তারকারাজি- (০৯)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
হৈমন্তিক হলুদ বিকেলে রৌদ্রদীপ্তি মাখো-মাখো সরু রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে আছে মিশমি। গায়ে নীলাশার মা নৌশিন আহমেদের একটি বেগুনিরঙা শাড়ি। মিশমি খুব সকালেই নীলাশাকে কল করে অনুরোধ করেছিল যে, সে যেন আজ ভার্সিটিতে না যায়। মিশমি পিহুকে সাথে নিয়ে নীলাশাদের বাসায় যাবে। এমন পেঁচানো কথা নীলাশার বোধগম্য হয়নি। যেহেতু মাকে ভার্সিটি যাওয়ার কথা বলেছিল মিশমি, তাই বন্ধু দু’জনের থেকে কারণটা আর গোপন রাখতে পারেনি। মিশমির অধীরতা দেখে পিহু খুশিতে বাক-বাকুম হলেও নীলাশা স্তব্ধ ছিল দীর্ঘক্ষণ। মিশমিও কারো প্রণয়ে এতটা ছটফট করতে পারে? এই নিয়ে মেয়েটিকে খোঁচা দিয়ে কথা বলাটাও কম করেনি নীলাশা। মিশমি লাজুক স্বভাবের মেয়ে৷ ফোনে বার্তা পেয়েই যে কীভাবে অদেখা ছেলেটির প্রেমে পড়ল তা নীলাশা সহজভাবে নিতে পারছে না। তবে পিহু সমর্থন করেছে বেশ! তার মতে প্রেম কখনো বলে-কয়ে, ভালোবাসার বিশাল ও যোগ্য কোনো প্রমাণ প্রস্তুত করে আসে না। নীলাশাও পরে তাল মিলিয়ে মিশমিকে তৈরি করল আজ বিকেলের জন্য। মিশমি বাঁধা দেয়নি। নীলাশার সাজানোর হাত ভালো। আজ একটু সাজলে মন্দ হবে না ব্যাপারটা। দুই বান্ধবীর খোঁচা দেওয়া কথাগুলো সে হাসিমুখেই গিলে নিয়েছিল বেশ! মিশমির সে কী লজ্জা…! বান্ধবীদের সামনে এত লজ্জা মানায় না-কি? তবুও তার লাজুকতা তখন বাঁধ মানেনি একটুকুও। সারাটা দিনের কথা ভেবেই মিশমির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। সে পিছনে ঘুরে উঁকি দেয় সূদুরের বটগাছের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে তাকে নজরে-নজরে রাখছে নীলাশা ও পিহু। পিহু বাচ্চাদের মতো জেদ করছিল, মিশমির সেই প্রেমিককে সে আজ-ই দেখবে। কিন্তু নীলাশা তাতে বাঁধা দিলেও লাভ বিশেষ হয়নি। নীলাশা আধুনিক মেয়ে। অন্যের একান্ত সময়ে মাথা ঘামানোর মতো স্বভাব তার তেমন একটা নেই। তবে মিশমি ঠিক-ই বুঝতে পেরেছিল যে, নীলাশাও যেতে চায়। সে আর দ্বিরুক্তি করেনি। তবে শর্ত ছিল কঠোর, তাদের কোনো কথা শোনা যাবে না ও বেশ দূরে অবস্থান করতে হবে। নীলাশারাও শর্তে রাজি ছিল। তাদের মনেও যেন কৈশোরের অধীর হাওয়া লেগেছে! আজ মিশমির প্রেমিক মিশমির জন্য বেলিফুল নিয়ে অপেক্ষা করবে৷ তাকে না দেখলে কি হয়? কিন্তু বর্তমানে অভিমানেরা যেন আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে মিশমিকে। বেলিফুল নিয়ে তো সেই মানবের অপেক্ষা করার কথা। অথচ বরাবরের মতোই অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাকে। মিশমি একবার ফোনের পর্দায় সময় দেখে নেয়। হৈমন্তিক বিকেলটা এবার সত্যিই ফুরিয়ে যাবে। কোথায় সে? প্রশ্নটা মনে জাগতেই চোখটা ধরে আসে তার। খুব অভিমান হয় মিশমির, খুবই। তখনই যেন এক ঝলক খুশির সংবাদ হাতে করে, কেউ একজন তার খুব কাছে এসে ডাকল,
