তারকারাজি- (০২)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
দুপুরের ঝাঁ চকচকে রোদের সংস্পর্শে এসে গরমে অস্থির হয়ে উঠেছে নিশান। শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে অনবরত। দুই ভ্রুর মাঝের বলিরেখাটা তীব্র বিরক্তিতে আরো একটু কিছুটা গভীর হয়ে উঠেছে। ইদানীং প্রায়-ই তাকে বিরক্ত হতে দেখা যাচ্ছে। নিশান তার ঘামে ভেজা শার্টটা ঝাড়া দেয়। মুখে তিক্ততা এনে বলে,
“ ন্যাহ্। আমার দ্বারা এত তেল-মালিশ করা হবে না। কী পাইছে কী ওরা? ওদের ভাড়া করা চামচা আমরা? বাপে আমাদের বলবে ঠেইলে-ঠেইলে মেয়েরে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে পাঠাও। আর তা করলে মেয়ে এসে ভব ধইরে আমাদের ভুল বুঝবে। আবার সেই ভুল বুঝাবুঝি আমাদের-ই মিটানো লাগবে। সিনেমা পাইছে না-কি? ওরে বল ওদের বাপ-বেটির কামলা খাটি না আমি। আর না কামলা খাটতে পারব। ”
বন্ধুদলের একে-অপরের মাঝে দুরত্ব বেশি নয়। তবুও নিশান ইচ্ছা করেই চেঁচিয়ে মিশমিকে বলল কথাটা। নীলাশা শুনেছে। কিন্তু জবাব দেয়নি একটুও। যে নিজেই এইসবে বিরক্ত, সে কী-করে বন্ধুর বিরক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবে? তার পাশ থেকে মিশমি স্বভাবসুলভ শান্ত কণ্ঠে বলে,
“ জানিস-ই তো ওর এইসব পছন্দ না। তাহলে প্রত্যেকবার সিনক্রিয়েট করার কি প্রয়োজন আছে? এখন একটু খাচ্ছি আমরা। ঠিক মতো খা-না রে বাপ! ”
বলেই মিশমি এক-চামচ চটপটি মুখে পুড়ে নিল। তিন বান্ধবীর হাতেই চটপটির প্লেট। তাদের এই চটপটি খাওয়া যেন সহ্য হচ্ছে না নিশানের। সে রেগে আছে। বান্ধবীদের উচিত সেই রাগী নিশানকে নিজেদের মূল্যবান সময়টা দেওয়া। কিন্তু না, তারা চটপটি খেতে ব্যস্ত। নিশান সিদ্ধান্ত নিল নীলাশার সাথে কথা বলার। ইনিয়ে-বিনিয়ে চেষ্টা করে যখন লাভ হলো না তখন সে নাক সিঁটকে বলে উঠল,
“ কী-রে নীলু, তোরা এগুলা কী খাস রে? স্বাদ-টাদ কি লাগে না-কি? এহ্, এটা খাওয়ার মতো কিছু হলো? এর থেকে আমার ডায়রিয়া-ও তো টাইট হয়। ”
কথাটা শোনা মাত্রই কাশতে কাশতে মুখের খাবারটুকু ফেলে দিল নীলাশা। সেখানে বসেই মুখ ভরে বমি করল সে। পেটের নাড়ি-ভুড়ি যেন উল্টে আসছে তার। নীলাশার বমি করা দেখে মিশমি দূরে সরে গেলেও শেষ রক্ষা হলো না। সেও বমি করতে লাগল। শুধু চটপটি খাওয়া পিহুই বোধহয় ছিল, যে কি-না এদের তামাশা দেখে হাসতে ব্যস্ত৷ মেয়েটা কথায় কথায় হাসে। টিএসসির বাহিরে হাঙ্গামাটা ভালোই বাঁধিয়ে দিল তারা। কিছুক্ষণ পর নিজেরা স্বাভাবিক হতেই নীলাশা ধমকে উঠে বলল,
“ ইউ ব্লাডি ডগ! তোর কোনো সেন্স আছে? ”
নিশান ঠোঁট চেপে ধরল। বিস্মিত হওয়ার ভঙ্গিমায় বলে উঠল,
“ আমি আবার কী করলাম দোস্ত? তোরা খাইতে পারিস আর আমি বলতে পারব না যে, ওটা আমার টয়… ”
“ থামবি তুই? তোর ডায়রিয়ার গপ্পো কেউ শুনতে চাইছে? ”
