তারকারাজি- (০৮)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
উত্তপ্ত ঢাকা শহরের প্রতি বোধহয় সূর্য মহাশয়ের খুব দয়া হয়েছে আজ! স্বর্ণকমলের ন্যায় সূর্যের নরম আলোয় ঝিলের পানির থৈ-থৈ নৃত্যে মন হারিয়েছে নীলাশা। সত্যি বলতে, সরোবরের নাম শুনলেও এখানে কখনোই আসা হয়নি তার। আজ-ই প্রথম এখানে এলো, তা-ও আবার সানামের হাত ধরে। কোলাহল আছে বটে! তবে এই সরোবরে বয়ে যাওয়া পবনে যেন ভিন্নরকম শান্তি ছড়িয়ে আছে। শেষ শারদের বিশুদ্ধ হাওয়ায় এলোমেলো উড়ন্ত চুলে যখন নীলাশা হাত চালিয়ে তা বাঁধার চেষ্টা করতে লাগল, তখনই পরিচিত এক তেজস্বী নারীকণ্ঠের ধমকে কেঁপে উঠল তার দেহ,
“ ওই লাল-নীল! নড়িস না। আগের মতো চ্যাগাইয়া দাঁড়া তো। ”
“ অ্যাহ, লাল-নীল? কী বললা? কীভাবে দাঁড়াব? ”
তিনটে প্রশ্ন একসাথে করতে করতেই পিছনে ঘুরে তাকাল নীলাশা। দেখল, সানাম তাকে ক্যামেরাবন্দী করতে একবার ডানে হেলে পড়ছে তো একবার বামে। আবার মাঝে মাঝে নীচেও বসে পড়ছে মেয়েটা। নীলাশা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
“ আরেহ্! তুমি আমার ছবি তুলছো কেন? ”
“ ধ্যাত! কত সুন্দর ভিউ আসছিল আর তুই একটা খচ্চর, নষ্ট করে দিলি ভিউটা। তুলতে পারলে এক্কেরে ঝাক্কাস পিকচার হতো! ”
নীলাশা বিড়বিড় করে সানামের শেষ কথাটি আওড়াতে লাগল। কথাটা তো সুন্দর করেও বলা যায় যে, অত্যন্ত সুন্দর একটা ছবি হতে পারতো। অথচ মেয়ের ভাষা দেখো? নীলাশা ভ্রু কুঁচকে সানামের দিকে তাকায়। পালিয়ে আসার বুদ্ধিটা এঁটে সানাম যে ভুল কিছু করেছে তা মনে হচ্ছে না নীলাশার। নইলে এইতো গত বছরের কথা। তার বাবা ইয়াসিন চৌধুরীর জন্য নিশানরা এমন এক অধিকার পেয়ে বসেছিল যে, তাকে জোর-জবরদস্তি করে হলেও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়ার দারুণ হৃদয়হীনতা দেখা দিল বন্ধুত্বে। এই নিয়ে বন্ধুমহলে ঝামেলাটা কম হয়নি। তখন থেকেই ইয়াসিন চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণাধীনতা খাটতে লাগল তাদের বন্ধুত্বে। বন্ধুরা হবে বন্ধুদের মতোই দায়িত্ববান। তারা কেন হবে বন্ধু নামে কারো নিয়ন্ত্রণাধীন যান্ত্রিক দায়িত্ববান? এদের বন্ধু বলা যায় না, রোবট বলতে হয়। অবশ্য এক সময় নীলাশা খেয়াল করেছিল, কিছুদিন পর থেকেই তার বন্ধুরা ইয়াসিন চৌধুরীকে তেমন একটা গুরুত্ব দিত না। তারাও বেশ বিরক্ত হয়েছিল তখন। নীলাশার সাথে এরূপ আচরণ করার তীব্র প্রতিবাদে মিশমির সঙ্গ দিয়েছিল নিশান ও