“ মিশমি? ”
চমকে উঠে অপেক্ষাময়ী যুবতী। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো বুকটাও কেমন চঞ্চল হয়ে উঠে তার। সে কি এসেছে? সে-ই কি ডাকল তাকে? মিশমি ঘুরে দাঁড়ায় না। হাত দু’খানা মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের কম্পন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে যায়। তখনই মিশমি সেই কণ্ঠের পুরুষের প্রণয়ী হাত দুটোর স্পর্শ অনুভব করে তার খোঁপায়। হৈমন্তিক হাওয়ায় বেলি ফুলের সুবাস পাওয়া যাচ্ছে না? মুহূর্তেই মিশমি বুঝে নেয় যে, বেলিফুলের মালাটা তার খোঁপায় বাঁধা হয়েছে। লজ্জায় হৃষ্টপুষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। এতদিনের অপেক্ষা ছিল যাকে দেখার… মিশমি কী-করে তার লজ্জামাখা মুখ ফিরিয়ে সেই মানবকে দেখবে? নিজের লজ্জামাখা মুখটা দেখাতেও যেন মিশমির সুগভীর লজ্জা! অতঃপর তার-ই কণ্ঠ ফিরে আসে মিশমির কানে,
“ এইযে এতদিন বাদে আমাদের দেখা হওয়ার সুযোগ হলো… তুমি কি আমার মুখ দেখতে চাইছো না? তাহলে কি ফিরে যাব আমি? ”
চকিতেই মিশমি ঘুরে তাকায়। আবেদনময়ী নারীর চোখে তৃষ্ণা মিটানোর দারুণ অধীরতা! যখন মিশমি তার প্রেমিকের দিকে তাকিয়ে কোনো এক চেনা ব্যক্তির চেহারার গঠন উপলব্ধি করল, তখন বিস্ময়ের স্তূপে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ল তার মস্তিষ্ক। দীর্ঘক্ষণ নিস্তব্ধতায় তাকিয়ে প্রশ্ন করল মিশমি,
“ আপনি? ”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন যুবক মুচকি হেসে বলে,
“ চমকে দিলাম না-কি? ”
মিশমির চোখের পলক পড়ে না। এ-ই সেই আগন্তুক যাকে নিয়ে মিশমি সেদিন ঘাবড়ে গিয়েছিল। নীলাশাকে খুঁজতে গিয়ে যে নিজের প্রেমিককেই সেদিন খুঁজে নিয়েছিল তা মিশমির খেয়ালে আসেনি। মিশমি চোখ নামিয়ে ছেলেটির পায়ের দিকে তাকায়। তখনই ছেলেটি বলে উঠে,
“ আরে, তুমি তো দেখি সত্যিই আমাকে জন্ম-খোড়া ভেবে নিছো! আমি মোটেও তা নই। একদম ফিট! ”
মিশমির মনে পড়ে একটি ঘটনা। এক সহপাঠীর থেকে শুনেছিল, কোনো এক ব্যক্তিগত কারণে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের সামনে তুমুল মারামারি হয়েছিল দুই জন অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ুয়া যুবকের মাঝে। তাদের মাঝে তিহাম নামের একটি ছেলে পায়ে গুরুতর আঘাত পায়। মিশমি দুইয়ে-দুইয়ে চার করে ফেলে মুহূর্তেই। সে এখানো কোনো এক অজানা ঘোরে নিবদ্ধ রয়েছে। কথা যেন দু’ঠোঁট চিড়ে বেরুচ্ছে না। তাকে এমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিহাম-ই বলে উঠে,
“ কী ব্যাপার বলো তো? তোমার কি আমাকে শুধু ফোনেই ভালো লেগেছে? না মানে, দেখে তো মনে হচ্ছে আমার জন্যই এসেছো। তাহলে এমন ভূত দেখার মতো তাকিয়ে আছো যে? সামনে থেকে দেখতে খুবই বাজে লাগি না-কি? ”
