তারকারাজি- (১১)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
|| দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ||
দিন কয়েক কাটতে না কাটতেই যখন বন্ধুদলের পাঁচজন নিজেদের প্রাণোচ্ছল সময় হাতের মুঠোয় ফিরে পেল তখন পিহু হুট করেই লক্ষ্য করল— তারকারাজির তারকাগুলোর মাঝে কোনোকিছু বন্দোবস্তের এক নিগূঢ়তম ব্যস্ততা। পিহুর চিন্তাশক্তি এতোটাও দুর্বল নয় যে, বন্ধুদের ফিসফিসানি এবং চোখে-চোখে করা নানান ইশারা দেখেও অবুঝ কন্যাটির মতো চুপ করে বসে থাকবে। সে তদন্ত চালিয়েছে বহুত কিন্তু লাভ বিশেষ হয়নি। কারণ তার আগেই যে অত্যুত্তম আয়োজনে অন্তরের স্পন্দনকে উত্তেজিত করে তুলেছে তার প্রিয় মহলটা তা ছিল অকল্পনীয় এবং স্বপ্নাতীত।
প্রকৃত অর্থেই অবিশ্বাস্য…!
কথা ছিল— নীল শাড়ি ও সাদা পাঞ্জাবি পরে বন্ধুদল উপস্থিত হবে মিশমির সমীপে। তৈরি হওয়ার সময় অবশ্য একটা কাণ্ড ঘটেছিল যা নিতান্তই কাকতালীয় ভেবে খুব বিরক্ত হয়েছিল পিহু। একে তে সানাম শাড়ি পরতেও পারে না আবার সামলাতেও পারে না। তার উপর সে নীল শাড়ি পরে তৈরি হয়ে গেলেও সানাম তার নীল শাড়িটা কোনোমতেই খুঁজে পেল না৷ সমতা বজায় রাখতে শেষমেশ একটা আকাশী রঙা শাড়িতেই বান্ধবীকে তৈরি করে, হসপিটালে ছুটে গেল সে। কিন্তু সেখানে পৌঁছেও যেন আশ্চর্যান্বিত না হয়ে থাকতে পারেনি পিহু। বন্ধু দুজনা সাদা শার্ট পরেছে এবং নীলাশাও পরেছে আকাশী রঙের একই ধাঁচের একটি শাড়ি। বিষয়টা সময় নিয়ে ভাবলে হয়তো ধরতে পারাটা ব্যাপার ছিল না পিহুর পক্ষে। তবে সেই সময়টুকু দেওয়া হয়নি তাকে। মুহূর্তেই চমৎকার আয়োজনগুলো অপরূপ উপায়ে উন্মুক্ত করে দিল তার বন্ধুরা।
মিশমির কেবিনটাকে আজ ভীষণ অন্ধকার লাগছে পিহুর কাছে। সাধারণত বাতি নেভানোর পরও ঘরে ক্ষীণ আলোর আভাস রয়ে যায়। পিহু নিজ অন্তরের গহীনের উত্তেজিত ফিসফিসানি শুনে উপলব্ধি করতে পারে চমৎকৃত হওয়ার পূর্বাভাস। মনটা কেমন অস্থির অস্থির করে উঠে তার। এইযে পবন বিশুদ্ধিকারকে ম-ম করছে মিশমির তমসাচ্ছন্ন কেবিনটি… অথচ এতেও মারাত্মকভাবে প্রিয় মানুষটির চিরকালের ব্যবহৃত সুগন্ধির ঘ্রাণ পাচ্ছে পিহু। এটাও কি কাকতালীয়? সুগন্ধিটা