তারকারাজি- (২১)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
|| দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ||
ঋতুটা বর্ষাকাল হলেও আকাশটা নির্মল, সুনীল। রিসোর্টের জাঁকজমকপূর্ণ সজ্জায় সজ্জিত ফটকটিতে বাঁধা আছে লাল ফিতে। ফিতাটির এপাশে কনেপক্ষ আর ওপাশে বরপক্ষ। সায়ান ও তার ভাইয়েরা গাড়িতে বসে থাকলেও আরাভরা বাকি ছয় বন্ধু মিলে কনেপক্ষের সাথে তর্কে লিপ্ত হয়েছে। কনেপক্ষ-ও কম কীসে? ত্রিশ হাজার টাকার দাবিতে অনড় দাঁড়িয়ে আছে নিশান, রিশান, পিহু, ঈশা ও মিশমির কাজিনরা। তারকারাজির পরিকল্পনা মোতাবেক সানাম ও নীলাশা লুকিয়েছে ফটকের দু’পাশের দানবীয় দুই স্তম্ভের আড়ালে। উদ্দেশ্য— বিশ হাজার টাকার নিচে নামলেই রিশান হাত দিয়ে ইশারা করবে তাদের একজনকে। এই ইশারা অবশ্য যে সে ইশারা নয়! হাতে টাকা রাখা মানুষটি ফটকের যে পাশে থাকবে ঠিক সেই পাশের হাত দিয়েই রিশান একটি বিশেষ ইশারা করবে নীলাশা বা সানামকে।
যাইহোক, যখন বরপক্ষ থেকে পনেরো হাজার টাকা দিবে বলেই শেষ ঘোষণা দেওয়া হলো তখন পিহুর চোখের ইশারায় নিশান-রিশানরাও বুঝে গেল তাদের করণীয়। তারা সম্মতি জানাতেই হাতে ঝকঝকে কয়েকটা টাকার নোট নিয়ে সাইফ এমন ভঙ্গিতে তা গুণতে লাগল যেন— এতোগুলো টাকা হাতে রেখে তার পা মাটিতেই পড়ছে না! অবশ্য তার এই ভাবভঙ্গি বেশিক্ষণ টিকে থাকল না৷ সাইফ রিশানের মুখোমুখি হলেও তার কিছুটা বাম দিকেই দাঁড়িয়ে আছে। তাই সে তার বাম হাতে বিশেষ ইশারাটি করতেই বাম স্তম্ভের পিছনে লুকিয়ে থাকা নীলাশা এসে, ঝড়ের বেগে টাকাগুলো কেড়ে নিল। পরনের ভারী লেহেঙ্গাটা খামচে ধরে, দৌড়ে রিসোর্টের মূল ভবনের দিকে এগিয়ে যেতে দেখা গেল সেই মেয়েটিকে। বরপক্ষের সকলেই বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ, হতবিহ্বল। তাদের চুপসে যাওয়া মুখটায় আরও আষাঢ়ী আঁধার নেমে এলো তখন, যখন নীলাশা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল,
“ গাইজ, বিশ হাজার আছে! চলে আয় সবাই। ”
আরাভ চেয়ে-চেয়ে দেখলো নিজ অঙ্গনার কর্মকাণ্ড। সে রেগেমেগে ভূত হয়ে গেল শুধুমাত্র এই কারণেই যে, কনেপক্ষ পাঁচ হাজার টাকা বেশি পেয়ে গিয়েছে। হোক তাদের কেউই তার স্ত্রী, ছোট ভাই, চেনা মানুষ…। কিন্তু দু’পক্ষের কেউ কাউকে মায়া দেখানো মানেই মীরজাফরি করা! আবার সেখানে কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিতেও বাদ রাখেনি কনেপক্ষ! সানাম তো তাদের সামনে এসে বলল,
