তারকারাজি- (২৪)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
সানন্দ আড্ডাখানায় এতক্ষণ ধরে সায়ান মিইয়ে থাকলেও এবার এই মিইয়ে থাকার প্রতিযোগিতায় অংশ নিল নীলাশা। নিষ্প্রভ আকাশের কৃষ্ণাভ ছায়া আজ বহুদিন পর খুবই অন্তরঙ্গভাবে গ্রাস করে ফেলেছে নীলাশার অপ্রখর মন।
মিশমির অনুপস্থিতির কয়েক মিনিট বাদেই আরাভের আত্মীয় আবির ও আবিরা এসেছিল তাদের সাথে দেখা করতে। আবির এই এলাকার ছেলে হওয়ায় ওর মাধ্যমেই না-কি ভ্রমণে সুবিধা ভোগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরাভরা। কাছাকাছি কোথাও দাওয়াতে এসেছিল বলেই আজ ছোট বোন আবিরাকে আরাভের সাথে দেখা করাতে নিয়ে এসছিল আবির ছেলেটি। ঘটনাটা মোটেও এমন নয় যে, আরাভ ও আবিরার সুসম্পর্ক দেখে নীলাশা ঈর্ষান্বিত। বরং তখনও নীলাশার মনে ছিল বিশদ প্রশান্তি। কিন্তু তারা চলে যাবার পর নীলাশা খুব ভালো করে খেয়াল করল যে, আরাভ তাদের মধ্যেই সানাম ও পিহুর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করলেও তার সাথে এখনও অবধি টুঁ শব্দটাও করেনি। এ-ই লক্ষ্য করে তীব্র ভর্ৎসনায় দুমড়েমুচড়ে গেল কন্যার কুসুমিত কোমল মন। অন্তর্মুখী নীলাশা যার জন্য নিজের বৈশিষ্ট্যে অনিয়মের রঙ লাগাল, আজ সে-ই নীলাশার দিকে নিয়মের ক্ষারিকা বর্ণ লাগিয়ে দিচ্ছে? নীলাশার মনে হলো এই বয়সে এসেও সে সবে প্রেমে পড়া অবুঝ কিশোরীদের মতো বড্ড বেশিই হ্যাংলামো করে ফেলেছে। না, এই পরোক্ষ অপমান মেয়েটির কাম্য নয়। নীলাশা ধীর স্বভাবেই উঠে দাঁড়াল সেখান থেকে। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তে তাকে উঠতে দেখে রিশান প্রশ্ন করল,
“ কই যাস? ”
নীলাশা শান্ত কণ্ঠেই উত্তর দিল তাকে,
“ আসছি একটু… এখান থেকেই। ”
এতক্ষণের মাঝে এই প্রথম আরাভ নীলাশার উদ্দেশ্যে কিছু বলল,
“ আমি যাব তোমার সাথে? ”
“ না ভাইয়া, আপনাকে আসতে হবে না। চলে আসব এক্ষুনি। ”
বলেই সে হাঁটতে লাগল সায়রের ধারের দিকে। নীলাশার কথা শুনে সকলের চোখের আয়তন যেন বৃদ্ধিই পেল বেশ! এতগুলো দিন… এতোটা মাস বাদে নীলাশা বোধহয় এই প্রথম আরাভকে ভাইয়া বলে সম্বোধন করল। কী নিদারুণ অভিমানটাই-না প্রকাশ করল সে! আরাভ নিশ্চল মস্তিষ্কে তাকিয়ে আছে নীলাশার যাত্রা পথে। যেন সে মোটেও আশা করেনি এটা! সেই সময় সাহেল দাঁতে দাঁত চেপে আরাভকে বলল,
“ দেখছোস, দেখছোস, দেখছোস? আগেই বলছিলাম পরে পস্তানো লাগবে তোর। এখন সায়ানের মতো ঠেলা সামলা। ”
রিশানের গম্ভীর প্রশ্ন, “ সায়ান ভাইয়ের মতো মানে? ”