মিশমি চোখ রাঙিয়ে শাসিয়ে উঠল বন্ধুকে। সে জানে, নিশান এইসব বলে নীলাশার মনোযোগ পেতে চাইছিল। তাই বলে এমন একটা বিশ্রী সমালোচনা কী-করে করে বসল যে, আশেপাশের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের দেখে হাসছে? তাদের বাক-বিতণ্ডার মধ্যেই এসে হাজির হলো রিশান। সে তার পরিচিত একজনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। এখানে এসে এদের কথা শুনে, পেটে হাত রেখে হাসতে শুরু করেছে সে। তার সাথে উপস্থিত হওয়া পাশের মেয়েটিও হাসছে। হাসাহাসির পর্ব শেষ হতেই নিশান, রিশানের পাশের মেয়েটিকে বলল,
“ কী-রে সানাম! বাটপারি তো ভালোই শিখছিস। মেডিকেলে পড়বি বলে ভার্সিটিতে ভর্তি হইলি। অথচ জানাইলি না আমাদের? ”
সানাম হেসে উত্তর দেয়, “ আরে ব্রো, ওইসব মেডিকেলের কাটাকুটি খেলা আমার দ্বারা হবে না। আমি তো চিল মারার মানুষ৷ ফূর্তিবাজি করেই তো জিন্দা আছি। এইসব মেডিকেলের পড়া আমার মাথায় ঢুকতো না। হুদাই ডাব্বা না-মেরে ভার্সিটিতে পড়ার ডিসিশন নিলাম। আর তোদের চমকে দিব দেখেই জানাই নাই। আজ এসে দিলাম তো চমকে! ”
বলেই সে হাসল। মিশমি একবার খেয়াল করল মেয়েটিকে। গায়ে লেডিস শার্ট, জিন্স, স্পোর্টস সু, খোঁপা করা চুল আর সব থেকে অবাক করার মতো ছিল মেয়েটির গলায় ঝোলানো ক্যামেরা। চাকচিক্যময় ক্যামেরাটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, মেয়েটির ফটোগ্রাফিতে আগ্রহ আছে। কথায় কথায় জানতে পারল এ-ই সেই উশৃঙ্খল সানাম, যে কী-না নিশানদের সাথে কোচিং করত। নীলাশা আর মিশমি তার অনেক গল্প শুনেছে। শুনেছে, মেয়েটি না-কি মাত্রাতিরিক্ত চঞ্চল ও ক্যাটক্যাটে ধরণের। তার বাবা-মা নেই। চাচা-চাচির কাছেই মানুষ হতে হয়েছে তাকে। কথাগুলো মনে পড়তেই একটু দয়ার সঞ্চার হলো নীলাশার মনে। ভাবল পরিচিত হবে মেয়েটির সাথে। কিন্তু তখন-ই সানাম নিশানদের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“ এই কার্টুন তিনটা কে-রে? দুইটাকে মনে হয় চিনছি, তোদের বড়োলোকি কুত্তা আর সারাদিন গল্প করে মাথা ধরিয়ে দেওয়া ঝাণ্ডুবাম। কিন্তু তিন নম্বরটা কে? ”
কথাটা শুনে নীলাশার মাঝে যে অসম্মানিত বোধ জাগ্রত হলো, তাতে করে আর পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা রইল না তার মাঝে। বন্ধুরা একেক সময় একেক নামেই ডাকে তাকে। তাই বলে এমন বিশ্রী সমালোচনাও করে না-কি অন্যজনের কাছে? রাগে শরীরটা কেঁপেই ওঠে নীলাশার। নীলাশার ব্যাপারে এমন খোলামেলা কথাটা শুনে বন্ধুরাও বেশ অপ্রস্তুত হয়৷ সানাম মুখের উপর কথা বলতে জানে বেশ! তাই বলে যে এভাবে একটা কথা বলে ফেলবে তা কিছুতেই ভেবে উঠতে পারেনি রিশানরা। তখন মিশমি-ই প্রতিবাদ করে বলে,
“ এইসব কী ধরণের কথাবার্তা, সানাম? আর রিশান, তোরা বাইরের মানুষের কাছে নীলাশার সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করিস? এটা তো জানা ছিল না আমাদের? ”
