তাজ ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব:৩৫

0
362

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৩৫

“ইলোমিলো?”
শ্রেয়ান ভাইয়ার ডাকে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। ফিরে তাকিয়ে বললাম,
“জি।”
“কিছু বলছো না যে?”
আমি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। এই মুহূর্তে আমার কি করা উচিত, কী বলা উচিত কিছুই মাথায় আসছে না। সব কেমন গোলমেলে লাগছে। এদিকে শ্রেয়ান ভাইয়া উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন উত্তরের আশায়। আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। দুহাত একসাথে করে কচলাতে কচলাতে বিব্রত কন্ঠে বললাম,
“হুট করে এসব কী বলছেন ভাইয়া? আমি তো কখনও এমন কিছু ভাবিনি।”
“আমি জানি তুমি এমন কিছু ভাবনি। হুট করে প্রপোজ না করলে সারপ্রাইজ দিতাম কীভাবে? তুমি তো আমার সম্পর্কে সবটা জানো ইলোমিলো। প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিয়ো না। সত্যিই ভালোবাসি তোমায়।”
“আপনাকে নিয়ে আমি কখনও এমন কিছু ভাবিনি ভাইয়া।”
“তা-ও জানি। একবার গ্রহণ করেই দেখো না। তারপর তুমিও ভালোবাসার অনুভূতি অনুভব করতে পারবে। আমার ভালোবাসা যদি মিথ্যা না হয়।”

