তারকারাজি- (২০)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
|| দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ||
বাহ্যজগতের অবস্থা করুণ। বিদ্যুৎস্পন্দনের তীব্রতায় ক্ষণে-ক্ষণেই ভয়ানকভাবে আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠছে চারিপাশ। ঝড়ো নিঃস্বন যেন বুকের ভেতরেও ঝঙ্কার তুলতে শুরু করেছে! অথচ এই ঝঙ্কৃত আওয়াজেও নিশান শুনতে পায় নিজ ভাইয়ের দীর্ঘশ্বাস। আমাদের জীবনে কিছু-কিছু মানুষ থাকে না এমন— যারা ছোটখাটো বিষয় নিয়েও তুমুল কৌতূহল দেখায়? নীলাশাকেও এই তালিকায় ফেলা যাবে নির্দ্বিধায়। হলো তো কিছুই না, অথচ বান্ধবীটার কৌতূহল দেখো… যেন আকাশচুম্বী!
ইয়াসিন চৌধুরীকে দায় মুক্ত করতে বোনকে কাছে রাখার যে মৃগতৃষ্ণিকায় ডুবুডুব অনুভূতি ছিল দুই ভাইয়ের, তা সাহেল এক তুড়িতেই পিষে ফেলেছিল সেই রাতে। পিষে ফেলার কথা বললে ভুল হবে, উপকার-ই করেছিল। দেখিয়েছিল বাস্তবতার বিরস চিত্র, কড়া রঙে আঁকা জীবনের ছবি! দু’জনের একত্রিত উপার্জনে যেখানে বিলাসিতার জন্য এখনও শতক খানিকটা টাকা হাতের মুঠোয় থাকে; সেখানে সেই শতক অঙ্কের টাকা দিয়ে কি বোনের জীবন গুছিয়ে দেওয়া যায়? আবার যেখানে তারা পাঁচ টগবগে যুবক বাসায় অবস্থিত, সেখানে কীভাবে থাকে একটি নব যৌবনা মেয়ে? নিশানদের আঁখিদ্বয়ে হতাশা তখন জ্বলজ্বলে, দৃশ্যমান। সাহেলের এই কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মতো ছিল না। নীলাশাকে ওভাবে অপমান করায় কী রাগ তার! গগন ছুঁইছুঁই সেই রাগকে যথাসম্ভব বুকে আগলে রেখে, কঠোর গলায় বলেছিল সে,
“ খুব তো বললি নীলাশা এমন কাজ করছে যাতে তোদের মাথা হেঁট হয়ে যায়। কিন্তু তুই কি জানিস— ঈশা কখনোই তোদের সাথে দেখা কেন করতো না? কারণ নীলাশা দিত না। ও জানতো ঈশার খোঁজ পেলে তোরা ওকে তোদের কাছে রাখবি। নীলাশা চাইছে— ঈশা অন্তত ইন্টার পাসটা করে তোদের সাথে দেখা করুক। এই যুগে একটা মানুষকে ইন্টার পাস করানোর অর্থ তোরা জানিস না? প্রাইভেট, কোচিং, কলেজ… টাকার উপর টাকা যায়! টিউশনির পর কামলা খাটলেও তোরা এগুলার দায়িত্ব নিতে পারতিস? না-কি আমরা কেউ পারতাম? শোন নিশান, ওর বাপের টাকা আছে দেখেই তোর বোনের দায়িত্ব নেওয়ার মতো সাহস ও দেখাইতে পারছে; যা আমরা কেউই পারতাম না। কিন্তু কী জানিস? টাকা কিন্তু ওর বাপের থেকেও ধনী মানুষদের আছে, মন-মানসিকতা কয় জনের আছে যে, বন্ধুদের এতো বড় বোনকে নিঃশর্তে লালন-পালন করবে? ইনফ্যাক্ট সেদিন নীলাশা না থাকলে ঈশা কোথাও মরে পড়ে থাকলেও তো খোঁজ পাইতি না তোরা! শোন, ভাগ্য করে বন্ধু পাইছিলি যে আসলেই বন্ধুত্বের মানে বোঝে। তোদের থেকে এই বেইমানিটা ও ডিজার্ভ করে না। শুধু ও ক্যান? নীলাশা, পিহু, সানাম, মিশমি, আরাভ, সায়ান… যারা তোদের কষ্ট দিবে না বলে ঈশাকে সামলে রাখছে, ওদের কেউই এই বেইমানি ডিজার্ভ করে না। ”