রিশানরা মোটেও এমন কোনো কথা বলেনি। বান্ধবীদের প্রশংসা না-করলেও কখনো বাজে কথা বলেনি কারো সম্বন্ধে। কিন্তু এটা এখন বাকিদের কী-করে বোঝাবে যে, বাঁকা কথা বলা তাদের-ই বান্ধবী সানামের স্বভাব? এটা বললে সানাম এখনি একটা তুলকালাম কাণ্ড ঘটাবে আর মাথা নোয়াতে হবে তাদের। এইতো নীলাশা অভিমান ভুলে কথা বলেছিল। আর এখন আবারও তাদের দিকে বিরাট এক অসম্মাননার অভিযোগের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছে। নীলাশা সেখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে অন্যদিকে নিরুদ্দেশ পা বাড়ায়। নিজের সম্পর্কে মানুষের এমন ধারণা শুনে আর কিছুই ভাবতে পারে না সে। তার জীবনে বন্ধু মানেই তো প্রাণ! তাহলে বন্ধুরা কেন এমন ব্যবহার করে তার সাথে? না, নীলাশা আর সহ্য করতে পারে না৷ মাথায় শুধু ঘুরপাক খায় সানামের বলা সেই কথা, ‘ নীলাশা বড়োলোকি কুত্তা! ’
নীলাশা তো নিরুদ্দেশ হারিয়ে গেল। কিন্তু তাকে খুঁজতে খুঁজতে নাজেহাল হতে হলো মিশমির। বিকেল হয়ে এসেছে। শরতের ভাসমাম মেঘের কোণে ছড়িয়েছে কয়েক ছটা কমলা রঙ। মিশমি আকাশের দিকে তাকায়। নীল আকাশের গায়ে মাখা সেই কমলা রঙেই হারিয়ে যায় দুটো চোখ। বন্ধুরা বেশ ধৈর্য্যহারা মানুষ। তারা নীলাশার এহেন রাগকে গুরুত্ব দিতে চায় না। কিন্তু মিশমির মায়া হয় খুব। মেয়েটা এখনও প্রাপ্তমনস্ক বাঙালি নারীমনা হয়ে উঠতে পারেনি। মিশমির ভয় হয়। এই আদুরে নীলাশা বাঙালি হিসেবে, নারীমনা আয়ত্ত করতে না-পারা পর্যন্ত যেন কোনো তীক্ষ্ণ আঘাত না পেয়ে বসে! কথাটা ভাবতে ভাবতেই কারো সাথে ধাক্কা লেগে গেল মিশমির৷ সে নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেও সামনের ওয়াকার স্টিক হাতে রাখা ছেলেটি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। মিশমি বুঝল, ছেলেটির পায়ে সমস্যা আছে বলেই এই সামান্য ধাক্কায় পড়ে গেছে সে। মিশমি আর দেরি না-করে ছেলেটিকে উঠতে সাহায্য করল। তখন-ই সেই ছেলে ধমকে বলল,
“ চোখ মাথায় তুলে হাঁটছিলে না-কি? পা-টা আমার শ্যাষ! ”
মিশমি মনে মনে কুণ্ঠিত বোধ করল। সে তো সত্যিই আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে শান্ত কণ্ঠেই বলল,
“ আসলে আমি খেয়াল করিনি ভাইয়া। মাফ করবেন। আপনার পায়ে তো মনে হয় আগের থেকেই সমস্যা ছিল। খুব কি ব্যথা পেলেন? ”
“ মানে? তুমি বলতে চাইছো আমি জন্ম-ল্যাংড়া? বেয়াদবির জায়গা পাও না, না? ”
মিশমি তার চোখ দুটো বার কয়েক ঝাপটে ছেলেটির দিকে তাকাল। চোখে বিস্ময়ের স্তূপ নিয়ে সে বলল,
“ আমি তেমন কিছুই বলিনি। আর আপনার পায়ে কী হয়েছে তা কি আমার জানার কথা? আপনিই বলেন ভাইয়া? ”
ছেলেটি মিশমিকে আপাদমস্তক দেখে নিল। মেয়েটিকে একবার যে দেখবে সে-ই বলবে, নিখুঁত শিল্পীর রং-তুলিতে রাঙানো কোনো এক পরীকেই দেখছে সে। ছেলেটি কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল, “ অনার্স ফাস্ট ইয়ার না-কি? ”
মিশমি মাথা ঝাঁকায়। অতঃপর অপর ব্যক্তি বলে, “ এর জন্যই জানো না। যাও, তোমাকে ছেড়ে দিলাম। তবে হ্যাঁ, তোমার নামটা যেন কী? এটা না-বলে এখান থেকে যেতে পারবে না তুমি। ”
মিশমি এবার সত্যিই ভয় পেল। এই ছেলে নাম কেন জিজ্ঞাসা করছে? কথা শুনে মনেই হচ্ছে তার সিনিয়র কেউ হবে। মিশমি চোখ মাটিতে নামায়। ধীর কণ্ঠে বলে, “ মিশমি হোসেন। ”