কি অন্য কেউ মেখেছে? পিহুর বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না। মন বলে উঠছে বারবার যে, আদ্রাফ এসেছে… সে এখানে আছে বলেই বন্ধুদের এতো নাটকীয়তা, এতো আয়োজন। কিন্তু না! চমৎকার উপহার দানের সমাপ্তিটা এখানেই ঘটেনি। বরং ভীষণ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে শোনা যায় নীলাশার কণ্ঠস্বরে বিশুদ্ধ মাতৃভাষা,
“ এইযে অভিনেত্রী! নাটকীয়তা তো তোর থেকেই শেখা। তবে তোর সাথে নাটক করে এভাবে চমকে দিব তা কখনোই ভাবিনি আমরা। হাজার হোক, চোরের উপর বাটপারি করাটা কিন্তু ভীষণ কঠিন কাজ।
নিজের জীবন, নিজের ব্যক্তিত্ব কিংবা আমরা নিজেকে ভুলে একদিন থমকেছিলাম যেই ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটিতে আজ সেই বর্ণময়, নরম সুতোর শক্ত বাঁধনে আবদ্ধ সম্পর্কটাকে তুই এতটাই দুর্বল ভাবতে পারলি? ও রে বান্ধবী! প্রতিজ্ঞা তো ছিল একে-অপরের জন্য কলিজা ছিঁড়ে দেওয়ার। আর তুই কি-না বন্ধুছাড়া বাগদান সারবি না বলে কেঁদে ভাসালি? ”
প্রশ্নের পরবর্তীতে নীলাশা থামল। স্তব্ধ কক্ষে শোনা গেল তার নিঃশ্বাসের ক্লান্ত আওয়াজ। অতঃপর আবারও সকলে শুনতে পেল তাকে,
“ যদি বন্ধু হয়ে হাতটা বাড়িয়ে বলি—
বন্ধুত্বে নেই কোনো বন্ধুকে অসুখী করার নিষ্ঠুর নিয়ম;
তবে কি তুই হাত ছুঁয়ে ফের আশ্বস্ত করবি—
আমাদের নির্বোধ প্রতিজ্ঞার আর হবে না কোনো অনিয়ম?
বন্ধু শোন,
তোর জন্য ধরতে পারি হাজার খানিক বাজি।
তবুও কি তুই ভাববি—
বন্ধু ছাড়া সত্যিই সম্পূর্ণ আমাদের তারকারাজি?
হোক না বাগদান…!
বিয়ে, জন্মদিন কিংবা রঙঢঙের শত অনুষ্ঠান।
আকাশ জুড়ে তারকারা কি একসাথে জ্বলে উঠবে না—
ফের অথবা আপ্রাণ?
রাত্রির আকাশটাও যে মেনে নিচ্ছে আজ—
বন্ধু ছাড়া তারকারা জীবিত থেকেও ভীষণ নিষ্প্রাণ!
বন্ধু শোন,
তুই চাইলেই ছুঁতে পারবি বন্ধুত্বের দশ হাত।
হোক তখন সুখের সকাল বা দুখের কালো রাত।
তবুও কেন করিস নিরর্থক যত ভয়…?
অযথাই দ্বিধা বা সংশয়?
ও যে হাস্যকর এক অবক্ষয়— তা কি তুই জানিস?
প্রিয় তারকা?
ও যে তোর উপহাস্য অত্যয়— তা কি তুই মানিস?
ওহে বন্ধু?
সত্যিই কি তোর হাত দুটো ধরেছিলাম—
ছেড়ে দেওয়ার তিক্ত সংকল্পে?