বাইশ বছরের প্রফুল্লিত জীবনে এমন বৈদ্যুতিক তরঙ্গের আঘাত পাওয়াটা মোটেও স্বাভাবিক ছিল না দুই ভাইয়ের পক্ষে। ওইযে দেড় বছর আগে ঘটে গেল এক বিস্ফোরণ! তারপর থেকে এলোমেলো হওয়া জীবনের প্রতি এই খিটখিটে মেজাজের নিশানের কোনো মায়া-ই হয়নি। একটা ছেলে কতো সহজ ভাষায় বুঝিয়ে গেল কতো কথা। অথচ তারা? বিবেকের প্রশ্নে বিবেকর-ই হার হয়েছিল সেদিন। রাত্রির জ্বলজ্বল করা সুদৃশ্য তারাগুলোও যেন মাথা ধরার মতো দবদব করছিল! এই এবড়ো-খেবড়ো জীবনকে নিয়ে সেদিনও মিলা রহমানকে মৌন প্রশ্ন ছুঁড়েছিল নিশান,
“ মা? অন্তত ছেলে-মেয়ের কথা ভেবেও তো ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে পারতা? এখন আমরা যে বাবা হারালাম, মা হারালাম, বন্ধু হারালাম, নিজেদের সবকিছুই হারালাম তোমার জন্য। মায়েরা না-কি ত্যাগী হয়, তুমি কি তবে আমাদের মা-ই নও? ”
কেউ শুনেনি সেই হৃদয় বিদারক চিৎকার… কেউ না। বন্ধু হারানোর কষ্টে অন্তর পুড়লেও সেই পোড়া গন্ধ কারো প্রশ্বাসের ভাগ নেয়নি। আচ্ছা, তাদের নীলাশা কি এর থেকেও বেশি যন্ত্রণার সম্মুখীন হয়েছিল? বন্ধুর থেকে পাওয়া কষ্টের গভীরতা কি এতই গাঢ় হয়? এই প্রশ্নের উত্তর নিশান-রিশান জানে না। বন্ধুরা তো কষ্টগুলো বুঝতেই দিল না তাদের! সেইদিনের কথা মনে পড়তেই তাদের মনে মাটির সাথে মিশে যাওয়ার লজ্জাজনক বাসনা জাগে। উপায়ন্তর না পেয়ে যখন বোনকে বান্ধবীর বাড়িতেই রেখে আসতে হলো, তখন রিশান খুবই নম্র স্বভাবে ইয়াসিন চৌধুরীকে বলেছিল,
“ আঙ্কেল? না বুঝে নীলাশার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলছি। মাফ করবেন আমাদের। আপনি ঈশাকে যেভাবে রাখছেন শুধু সেভাবে কেন? ওকে নিজেদের কাছে রাখার ক্ষমতাটাও আমাদের নাই। কী করলে আপনার এই ঋণ শোধ করতে পারব, বলবেন আমাদের? নাহলে আপনাদের মুখ দেখানোটাও আমাদের কাছে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ”
ইয়াসিন চৌধুরী উত্তর দিয়েছিলেন, “ ঋণ যদি সত্যিই পরিশোধ করতে চাও তো ঈশাকে এখানে থাকতে দাও তোমরা। তোমরা যতদিন চাইবে ঈশা ততোদিন-ই না-হয় থাকবে কিন্তু তাও ও থাকুক। নীলাশাকে আরাভদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা চলছে, শুনেছো নিশ্চয়ই? ওকে তো অতো কাছে পাবো না। নীলাশার বদলে ঈশা থাকলে অন্তত বলতে পারব— আমাদের আরেকটা মেয়ে এখনও আমাদের কাছেই আছে। যার জন্য এতো বড় বাড়ি সেখানে সেই নীলাশা না থাকলে আমাদেরও তো দম আঁটকে আসবে? ঈশা থাকুক… আমরাও একটু শান্তিতে থাকতে পারব ওকে নিয়ে। ”
সবকিছু নিয়েই গর্ববোধ করা যায় না… করতে হয় না। আবেগে পরিপূর্ণ আমাদের মনটা জানে, অবগুণ্ঠিত অনুভূতির জোর কী মারাত্মক! এক মুহূর্তেই এলোমেলো করে দিতে পারে অন্তঃকরণের সুবিন্যস্ত কঠোরতা। উথাল-পাথাল করে দিতে পারে অনুভূতির সকল শব্দ, বাক্য, পংক্তি। আচ্ছা, কীসে আনন্দ বেশি— এতোগুলো মানুষের ভালোবাসা পেয়ে হাজার কষ্টেও হেসে ফেলাটায়? না-কি তাদের একান্তে অনুভব না করে, লোক জানিয়ে গর্ব বোধ করাটায়? নিশানের মতে তাদের একান্তে অনুভব করাতেই আছে প্রকৃত সুখের আভাস। সবাই জানলে কি আর সেই সুখ নিজের থাকবে? তা তো ছড়িয়ে যাবে সবার মাঝে৷ কিন্তু গোপনীয়তার ভাগ তো কেউ নিতে পারবে না! এই সানন্দ ব্যাপারটি শুধুই নিজেদের দুই ভাইয়ের সুখানুভূতি ভেবে আনমনেই হেসে ফেলা যাবে। কখনো আবেগে আপ্লুত হয়ে বা নিজ ভুলে অনুতপ্ত হয়েও গোপনে-গোপনে নিজেদের দোষারোপ করা যাবে, কষ্ট পাওয়া যাবে। নিভৃতে যতনে আগলে রাখা যাবে কিছু অন্যরকম ভালোবাসার স্মৃতি! কেউ সেখানে ভাগ বসাবে না… ভাগ বসানোর সুযোগ পাবে না।
কিন্তু বন্ধুরা সব-সময় বাগড়া দিবেই; সেইটা ভালো কাজে হোক কী মন্দ কাজে! তাদের লাখো প্রশ্নের কলকাকলিতে অতিষ্ঠ হয়েই ধমকে উঠল নিশান। রিশান তো সেদিনের অজানা বিষয়টি গড়গড়িয়ে বলেই দিল। তাও এতো কেন প্রশ্ন থাকতে হবে এদের? নিশান মনে-মনে চরম এক উক্তি করে বসল— মেয়ে মানুষের কৌতূহল হয় আকাশছোঁয়া! এদের কৌতূহল মিটাতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেলেও তাদের কৌতূহল শেষ হবার নয়। আচ্ছা বিপদ এই বান্ধবীগুলো! মুখে বলে তো প্রকাশ করা যাবে না তাই মনে-মনেই হাজার খানিক বিরক্তি উপড়ে ফেলতে হচ্ছে নিশানকে। তবে যাইহোক, তাদের বান্ধবীরা সেরার সেরা! এটা মানতেই হবে।
তখন সকলের আনন্দমুখর হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে হঠাৎই একটি কথা বৈদ্যুতিক বেগে আঘাত করল রিশানের মাথায়। এক মুহূর্তও ব্যয় না করে সে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“ নীল? সাহেল ভাই বলতাছিল— তুই না-কি ঈশারে আমাদের সাথে দেখা করতে দিতি না? ”
নীলাশা মৌন থেকেই সম্মতি জানালো। অতঃপর বলল,
“ হু, তোদের দেখাতে আমিই নিয়ে যেতাম আর আমিই সাথে করে নিয়ে আসতাম। এছাড়া ও কখনোই তোদের দেখার জন্য বেরোয়নি, আমরাই দিইনি। বাট হুয়াই? ”
রিশান বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে বলল, “ তাহলে হলের সামনে যেই মেয়েটা দাঁড়ায় থাকতো সেইটা কে? ”
ভারী কঠিন প্রশ্ন— মেয়েটা কে? ঈশাকে পেয়ে এক নিমিষেই ভুলে যাওয়া অচেনা মেয়েটির প্রতি সেই আগ্রহটা তিলতিল করে সজীব হতে লাগল দুটো ভাইয়ের মনেই। নিজ বক্ষস্থল হতে ঝড়ো হাওয়ার মতো সাঁইসাঁই শব্দ শুনতে পেল রিশান। এতো প্রবলতায় কাঁপছে কেন তার হৃদপিণ্ড? আচ্ছা, নিশানেরও কী এমন অনুভূত হচ্ছে? রিশান নিজের ভাইয়ের দিকে তাকাল একবার। ছেলেটা অবাক হলেও তার মতো অস্থির দেখাচ্ছে না নিশানকে। অথচ এইটুকু সময়েই রিশান যেন তার ভয়ঙ্কর প্রণয়িনীর নামটা শুনতে যাচ্ছে বলে দুনিয়া অন্ধকার করে ফেলেছে। অন্তরটা কী ভীষণ কাঁপছে! এই গহীন অস্থিরতায় নিমজ্জিত মনকে যেখানে শান্ত করার কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে, ঠিক সেখানটাতেই সানামকে বলতে শোনা গেল,
“ বোধহয় সোহা হবে! আমাদের ভার্সিটিতেই তো চান্স হইছে ওর। সেদিন কথাও হলো অনেক। ”
