তারকারাজি- (১০)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
|| দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ||
|| বর্ধিতাংশ ||
মানবজাতির অদৃশ্য ব্যথাগুলোর মাঝে সবচেয়ে তীক্ষ্ণ, জঘন্য ও ভয়ঙ্কর অনুভূতিময় ব্যথাটা আসলে ‘ভালোবাসা’ বলেই বোধ হয় সায়ানের। তার মতে— কাউকে ভালোবাসার থেকে বড় যন্ত্রণার আর কিছুই নেই।
এইতো সেদিনকার কথা!
যে মেয়েটি একদিন হৃদয় ছেদ করে বক্ষের সর্বাংশে হাহাকার সৃষ্টি করে দিয়েছিল… যার প্রণয়ে না-পাওয়ার খেতাব জুড়ে থাকার পরও ভালোবেসে যাবে বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে অটল থেকেছিল সায়ান; আজ সেই তাম্রবর্ণের সায়ান স্বীকার করতে বাধ্য হয়— সে তার বিনিদ্র কল্পনার রূপসীর ভালোবাসায় অটল থাকতে পারছে না। এই নিথর মেয়েটাকে তো সে ভালোবাসেনি! দৃঢ়প্রতিজ্ঞাকে ভেঙে চুরমার করে বলতে ইচ্ছে হয় তার,
“ মিশমি? তুমি অন্য কারো হও। তবুও কোনোদিন কারো না-হতে পারার পথে পা বাড়িয়ে ফেলো না। তোমাকে ভালোবেসে আমি ভুল করেছি। এই ভুলেই আমার মরণ দেখিয়ে দিও না তুমি। ”
সায়ানের আত্মাটা দুমড়ে-মুচড়ে ওঠে বারবার। সকলের মাঝেই যখন মিশমির স্বাভাবিকতাটা ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা লক্ষ্য করা যায় তখনও অত্যন্ত নীরবে, মনের গহীনে মিশমির অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর যন্ত্রণাকে বেঁধে রেখে ভয়ে কুঁকড়ে যায় সায়ান। তার মারাত্মক এক বাজে অভ্যাস— শুধুমাত্র সে সম্পর্কিত থাকা ব্যতীত আশেপাশের সকল সন্দেহপূর্ণ কথাকে আগেভাগেই নঞর্থক ভাবনায় প্রবেশ করিয়ে, ভয় এবং দুঃশ্চিতায় উত্তেজিত হয়ে পড়া। সেই অভ্যাস তার শৈশব থেকে টগবগে যুবকে পরিণত হওয়ার পরও বহাল রয়েছে। পাল্টায়নি বিন্দুমাত্রও। এইযে প্রতিটা দিন নিজের ব্যস্ততাকে ঠেলে দিয়ে, রাত্রির গভীরে হলেও ক্লান্ত দেহে প্রেয়সীর নিকট উপস্থিত হয় সায়ান এবং নিজ হাতে মিশমির স্পন্দন পরীক্ষা করে, আত্মতৃপ্তিতে স্থান ত্যাগ করে বা বসে থেকেই কাটিয়ে দেয় দীর্ঘ সময়… এর পিছনের কারণটি কিন্তু কোনো না কোনোভাবে নিজের অভ্যাসে এসেই থম মেরে থেমে যায়।
এইতো আজও রাত দশটার কনকনে ঠাণ্ডার শীতকালে ঘামে ভেজা শার্টে সায়ানের দেখা মিললো মিশমির কেবিনে। ছেলেটি এসেই নানান যন্ত্রপাতিতে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল মিশমির শারীরিক অবস্থা। এই তিনটি মাসে সূক্ষ্মতম হলেও এগুলো বুঝতে শিখে গিয়েছে সে। অথচ এমনও দিন আসবে তা হয়তো নিজেও কল্পনা করেনি মানুষটি৷ অন্যান্য রাত্রির মতো আজও মিশমির কাছে উপস্থিত আছেন ঝুমুর বেগম। সায়ান সালাম দিয়ে সকল কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর যখন শুধালো,
“ আন্টি? আজকে তাহলে আমি যাচ্ছি। কোনো সমস্যা হলে আমাকে কল করে দিয়েন সেইটা যত রাত-ই হোক। আচ্ছা? ”