আমাদের স্বপ্নই তো ছিল এমন—
বন্ধুত্ব আজীবন রয়ে যাবে আমাদের পুরো গল্পে।
ক্ষয়ানো ছাড়া অসম্পূর্ণ হবে না এই তারকারাজি…
হোক তা অসীম যন্ত্রণায় বা অত্যন্ত অল্পেই। ”
পিহুর শিরা-উপশিরায় বয়ে গেল হিমশীতল শিহরণ। কেবিনের বাতিগুলো জ্বালানো হলো। নিশানরা কোত্থেকে যেন বিছানার চাদরে করে নিয়ে আসা একাধিক বেলুন উড়িয়ে দিল কক্ষজুড়ে। পিহুর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা চকচক করে উঠল। সে সবকিছু এক নিমিষে বুঝে গেলেও বর্তমানে চুপ রইল। বন্ধুদের এতো আয়োজনে অবাক না হলে যে চরম আফসোস জাগিয়ে তাদের অনুভূতিকে অসম্মান করা হবে তা খুব ভালোই জ্ঞানে রেখেছে সে। নিজের ক্ষীণ বিস্ময়কে প্রাচুর্যে পরিণত করে, অধীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল পিহু। আদ্রাফের আগমনটা যে আজ ঘটবেই তা সে অনুভব করতে পারছে। আদ্রাফের ভাষ্যমতে— আজ তার মনটা সত্যিই ছটফটিয়ে উঠছে ভালোবাসার মানুষের উপস্থিতি ঘটবে বলে। এই কী শিরশিরে অনুভূতি পিহুর! কী তৃষ্ণা তার মীনাক্ষী দুটোয়!
বর্ণময় সকল জল্পনা-কল্পনার মাঝেই নিজের প্রিয় পুরুষটি যখন সাহেব বেশে কেবিনে প্রবেশ করল তখন দৃষ্টির তৃষ্ণা ভুলে বিপরীত পানে ঘুরে দাঁড়াল পিহু। অস্থির তার পলক, তিরতির করে কাঁপা ঠোঁট আর ক্ষিপ্রতায় ঠাসা হৃদয়ের প্রত্যেকটি স্পন্দন যেন মুহূর্তেই তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওই পুরুষের বুকে। ভীষণ অভিমানী সেজে বলতে ইচ্ছে করছে তার,
“ তুমি কেন বুঝলে না আমার ইচ্ছাটা? আমি যে আমার জীবনের বিশেষ মুহূর্তগুলোতে নিজের সকল আপনজনদের উপস্থিতি চেয়েছিলাম। পার্থক্য কেন করা হলো তোমার নিজের দাদী আর আমার নিজের বান্ধবী মিশমির মাঝে? কেন এই নিষ্ঠুরতা? ”
কিন্তু ছুটে যাওয়া হলো না পিহুর। বরং কেঁদে ভাসিয়ে মুহূর্তেই কাজলের তীক্ষ্ণ রেখাটায় ম্লানিমা এঁটে দিল সে। পিহুর হঠাৎই জেগে ওঠা তীব্র ক্ষোভটা অবশ্য মিটিয়ে দিতে পারল না বন্ধুরা। তারা মিশমির কেবিনেই একাকী ছেড়ে দিল প্রেমিকযুগলকে। অবশ্য এর পিছনেও ছিল আরও কিছু আয়োজনের বিশেষ কারণ। কয়েক মুহূর্ত বাদে যখন বিশাল একটা কেক নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করল বন্ধুদল তখন পিহু-আদ্রাফ দুজনেই ছিল বেশ হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণোচ্ছল। একে-অপরের সাথে বরাবরের মতোই রসিকতায় মশগুল থাকতে দেখা গিয়েছিল তাদের। এই দেখে অবশ্য প্রশ্নও করা হয়েছিল তবে