এখন? কী বলব আমি? শ্রেয়ান ভাইয়ার কথাবার্তা আর মুখের অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছে সে কতটা সিরিয়াস। ভাঙা মনের মানুষ উনি। বুকের মধ্যে ভালোবাসার মানুষটাকে হারানোর কষ্ট ধামাচাপা দিয়ে হাসিমুখে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিচ্ছেন। সেই মানুষটা যখন আমাকে নিজের ভালোবাসার মানুষের জায়গায় বসিয়ে বুকের কষ্টগুলোকে নিংড়ে ফেলতে চাইছে, তখন তার মুখের ওপর আমি ‘না’ বলব কীভাবে? ভাঙা মনের মানুষটাকে আমি স্বেচ্ছায় আরও গুঁড়িয়ে দিব কীভাবে? এই যে সে ভীষণ আশাবাদী হয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, ওই দৃষ্টিতে ভয়ানক বর্ষণ ডেকে আনব কীভাবে? এতসব ভাবনা মাথায় নিয়ে আমার মুখ দিয়ে ‘না’ শব্দটা কিছুতেই বের হতে চাইছিল না। আবার হ্যাঁ-ও বলতে পারছি না। শ্রেয়ান ভাইয়া আবার ডাকতেই আমি নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে জিব দিয়ে নিজের শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিলাম। বড়ো একটা দম নিয়ে সাহস জুগিয়ে আমতা-আমতা করে বললাম,
“আমার একটু সময় প্রয়োজন ভাইয়া। আসলে আমি নার্ভাস হয়ে পড়ছি।”
শ্রেয়ান ভাইয়ার মুখ দেখে মনে হলো উনি আমার মুখ থেকে এমন উত্তর আশা করেননি। তবু মিনিট খানেক তাকিয়ে থেকে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“ঠিক আছে। তুমি যখন চাইছো তখন সময় নাও। কিন্তু প্লিজ, ফিরিয়ে দিয়ো না। উত্তরটা যেন পজিটিভ আসে।”
আমি মেকি হেসে বললাম,
“ভেবে দেখব।”
“এটা অন্তত নাও”, হাতের গোলাপগুলো আমার দিকে এগিয়ে ধরে বললেন শ্রেয়ান ভাইয়া।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি ওনার হাত থেকে ফুলগুলো নিলাম। তারপর বললাম,
“এখন আসি।”
“আসি মানে? মাত্রই তো এলে। ফুসকা খাবে না তুমি? তাজ গেল কোথায়?”
“উনি বোধ হয় গিয়ে গাড়িতে বসেছেন। হয়তো আবার শরীর খারাপ করছে। আমি গিয়ে দেখছি। সময় পেলে বাড়ি আসবেন ভাইয়া।”
তাড়া দেখিয়ে কথাগুলো বলেই আমি দ্রুত পায়ে হাঁটা
দিলাম। পেছন থেকে শ্রেয়ান ভাইয়া বারকয়েক ডাকলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলাম না। না শোনার ভান করে যত দ্রুত পারলাম পার্ক থেকে বেরিয়ে এলাম। গাড়ির কাছে গিয়ে বড়ো করে দম নিলাম। ভেতরে যে সাক্ষাৎ যমদূত বসে আছে, না জানি কপালে কী আছে। সাহস জুগিয়ে দরজা খুলে সিটে উঠে বসলাম। দেখলাম মহারাজ শক্তপোক্ত গম্ভীর মুখে দুহাতে স্টেয়ারিং চেপে ধরে বসে আছেন। রাগত কটমটে দৃষ্টি রাস্তায় আবদ্ধ। আমি গলা ঝেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। লাভ হলো না। উনি বিনা বাক্যে গাড়ি স্টার্ট করলেন, তবু আমার দিকে ফিরে তাকালেন না। আমি পুনরায় গলা ঝেড়ে বললাম,
“শ্রেয়ান ভাইয়াকে না বলে চলে এলেন কেন? এখানে এসে তাহলে লাভ কী হলো? যার জন্য এসেছেন তাকে না বলেই তো চলে যাচ্ছেন।”
তাজ ভাই নিরুত্তর। কিছুক্ষণ উত্তরের আশায় তাকিয়ে থেকে আমি আবার বললাম,
“আমরা কি এখন সোজা বাড়ি চলে যাব?”
এবারও নিরাশ হলাম। তারপর নিজেও কিছুক্ষণ চুপ মেরে রইলাম। হঠাৎ মাথায় শয়তানি বুদ্ধি কড়া নাড়ল। হাতের গোলাপগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে আড়চোখে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“গোলাপগুলো সুন্দর না? একদম তাজা। আমার খুব ভালো লেগেছে।”
সঙ্গে সঙ্গে জোরেশোরে গাড়ি ব্রেক কষার শব্দ হলো। আমি দাঁতে জিব কেটে সুনামির অপেক্ষা করলাম। তাজ ভাই ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে ফুলগুলো কেড়ে নিলেন। আমি হন্তদন্ত হয়ে বললাম,
“আরে, ফুল নিচ্ছেন কেন?”
“বড্ড‌ বেশি সুন্দর।”
গম্ভীর শান্ত স্বরে কথাটা বলেই উনি ফুলগুলো জানালা দিয়ে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। আমি আহাজারি করে বলে উঠলাম,
“এটা কী করলেন? এত সুন্দর ফুলগুলো রাস্তায় ফেলে দিলেন?”
“গাড়ি থেকে বের হ”, আমার দিকে না তাকিয়েই শক্ত মুখে বললেন তাজ ভাই।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
“কেন? আমি বাড়ি যাব কীভাবে?”
“পেছনে গিয়ে বোস।”
“না”, ত্যাড়াভাবে বললাম আমি।
সঙ্গে সঙ্গে তাজ ভাই ধমকে উঠলেন,
“এক ধাক্কায় রাস্তায় ফেলে দিব, ইডিয়ট। পেছনে যেতে বলেছি না?”
আমি অসহায় মুখে বললাম,
“এমন করছেন কেন? একা একা পেছনে বসে থাকতে ভালো লাগবে আমার?”
“তোকে যেতে বলেছি।”
“প্লিজ।”
“আর একটা কথা বললে একদম শুট করে দিব। চুপচাপ পেছনে যা।”
ধমকের সুরে কথাটা বলতে বলতে উনি আমার দিকে ফিরে তাকালেন। উনি তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে আমি ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
“শ্রেয়ান ভাইয়া এমন কিছু করবে আমি ভাবতেও পারিনি। ওনার কথাবার্তায় বুঝলাম যে উনি সিরিয়াস, আর আমি ফিরিয়ে দিলেও খুব কষ্ট পাবেন। আমি চাই না উনি আমার জন্য কষ্ট পান। তাই আমি সময় চেয়েছি। উনি আমাকে সময় দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আমি কোনোকালেই ওনাকে একসেপ্ট করার কথা ভাবতে পারব না। ওনাকে বুঝিয়ে বলব। সময় নিয়ে বুঝিয়ে বললে হয়তো উনি কিছুটা হলেও কম কষ্ট পাবেন। ওনার প্রতি আমার বিশেষ কোনো অনুভূতি নেই। সত্যি বলছি।”
তাজ ভাই গম্ভীর মুখে আমার কথা শুনলেন। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিলেন। এটা কি স্বস্তির নিঃশ্বাস না কি? উনি চোখ খুলে দ্বিতীয়বার আর আমার দিকে তাকালেন না। গুমোট মুখে গাড়ি স্টার্ট করলেন। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। মাঝে মাঝে আড়চোখে ওনার দিকে তাকালাম। রাগত ভাবটা এখন আর নেই। তবে গম্ভীর ভাবটা বিদ্যমান। এদিকে ফুলগুলো হারিয়েও আমার খানিক মন খারাপ হলো। এত সুন্দর ফুলগুলোর ওপর রাগ ঢেলে কী লাভ হলো? শয়তান লোক!