রিশান-ও। কিন্তু লাভ হয়নি। আমাদের সমাজ বিজ্ঞানে গুরুজনের কথা মান্য করা যে বাধ্যতামূলক! সেখানে ইয়াসিন চৌধুরীর অনুরোধকে উপেক্ষা করে চলা সম্ভব হয়নি বন্ধুদের ক্ষেত্রে। তিনি জানতেন যে, বন্ধুদের জোরেই বন্ধুপ্রাণ নীলাশাকে স্বাভাবিক করা যাবে৷ বলে না, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা? কিন্তু তাদের কেই-বা বোঝাতে পারবে যে, নীলাশা আর পাঁচজনের মতোই স্বাভাবিক আছে? সে কোনো মানসিক রোগী নয়?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুদূরে চোখ রাখে নীলাশা। দৃষ্টির উদাসীনতায় মুহূর্তেই সুগভীর টকটকে রূপ ধারণ করে ফেলে সূর্য। তারপর ধীরস্থিরে লুকিয়ে পড়ে নিজের গুপ্ত ঠিকানায়। আকাশটা এখনও লালচে। বোঝা যাচ্ছে, সন্ধ্যার ফিরে আসার খুব তাড়া আজ!
সানাম ভার্সিটির ফটক পেরিয়ে এসেছে৷ নীলরঙা গাঢ় সন্ধ্যার আকাশের বিশালতায় বঙ্কিম চাঁদটা উঁকি দিয়েছে মাত্রই। সারাটা দিন নীলাশার সাথে ঘুরাঘুরি করেছে সে। এখন ক্লান্তশ্রান্ত দেহটা যেন এগিয়ে যেতে খুবই অনিচ্ছুক! সানাম কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে চলে হলের দিকে। বাতাসে কোনো উষ্ণতা নেই। তবে তাতে শরীর জ্বালা করার মতো কোনোকিছুর আভাস পাচ্ছে সানাম। সে বিরক্ত হয়ে আকাশের দিকে মাথা উঁচিয়ে তাকায়। হাঁটতে থাকে আনমনে। কাল তাকে তার চাচার বাসায় ফিরতে হবে। মা-বাবার মৃত্যু বার্ষিকী কাল। কতগুলো বছর হয়ে গেল বাবা-মার আদুরে ডাক না শোনার। ‘সুমনা’ নামটা বাবার দেওয়া। মেয়ের মন হবে সুন্দর। সেই ইচ্ছাতেই আকিকা হয়েছিল সানামের। কিন্তু বুদ্ধিজ্ঞান হওয়ার পর সানাম এটা লক্ষ্য করেছিল যে, বাবা-মা খুব কমই তাকে সুমনা বলে ডাকত। তাদের ডাকা একটা আদুরে নাম ছিল সানামের, ‘সুমো’। এখন বাবা-মার সাথে নামটাও হারিয়ে গিয়েছে বহুদূর। কেউ আর ডাকে না তাকে এই নামে। চকিতেই সানামের চোখের কার্নিশে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। ধীরে-ধীরে জমা হয় নোনাজল। এই বুঝি গড়িয়ে পড়ল তা! ঠিক এমন সময়ে সানাম যে বিশ্রী ঘটনার সম্মুখীন হলো তা যেন এই মুহূর্তে কল্পনাতীত ছিল তার কাছে। তার মনে হলো, কোনো এক বেহায়া হাত এসে থামল তার বক্ষস্থলের এক পাশে। সানামের শরীর কেঁপে উঠল সেই স্পর্শে। সে সামনের মানুষটির দিকে তাকাতেই এক পরিচিত যুবকের মুখশ্রী দেখতে পেল। গা শিরশির করতে থাকলেও সানাম এগিয়ে যায় ছেলেটির দিকে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ছেলেটির গালে থাপ্পড় বসিয়ে বলে উঠল,
