তারকারাজি- (১৬)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
|| দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ||
|| প্রথমাংশ ||
চৈত্রের পূর্ণ চাঁদ তখন কোমলতামণ্ডিত উজ্জ্বল দীপ্তি ছড়াচ্ছে ভুবনসংসারে। সোনালী আলোয় লুটোপুটি খাওয়া নির্জন গলি ছেড়ে বড় রাস্তায় চার চাকা ফেলল নীলাশার গাড়িটি। এই গাড়িটি তার বিয়ের উপহার। লন্ডন থেকে তার দাদাজান টাকা পাঠিয়েছিলেন গাড়িটি কেনার জন্য। নিত্যদিনের সঙ্গী এই গাড়িটার ড্রাইভিং সীটেই দেখা যায় নীলাশাকে। তবে তার পাশের সীটটা পাল্টায় নিজের মালিক। এই যেমন আজ তার পাশের সীটে জায়গা হয়েছে ঈশার। হয়তো কাল সকাল থেকে রাত অবধি এই সীটে জায়গা হবে অন্যকারো অথবা অন্যকারোদের।
ঈশা ভাবলেশহীন আপেল চিবুচ্ছে। তার দন্ত ও সতেজ আপেল থেকে সৃষ্ট শব্দটি ঘুরেফিরে নীলাশার কানে লাগতেই সে বলল,
“ আস্তে খা। এমনভাবে খাচ্ছিস যেন কতদিন না খেয়ে ছিলিস তুই! ”
নীলাশা এক পলক ঈশার দিকে তাকিয়েই ড্রাইভিং-এ মনোযোগী হলো। ঈশাকে উত্তর দিতে শোনা গেল,
“ আপেলটাই তো কচকচ করতেছে! আমি তো আস্তেই খাই, দেখো না? ”
নীলাশা হাসল। অতঃপর কিছু একটা মনে পড়তেই বলল,
“ আচ্ছা শোন, কাল থেকে তোকে ড্রাইভিং শিখাবো আমি। তোর তো এসএসসি শেষ। এখন নিশ্চয় তুই ফ্রি আছিস? এই টাইমটাতেই না-হয় ট্রেইনিং দেওয়া যাবে তোকে। ”
ঈশা খানিকটা থমকালো। আশ্চর্যান্বিত স্বরে বলল,
“ আমি ড্রাইভিং শিখে কী করব? তুমি গাড়ি পাইছো দেখে আমাকেও কেউ গাড়ি গিফট করবে না-কি? এখন একটু ফ্রি আছি আর তুমি কি-না…? না, না। আমি শিখবো না। ”
“ শোন? তোকে শেখা-ই লাগবে। শুধু ড্রাইভিং কেন? ড্রাইভিং, কুকিং, সেল্ফ ডিফেন্ডিং… সবকিছু শিখে রাখা ভালো। কখন কোনটা কাজে লেগে যাবে তা তুই নিজেও বুঝবি না। ”
“ তাই বলে সেল্ফ ডিফেন্ডিং মানে মারামারি-ও? ওগুলা তো ছেলেরা করে। এর থেকে আমাকে এমন একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিও যে ড্রাইভিং জানে, কুকিং জানে, সেল্ফ-ডি… ইয়ে মানে ফাইটিং-ও জানে। বলতে পারো— সে নিজেই সবকিছু করবে এমন টাইপ একটা ছেলে! আর আমি শুধু পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকব। ব্যাপারটা দারুণ হবে না? ”
নীলাশা হাসল, “ তাহলে তো সাহেল ভাইয়ের সাথেই কথা পাকা করতে হবে। হি ইজ অলরাউন্ডার। সবই তো মোটামুটি পারে! ”
ঈশা ভড়কালো। সোজা হয়ে বসে বলল,
“ ওইটাকে ভাই ডেকে আসছি। উনি সাহেব চলবে না। যাকে ভাই ডাকি নাই তার সাথে দিও, আপত্তি নাই। শুধু সব কাম-কাজ সে করে দিলেই হলো! এগুলা আলাপ বাদ দিয়ে শোনো নীলাপু, এখন আইসক্রিম খেলে কেমন হয়? তোমার গাড়ির এসিতে আমার পেট ঠাণ্ডা হচ্ছে না। পেট ঠাণ্ডা করা বেশি জরুরি। একটা খাওয়াবা না-কি? সামনেই তো আইসক্রিম পার্লার! ”
নীলাশা তৎক্ষনাৎ সম্মতির হাসিতে ঠোঁট প্রসারিত করল। মেয়েটা তার কাছে ওই আইসক্রিমটাই আবদার করে শুধু। এছাড়া তার না-কি কোনো কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই! গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে আইসক্রিম পার্লারের উদ্দেশ্যে চলতে লাগল তারা। কিন্তু তার আগেই হঠাৎ দেখা হয়ে গেল আরাভ এবং তার বন্ধুদের সাথে। সেখানে উপস্থিতি ছিল নিশান ও রিশানেরও। পিচঢালা রাস্তার ডানদিকের এক পার্কের দ্বারে কথোপকথনে মশগুল থেকেও নীলাশার গাড়ি দেখতে পেয়েছে তারা। বোধহয় পার্ক থেকেই বেরিয়েছে! তখন এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো যেখানে তাদের এড়িয়ে নীলাশাদের চলে যাওয়া হতো চরম এক বেয়াদবির উদাহরণ। ঈশা তো পিছন থেকেই নিশানদের দেখে মাথা নত করে ফেলেছে। এদিকে নীলাশাও তাদের সাথে কথা বলে আসার জন্য গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। যাওয়ার আগে সে খুব সাবধান করে গেল ঈশাকে,
“ গাড়ি থেকে নামিস না, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবো। ঠিক করে শোন— নিশানরা তোকে দেখে ফেললে আমি কিন্তু নিজেই তোকে খুন করে ফেলব, ঈশু। বি কেয়ারফুল! ”
নীলাশার এই হুমকিটা বরাবরই খুব অদ্ভুত লাগে ঈশার কাছে। সে বুঝতে পারে না নীলাশার ভাবসাব। যদি সে সত্যিই তিন ভাই-বোনের মিলন চাইতো তাহলে নিশ্চয়ই এমন হুমকি দিত না? আর যদি না-ই চাইতো তবে তার এতো যত্নও করতো না সে। তাহলে তার উদ্দেশ্য কী? এই নিয়ে ঈশা একবার প্রশ্ন করেছিল তাকে। নীলাশা ঈশাকে স্পষ্ট নিষেধ করেছিল দ্বিতীয়বার এই প্রশ্ন করতে। সে নিশ্চয়ই তাদের ভাই-বোনদের খারাপ চাইবে না? ঈশাও ছিল এই নিয়ে নিস্পৃহ। জানতে ইচ্ছা করেনি আর। এখানে তো ভালোই থাকছে সে। এমনটা তো আর না যে, সে ইয়াসিন চৌধুরীর কাঁধে বোঝা? বরং সে তার ভাইদের কাঁধের-ই বোঝা হতো। তার ভাইয়েরা তো আর তাকে বোন মানে না! সেই বিরহেই না-হয় কাটুক সময়, ভালোবাসাগুলো নিভৃতের ধুলোতেই চাপা পড়ুক, গলা ভেঙে কান্না নেমে আসুক দু’চোখে… তবুও সে ধরা দিবে না নিশানদের।
এদিকে নীলাশা কথা বলতে লাগল সকলের সাথে। গাড়িতে থাকা বিপরীতমুখী, মাথায় ওড়না টানা নারীদেহকে ঘিরে প্রথম প্রশ্নটাই ছিল রিশানের,
“ ওইটা ক্যারা রে, ঘুমটা-ঘামটি দিয়ে নতুন বউয়ের মতো বসে আছে? ”
নীলাশার কণ্ঠটা মুহূর্তেই ভগ্নদশাগ্রস্ত হলো। অপ্রস্তুত হলো হাসি। আরাভ, সায়ান আর সাহেল তো বুঝতেই পেরেছে ওটা ঈশা। তাই তাদের মধ্য থেকে সাহেল-ই কথা ঘুরিয়ে নিল আগেভাগে,
“ আজকাল মাইয়া মানুষের দিকে তোর এতো চোখ যাচ্ছে ক্যান? ওইটা যে-ই হোক, তোর বান্ধবী তোর সামনে আছে না? বান্ধবীর সঙ্গে কথা বল। চোখ এতো মাইয়া খুঁজে ক্যান খালি? ”