মিশমি অপ্রস্তুত হয়ে আশেপাশে তাকায়। অত্যন্ত ধীর কণ্ঠে বলে, “ আপনি খুব সুন্দর, তিহাম। ”
তিহাম যেন একটু অবাক-ই হলো, “ নাম জানলে কী-করে? অবশ্য জানতে পারাটাও অস্বাভাবিক কিছু না। চলো হাঁটি। এখানে অনেক রোদ। ”
মিশমি এক পলক তাকায়। ঠোঁটে লেপ্টে থাকা হাসিটা সূর্যের কিরণের মতোই উজ্জ্বল দেখায়। তারা সরু পথটি ধরে হাঁটতে লাগে। কথার প্যাঁচে কথা বলে তিহাম,
“ তোমার ফ্রেন্ডসদের-ও তো দেখলাম আসছে। ডাকলা না ওদের? ”
“ উহু, থাকুক ওরা। ”
উত্তর দিয়েই বিশাল আকাশে চোখ রাখে মিশমি। আকাশে তখন লাল-নীলের শেষ অপরাহ্নের খেলা। তার উত্তরে উত্তর ফিরে আসে মুহূর্তেই,
“ একটা কথা জানার আছে। ”
মিশমি চকিতেই তিহামের দিকে ঘুরে তাকায়, “ বলেন? ”
“ আমি ডাকলাম আর তুমি চলে আসলে। আমি কি তবে ধরে নিব উত্তরটা পজেটিভ? ”
মিশমি চোখ সরিয়ে মাথা নত করল। ওষ্ঠদ্বয়ে হাসি নেই। কাটতে লাগল দীর্ঘক্ষণ। বাহ্যজগৎ সন্ধ্যার শুদ্ধাচারে সাজতে একদম-ই প্রস্তুত। তখনই মিশমি জবাব দিল, “ আমাকে একটু ভাবতে দেন, তিহাম। ”
তিহামের স্বল্প বিস্মিত স্বর, “ এখানে আসার পরও তোমার সময়ের প্রয়োজন? ”
“ হ্যাঁ, প্রয়োজন। অবশ্যই আমি আপনার কোনো অপ্রকাশিত প্রশ্নের উত্তরস্বরূপ এখানে আসিনি৷ আশা করি আপনি বুঝবেন। ”
মিশমির জন্য গোটা দিনটা কর্মহীনতা কাটলেও এখন এসে পড়ালেখা গুছিয়ে নিতে হচ্ছে পিহুকে। রাত খুব বেশি হয়নি। সুদূরের মসজিদ থেকে এশার আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। করুণ, নমনীয় স্বরে স্রষ্টার ডাক দিচ্ছেন মুয়াজ্জিন। কণ্ঠে তার কতই-না ব্যাকুলতা! পিহু উদাস চোখে তাকায় বদ্ধ জানালার ওপাড়ে। জানালার ওপাড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মনে হচ্ছে, আকাশে মেঘ করেছে ভীষণ! পিহু ক্লান্ত মাথাটা হেলিয়ে দেয় টেবিলের উপর। মুখের উপর আছড়ে পড়া টেবিল-ল্যাম্পের বাতিটা নিভিয়ে চোখ বুজে নেয় সে। কেটে যায় কয়েক মুহূর্তে, সেকেণ্ড ও সময়। অতঃপর কারো ডাকে তন্দ্রা ভঙ্গ হয় তার। পিহু চোখ কচলে উঠে বসে। ঘড়িতে তখন রাত সাতটা বেজে ত্রিশ মিনিট। পিহু আঁজলা ভরে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে জানালা খুলে দাঁড়ায়। দমকা হাওয়ায় এলোমেলো হয় চুল। তখনই কেউ প্রশ্ন করে,
“ কী-রে পিহু, তোর মায়ের কী অবস্থা রে? ”
পিহু পিছন ফিরে তাকায়। খিলখিল করে হেসে বলে,
“ আম্মুর শরীর এখন ভালো আছে, সুইটি আপু। এইসব ভাবধরা অসুখ কি বেশি দিন টিকে না-কি? ”