“ ছিঃ সাইফ ভাই! আপনারা ভার্সিটিজুড়ে রাজনীতি করে বেড়ান বলে জানতাম। কিন্তু এমন নোংরা মানসিকতার মানুষ কী-করে হতে পারেন আপনি? ”
সাইফকে নিজের কথা শুনে যেন খুব অবাক হতে দেখল সানাম। ভাবটা দেখে মনে হচ্ছে যে, সে যেন কিচ্ছুটি করেনি। সানাম একবার সাইফের পিছনের দিকে উঁকি দিল। আরাভ, সায়ান ও তনয় দাঁড়িয়ে আছে। ঘৃণায় শিরা-উপশিরায় কম্পন সৃষ্টি হলো তার। সে চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“ চরিত্রহীন সবগুলা! আপনাদের মতো নোংরা ছেলেরা কেন শিক্ষার নাম করে এখানে আসে বলেন তো? নোংরামি করবেন পতিতালয়ে গিয়ে করেন। মেয়েদের অভাব পাবেন না-কি? ”
কথাটা বলেই সে শ্রুতিকটু গালি দিয়ে বসল সাইফকে। যে শব্দটি সানাম উচ্চারণ করেছে তা শ্রবণেন্দ্রিয় হতেই সাইফদের রক্ত মাথায় উঠে গেল। সানামের কথার উত্তরে ভেসে এলো কারো হুঙ্কার,
“ জাস্ট শাট আপ! তুমি না-জেনে, না-বুঝে এত বড় কথা বলো কীভাবে? এই তুমি চেনো আমাদের? বেয়াদবি করার আর মানুষ পাও নাই, না? সাইফ কিছুই… ”
সায়ান নামের ছেলেটি তার কথা সম্পন্ন করতে পারে না। তার আগেই সানাম সায়ানের সামনে পেটের উপর হাত গুটিয়ে দাঁড়ায়। ঘাড় বাঁকিয়ে অত্যন্ত নিচুস্বরে হুমকি দেয় সে,
“ সেইটা তো পরেই দেখতে পাবেন, সায়ান ভাই। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ! ”
সানাম আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না সেখানে। ক্রুদ্ধ মনে তেজস্বী নারী এগিয়ে চলে চোখের বাহিরে। সানাম জানে, সাইফের আচরণের জবাব কীভাবে দিতে হবে তাকে। তাই তাদের সাথে তর্কে লিপ্ত হয়ে নিজের সময় নষ্ট করার মানেই খুঁজে পায় না সে। চলতে চলতে অনেকটা পথ-ই পেরিয়ে যায় সানামের। তখনই পিছন থেকে কারো কথা শোনা যায়,
“ আরে বাদ দে। মেয়েরা মুখে অনেক কথাই বলে। ও তোকে ভুল বুঝছে মানে তোকেও ওর ভুল ভাঙানোর জন্য উঠেপড়ে লাগা লাগবে না-কি? মেয়েটারে হুদাই এত দাম দেওয়ার দরকার তো নাই! নিজে ভুল বুঝছে, নিজে-ই ঠিকটা বুঝবে। যতসব আজাইরা ঝামেলা! ”
কথাটা শুনে সানাম একবার থামে। কিছু মুহূর্ত ব্যয়ে আবারও চলতে শুরু করে সে। বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে বিড়বিড় করে বলে, “ সানামকে এতটাও সোজাভাবে নিও না, সাইফ সোনা! আমি সানাম, সুমনা নই। ”