আরাভদের একটু বিচলিতই দেখালো এই প্রশ্নে। যথা সম্ভব নিজেদের স্বাভাবিক করে নিয়ে দারুণ কৌশলে কথা ঘুরিয়ে নিল তারা। ওদিকে অভিমানিনীর নগ্ন পা দুটো ছুঁয়েছে হিমশীতল জলধির জল। শৈত্যের ছোঁয়া কাবু করতে পারে না নীলাশার দেহকে। কাবু করতে পারে না নীলাশার তপ্ত অন্তরটাকে। বাহ্যিক শীতলতা কি অন্তরের আকুলতাকে হিম করতে পারে? না, কখনোই না। এই নিষ্ঠুরতম অপমান নীলাশা কখনোই ভুলবে না। নিজের মনকে কঠিক চুক্তিতে আবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল সে। মনে মনে হাজার খানিক মিথ্যে প্রতিজ্ঞা করে নিতেই জলধিতে কারো হাঁটার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুনতে পেল নীলাশা। কেউ সমীপে এসে দাঁড়াল না? ঘুরে তাকানোর আগেই শোনা গেল এক আগন্তুকের পরিচিত কণ্ঠ,
“ রেগে আছো? ”
নীলাশা তাকাল। খানিকটা বিস্ময় নিয়েই বলল,
“ সায়ান ভাইয়া আপনি? ”
“ অনেকক্ষণ ধরেই কথা বলতে চাচ্ছিলাম। ফাঁকাই পেলাম না তোমাকে! যদি রেগে না থাকো তো একটা প্রশ্ন করতাম। ”
নীলাশা হাসল। জানালো সে রেগে নেই। অতঃপর সায়ানকে বলতে শোনা গেল,
“ তখন মিথ্যা কথা বলছিলা কেন? ”
বিষয়টি বুঝলেও নীলাশা সহজেই স্বীকার করল না তার মিথ্যা বলা সম্পর্কে। নয়তো মিশমির মতো মেয়েটি একাই এক স্বল্প পরিচিত ছেলের সাথে আলাদাভাবে বসে গেল আর তা নিয়ে বন্ধুমহলে তদন্ত চলবে না, তা কী-করে হয়? নীলাশার বাকি সবাইকে সামলে নেওয়ার দায়িত্বে সানামও ছিল অংশীদার। তাদের বিষয়টি বুঝতে মোটেও অসুবিধে হয়নি। তারা দুজন এ-ও ঠিক করেছিল যে, নিজেরা যা বোঝার বুঝেছে। বাকিদের বুঝতে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাই এই-সেই করে অবুঝ সাজার নাটকীয়তায় সায়ানের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কের প্রভাব পড়তেই নীলাশা বাধ্য হয়ে উত্তর দিল,
“ ইচ্ছে হয়েছিল তাই। কেন, মানুষের অনুভূতিকে সম্মান জানানো কি অন্যায়? ”
সায়ান না-বোঝার ভান করল,
“ অনুভূতি? কার আর কীসের? ”
নীলাশা হাসল, “ ডোন্ট ইউ লাভ মিশমি? এখন নিশ্চয়ই চোরের উপর বাটপারি করবেন না? ”
সায়ান বুঝল যে, এখানে কথা পেঁচিয়ে লাভ নেই কোনো। নীলাশা বুঝে গিয়েছে সবটা। কিন্তু কীভাবে? প্রশ্নটা করতেই নীলাশা দায়সারাভাবে উত্তর দিল,
“ ছাড়ুন, ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে। ”
বলতেই সায়ান খেয়াল করল নীলাশাকে সমুদ্রের গভীরতায় তাকাতে যেখানে জট পাকিয়েছে ধূসর অন্ধকার। সেও সেদিকে তাকিয়ে উদাস কণ্ঠে বলল,
“ যে ভালোবাসতে জানে সে অন্যের ভালোবাসা ধরতেও জানে। ”
নীলাশা প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। বরং সে বলল,
“ আমার কী মনে হয় জানেন? মিশ্শি তিহামের মতো ক্যারেকটারলেস একটা ছেলের কিছুতেই হবে না। মিশ্শি নিখুঁত মনের মানুষ আর সেখানে তিহাম…! নো, দিস ইজ নট অ্যাকসেপ্ট্যাবল অ্যাট অল। আমি তো ওদের ব্রেকআপ করিয়েই ছাড়ব! দেখি ওরা ওদের রিলেশনশিপ ক্যামনে টিকিয়ে রাখে। ”
সায়ান হাসল নীলাশার শেষোক্ত কথায়। বাস্তবতা এতো সহজ না-কি? সম্পর্ক গড়া বা ভাঙার ক্ষমতা কি আদৌ আমাদের হাতে আছে? তবে এই নিয়ে কথা না বাড়িয়ে, সায়ান নীলাশাকে হাতের ইশারায় ডেকে বলল,
“ চলে আসো এখান থেকে। আঙ্কেল একা থাকতে নিষেধ করছিল না? তোমাকে সাথে করে না নিয়ে গেলে আবারও ঘুরে আসতে হবে আমাকে। ”