রিশান জিহ্বায় কামড় দিল। সাহেলের বলা এক কথাতেই যেন দমে গেল সে। না, এই নিয়ে প্রশ্ন করে বেহুদা লজ্জিত হওয়া যাবে না বলেই অন্তরে-অন্তরে সিদ্ধান্ত নিল তারা দুই ভাই। কিন্তু যতটা সহজেই সামাল দেওয়া গিয়েছিল ব্যাপারটা প্রকৃতপক্ষে তা-ই যেন পুনরায় লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল নীলাশার পরিকল্পনা। এক অদ্ভুতুড়ে ঝড়ো হাওয়ার দোলাচালে সবটা যে এভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে তা অতীতকালে বিন্দুমাত্রও টের পায়নি নীলাশা… বিন্দুমাত্রও না।
তখন কোন যেন এক মাতাল যুবক এসে গাড়ির জানালায় আঙুল ঠুকছিল। ঈশা তো প্রথমেই ভেবে নিয়েছিল কোনো ভিক্ষুকের কাজ এটি। সে নীলাশাদের বিপরীতে আরেকটু ঘুরে বসে, নিজের ব্যাগ থেকে পুরনো দশ টাকার নোট বের করল। জানালার কাঁচ নামিয়ে যেই-না টাকা বাড়িয়ে ধরল ঠিক তখনই সেই মাতাল যুবক জানালা দিয়ে ভিতরে হাত বাড়িয়ে, গাড়ির লক খুলে ফেলল। সহসা বিস্ময়ের বিধ্বংসী আঘাতে নির্বাক বসে রইল ঈশা। আত্মাটা কেঁপে উঠলেও শরীর থাকল অনড়, অবশ। তবে এই নিস্তব্ধতা তার মাঝে আর স্থায়ী হলো না তখন, যখন ছেলেটি তার হাত মুচড়ে ধরে তাকে মাটিতে দাঁড়াতে বাধ্য করল। আতঙ্কে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য মেয়েটি নীলাশাকে সম্বোধন করেই চিৎকার করে উঠল। জড়োসড়ো হলো আশেপাশের মানুষ। তবে দিগ্বিদিক না তাকিয়ে যখন নীলাশারা সবাই সেখানে উপস্থিত হলো, তখন মাতাল ছেলেটি আপন চিত্তেই ছেড়ে দিল ঈশার হাত। ওড়নাটা গা থেকে পিছলে রাস্তায় পড়লেও ঈশা এসে লুটিয়ে পড়ল নীলাশার বুকে। আরাভরা বীরত্বের সাথেই প্রতিবাদী হয়ে উঠল তখন। মারামারি, হাতাহাতি গভীরতায় পৌঁছানোর আগেই ছেলেটি নিজের ভুল স্বীকার করল যে, সে তার প্রেমিকাকে মনে করেই ঈশার হাত ধরে ফেলেছিল। এই নিয়ে হাঙ্গামাটা যখন একদম থেমে গেল ঠিক তখন-ই যেন ভয়ানক কিছুর আভাস দিয়ে থমথমে স্বরে ডেকে উঠল নিশান,
“ নীলাশা? আমার দিকে তাকা। ”
সেই পানে না তাকিয়েই নীলাশা নিজের কাল্পনিক পটে দেখতে পেল বন্ধুর রাগান্বিত চেহারা। রিশানের রাগ একদম-ই নেই তা বললে ভুল হবে। কিন্তু মারাত্মক রাগটা তো নিশান-ই দেখাবে এবার! সে অত্যন্ত ধীরে আরাভের দিকে চাইলো। পাখির ডানা ঝাপটানোর মতোই বার কয়েক পলক ফেলল নীলাশা। চোখে কী ভয় তার! স্নায়ুকোষ মিথ্যে যুক্তি দাঁড় করালেও সেইদিকে তাকানোর সাহস হয় না মনে। তবে আরাভ বুঝল সবটা। চোখের পলকে স্ত্রীকে আশ্বস্ত করেই এগিয়ে গেল নিশানের দিকে। ছেলেটির কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ ভাই শোন, ওরা দুজনেই ভয় পেয়ে গেছে, দেখতেছিস না? ওদের বাসায় ফিরতে দে। কাল কথা বলে নিস যা বলার। ”
কথাটা শ্রবণেন্দ্রিয় হতেই নিশান যেন আগ্নেয়গিরির ন্যায় উদগ্র হয়ে উঠল। ঈশাকে প্রথম ঝলকে দেখার পর-ই যে দুঃসহ নির্জীবতা শুষে নিয়েছিল দুই ভাইয়ের শ্বাস-প্রশ্বাসের শক্তি, তা হয়তো চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তুললেও চিরকাল ব্যাখ্যাতীত-ই থেকে যাবে। আপাদমস্তক অসাড়তা কী তাচ্ছিল্যের সুরেই-না হেসে উঠেছিল নিজেদের বন্ধু, নিজেদের বড়ভাইদের করা এতোদিনের নাটকীয়তায়। নিশানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। ইচ্ছা করল— কাঁধ থেকে আরাভের হাতটা ঝেড়ে ফেলে দিতে। কিন্তু না, তা করতে পারল না নিশান৷ তবে সে প্রশ্ন করল ঠিকি,