সেদিনের পর ভার্সিটিতে এসে সানামকে বহুবার খুঁজেছিল নীলাশা। কিন্তু খুঁজে পাওয়া হলো না তাকে। নিশানের থেকে শোনা গেল তার বাবা-মার মৃত্যু বার্ষিকীর কথা। শুনেছে নিশান-ও গিয়েছিল। অথচ সেদিন মেয়েটা একবারও জানালো না যে, তার পরের দিন-ই তার জন্য একটা বিশেষ দিন ছিল? অভিমানী নীলাশার এবার আর কোনো অভিমান হলো না। সানাম যে নিজের সকল কষ্ট-দুঃখ নিজের মাঝেই যত্ন করে আড়াল করতে জানে তা নীলাশার বোঝা হয়ে গেছে। দুই দিন গত হতেই নীলাশা সানামের কথা ভুলে গেল। খোঁজ নেওয়া হলো না মেয়েটির। রিশান ফিরে এসেছে। তার পরের দিন পিহুও ফিরে এসেছে। মহলের বিবর্ণতা কেটে গিয়ে আবারও ঝলমলিয়ে উঠেছে বন্ধুদের প্রাণ। হাসি, আড্ডা, একে-অপরকে বিদ্রুপ করে কথা বলা… যেন কানায়-কানায় পরিপূর্ণ হলো বন্ধুমহল। এদিকে মিশমিরও খুঁজে পাওয়া হচ্ছে না সেই প্রেরকের ঠিকানা। এইযে গত কয়েক দিনের তীব্র প্রণয়ের কল্পনায় ভয়ঙ্কর তৃষ্ণায় তৃষ্ণাদগ্ধ মিশমি অপেক্ষায় কাতরাচ্ছে, তা কি সেই বার্তা প্রেরক অনুভব করতে পারছে না? যে তীব্র প্রণয়ে মিশমিকে তৃষ্ণার্ত হতে বাধ্য করল সেই মানব… সে কি সত্যিই বুঝতে অক্ষম যে, কোনো এক প্রণয়িনী তার জন্য ব্যাকুল?
বাহিরের হরিদ্বর্ণ তরুর শীর্ষ শাখায় যখন জমাট বাঁধা অন্ধকার, তখনও মিশমি রাত্রির আকাশে চেয়ে তারা গুনতে ব্যস্ত। প্রোজ্জ্বল তারাগুলো মিশমিকে যেন খুব গভীরভাবে আলিঙ্গন করে যাচ্ছে। মিশমি সুদূর আকাশে চেয়ে ভাবে, আকাশ আমাদের থেকে কত দূর? বৈজ্ঞানিক ভাষায় হয়তো এর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক ভাষায় এর ব্যাখ্যা কী? বা আছে কি কোনো উদাহরণ? তখনই কেউ যেন বলে উঠল,
“ যতটা দূরে তোমার সে আছে! ”
মিশমি চমকে উঠে তার দু’পাশে তাকায়। অতঃপর চারদিকে একবার ঘুরে নিয়ে ভাবে সে, কে দিল এমন ধারা উত্তর? কোথাও তো কেউ নেই! কিন্তু সে স্পষ্ট শুনেছে সেই উত্তর, যতটা দূরে তার সে আছে ঠিক ততটা দূরেই আকাশ। আচ্ছা, এটা কি সত্যিই? তবে কে সেই ‘সে’? বার্তা প্রেরক? ফোনের মেসেজ টুনের আওয়াজে ভাবনার বিচ্ছিন্ন ঘটে মিশমির। সে তাড়াহুড়ো করে ফোনের পর্দায় তাকাতেই বার্তা পড়তে সক্ষম হয়,
“ পারুলতা মিশমি, পারুল বেশে এসো রবীন্দ্র সরোবরে, বিকেল ৫টায়। আমি এক মুঠো বেলির মালা নিয়ে অপেক্ষা করব তোমার জন্য। ”
#চলবে ইন শা আল্লাহ!
( বিঃদ্রঃ১ শারীরিক অসুস্থতার জন্য এতদিন লেখা দিতে পারিনি। আমি অত্যন্ত দুঃখিত।
বিঃদ্রঃ২ রি-চেইক করতে পারিনি। বানানে ও বাক্যবিন্যাসে ভুল থাকলে অবশ্যই জানাবেন আমাকে। আর উপন্যাসের মূল কাহিনি শুরু হবে আগামী পর্ব থেকে, ইন শা আল্লাহ।)