সায়ান পা বাড়ালো সমুদ্রের বিপরীতে। তাকে চলে যেতে দেখে নীলাশা কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখালো না। কিন্তু সায়ান শেষ কথাটা কেন বলল? নীলাশার কেন যেন খুব খটকা লাগল বিষয়টি নিয়ে। তাই সে পিছু ডেকে বলল,
“ সায়ান ভাই, আপনি শুধুই আমার সাথে কথা বলতে এসেছিলেন তো? ”
নীলাশার প্রশ্নে সায়ানের পা জোড়া থামলেও সে পিছে ফিরে তাকাল না। বরং বিশদ হেসে বলল,
“ না, তোমাকে নিয়ে যেতে পাঠানো হলো বলেই এক ঢিলে দুই পাখি মারতে আসলাম। ”
মুহূর্তেই নীলাশার শরীরটা শিরশির করে উঠল। সৈকতের খ্যাপাটে, সর্বনাশী হাওয়া কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে দিয়ে গেল এক কাঙ্ক্ষিত নাম। কিন্তু সত্যিই কি সে? নিশ্চিত হতে যেই-না সে সায়ানকে সর্বদেশীয় ভাষায় প্রশ্ন করল তখন সায়ান আবারও পাড়ে যেতে যেতেই অত্যন্ত হাস্যোজ্জ্বল মুখে, গলা উঁচিয়ে উত্তর দিল,
“ নামটা বলে দিলে কিন্তু রাগ কমে যাবে! আরেকটু না-হয় রেগে থাকো তোমার গায়কবাবুর উপর? ”
নীলাশা উত্তর দিতে পারল না। মুহূর্তেই কান, মুখ গরম হয়ে এলো তার। বক্ষস্থল ভেদ করে হৃদপিণ্ড ছুঁলো সেই পুরাতন সুড়সুড়িপূর্ণ লাজ। বোনতুল্য মেয়েটিকে আকারে-ইঙ্গিতে এভাবে লজ্জায় ফেলে গেল সায়ান! নীলাশার হঠাৎই মিশমির মতো মনে হলো যে, বয়োজ্যেষ্ঠ ভাইদের সামনে মরণ ঘটলেও হৃদয়ঘটিত অনুভূতি প্রকাশ করা ভয়াবহ অপরাধ! এরা মোটেও সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে ছাড়ে না।
সমুদ্রের উত্তাল কল্লোলের সাথে মিশমির মিনমিনিয়ে গাওয়া গান যে স্নিগ্ধশীতল মূর্ছনা তৈরি করেছে তা নিঃসন্দেহে উপভোগ্য ও পছন্দনীয়। জলধির খুব কাছাকাছি অনুষ্ণ, সিক্ত বালুকাবৎ ভূমিতে বসে অত্যন্ত অপ্রিয়ভাবে তিহামের কাঁধে মাথা রেখেছে মিশমি। না, রেখেছে বললে ভুল হবে৷ তিহাম জোর-জবরদস্তি নিজের কাঁধে তার মাথাটা রাখিয়ে, দু’হাতে জড়িয়ে রেখেছে মিশমিকে। যেন মিশমিকে হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা রয়েছে তার! প্রেক্ষাপটে পরিলক্ষিত, অস্বস্তিতে ভুক্তভোগী মিশমিও এক কোমল অনুভূতি খুঁজে নিতে চাচ্ছে তিহামের কাঁধে মাথা রেখে। চোখের পাতা বদ্ধ। কিন্তু ঠোঁটে লেগে আছে অনুভূতিপ্রবণ কলি,
‘ আমার একলা আকাশ থমকে গেছে
রাতের স্রোতে ভেসে/
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
আমার দিনগুলো সব রং চিনেছে
তোমার কাছে এসে/
শুধু তোমায় ভালোবেসে। ’
“ সত্যিই কি তাই? ” সাবলীলভাবেই প্রশ্ন ছুঁড়ল তিহাম। মিশমি থামল। ওষ্ঠদ্বয়ে মাখলো গাঢ় লাজুক হাসি। সে মাথা উঠিয়ে ওই দূরে তাকায় যেখানে বন্ধুরা সবাই আড্ডা জমিয়েছে। একটু কি দেখা যায় তাদের? মিশমি নঞর্থক উত্তরটা জানার পরও অহেতুক চেষ্টা চালালো। উঠেও দাঁড়াল নিমিষেই। আর যা-ই হোক, সে তিহামের প্রশ্নের উত্তর দিবে না কোনোমতেই। কথা ঘুরিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে মিশমি তার দৃষ্টি নত করে তিহামকে বলল,