উত্তর আসেনি কোনো। অতঃপর যখন দুটো আংটির বাক্স এগিয়ে দেওয়া হলো তাদের দিকে তখন প্রকৃত অর্থেই ভীষণ চমকে উঠল পিহু। তার মস্তিষ্ক আগেই বলেছিল যে, আদ্রাফ তার আংটি এনেছে। কিন্তু আদ্রাফকে পড়ানোর জন্য নির্ধারিত দামী আংটিটা বন্ধুরা কোথায় পেল? সে তো ভেবেছিল লতাপাতায় মোড়ানো একটা আংটি দিয়েই হয়তো তার বন্ধুরা বলবে,
“ পিহু, এটা পরিয়ে দে ভাইয়াকে। আজ ফকির বলে আংটি কিনতে পারি নাই ভাইয়ের জন্যে। ”
এখানে এসেই যেন দ্বিতীয়বারের মতো আশ্চর্যান্বিত হতে দেখা গেল তাকে। তার ভরকে যাওয়া মুখটা ভীষণ রসিকতা জাগিয়ে তুললো আদ্রাফের মনে। অবশ্য আদ্রাফ তা প্রকাশ করলও বেশ! কিন্তু বিষয়টা আসলে কী ঘটল তা ধরতে পারল না পিহু।
পিহু যখন প্রশ্ন তুললো এই নিয়ে তখন তার সন্দেহের নিশানাটা ছিল আদ্রাফ আর নীলাশার দিকেই। এই ওস্তাদি তারা দুজন ছাড়া যে কেউ করবে না— তা সে ধারণা করেছিল ঠিকি তবে ধারণাটা খুব একটা সঠিক হলো না। নিজের পরিবার থেকে আদ্রাফের জন্য আংটি পাঠানো হয়েছে জেনে যে বৈদ্যুতিক কম্পনে সচল হয়ে উঠেছিল মেয়েটির মস্তিষ্ক তা উপলব্ধি করে হাসতে বাধ্যই হয়েছিল বন্ধুরা। পিহু প্রশ্ন করল,
“ আমার বাবা পাঠিয়েছে মানে? বাসার সবাই সবটা জানতো? আর জানার পরও কেউ আসলো না কেন? আমি তো বলছিলাম আমার এনগেজমেন্টে সবাইকেই থাকতে হবে। অন্তত আমাদের বাবা-মায়েরাও তো আসতে পারতো, আদ্রাফ। তুমি কেন আনলে না সবাইকে? আচ্ছা, আদৃতা আপুও কি আসতে পারল না? ”
এমন গাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ কথার উত্তরে আদ্রাফের মিষ্ট হাসি দেখে যেন পিহু বোকা বনে গেল। এতেও আবার কোনো রঙঢঙের আয়োজন আছে না-কি? ভাবনাটা যেই পিহুর মাথায় এলো ওমনিই নিশান আর রিশান মিলে তাদের ফোন দুটো এগিয়ে দিল পিহুর সামনে। সেখানে পিহু সরাসরি দেখতে পায় তার চেনা কিছু মুখ। একটি ফোনে দেখা যাচ্ছে পিহুর অত্যন্ত নিকটবর্তী সকল আত্মীয়দের এবং অন্যটিতে দেখা যাচ্ছে আদ্রাফের সকল নিকটবর্তী আত্মীয়দের। বিশেষ এই মুহূর্তটা যে এভাবে তার জীবনে আনন্দ বইয়ে নিয়ে আসবে তা পিহু কোনোদিনও ভাবেনি। ঠিক এই মুহূর্তটার জন্য পিহুর যেন মনেই হলো না— তার বাগদানটা স্বজন ছাড়াই সমাপ্ত হতে যাচ্ছে। তার চোখ জোড়া ছলছল করে উঠল নিমিষেই। এইযে অতি সাধারণ আয়োজনেই চমকে দিল তার বন্ধুরা তা আগে কেন পিহুর মাথায় আসেনি? এইযে মনমরা কতো রাত কাটলো… সমস্যা-সমস্যা করে দিনাতিপাত করল কিন্তু সমাধানের হদিস কেন খুঁজলো না সে?