পিহুর কথা শুনে প্রবীণ শিক্ষার্থী সুইটি ভ্রু কুঁচকায়। মেয়েটি যেদিন থেকে হলে এসেছে সেদিন থেকেই তাকে হাসতে দেখছে সুইটি। এটা অবশ্য স্বাভাবিক! তবে কারণে-অকারণে হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো কী হলো? এইতো এখন, মায়ের সুস্থতা নিয়েও তার হাসি থামছে না। সুইটি নামের মেয়েটা আর কথা বাড়ালো না। রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে বিছানা নিতেই পিহুর কাণ্ডে রাজ্যসম বিস্ময় নিয়ে বসে রইল সুইটি ও ঘরে অবস্থানরত আরেকটি মেয়ে। বন্ধুমহলের মেসেঞ্জার গ্রুপে মিশমিকে আকারে-ইঙ্গিতে খোঁচা দেওয়া নিয়ে দমফাটা হাসিতে নিমজ্জিত হলো পিহু। সেই হাসির দাপটে ঘরময় সবকিছুই যেন খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। ইশ, কী মাথাধরা হাসি এটা! থালা-বাসনের ঝনঝন শব্দও সহ্য করা যাবে। তবে পিহুর এই হাসি যেন অসহনীয়। রাগে সুইটি ধমকে উঠে,
“ থামবি তুই পিহু? রাত-বিরেতে ভূত শরছে তোরে? নিজে ঘুমাচ্ছিস না আর আমাদেরও দিচ্ছিস না। ”
পিহু মুখ চেপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। নিজের এরূপ হাসির জন্য এ’পর্যন্ত কম কথা শুনেনি সে। আজ তার কপালে যে ঘোর শনি আছে তা আর তার বুঝের বাহিরে নেই। কিন্তু পিহুর ভাগ্য এইবারও সহায় হলো না। সে আরো জোরে হাসতে লাগল এইবার। তখনই আরেকজন রুমমেট বলে উঠল,
“ আপু, এই মেয়েটা চরম মাপের ফাজিল! একে মুরগী বানায়ে রাখো সারারাত। তাহলে এমন রাক্ষসীদের মতো হাসার শখ মিটে যাবে। ”
পিহু এবারও নিজের হাসি থামাতে পারে না। উলটে হেসে লুটোপুটি খেতে-খেতে বলে,
“ প্রিয়ন্তী আপু, তোমাকে রাগলে সেই রকম ফানি লাগে। জোকারও এত… ”
শেষ কথাটা আর সমাপ্ত করা হলো না তার। সে বুঝতে পেরেছে যে, ভুল জায়গায় ভুল কথা বলতে যাচ্ছিল সে। পিহু অনেক কষ্টে এবার নিজেকে দমিয়ে রাখতে সক্ষম হলো। কিন্তু শনি মহাশয় ভাগ্যে ঘুরপাক খেতে বিরত থাকল না। সানাম নেই। তাই পক্ষে কথা বলার মানুষটাও নেই তার কাছে।
সেই রাতে পিহুর আর জায়গা হলো না ঘরে। বড় আপুরা দয়া দেখিয়ে শুধুমাত্র ঘর থেকে বের করে দিতে পারতেন। কিন্তু সেই সৌভাগ্য হয়নি পিহুর। সারাটা রাত অন্ধকার বাথরুমে বন্দী থেকেই কাটিয়ে দিয়েছিল সে। সে কী যন্ত্রণার কথা! পিহু হাসিমুখে সেই শাস্তি গ্রহণ করলেও পরে অবশ্য বুঝেছিল যে, অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালো না। সানাম থাকলে হয়তো কোনো একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারত। কিন্তু পিহু কি আর সানাম হতে পারে? বন্ধুরা বুদ্ধি দিয়েছিল অনেক। কিন্তু লাভ বিশেষ হয়নি! বালতি উপুড় করে, তাতে বসে-বসে বন্ধুদের সাথে কথা বলেই রাত কাটিয়েছিল সে। হলের অন্য একটি মেয়ে দরজা খুলেছিল ঠিক ভোর সাড়ে চারটায়। বোধহয় ওযু করার উদ্দেশ্যেই এসেছিল মেয়েটি! তখন ছাড়া পেয়ে পিহু হেসেছিল ঠিকি। তবে বন্ধুরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করতে ছাড়েনি। এই নিয়ে একটি স্লোগান-ও তৈরি করেছিল তারা,
“ পিহুর ঐতিহাসিক টয়লেটময় রাত্রিযাপন! ”
#চলবে ইন শা আল্লাহ!
( বিশেষ বিশেষ বিশেষ দ্রষ্টব্য : যাদের গল্পটা একটু হলেও ভালো লাগে, তারা কিছুটা হলেও রেসপন্স করবেন। আমি সত্যিই খুব খুশি হবো আপনাদের রেসপন্স পেয়ে, আসসালামু আলাইকুম)