ঝুমুর বেগম তখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আপাদমস্তক দেখে নিল ক্লান্ত সায়ানকে। চোখ দুটো ফোলা, গায়ের শার্টটা ভিজে জবজব করছে। তিনি জানেন— সায়ান অফিস থেকে ফিরে সোজা এখানে চলে এসেছে। বরাবর তো তা-ই করে! সকালে অফিসে যাওয়ার আগে একবার দেখে যায় মেয়েটাকে; আবার রাত্রিতে ফেরার সময়ও পুনরায় এসে প্রেয়সীকে দেখে যায় সে। ঝুমুর বেগম এই নিয়ে একবার প্রশ্ন করেছিলেন সায়ানকে। আজ অনেকদিন বাদে তার এমন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করায় সায়ান আগের মতোই উত্তর দিল,
“ অফিসের পথেই তো! তাই একটু দেখে যাই ওকে। ”
ঝুমুর বেগম জানেন যে— সায়ান, আরাভ, সাইফ ও শিহাব যেই কোম্পানিতে চাকরি করে তা হসপিটাল হতে উল্টো দিকে। আরাভ নিজেই নিশ্চিত করেছিল ব্যাপারটি। তবুও কাঠিন্য মস্তিষ্কের ঝুমুর বেগম চুপ থাকেন। প্রশ্ন করলে ছেলেটা যে লজ্জায় নুইয়ে যাবে তা ওনার অজানা নয়। এইযে এতোগুলো দিন বিদায় নিল, রাত্রি নেমে আঁধারের রঙ ছুঁয়ে গেল আসমানে… তিনি খেয়াল করেছেন ছেলেটির পাগলপ্রায় দশা। অবশ্য একে-একে দুই করতেও বেশিক্ষণ লাগেনি ঝুমুর বেগমের। তবে উনি এই নিয়ে কখনোই কোনো প্রশ্ন করেননি সায়ানকে। বরং তিনি বরাবরের মতোই মাতৃবৎ অনুভূতির সাথে বললেন,
“ চোখমুখের অবস্থা তো আর দেখা যাচ্ছে না, সায়ান। খাওয়া-দাওয়া কি করো না? ”
সায়ান ক্ষীণ হাসল, “ ঠিক করেই তো খাই! এখন শরীরে খাবার না লাগলে আমি কী করতে পারি, বলেন? ”
“ এতো কষ্ট করে দু’বেলা না এসে একবার-ই তো দেখে যেতে পারো। ও তো হারিয়ে যাচ্ছে না! আমার তো মনে হয় ওর চিন্তাতেই তোমার গায়ে খাবার লাগে না। ”
সায়ান অপ্রস্তুত হলো। ঝুমুর বেগমের বিচক্ষণতা সম্বন্ধে সায়ানের ধারণা আছে। তার ভয় হয়। ঝুমুর বেগম যদি বিষয়টি বুঝে যান তবে তার এখানে আসা হয়তো নিষিদ্ধ ঘোষণা করবেন তিনি। সে এতটাও উচ্ছৃঙ্খল প্রেমিক হতে পারবে না যতটা হলে মিশমির মার নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও মিশমিকে এক নজর দেখার জন্য ছুটে আসবে সে। আবার সে এতটাও নিশ্চিন্ত বসে থাকতে পারবে না যতটা নিশ্চিন্ত হলে মিশমিকে দেখার তৃষ্ণা জাগবে না নিজের। এ কি জ্বালাময়ী অবস্থা তার! নদীর একুল-ওকুল দু’খানেই যেন সমস্যা দেখতে পাচ্ছে সে।
সায়ান সন্দেহ কাটানোর জন্য যথোপযুক্ত উত্তর দিয়ে বিদায় নিল। তার হন্তদন্ত ছুটে চলা দেখে বোধহয় ঝুমুর বেগম ক্ষীণ হাসলেন। ছেলেটা যে মুহূর্তেই ভরকে গিয়েছে তা বুঝতে আর অসুবিধে হয়নি ওনার। ছেলেটা ভীষণ শান্ত হলেও খুব অস্থির তার চালচলন। মস্তিষ্কের অভিজ্ঞতায় খুব সহজেই তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে, এই ছেলেটা একসময় অত্যন্ত হাস্যোজ্জ্বল, কর্মঠ ও দুরন্ত ছিল।এবং তিনি এটাও জানেন— নিজের মেয়ের প্রতি সায়ান ছেলেটার এই ব্যাকুলতা এতগুলো দিনেও নিভুনিভু হয়নি। হয়তো আর হবেও না মিশমির নিষ্ক্রিয় থাকার বাকি দিনগুলোতে… তা পরবর্তীতে মিশমি জীবিতই থাকুক কি মৃত!
মিশমির প্রতি এই ছেলের পাগলামো কোনোদিনও ক্ষান্ত হবে না। হতেই পারে না!
অরুণাভ আকাশের নিম্নস্থ রুক্ষ তৃণে অনগ্ন মিত্রাঙ্গনটা আজও বরাবরের মতোই জনবহুল। কত দিন আসা হয় না এখানে! তার চেড়া বুক জুড়ে রোমশ ঘাসগুলো জীবিত। তবুও তাদের মৃতপ্রায় লাগছে পরিবর্তিত ঋতুর নিজস্ব বিবর্ণতায়৷ ঠিক যেন মিশমির প্রতিচ্ছবি!