“ অনেকক্ষণ তো হলো। এইবার আমাদের যাওয়া উচিত। তুমিও তো ভাইয়াদের সাথে দেখা করোনি। ব্যাপারটা খারাপ দেখায় না? চলো যাই। ”
মিশমি উল্টো দিকে ফিরে যাবার জন্য উদ্যত হতেই তিহাম মিশমির বা’হাতটা ধরে নিল। সযত্নে নিজের বুকের সাথে আগলে ধরে বলল,
“ মিশমি, আই’ম সরি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার জন্য। ”
একবার না, দু’বার না… তিহাম বহুবার এই একই কথা নানান আয়োজন-বিয়োজনে মিশমির কাছে প্রদর্শন করেছে। সামান্য ধমক দিয়ে যদি সে এতটাই অনুতপ্ত হয় তাহলে মিশমির কেমন অনুভব করা উচিত তার গায়ে হাত তুলে? ভীষণ অপরাধবোধে বিদ্ধ অন্তরটা হুহু করে কেঁপে উঠল রমণীর। হোটেলে অবস্থানরত সময়ে তিহামের আচমকা এতোটা গভীর স্পর্শ কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি মিশমি। তাদের সম্পর্কটা তো এমনিতেও সুন্দর ছিল। তবে প্রয়োজন কী নতুন করে রং লাগানোর? মিশমি তখন তীব্র প্রতিবাদ দেখিয়ে তিহামের গালে আঘাত করেছিল ঠিকি কিন্তু জিততে পারেনি নিজের অনুভূতির সাথে লড়াই করে। সে ভয় পেয়েছিল খুব। ভালোবাসার মানুষ হারালে না-কি সুখে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তিহামকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে অন্তরটা কেঁপে উঠেছিল মিশমির। চোখে এসেছিল জল। তাই-না সে ছুটে এসেছে তিহামের ভুল ক্ষমা করে দিতে! এইসকল কিছু মনে পড়তেই মিশমির হাসিটা মলিন হলো খুব৷ সে অস্বস্তিতে নিজের হাতটি ছাড়িয়ে দৃষ্টি নত করেই বলল,
“ যা হইছে ভুলে যাও। আমি তোমাকে আগেও বলছি আমরা স্কুল পড়ুয়া কোনো স্টুডেন্ট না। ভুল করার বয়সটা আমাদের পেড়িয়ে গেছে তিহাম৷ আমি চাইনা আমাদের ভালো সম্পর্কটা ভুল সম্পর্ক বনে যাক। চলে এসো। ”
মিশমি চলে গেল। তিহাম আটকায়নি একবারও। সৈকতের অবাধ হাওয়া যেখানে শীতলতায় ভরিয়ে তুলে সৈকতবিলাসীদের, সেখানে তিহামের মনে সৃষ্টি করল নিষিদ্ধ এক উষ্ণতা। সে আলতো করে নিজের গালে হাত বুলিয়ে চলল অবিচলে। তখন যে অঙ্গনা এখানটায় আঘাত করেছিল, একটু আগে সেই অঙ্গনা-ই এসে সেখানে তার ক্রন্দনে কম্পিত ঠোঁট জোড়া ছুঁয়ে গিয়েছে। সেই বিস্ময়কর দৃশ্যটা তিহামের চোখে এখনো জ্বলজ্বল করে ভাসছে। মিশমির আকস্মিক কাজে সে অবাক হয়েছিল খুব। কিন্তু রেগে থাকতে পারেনি তার উপর। মিশমি মেয়েটা যে তাকে নিঃশর্ত ভালোবেসে ফেলেছে সেইটা ভেবেই খুশিতে আটখানা হতে দেখা গেল তিহামকে। নৈসর্গিক আনন্দে মাতাল হলো তার মন। অন্তরটা কেঁপে কেঁপে উন্মাদের মতো সেই রমণীর নামই পুনঃপাঠ করতে লাগল, যে রমণী স্বভাবসুলভ ছুটে গেল তার বিপরীতে। কিন্তু তারপর…?
#চলবে ইন শা আল্লাহ!
(বিঃদ্রঃ আগামী দুইদিন ব্যক্তিগত কারণে গল্প দিতে পারব না। ইন শা আল্লাহ মঙ্গলবার, ১৬ই নভেম্বর নতুন পর্ব দিব)