“ কোন ডিপার্টমেন্ট? ”
মিশমি জবাব দেয়। ছেলেটি সরে দাঁড়াতেই যথাসম্ভব দ্রুত স্থান ত্যাগ করে সে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে। প্রায় অনেকটা দূর এসে তার মনে পড়ে নীলাশাকে খোঁজার কথা। অথচ সেই ব্যক্তির ভয়ে যে তখন উল্টো পথে পা বাড়িয়ে ফেলেছে তা আর খেয়াল-ই করা হয়নি তার। এখন কি আবার ও-পথে যেতে হবে? মিশমি এবার বাকি বন্ধুদের মতোই খুব বিরক্ত হয়। নীলাশা মেয়েটা অত্যন্ত আদুরে। তাই বলে কেন এত অভিমানিনী হতে হবে তাকে? সে আদুরে মানে অন্যদেরও নিজের আদর-ভালোবাসায় নিজের খারাপ-লাগা, ভালো-লাগা, নিজের অনুভূতিগুলো বুঝাতে হবে। তাহলেই-না মানুষ তাকে বুঝবে! আর তা না-করে হুড়মুড়িয়ে চলে গেল সে। কোথায় গেল জানালো-ও না। মিশমির এবার সত্যিই নিশানদের মতো বলতে ইচ্ছা করে, “ ভব ধরা মাইয়া! ”
মাঝখান থেকে সেই আগন্তুক তার কী কী করতে পারে, তা নিয়েই চিন্তায় মগ্ন হয়ে হাঁটতে লাগল মিশমি। এমনিতেই এইসব ব্যাপারে মিশমি খুব-ই ভীতু। ছেলেটা যেভাবে প্রশ্ন করল… মিশমি তো বাধ্যই ছিল উত্তর দিতে। তার জায়গায় নীলাশা বা পিহু হলে মোটেও উত্তর দিত না। বরং আরো এক ধাপ হাঙ্গামা-ই বাঁধিয়ে ফেলত সেখানে। এমন মেয়ে দুটো তার বন্ধু কী-করে হতে পারে? উত্তর খুঁজে পায় না মিশমি। শান্তশিষ্ট শব্দটির সাথে অবশ্যই তার বিপরীত শব্দ মিলে না। তাহলে তাদের কেন মিলন হতে হলো যখন তারা সবাই-ই একে-অপরের বিপরীত?
বিকেল ছাড়িয়ে নেমে এলো সন্ধ্যা। বিতৃষ্ণ নীলাশার চোখে ভেসে উঠল বৃষ্টির আগমন বার্তা। তমসাচ্ছন্ন আকাশটা থেকে-থেকেই গমগমে হয়ে উঠছে। কেমন গম্ভীর স্বরে ঘোষণা করছে যে, বৃষ্টি নামলো বলে! নীলাশা সেখান থেকে সরে যায় না। ইচ্ছা করে না তার। বৃষ্টি নামুক এই শহরে। বৃষ্টি নামুক তার কাঠ হয়ে যাওয়া অন্তরে। একটা বার বৃষ্টি নেমে আসুক তার জীবনে… শুধু একটা বার! কিন্তু না, বৃষ্টি নামে না। শুধু কানে আসে মেঘেদের ডাক। সেই সাথে আসে আরো একটি কণ্ঠ,
“ এই মেয়ে, ভার্সিটিতে এই সময় কী কাজ? হলে থাকো না-কি? যাও, হলে যাও। ”
নীলাশা প্রথম ধাপে চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নেয়। মানুষের-ই কণ্ঠ এটা। ভূত-প্রেত তো আর না! সে নিঃশঙ্কতায় আশেপাশে তাকাতেই এক কৃষ্ণাভ পুরুষালি ছায়া দেখতে পায়। এই দিকটায় আলো নেই। ধু ধু অন্ধকার দেখেই এখানে বসেছিল নীলাশা। সেই ঝঙ্কার তোলা কণ্ঠের পুরুষকে দেখতে পায় না সে। নীলাশা আরেকটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। আগন্তুকের ঠোঁটের ফাঁকে এক টুকরো আগুন জ্বলজ্বল করছে। সে কাছে এগিয়ে আসতেই নীলাশা নাক সিঁটকে কাশতে লাগে। কাশতে কাশতেই সে খেয়াল করল সেই আগুনটা হারিয়ে গেছে। মানুষটাও বোধহয় চলে গেছে এখান থেকে। নীলাশা চিন্তামুক্ত হয়। না-জানি কে এসেছিল! সে উদাস চোখ দুটো মেলে তাকায় আকাশের দিকে। গুনগুনিয়ে বলে উঠে,
“ যদি একবার হাসিস, ভালোবাসি বলিস, তবে কীই-বা এমন হবে ক্ষতি?