বাগদানের কার্যক্রম, আয়োজন ও আনন্দ-ফূর্তি শেষে আদ্রাফ বিদায় চাইলো সকলের কাছে। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে নিশির আঁধার স্পষ্ট ফুটে উঠেছে প্রকৃতিতে। পিহু অবশ্য বলেছিল আদ্রাফকে থেকে যেতে। কিন্তু তার কার্যালয় থেকে ছুটি মিলেনি! আজ সকালে এসেছে আর আজ রাতের বাসেই তাকে ময়মনসিংহ ফিরে যেতে হবে। পিহু আর বাঁধা দিল না। দূরত্বের এই সম্পর্কটা যে পরিণয় পাবে একদিন সেই অপেক্ষাতেই অক্লান্তভাবে স্থির থাকল পিহু। এদিকে হসপিটাল জুড়ে জানা-জানিও হয়ে গিয়েছে রোগীর কেবিনে বাগদানের বন্দোবস্তের অকল্পনীয় বিষয়টি। কেউ-কেউ তো আবার দরজায় টোকা ফেলে উঁকিঝুঁকিও দিয়ে যাচ্ছে ব্যঙ্গপূর্ণ দৃষ্টিতে। রোগীর কেবিনে এহেন আয়োজন পছন্দ হচ্ছে না বলে বাঁধা-ও দিল অনেকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! বন্ধুরা যেন শেকড় গেঁথে বসেছে যে— সকালের সূর্যের আলো না দেখা অবধি তারা এখান থেকে যাবে না। সেই প্রতিজ্ঞাতেই দেখা মিললো সায়ানের, ঝুমুর বেগমের ও মঈনুল হোসেনের। ঝুমুর বেগম তো স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন,
“ তোমরা থাকতে চেয়েছো যখন তখন আমি মানা করব না। কেবিনের ভিতরেই থাকো সকলে কিন্তু নিশান আর রিশান সায়ানের সাথে চলে যাক। সায়ানরা তিন বন্ধু মিলে না-কি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছে? আজ রাতে না-হয় ওরা দু’জন সেখানেই থাকবে। হোস্টেল তো খোলা পাবে না! ”
এই কথাটা মঈনুল হোসেন বললেও হয়তো বন্ধুদল তীব্র প্রতিবাদ জানাতো। কিন্তু ঝুমুর বেগমের প্রতি যে সূক্ষ্মতম ভীতি ও সম্মান রয়েছে তা থেকে এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার মতো ইচ্ছাশক্তি জাগলো না কারো মনে। তারা বেশ খানিকটা সময় নিয়েই কেবিনে আড্ডা শুরু করে দিল। কথার প্যাঁচে যখন কথা উঠল মিশমিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার তখন নিশান কেমন বিজ্ঞদের মতো বলে উঠল,
“ মিশার মারাত্মক সুড়সুড়ি আছে না? তোরা একখান কাম কর— ওরে ইচ্ছা মতো সুড়সুড়ি দে। উঠবে না আবার? বাপ বাপ করবে। ”
এই কথা শুনে বন্ধুরা যেন তাজ্জব বনে গেল! এটা কোনো পরিকল্পনা হলো না-কি? সায়ান হেসে ফেলল ভাইতুল্য ছেলেটির কথা শুনে। সানাম তো মৃদু হেসেই বলল,
“ ছাগল! সুড়সুড়িটা তো বডিতেই দেওয়া লাগে। ও বুঝবে ক্যামনে যে, আমরা ওরে সুড়সুড়ি দিচ্ছি? ফালতু প্ল্যান। ”
অতঃপর পিহু যখন দেখল সায়ান মিশমির হাতে ভীষণ আদরে নিজের বৃদ্ধা আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছে তখন পিহু ঠোঁটে হাসি চেপেই ফিসফিসিয়ে বলে ফেলল,
“ এর থেকে সায়ান ভাই মিশমিকে একটা কিস করুক। ওর যা লজ্জা! এমনিতেই শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠে পড়বে। ”
কথাটা বলে পিহু নিজেও বেশ স্তব্ধীভূত হলো। শৈত্যের এই নৈঃশব্দ্যে পূর্ণতাপ্রাপ্ত কেবিনে তার ফিসফিসিয়ে বলা কথাটা যে নিকটে অবস্থিত বন্ধুদল পেরিয়ে, অকস্মাৎ উপস্থিত হওয়া মিশমির বাবা-মার কানে পৌঁছে যাবে তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি মেয়েটি। সে স্তম্ভের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একবার বড়-বড় চোখে সায়ানের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার বান্ধবীর থমকে যাওয়া বাবা-মায়ের দিকে তাকাচ্ছে।