“ এর জন্যই বলি আপনি একটা অকর্মা, সাইফ ভাই। দিলেন তো কবুতরের সামনে দানা ঢেলে? এবার বুঝেন ঠ্যালা কেমন লাগে! ”
সানাম ও নিশানরা সকলেই স্থান ত্যাগ করল। নিজের বোকামোতে সাইফের তো চোখে পানি চলে আসার-ই অবস্থা হয়েছে, অন্যদিকে বন্ধু-বান্ধবসহ সায়ানের ভাইয়েরাও তাকে দোষারোপ করছে। কী দরকার ছিল এতো ভাব দেখিয়ে টাকাগুলো বের করার? বর্ষার এক ঔজ্বল্য রৌদ্রের দুপুরে সাইফের লাল হয়ে যাওয়া মুখটা ছিল দেখার মতো। এই জীবনে সে আর টাকার ঝামেলা নিবে না ভাই! মনে মনে এই প্রতিজ্ঞা করে নিতেই ঝুমুর বেগমসহ বাড়ির গুরুজনদের দেখা মিললো সেখানে। বরকে গাড়ি থেকে নামানোর রীতি অনুসরণ করে, সকলকে ভবনের ভিতরে নিয়ে যেতেই তারা খেয়াল করল— নীলাশারা সকলে মিলে কিছু একটার জন্য বহুত তাড়াহুড়ো করছে। নিশ্চয়ই এরপর জুতো চুরি করার ফন্দি আঁটছে তারা! সায়ান মুখ কাঁচুমাচু করেই বন্ধুদের দিকে তাকাল। সতর্কতা অবলম্বন করে, অত্যন্ত চাপা স্বরে বলল,
“ ভাই? তোদের সাথে-সাথে আমার মান-সম্মানটাও ডুবাইস না, প্লিজ। জীবনে একটাই বিয়ে করতাছি। তাও যদি শালা-শালীর ভয়ে কাপুরুষের মতো থাকা লাগে আমার, তো ব্যাপারটা হাইস্যকর হয়ে যাবে না? ”
সাহেল নিজের তুমুল মেজাজ খারাপ নিয়ে নিচুস্বরে ধমকে উঠল,
“ অ্যাই ব্যাটা! তুই জামাই মানুষ জামাইয়ের মতো তব্দা লেগে থাকবি। তোর এতো প্যানপ্যানানি, ভ্যানভ্যানানি ক্যান? আর আরাভ? তুই জানোস না তোর বউ একলাই একশো? বউরেই যদি আমাদের পক্ষে রাখতে না পারোস তাইলে বিয়ে করছোস কীসের জন্যে? কত্তগুলা টাকা মাইরে নিছে, ধুর! ”
আরাভ উল্টো ভাব নিয়ে বলল, “ কী বললি তুই? আমরা পাত্রপক্ষ এতই বলদ যে, কনেপক্ষের হেল্প নেওয়া লাগবে? জিন্দেগীতে না। ওরা তো সায়ানরে স্টেজেই বসাবে দেখতাছি। তোরা অ্যালার্ট থাক। আমরা স্টেজের কাছাকাছি থাকব যাতে ওরা জুতা না নিতে পারে। দেখি ক্যামনে কী করে এবার! ”
আরাভরা তাদের পরিকল্পনা অনুসরণ করেই নিজেদের অবস্থান বুঝে নিল আর অন্যদিকে সানাম আর নিশান মিলে তাণ্ডব শুরু করে দিয়েছে যেন! জুতো চুরি করার পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সুযোগ যেখানে হয়ে এসেছে, সেখানে রিশানটাই উপস্থিত নেই। সে ‘দুই মিনিট’ বলে ওয়াশরুমে যে গিয়েছে আর আসার নাম নিচ্ছে না। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে নিশান-ই ওয়াশরুমের দিকে ছুটে চলল। দরজায় ঠকঠক শব্দ করে গলা উঁচিয়ে বলল,
“ অ্যাই রিশান! তোর কতক্ষণ লাগবে আর? ”
রিশান ভিতর থেকেই জবাব দিল যে, সে আসছে। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট হলো না নিশান। রাগে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে ছেলেটি৷ এমনিও তো রাগ হলে নিজেকে সামলাতে পারে না সে। তাই অগ্নিমূর্তি ধারণ করা নিশান আগের থেকেও জোরে দরজায় আঘাত করে, চেঁচিয়ে বলল,
“ কামের সময়-ই তোর হাগা-মোতার সময় হয়, তাই না? বাইর হ তাত্তারি! ”
কথাটি বলার পর-পরই আশেপাশের এক অপ্রত্যাশিত নিস্তব্ধতার ধাক্কায় নিশানের মস্তিষ্ক সতর্ক হয়ে উঠল। সে চারিপাশে তাকিয়ে দেখলো যে, মানুষজন তার দিকে তাকিয়ে চাপা ঠোঁটে হাসছে এবং তার অধিকাংশই মেয়ে। আজকাল এই উচ্চস্বরে উদ্ভট কথা বলার জন্যই বেশ লজ্জিত হতে হচ্ছে ছেলেটিকে। লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া ছেলেটির এবার ভাইয়ের প্রতি ভীষণ রাগ উঠে গেল। আক্রোশে ফেটে পড়ে সে দরজা ভেঙে ফেলার হাল তৈরি করল। ঠিক সেই সময় কোত্থেকে যেন একটি মেয়ে দারুণ মেঘবৎ কণ্ঠে তাকে ডেকে বলল,
“ শুধু-শুধু গণ্ডগোল কেন করতেছেন আপনি? বিয়ে বাড়িতে গণ্ডগোল না করলে কি আপনাদের খাবার হজম হয় না? সত্যিই… বাঙালি সেই আগেও যেমন ছিল, এখনও তেমন আছে। বিয়েবাড়িতে গণ্ডগোল না হলেও গণ্ডগোল করার ছুতো খুঁজে বেড়াতে হবে আমাদের দেশের মানুষদের। ”
গমগমে কণ্ঠের নারীটি কি অপমান করল নিশানকে? নিশান সহসা পিছনে তাকাতেই তার আকাশচুম্বী লাজ, রাগ সব যেন উধাও হয়ে গেল। সামনের কালো শাড়ি পরিহিতা মোহিনী যে তাদের ভার্সিটির-ই ওই সাইমা নামের মেয়েটা তা বিশ্বাস করতেও নিজের হাতে চিমটি কাটতে হলো নিশানের! রাগ সংবরণ করে ঠোঁটে টানা-টানা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলল নিশান। হাত দুটো পিঠপিছনে বদ্ধ রেখে বলল,
“ আরে সাইমা যে! তুমিও এখানে দাওয়াতি না-কি? কিন্তু মিশমি তোমার সম্পর্কে কী হয়? ”
মেয়েটি একটু নতই হলো এবার। সে জানে নিশান নামের এই সিনিয়র ছেলেটি তাকে পছন্দ করে প্রায় দু’সপ্তাহ থেকে। তাদের দেখা হওয়াটাও একটা বিশ্রীরকম অভিজ্ঞতা ছিল তার জন্য! তবে সাইমা নামের এই মেয়েটি বরাবরই চুপ করে রয় শুধুমাত্র নিশান তার সিনিয়র বলে। এইতো… আজও ভুল করে শাসিয়ে ফেলেছে দেখে কেমন হাঁসফাঁস করতে দেখা যাচ্ছে তাকে। মেয়েটির এই অস্থিরতা দেখে নিশান কেন যেন ভীষণ আনন্দ-ই পায়! একটুতেই ঘেমে উঠতে দেখা যায় নারীটিকে। নিশান বলল,
“ আচ্ছা, পরে কথা বলছি তোমার সাথে। আমাকে দেখলেই যেভাবে ঘেমে যাও! এরপর মাথা ঘুরে পড়লে, বিয়ে বাড়িতে গণ্ডগোল বাজানোর তকমাটা কার গায়ে লেগে যাবে তা তো বলা মুশকিল। তবে হ্যাঁ, আমার সাথে দেখা না-করে যদি এখান থেকে গেছো তো তোমার খবর আছে ভার্সিটিতে। এখন যাও, আমরা সবাই ইজি কাজে বিজি আছি একটু। ”