রিশান হঠাৎই শুনতে পেল ঝিঁঝি পোকার ডাক৷ অভিভূত আঁখির কৃষ্ণকায় মণি জোড়া থমকালো সানামের উপর৷ আত্মা কাঁপছে… প্রবল বেগে কেঁপে উঠছে। সে প্রশ্ন করে জড়ীভূত কণ্ঠে,
“ ওর এখানে চান্স হইছে? কোন ডিপার্টমেন্টে? বাসা তো অনেক দূর। হলে থাকে না-কি? ”
সানাম তার বান্ধবীদের মুখপানে একবার তাকায়। মুখের ছাপেই খুঁজে নিতে চায় তাদের মনের ভাষা। সেই ভাষা কি একটু হলেও বোঝা যায়? সানাম কিছুক্ষণ মৌন থেকে খেয়াল করল— না, বোঝা যায় না৷ সে জবাব দিল। অতঃপর রিশান একটু কঠোর স্বরেই প্রশ্ন করল,
“ তোরা সবাই জানতিস অথচ আমাকে বলিস নাই ক্যান? ”
পিহু তাচ্ছিল্যের সুরে উত্তর দিল, “ শুনে কী করবি? সেই তো পলান-টুক্কুরুই খেলবি ওর সাথে। তুই তো ওকে ভালোবাসবি না, তাই না? তাহলে সোহাকেই না-হয় ভালোবাসতে দে তোকে? ”
রিশান কেবলই স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তার চোখের এলোমেলো দৃষ্টি মেঝেতে লুটোপুটি খেতে দেখলেও অন্তঃস্থলের এলোমেলো অনুভূতিগুলো নজরে পড়ল না কারোর। ঘরময় ঝিমঝিমে পবনের সংস্পর্শে এসে রিশানের শরীর ঘেমে উঠল। নিরিবিলির বিস্তারে মুহূর্তেই অনুভূত হলো যে, সে শ্মশানে অবস্থিত। কী ভয়ঙ্কর অসাড়তা গ্রাস করে ফেলল অন্তর, মস্তিষ্ক। ক্ষণকাল পূর্বের কথাগুলো ঘুরেফিরে কানে বাজছে তার। যেন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কানের পর্দাটাই ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে পিহুর শেষোক্ত প্রশ্নটা!
“ এখন মানুষ রিলেশন করছে, ছাড়ছে, আবার নতুন করে ধরছে… এটাই। তোর কি মনে হয়, সোহা আর তোর রিলেশনটা জাস্ট এমন-ই টাইম পাস ছিল? না-কি ভালোবাসা-ও? ”
নীলাশার কথায় তার দিকে উদাস চোখে চাইলো রিশান। কোনো উত্তর নেই তার কাছে। ভালোবাসা কি মুখের কথা? তবুও মনটা কেমন মুচড়িয়ে ওঠে ওই প্রণয়িনীর জন্যে। ওই প্রণয়িনীর নামটা রিশানের অন্তরে কম্পনের সৃষ্টি করে… ভয়ঙ্কর এক কম্পন। রিশান নিরুত্তর উঠে দাঁড়াল। কাউকে কিছু না বলে, কয়েক মুহূর্তেই কেবিন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল ছেলেটি। বোধহয় সোহাকে খুঁজতেই যাচ্ছে সে। নয়তো একাকী কিছু অভিযোগ উড়াতে! ভাইয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আরেকটি ভাইয়ের কিছু বলার ভাষা থাকে না। সে স্তব্ধ রয়। ঠিক ততোটাই স্তব্ধ যতটা রইলে মনের কষ্টটা বন্ধুরাও বোঝে না!
#চলবে ইন শা আল্লাহ!
( #বিঃদ্রঃ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের আর মাত্র দুইটা কি তিনটা পর্ব বাকি, ইন শা আল্লাহ। জানি গত তিন পর্ব থেকে লেখার মানটা খারাপ হচ্ছে। তাই ঝটপট দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ শেষ করে একটু বিরতি নিতে চাই। ভয় পাওয়ার কিছু নেই— তৃতীয় পরিচ্ছেদ খুবই-খুবই অল্প পর্বের হবে এবং তার সমাপ্তিই হবে উপন্যাসের মূল সমাপ্তি, ইন শা আল্লাহ। তাই ধৈর্য্য ধরে আরও কিছুটা দিন পাশে থাকার অনুরোধ রইল, প্রিয় পাঠক)