আমাকে বাড়িতে রেখে তাজ ভাই আবার বাইরে বেরিয়েছেন। সেই যে বেরিয়েছেন, তারপর ফিরেছেন রাত দশটায়। অনেকদিন পর আজ তাজ ভাই, বাবা আর আমি একসাথে ডিনার করেছি। তবে আমি খেয়াল করেছি তাজ ভাই প্রয়োজন ছাড়া আমার সাথে কথা বলছেন না। যা-ই হোক, আজ আমার ঘুম প্রয়োজন। গতরাতেও ঘুমাতে পারিনি। আজ লম্বা একটা ঘুম দিয়ে মনটা রিফ্রেশ করব। করলামও তাই। খেয়েদেয়ে গিয়ে যে বিছানায় সটান শুয়ে ঘুম দিলাম। এক ঘুমে রাত কাবার। পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম বাবার ডাকে। তাজ ভাই আসার পর বুঝি বাবা আজই প্রথম ডাকল। প্রতিদিন তো উনিই ডেকে দেন, আজ কী হলো? এটা নিয়ে বেশি ভাবলাম না। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে নামতে যেতেই শিয়রের কাছে চোখ পড়ল। ভাঁজ করা চিরকুট আর এক গুচ্ছ লাল গোলাপ। এই চিঠির প্রাপককে আমার ভালো করেই চেনা আছে। এর আগেও এমন অনেক চিঠি পেয়েছি। কিন্তু আজ কেন জানি মনটা খুশিতে নেচে উঠল। ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠল। তড়িঘড়ি করে কাগজটা হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরলাম।