নিশান ভেবেছিল যে, সাইমা দৌড়ে পালাবে। কিন্তু না। অত্যন্ত নম্রমুখেই সে শাড়ির কুঁচি হেলিয়ে-দুলিয়ে চোখের অগোচর হলো। সেই মুহূর্তে রিশানও উপস্থিত হয়েছে তার সামনে। মাথাচাড়া দেওয়া রাগটাকে পুনরায় সংবরণ করে তারা এগিয়ে গেল নীলাশাদের দিকে। নীলাশারা তখন বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে সায়ানের সাথে ছবি তুলতে ব্যস্ত। নিশান স্টেজের উপর দাঁড়িয়ে ধমকে উঠল এ-ই বলে যে,
“ কয়ডা ছবি তোলার লাগে তোদের? এখন সর, আমি আর রিশান ছবি তুলমু। ”
তারা উঠতেই রিশান গলা উঁচিয়ে বলল, “ ও ক্যামেরাম্যান ভাই? ঝাকানাকা কয়েকটা ছবি তুলো তো। ছবি ভালো না উঠলে টাকাও পাবা না কিন্তু। ”
সায়ান হাসল হালকা। সকলের সামনে মূর্তির মতো বসে থেকে তার যে অসহায়ত্ব বোধ হচ্ছে, তা আর বলে বোঝানোর নয়। নিশান আর রিশান সায়ানের দু’পাশে বসে ছবি তুলতে লাগল আর নীলাশা, পিহু, সানাম আরাভদের সাথে কথা বলায় মত্ত হলো। কথা হলো মিনিট দুয়েকের মতো। নীলাশার প্রতি সাইফের কী যে একটা ক্ষোভ! মেয়েটির তখনকার কাজ নিয়ে হাসাহাসি করল সকলে আর ঠিক সেই মুহূর্তেই দ্বিতীয় বিস্ফোরণটা ঘটে গেল বরপক্ষের সাথে।
সায়ানের কাছে বসে থেকেই রিশান ঈশাকে ডাকল তার ফোনেও কিছু ছবি তুলে নেওয়ার জন্য। ঈশা তুলেও নিল বেশ। অতঃপর নিশান সায়ানের শেরওয়ানিটা নেড়েচেড়ে, আরেকটু ঠিকঠাক করে দিতে নিতেই ঈশা সায়ানের পা থেকে জুতো জোড়া টেনে নিল। তাকে আর পায় কে! এক দৌড়ে সোজা দোতলায় উঠতে লাগল মেয়েটি। তাদের এই নিখুঁত পরিকল্পনায় সায়ান থতমত খেয়ে গেল। এই ছিল এদের মনে? কিছু যে করবে তার-ও সুযোগ মিললো না সায়ানের কারণ— দুই যমজ ভাই মিলে তার হাতটা এমনভাবে পেঁচিয়ে রেখেছে যে, উঠে দাঁড়ানোর জোর নেই। সে চেঁচিয়ে ডাকতেও পারছে না পিছনে দাঁড়িয়ে গল্পে ডুবে যাওয়া বন্ধুদের। অবশ্য তার প্রয়োজনও পড়ল না কারণ— মিশমির সম্পর্কের ভাই-বোনেরাই চেঁচিয়ে উঠল ‘বরের জুতো চুরি হয়ে গেছে’ বলে। কনেপক্ষের উল্লাসে এবং দোতলায় উঠতে থাকা ঈশার দিকে তাকিয়ে, ব্যাপারটা বুঝতে দেরি হলো না আরাভদের। তারা সেদিকে যাওয়ার আগেই সানাম চেঁচিয়ে উঠল,
“ ঈশু? উপরে আন্টি আছে, মিশার আম্মু। আন্টির কাছে গিয়ে বসে থাক। ”
ব্যস! এরপরে ওদিকে গিয়ে, জুতো নিয়ে ছেলেমানুষী করাটাকে বরপক্ষের কাছে অসভ্যতা বলেই মনে হলো। সায়ানের ভাইয়েরা যেতে চাইলেও সায়ান স্পষ্ট না করে দিল তাদের। ঝুমুর বেগমকে যে তারা অনেক ভয় পায়, এমনটা নয়। তবুও ওই মানুষটার সামনে দৃষ্টি উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকাটাই যেন চরম বেয়াদবি বলে মনে হয় তাদের। তবে এই নিয়ে হাঙ্গামাটা বেশিক্ষণ টিকলো বলে মনে হলো না! ঝুমুর বেগমের কথা বলে তাদের আঁটকে রাখা হচ্ছে বলেই মনে হলো তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন সাহেল ও আরাভের। মেয়ের বিয়েতে এক জায়গায় বসে থাকা যায় না-কি? আরাভ একপ্রকার ঠেলেঠুলেই সাহেলকে দোতলায় পাঠালো। দোতলায় উঠতে না উঠতেই করিডোরের জানালায় দেখা গেল ঈশাকে। সে হাতে জুতো নিয়ে, উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। সাহেলের মনে হলো— বরের জুতো জোড়া যেন সোনার মতোই চকচকে দেখাচ্ছে। আসলে তা নয় বরং জুতো দেখে সাহেলের চোখ দুটোই ঝলমলিয়ে উঠেছে সেই সময়। সে ভেবেছিল ধীরে-ধীরে গিয়ে, জুতো জোড়া নিয়ে নিবে মেয়েটির হাত থেকে। কিন্তু তার আগেই ঈশা কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে জুতো জোড়া লুকিয়ে নিল। নিল তো নিলই একদম লেহেঙ্গার লম্বা আঁচলটুকু সামনে এনে, তা দিয়ে জুতো ঢেকে, পেটের উপর গুটিয়ে রাখল তা। সাহেল বুঝেছে এটাও তাদের পরিকল্পনার-ই অংশ। তাই বলে সে হার মানবে না-কি? অতঃপর যখন জুতো উদ্ধার করা সাহেলকে নিচে আসতে দেখল সবাই, তখন নিশানের মুখটা ছোট হয়ে গেল। ঈশা নামার পর যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, কীভাবে জুতো হাতছাড়া হলো তখন সাহেল-ই উল্লাসী স্বরে বলল,
“ তোর বোন নিজের থেকেই তো জুতা দিয়ে দিল আমাকে। জিজ্ঞেস কর ওকে? ”
ঈশা মুখ কালো করে তাকাল নিশানের দিকে। সে কেন দিয়েছে তা ভাইদের বলতেও লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে যেন। বোনের স্তব্ধতা দেখে নিশান দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠল যে, তার ঈশাকে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছা করছে। যদিও তা স্বাভাবিক রাগেই বলেছে যা সে বরাবর-ই বলে থাকে। তবে ঈশা সেই কথাকেই আষ্টেপৃষ্টে ধরে দোতলায় চলে গেল। ভাইয়ের প্রতি যে তুমুল রাগ জন্মেছে তা আর প্রকাশ্যে আনল না মেয়েটি।
ঠিক এমনই নানান রীতিনীতি, খেলাধুলা, হাসি-কান্নার মাঝেই বিয়ে পড়ানো হয়ে গেল মিশমি ও সায়ানের। তাদের পরিণয়ের আনন্দে চঞ্চল হয়ে উঠল গোটা মহল। প্রদোষকালের ঝলমলানো আলোর বৈচিত্র্যময় রঙে ও ব্যস্ততামুক্ত দালানটিও হয়ে উঠল উৎসবমুখর… একদল মুক্তপাখির আড্ডার কারখানা!