অন্যদিকে নীলাশা তখন দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে পানি পান করছিল। এমন কথা শুনে তার মুখ থেকে পানি বেরিয়ে আসাটা যতটা স্বাভাবিক ছিল ঠিক ততোটাই অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল— সেই পানি পাশের সোফায় বসে থাকা নিশানের মাথায় পড়ে যাওয়া। নীলাশার চক্ষুছানাবড়া! অন্য সময় হলে হয়তো সে নিশানকে ভয় পেতো আর নিশানও তার গর্দান নিবে বলে দৌড় লাগাতো। কিন্তু আজ তা হলো না। নীলাশার চোখের ইশারা পেয়ে অভিনয়ের-ই আশ্রয় নিল নিশান। নীলাশাকে ভদ্রভাবেই ধমকে-টমকে উঠে দাঁড়াল সে,
“ মাথায় একটু পানি দিয়ে আসি ওয়াশরুম থেকে। নীল? তুইও আয়। আমারে একটু হেল্প করবি। ”
তার কথা শেষ হতেই রিশানও তাড়াহুড়ো বাঁধিয়ে দিল কেবিন ত্যাগ করার। সায়ানও অপ্রস্তুত হলো। ঝুমুর বেগম তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগে পালিয়ে যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে হলো সায়ানের। পিহু মেয়েটা কথা বলে বেশি। তাই বলে সবাইকে এবং বিশেষ করে তাকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলে দিবে তা মোটেও আশা করেনি সায়ান। মনে মনে শুধু একটাই অনুনয়-বিনয় করছে সে— মিশমির বাবা-মা যত যাই বলুক না-কেন! দয়া করে যেন মিশমিকে দেখতে আসা বন্ধ করার ভয়ঙ্কর কথাটা বলে না বসেন! সায়ান যে ও-কথা রাখতেও পারবে না আবার ফেলতেও পারবে না!
তবে পরবর্তী ঘটনাটা যতটা অস্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল ততটাই যেন স্বাভাবিকতায় বহমান হলো। ঝুমুর বেগম নিশানদের পথ আঁটকে বললেন,
“ পানিই পড়েছে, নিশান। এই ঠাণ্ডায় আবার করে মাথায় পানি ঢালার প্রয়োজন দেখতে পাচ্ছি না আমি। আর সায়ান? মিশমির বাবা সবার জন্য খাবার এনেছে। খেয়ে তারপর যাও তোমরা। সবাই ঠিক করে খেয়ে নিবে আর এই কথাটা যেন আমাকে দ্বিতীয়বার বলতে না-হয়। যাও। ”
সায়ান একবার শান্ত দৃষ্টি বিনিময় করেই সম্মতি জানিয়ে নিলো। অতঃপর সকলেই বিনা বাক্য ব্যয়ে খাওয়া আরম্ভ করল। কারো মুখে কোনো বুলি নেই। কেমন থমথমে পরিবেশেই কাটিয়ে দিল কিছু সময়। নীলাশাদের বুকটা কেমন কাঁপছে। না-জানি ওনারা কী ভাবলেন। তবে তাদের অন্তরের এই কাঁপুনিটা গাঢ় হলো তখন যখন সায়ান ও বন্ধু দু’জনের বিদায় হওয়ার পর ঝুমুর বেগম ও মঈনুল হোসেন দুজন-দুজনের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত ক্ষীণ হাসিতে ঠোঁট প্রসারিত করলেন। এই হাসিটা উপস্থিত তিন বান্ধবী লক্ষ্য করলেও হাসার কারণটির ব্যাখ্যা পেতে নিজেদের দুর্বল-ই ভেবে নিল তারা। গলাটা শুকিয়ে এলো নিমিষেই। তবে হাসির রেখা পরীক্ষা করে সেই নিগূঢ় কারণটি কোনোমতেই ধরতে পারল না তারা। না পিহু, না সানাম আর না নীলাশা… কেউই পারল না!
#চলবে ইন শা আল্লাহ!
(বিঃদ্রঃ রি-চেইক করতে পারিনি সময়ের অভাবে। ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ)