা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের মূলে প্রবেশ করার পর্ব। এর পরের কয়েকটি পর্ব আমার জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, তা সময় নিয়ে হলেও আমাকে ভীষণ মনোযোগের সাহায্যে লিখতে হতে পারে, ইন শা আল্লাহ। তাই আমি ঠিক করেছি যে, ইন শা আল্লাহ পরের কয়েকটি পর্ব দু’দিনের বিরতিতে পোস্ট করব আমি। আশা করি সকলে আমাকে সেই সুযোগ দিবেন)