মেঝেতে মোটা তোষক বিছিয়ে বসানো হয়েছে সায়ান ও মিশমিকে এবং তাদের একপাশে বসেছে আরাভরা, আরেক পাশে বসেছে নীলাশারা। হৈচৈমুক্ত সন্ধ্যাটিকে আরেকটু চঞ্চল করে তুলতেই এই আয়োজন করেছে তারা। কনেপক্ষে উপস্থিত আছে রাহাত, আদ্রাফ ও সোহা নিজেও। বলা বাহুল্য যে, সোহা আর রিশানের সম্পর্ক ঠিক তেমনটাই হয়ে গিয়েছে যেমনটা আগেও ছিল। তাই রিশানের অনুরোধে একপ্রকার অতিষ্ঠ হয়েই মেয়েটিকে দাওয়াত করেছে মিশমি। নয়তো সে কখনোই সোহাকে আসতে বলতো না নিজের বিয়ের দিনে৷ ঝুমুর বেগম যদি জানেন বন্ধুর প্রেমিকাকে ওনার মেয়ে দাওয়াত করেছে, তো নিশ্চয়ই কয়েকটি বিদ্রুপাত্মক কথা শুনিয়ে দিতেন তিনি। ভাগ্যিস এখনো জানেন না! সে যাইহোক, আসর জমানোর সময় হঠাৎ খেয়ালে এলো— ঈশা ও সাইফ তাদের মাঝ থেকে অনুপস্থিত। তাদের দুজনকে কল করা হলে সাইফ জানালো যে, সে আসছে। কিন্তু ঈশা কলটা রিসিভ তো করলই না, উল্টে কলটাই কেটে দিল। প্রশ্ন উঠল তার এমন আচরণ নিয়ে আর ঠিক তখনই মিশমি ধমকের সুরে নিশানকে বলল,
“ শুধু শুধু ওকে ধমকাইছিস তখন। সামান্য জুতা নিয়ে কেউ এমন কাড়াকাড়ি করে? ওকে তো তারপর আর দেখলাম-ই না কোথাও। ”
নিশানও উল্টো তেজ দেখালো, “ আরেহ্, ওরে সিরিয়াসলি কিছু বলছিলাম না-কি? ও নিজের থেকে জুতা দিয়ে দিছে দেখে তোর থেকেও আস্তে, একদম ছোট্ট করে একটা ধমক মারছিলাম। কে জানতো যে, ও আমাদের নীলের মতোই হয়ে গেছে; একদম আলালের ঘরের দুলালি! কিছু কইলেই নাগিনের মতো ফোঁসফোঁস করে খালি! ”
নীলাশা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রতিবাদ করল, “ বাজে কথা বলবি না। ও এক কথায় জুতা দিয়ে দেওয়ার মানুষ না। নিশ্চিত সাহেল ভাই কিছু বলছে ওকে। সাহেল ভাই? ওকে নিয়ে আসেন এখানে। কী না-কি কী বলছেন ওকে, এখন আপনার-ই দেখা লাগবে সেইটা। ”
সাহেল নিচের ঠোঁট কামড়ে খানিকটা হাসল। মেয়েটা তার জন্যই যে থম মেরে বসে আছে তা সাহেলের জানা কথা। তবে নীলাশার আচরণে সে মোটেও স্বাভাবিকতা দেখতে পাচ্ছে না। সে তো বলল,
“ নীল? তুমি জানো— তুমি যখন আমাকে ডাকো তখন আমার আত্মা কাঁপে? মাথার মধ্যে কী চলতাছে তোমার? হুম? ”
নীলাশা সরল মনে হাসল একটু। এক পলক বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে স্মিতহাস্যেই বলল,
“ কী যে বলেন ভাইয়া! আমি আপনাকে কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে কিছু করতে বলেছি কখনো? বলেন তো? ”
সকলেই ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে করে মৃদু হাসল। তবে সাহেল উত্তর দিল না। সে চলে গেল ঈশার কাছে এবং দশ মিনিটের মধ্যে মেয়েটিকে নিয়ে ফিরেও এলো বেশ। এই দেখে তারকাদের রহস্যময় হাসিটা ছিল সকলের চোখেই লক্ষণীয়।
আড্ডা জমে উঠল এবার। সানন্দ আড্ডাখানায় নিশান ও রিশানকে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে দেখে যখন পিহু জিজ্ঞাসা করল যে, তারা কী নিয়ে আলোচনা করছে। তখন পাশ থেকেই সানাম উচ্চবাচ্যে বলতে লাগল,
“ আরেহ, সোহার সাথে অন্য একটা মেয়ের ডিপার্টমেন্ট গুলিয়ে ফেলছিল নিশান, মনে আছে? ওই মেয়ের প্রেমে এইযে হাবুডুবু খাচ্ছে এই বান্দা, জানোস না তো! বিয়ে বাড়িতেও না-কি আসছিল ওই মেয়ে। ওর ছবিও তুলে রাখছে কিন্তু দেখাইতাছে না আমাদের। কেমনডা লাগে একটু বল? ”
সানামের গড়গড়িয়ে বলা কথা শুনে নিশানের চোখ বড়-বড় হয়ে গেল। এতগুলো বড় মানুষের সামনে এই কথাটা বলার কি খুব প্রয়োজন ছিল? নিশান জানে যে, সানাম এটা ইচ্ছা করেই করেছে। কারণ তাদের না দেখালেও আরাভরা যদি একবার জেঁকে ধরে তো মেয়েটার ছবি দেখাতে সে বাধ্য। অবশ্য তা-ই হলো! যতই বড়ভাই হোক, তামাশা করার কোন ছুতো পেলেই আরাভদের যে জোঁকের মতো তা খামচে ধরার ছেলেমানুষী স্বভাব আছে, তা নিশানের জানা। শেষে বাধ্য হয়েই গোপনে তোলা সাইমার ছবিটি বের করে, ফোনটা এগিয়ে দিল মিশমির কাছে। মিশমি দেখতে না দেখতেই তা কেড়ে নিয়ে, নীলাশা ও ঈশা দেখা শুরু করল। অতঃপর পিহু, সোহা এবং সানাম যখন ছবিটি দেখতে গেল ঠিক তখনই আকস্মিকতার ধাক্কায় নিশানের মরমর অবস্থার দেখা মিললো। সানাম তো মাথায় হাত দিয়েই চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“ সর্বনাশ! এইটা তুই কী করছিস নিশান? তুই জানোস এই মাইয়া কে? ”
নিশান ক্যাবলাকান্ত চাহনিতে মনে করার চেষ্টা করল একবার। সাইমার নামও সোহা, ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী, ভার্সিটির হলেই থাকে। এছাড়া আর কী জানার আছে তার? সে মাথা নাড়িয়ে নঞর্থক উত্তর দিল। তখনই সানাম বিস্ময়াবিষ্ট কণ্ঠে থমকে-থমকে বলল,
“ এইটা আমাদের সাইফ ভাইয়ের ছোট বোন সোহা। লাইন মারার আর মানুষ পাস নাই রে? ”
অপ্রত্যাশিতভাবেই থমথমে হয়ে উঠল আড্ডাটা। নিশানের চোয়াল ঝুলে পড়েছে এটা শুনে। এই কথা সাইফ জানতে পারলে তার যে কী অবস্থা হবে তা কল্পনাতীত বলেই মনে হচ্ছে নিশানের। এই থমথমে পরিবেশের মধ্যেই সকলকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে দেখা গেল। কী একটা অবস্থা! ঈশা তো হতবুদ্ধিভাব প্রকাশ করে বলেই উঠল,
“ জটিল সমীকরণ! ছোট ভাইয়াও সোহা নামের একটা মেয়েকে পছন্দ করে আবার বড় ভাইয়াও সোহা নামের একটা মেয়েকে পছন্দ করে। কে কোন সোহা তা বুঝব কীভাবে এখন? আমিই তো অদল-বদল করে ফেলতেছি! ”
“ নিশান আবার কোন সোহাকে পছন্দ করল? ”
ব্যস! যখন সাইফ এসে প্রশ্নটা করল তখন নিশান ঘেমে-নেয়ে একাকার। সাইফের পিছনে তার প্রেয়সী সোহা, অর্থাৎ সাইমার ভীতিগ্রস্ত মুখ দেখে ছেলেটা যেন আরও বেশি অপ্রস্তুত হলো। সত্যি কথা ভাই… সে যদি ভুল করেও উপলব্ধি করত ওটা সাইফের বোন তো জিন্দেগীতেও ওমুখো হতো না সে।
জিন্দেগীতেও না!
#চলবে ইন শা আল্লাহ!
(#বিঃদ্রঃ পেজের রিচ কমে যাচ্ছে। আমি অনুরোধ করব সকলেই যেন একটু বেশি মন্তব্য করে পাশে থাকেন আমার।হোক তা পজেটিভ মন্তব্য বা নেগেটিভ, উপন্যাসকেন্দ্রিক হওয়া চাই। আশা করি সহযোগিতা করবেন সকলে)