দু’পা ভাঁজ করে নিজ ফোনে চোখ গেঁথে রেখেছে নীলাশা। ভ্রু জোড়ার মধ্যিখানে সুকৌশলে ফোটানো ভাঁজে শিশিরের মতো জমেছে ঘাম। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে নিশান সজোরে নীলাশার মাথাটা ঠেলে দিল পিছনের দিকে। রুক্ষ কণ্ঠে ধমকে বলল,
“ ওই শালি! শীতের মধ্যেও ঘেমে প্যানপ্যানা হয়ে যাচ্ছোস ক্যান? এতো অস্বাভাবিক লক্ষণ তো ভালো না। পেট বাঁধাইছোস না-কি। ”
নীলাশা তার কপালে আঘাত করা স্থানে আঙুল ঘষে, নিরর্থক ব্যথিত শব্দ উচ্চারণ করল। অতঃপর নিশানের গায়ে মৃদু থুতু ছিটিয়ে তিক্ততার সাথে বলল,
“ কী বিশ্রী! তোর চিন্তা-ভাবনা থুতু পাওয়ার যোগ্য। কাছে আয়, বিশাল এক দলা থুতু দিয়ে তোর ভাবনাকে সম্মান জানাই। ”
নিশান রাগে ভস্ম হয়ে আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসে উঠল। নীলাশার কাঁধে বার দুয়েক অদম্য আঘাত করে, গালিগালাজ করতে লাগল সে। নীলাশাও প্রচণ্ড বিরক্ত! শুরুটা কি সে করেছিল যে, এমন আক্রমণ সে মাথা পেতে নিবে? নীলাশাও শুরু করল বাচ্য আক্রমণ। অতঃপর এদের এই বিতণ্ডা সহ্য করতে না পেরে পিহু যখন চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“ তোরা থামবি না-কি আমাকে চলে যেতে বলতেছিস এখান থেকে? বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করার কোনো মানে হয়? হয় থাম নাহলে আমাকে বিদায় দে। আমার ভাল্লাগতাছে না তোদের রঙঢঙ। ”
তখন নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল বন্ধুদের মাঝে। অতিক্রম হলো সেকেণ্ড কয়েক। অতঃপর রিশান খুবই শান্ত স্বভাবে পিহুকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে বলতে লাগল,
“ আচ্ছা পিহু, তুই যে এইরকম মুড অফ করে বসে আছিস এটা কি আমাদের খুব ভালো লাগতাছে? তোর সঙ্গে আদ্রাফ ভাইয়ের কী কী হইতাছে তা কিন্তু আমরা পুরাপুরি জানি না। তাও বলতাছি— ভাইয়ের উপরের রাগটা আমাদের উপ্রে দেখাইস না। এমন করলে তো তু… ”
রিশানকে শেষ করতে দিল না নিজের কথা। তার আগেই চোখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে পিহু শাসিয়ে উঠে বলল,
“ তোকে কে বলল আমার মুড অফ? আমার মুড অফ থাকলে আমি এখানে আসতাম? তোদের সাথে থাকতাম? আদ্রাফের সাথে আমার যা ইচ্ছা তাই হয়ে যাক, আমি কি তোদের উপর জুলুম-টুলুম কিছু করছি? বল, করছি? আসলে তোরা মানুষের কদর করতে জানিস না। তা না-হলে এমন অভিযোগ করতে পারতিস?… ”
কথা বলল আরও অনেক। অতঃপর বন্ধুদের কথাকে পিছনে ফেলে, হাওয়ার গতিতে উঠে দাঁড়াল পিহু। তেজস্বিনীর মতো রিকশা ধরেই পথের বাঁকে হারালো সে। শুনলো না শত পিছুডাক, সান্ত্বনা। বন্ধুরা হতাশ হলো। নিশানের তো রাগও হলো খুব। অযথাই এই আচরণ কি মেনে নেওয়ার যোগ্য? সকলের মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে যাওয়া মেয়েটিকে কেন্দ্র করে সানাম ভাবতে বসল অন্তরের গহীন থেকে। সত্যিই কি কোনো উপায় আছে তার মন ভালো করার? সানাম খুঁজে খুঁজেও সন্ধান পেল না সেই উপায়ের। তখনই নীলাশা অত্যন্ত গাম্ভীর্যের সাথে বলে উঠল,
“ নিশান? তোর কাছে না আদ্রাফ ভাইয়ের ফোন নাম্বার আছে? টেক্সট কর তো আমাকে। ”
নিশান এক ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল, “ ক্যান? কী করবি তুই? ধান্দা কী তোর? ”
নীলাশা উক্ত প্রশ্নটির উত্তর দিল না। তবে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“ জাস্ট ওয়েট অ্যাণ্ড ওয়াচ! কীভাবে কী করতে হবে তা আমার জানা। ”
#চলবে ইন শা আল্লাহ!