“ তোমরা তো জানতা যে, কেমন পাগলের মতো ওরে খুঁজে বেড়াইছি আমরা। তাও এতো নাটক করার কোনো কারণ ছিল, আরাভ ভাই? ”
আরাভ বুঝ দিল আবারও। সাহেল তো নীলাশাকে একপ্রকার আদেশ-ই করল বাসায় ফিরে যেতে কিন্তু তা করা হলো না নীলাশাদের। তার আগেই রিশান এসে খপ করে ঈশার হাত টেনে ধরল। রাগে লাল হয়ে আসা চোখ দুটোয় চেয়ে থেকে প্রশ্ন করল সে,
“ এতোদিন তুই নীলাশার সাথে ছিলিস? সত্যি করে বলবি, নাহলে কিন্তু এখানেই থাপড়ানো শুরু করব আমি। ”
নিশানও তেড়ে এলো সেদিকে কিন্তু উত্তর দিল না ঈশা। উল্টে ভীষণ তিক্ততার সহিত প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“ কেন, কোনো সমস্যা? তোমাদের তো সমস্যা হওয়ার কথা না? আমি তো তোমাদের কেউ না৷ না আছে রক্তের সম্পর্ক আর না আছে অন্যকিছু। তাহলে এতো কৈফিয়ত চাচ্ছো কেন? আমাকে যদি নীলাপু নিজের কাছে রাখে তো তোমাদের এতো বাঁধতেছে কেন? আমি তো তোমাদের নিজের কেউ না। সেদিন যেইরকম একা রেখে আসছিলা আজকে কেন একা ছেড়ে দিয়ে চুপ থাকতে পারতেছো না তোমরা? তোমাদের ফ্রেন্ড দেখে গায়ে লাগতেছে? তোমাদের ফ্রেন্ডের উপর বোঝা মনে হচ্ছে আমাকে? বলে দাও না সেইটা! ”
সকলের সামনে বোনের এই তেজীয়ান কণ্ঠ শুনে ভাইদের মনে হলো— এতদিনের সামলে রাখা সেই নড়বড়ে সম্মানটুকু যেন কোনো বলিষ্ঠ সমর্থকের অভাবে ধ্বসেই পড়বে আজ! আত্মসম্মানে পাওয়া আঘাত ও সবকিছু সকলে জেনে যাওয়ার আশঙ্কায় নিশানের রাগ যেন আর হাতের মুঠোয় থাকতে চাইলো না। তার এই রাগ সোজা হাতটা টেনে নিয়ে, বোনের গালে দুঃসহ এক আঘাত করতে বাধ্যই করল নিশানকে। ঈশা প্রাণহীন, হিমশীতল চোখে তাকিয়ে থাকল নিশানের দিকে। ভাইয়ের এই কাজটা যে রিশানের কাছেও ভীষণ অহেতুক মনে হয়েছে তা আর নতুন করে বলবার নয়৷ নীলাশা তো নিশানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ধমকে উঠল,
“ পাবলিক প্ল্যাসে সিন ক্রিয়েট করছিস কেন? কালকে কি কথা বলা যেত না? এতো বড় মেয়ের গায়ে তুই হাত তুলিস কীভাবে? ”
নীলাশা ঈশার হাত ধরল। আকস্মিকতায় পাথুরে হয়ে যাওয়া শরীরটাকে কাছে টেনেও সরিয়ে আনতে পারল না সে। সে ঈশাকে ডাকল বাসায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। অথচ নিশান বোনের হাতের উপর থেকে নীলাশার হাতটা ঝেড়ে ফেলল৷ দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগল,
“ থাক বোইন, অনেক দয়া করছোস। মানুষের দয়া পেতে পেতে নিজেদের আর অস্তিত্ব দেখতে পারতাছি না। ও যখন আমাদের জন্যই চলে আসছে তখন নিজেরা কুত্তার খাবার খেয়ে হইলেও ওরে দেখে রাখব, তাও তোর বাপের টাকা নিব না! কেউ নাই দেখে রাস্তার ভিখারি মনে হয় আমাদের? দয়ার উপর দয়া করে সাধু সাজার হলে তোর দয়া যারা নিতে চায় তাদের কাছে যাইস; আমাদেরকে তোর বাপ, তোর জামাইয়ের টাকার ফুটানি দেখাইস না। ”