আমি যে মরি, বন্ধু-বন্ধু করি, তোরা কেন ছড়াস বিষাদের জ্যোতি? ”
“ বিষাদের জ্যোতি কেমন হয়? ”
প্রশ্ন শুনে চমকে উঠে নীলাশা। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে। কই, কোথাও নেই তো সেই পুরুষটা? নীলাশা বলে,
“ আরেহ, আপনি সেই সিগারেটওয়ালা না? আপনি যান নাই না-কি? ”
পুরুষ কণ্ঠটি হাওয়ায় ভেসে আসে,
“ সিগারেটওয়ালা? এইটা কী-রকম নাম হলো আজব! এই মেয়ে, তোমার নাম কি বলো তো? এই অন্ধকারের মধ্যে এমন বিষাদের ছন্দ মিলাচ্ছ কেন? ব্রেকআপ-ট্রেকআপ হলো না-কি? ”
“ আপনি কি শুনেন নাই আমি বন্ধুর কথা বলেছি, বয়ফ্রেন্ডের না? এন্ড হোয়ার আর ইউ? একটু আগে তো ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম। এখন তো একদম গায়েব হয়ে গেছেন। ”
কথাটা বলে আবারও আশেপাশে তাকাল নীলাশা। ভয়ে বুকটা কেমন ধকধক করতে লাগল। এমন একটা আলোশূন্য জায়গায় বসে থাকাটা নীলাশার উচিত হয়নি বলেই মনে হচ্ছে। না-জানি ছেলেটা কেমন! ভয়ে-ভয়েই এদিকে-সেদিকে খুঁজে সেজে। আর তার মাঝেই নীলাশা আলোর দিশা দেখতে পেল। কেউ একজন নীলাশার মুখের দিকে আলো ধরেছে। নীলাশা থাকতে না-পেরে মুখের সামনে হাত দিয়ে বলল, “ আরেহ, চোখে ফ্ল্যাশ কেন ধরেছেন? ”
মনে হলো ছেলেটি তড়িঘড়ি করে আলো নিভিয়ে দিল। তারপর নিস্তব্ধতার মাঝেই কারো এগিয়ে আসার স্পষ্ট আওয়াজ শোনা গেল। নীলাশা ঘাবড়ে উঠে দাঁড়ায়। কিছু বলার আগেই ছেলেটি বলে,
“ বন্ধুদের সাথে ঝগড়া করে এখানে এসে বসে আছো? সিরিয়াসলি? তুমি কি প্লে-নার্সারিতে পড়া বাচ্চা না-কি? ”
নীলাশা শান্ত হয়ে দাঁড়াল। কেন যেন ভয় লাগল না তার। মনের গুপ্তদ্বারে সজীব হাওয়া এসে, খানিকক্ষণের জন্য নিভিয়ে দিল শত বিষাদের জ্যোতি। সে বলল, “ আপনার পাশে বসা যাবে? ”
ছেলেটি উত্তর দিল না। নীলাশাকে বসতে বলে সে উঠে দাঁড়াল। যেন মেয়েটির পাশে বসলেই তার সর্বনাশ হয়ে যাবে! নীলাশা বসতেই সে বলল,
“ তুমি তো মনে হয় হলে থাকো না। এত রাতে এখানে বিষাদের আলাপ জুড়ে বসেছো কেন? ভয় লাগে না না-কি? ”
“ আপনাকে তো খারাপ মানুষ মনে হচ্ছে না। ভয় লাগবে কেন? ”
“ কারো কথা শুনেই কি বোঝা যায় যে, সে খারাপ না-কি ভালো? আমাদের মানবজাতির মাঝেও আজব এক জাতি হলো তোমরা। নিজেদের ভালো নিজেরা বুঝো না। যাই হোক, কীসে পড়ো তুমি শুনি? ”
নীলাশা উত্তর দেয়। আরও একটা-দুটা কথা বলতেই ছেলেটি আকাশের দিকে তাকায়। নীলাশা অস্পষ্ট হলেও দেখতে পায় মানুষটির মুখ। ছেলেটার কণ্ঠমণি বেশ উঁচু। আতিশয্য লম্বা সে। নীলাশা যখন খুঁটিতে খুঁটিয়ে ছেলেটিকে দেখতে ব্যস্ত, তখন-ই ছেলেটি নীলাশার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ বৃষ্টি নামবে। বাসায় যাবা না? না-কি বন্ধুদের জন্য এখানেই বসে-বসে ভ্যা ভ্যা করবা? সত্যিই… তোমরা আজকালকার মেয়েরা এত ন্যাকা! বন্ধুদের সাথে ঝগড়া করে বসে আছো, হাহ্! ”
নীলাশা তখন-ই চোখ সরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু সে খুব অবাক হলো ছেলেটির বলা কথায়। সে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“ হুয়াই আর ইউ টকিং লাইক দিস? যেইটা জানেন না সেইটা নিয়ে কথা কেন বলেন? ”
ছেলেটি মুখভঙ্গি এমন করল যেন সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির কণ্ঠে ব্রিটিশ স্বরাঘাতটা মানিয়েছে বেশ! নীলাশা পাল্টা উত্তরের আশা করতে করতেই উদাস চোখ দুটো আকাশের পানে রাখে৷ বিদ্যুৎপ্রভায় চোখেমুখে মুগ্ধতা ফুটে উঠে। ওই এক ঝলকেই নীলাশাকে দেখে নেয় ছেলেটি। তখন নীলাশাকে বলতে শোনা যায়,
“ সঙ্গপ্রিয় মানুষরাই কেন এই পৃথিবীতে নিঃসঙ্গ হয়? বলতে পারেন আপনি? ”
ছেলেটিকে উত্তর দিতে শোনা যায় না। মনে হয় সে জানে না। নীলাশার মনে হলো কোনো মানুষের-ই বোধহয় এর সঠিক উত্তর জানা নেই। আর তখনই ছেলেটি উত্তর দিল,
“ কারণ সঙ্গপ্রিয় মানুষের চোখে বিষাদের জ্যোতি। সঙ্গপ্রিয় মানুষরা শুধু নিজেদের সঙ্গই খুঁজে। যত সঙ্গ পায় ততই চায় তারা। আশেপাশে তাকিয়ে দেখার সময় কি তাদের আছে? অথচ তারা যদি তাদের চোখের সেই বিষাদ-জ্যোতি নিভিয়ে মনো-জ্যোতি জ্বেলে দেয় তো দেখবে, তারা নিঃসঙ্গ নয়। তাদের ভালোবাসার, আনন্দ-উল্লাসে বেঁধে রাখার জন্য তাদের সঙ্গের অভাব নেই। কিন্তু সঙ্গপ্রিয় মানুষ এমনটা দেখতে পারে না-কি? এর জন্য একমাত্র দায়ী সেই বিষাদ-জ্যোতি। যে জ্যোতির নাম-ই বিষাদ, সে তো বিষাদময় দৃশ্যই দেখাবে! ”
নীলাশা চোখ ফিরিয়ে তাকায় ছেলেটির দিকে। ছেলেটির ব্যস্ততায় তার মুখটা এবারও দেখতে পেল না নীলাশা। সে ভাবে, সত্যিই কি তার প্রশ্নের সঠিক জবাব এটা? নীলাশা কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু তখন-ই ছেলেটি বিদায় জানিয়ে হুড়মুড়িয়ে চলে যেতে থাকে। জমাট বাঁধা অন্ধকারে সে হারিয়ে ফেলে আগন্তুককে। একটু কি দেখা যায়? নীলাশা চেষ্টা করে। কিন্তু না, জুতোর শব্দ ছাড়া ছেলেটির আর কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পায় না নীলাশা। সে তৎক্ষনাৎ গলা উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
“ আরে সিগারেটওয়ালা, আপনার নামটাই তো শোনা হলো না আমার? ”
মনে হলো যেন চলতে চলতে জুতোর আওয়াজ খানিকটা থামল। অতঃপর হাওয়ায় ভেসে এলো সেই পুরুষালি কণ্ঠস্বর, “ আরাভ! ”
#চলবে ইন শা আল্লাহ!