নিশান নীলাশার দিকে আরও খানিকটা এগিয়ে এলো ঠিক যতটা কাছে আসলে তার তপ্ত নিঃশ্বাস নীলাশার মুখে আঁচড়ে পড়া সম্ভব। অতঃপর সে চাপা কণ্ঠে আবারও বলল,
“ আজকে যদি তোর বিয়ে না হইতো তাহলে থাপ্পড়টা ঈশা খাইতো না, তুই খাইতি। ঈশা তো ছোট কিন্তু তুই ক্যামনে এই কাজটা করলি যেইটায় আমাদের মাথা হেঁট হয়? বন্ধু-বন্ধু করে না মরে যাস? এইটাই তোর বন্ধুত্ব যে, ক্যামনে বন্ধুদের উইকনেসের সুযোগ নেওয়া যায়? দেন ফিনিশ ইট, নীলাশা। তোকে আর সহ্য হচ্ছে না আমার। জাস্ট ব্রেক দিস ফ্রেন্ডশিপ! আমি ঈশাকে তোর সাথে আর দেখতে চাই না৷ ”
নিশান যখন চেঁচিয়ে উঠল শেষোক্ত কথা দুটি বলে তখন নীলাশার ছলছলে চোখ দুটোতেই যেন থমকে গেল সকলে। মেয়েটার নিজের বন্ধুর দিকে চেয়ে থাকা ওই নিষ্পলক চাহনিতে কেউ ধরতে পারল না তার পুরো মর্মানুভূতি। ঈশা সবটা শুনেই ফ্যাচফ্যাচে কণ্ঠে বিস্ময় প্রকাশ করল,
“ ভাইয়া? তুমি এইভাবে কেন কথা বলতাছো? ”
নিশান উত্তরহীন চোখ রাঙিয়ে তাকাল ঈশার দিকে৷ দেখতে পেল— হায়নাদের ন্যায় ক্ষিপ্রতায় নীলাশা তার গাড়িতে উঠে পড়ল। কেউ কিছু বলার আগেই নিজের থেকেও বেশি ক্ষিপ্রতায় গাড়ি চালিয়ে চলে গেল সে। আরাভ বোধহয় অনুভব করতে পারল ভয়ানক কিছু। নিজের বাইক নিয়ে ছুটে গেল সে নিজেও। নীলাশা ঠিক কী অঘটন ঘটাতে পারে তা বুঝতে পেরে রোহান আর তনয়ও নিজেদের বাইক নিয়ে ছুটে গেল আরাভের পিছু-পিছু। মুহূর্ত কয়েকেই এলোমেলো হয়ে গেল এতোদিনের দেখে আসা চিত্র। পরিবেশ এখনও থমথমে। কী থেকে কী হয়ে গেল তা ব্যাখ্যাতীত মনে হলো উপস্থিত সকলের। সায়ান তো চুপ থাকতে না পেরে বিস্ময়াহত কণ্ঠে বলল,
“ এগুলা তুই কী বললি, নিশান? তুই বুঝতে পারতাছোস কী হতে পারে? ”
নিশান উত্তর দিতে পারল না। নীলাশা যে গতিতে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেল এরপর তার জীবিত থাকার সংবাদটা কানে পৌঁছালেই তৃপ্তি মিলবে নিশানের। এছাড়া আর কোনো অনুভূতিই কাজ করছে না তার মাঝে৷ সে নিজের মানসিক নিপীড়নকে পিছে ফেলে নীলাশার প্রতি কোনো কোমল অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছে না আর। বাবা নেই, মা নেই আর তাই বলে কি তারা ফেলনা হয়ে গিয়েছে? তাদের নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা কি সত্যিই মানুষের স্বভাব হয়ে গিয়েছে? তাদের নিজেদের কোনো জীবন থাকতে পারে না? কেন মানুষ দয়া করলেই বেঁচে থাকার আশা দেখতে পাবে তারা?
যাদের জীবনটা ঠিক নিশান, রিশান ও ঈশাদের মতোই তারা কি আত্মসম্মানের সাথে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে অপরাধ করে ফেলবে? খুব ঘৃণিত অপরাধ?
#চলবে ইন শা আল্লাহ!