বনলতা,
যেদিন মা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। জীবনে প্রথমবার সেদিন আমি বড্ড অসহায় বোধ করেছিলাম। দ্বিতীয়বার অসহায় বোধ করেছিলাম যেদিন বাবাও আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আর আজ তৃতীয়বারের মতো নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। প্রথম আর দ্বিতীয়বার হারানোর ব্যথায় নিজেকে অসহায় মনে হয়েছিল। আর আজ হারানোর ভয়ে। হারানোর ভয় যে কী ভয়ংকর পীড়া দেয়, তা তুমি বুঝবে না। কারণ তুমি কখনও এটা টের পাওনি। এই যে আমার বুকের বাঁ পাশে ফোটন কণার অস্তিত্ব অনুভব করছি। তীব্র হাহাকারে শ্বাসকষ্টে ভুগছি। বিনিদ্র রাতের ঘোর অন্ধকার হাতড়ে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। এসব যদি তুমি নিজের বেলায় টের পেতে, তাহলে হয়তো তুমি নিজেকে সামলাতে পারতে না। ভেবেছিলাম আজ রাতে খুব করে একটা শান্তির ঘুম দিব। অথচ তুমি আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে নিজে পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছ। ইচ্ছে করছিল তোমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে জিজ্ঞেস করতে, হারানোর ভয় এত বাড়াচ্ছ কেন? তোমাকে বলেছিলাম না, আমি তোমাকে হারানোর ভয় পাই? তবে কেন এত বাড়াবাড়ি রকমের ভয়ে তটস্থ করে দিচ্ছ আমায়? মাকে হারানোর পর আমাকে বাবা সামলেছে। বাবাকে হারানোর পর ভাইয়া সামলেছে। সেই ভাইকে সুদূর সুইডেন রেখে আমি তোমার কাছে আশ্রয় খুঁজেছি। তোমাকে হারিয়ে ফেললে আমাকে কে সামলাবে? তোমার কাছে আছে এর উত্তর? বলবে আমাকে? আমার কাছে একটা উত্তর আছে। বলব? তোমাকে হারালে আমার শ্বাসটুকুও বন্ধ হয়ে যাবে। বিশ্বাস করো, স্রেফ বন্ধ হয়ে যাবে। তোমার কাছে একটা জিনিস চাইব, দিবে? এটাই তোমার কাছে আমার প্রথম এবং শেষ চাওয়া। জীবনে কোনোদিনও আর কিচ্ছু চাইব না। তোমার কাছে বাকি জীবনের জন্য একটু সুখের আশ্রয় দিবে? সুখ শব্দটার ওপর আমার বড্ড বেশি লোভ। তবে সেটা শুধু এবং শুধুই তোমার থেকে চাই। দিবে?

চিরকুট পড়া শেষ করতেই এতক্ষণের দলা পাকানো কান্নারা বাঁধ ভাঙল। দু ফোঁটা অশ্রু চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ল চিরকুটের ওপর। বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করলাম। সামান্য একটা চিরকুটই তো। এতটা যন্ত্রণা মাখিয়ে কেন লিখতে হবে? আজকাল যে আমারও বুকে ব্যথা হয়, তা কি সে টের পায় না? চিরকুট হাতে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে থম মেরে বসে মিনিট পাঁচেক চোখের অশ্রু ঝরালাম। তারপর গোলাপগুলো হাতে নিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম। এ কেমন অনুভূতি! এমন অসহ্যকর অনুভূতি সহ্য করার ক্ষমতা তো আমার নেই। কাবার্ডের একপাশে গোলাপ আর চিরকুট রেখে দ্রুত গিয়ে অজু করে এলাম। তারপর নামাজ আদায় করে রুম থেকে বেরোলাম। এদিক-ওদিক না তাকিয়ে সোজা তাজ ভাইয়ের রুমে চলে গেলাম। আস্তে করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। বিছানা শূন্য। উনি কি এখনও মসজিদ থেকে ফেরেননি? কিন্তু এতক্ষণে তো ফেরার কথা। হঠাৎ বেলকনির দরজা খোলা দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। আমার পা থমকাল। বেলকনির মেঝেতে বসে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন তাজ ভাই। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। মলিন মুখটা মায়ায় ভরা। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওনার মুখোমুখি বসলাম। মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে আমার চোখ ফেটে আবার আশ্রু বেরিয়ে এল। সবেমাত্র আমি ওনাকে ডাকার জন্য মুখ খুলেছি, তখনই উনি চোখ বন্ধ অবস্থাতেই মৃদু কন্ঠে বলে উঠলেন,
“অতি প্রিয় মানুষরা সবসময় ফাঁকি দিতে ভালোবাসে, তাই না?”
পরক্ষণেই আস্তে করে চোখ খুলে আমার চোখে নিজের ঘোলাটে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
“যদি মা ফিরে আসত, তাহলে কেমন হত? আমার সব সুখ ফিরে পেতাম?”
ওনার কথা শুনে এবার আমি ঠোঁট ভেঙে ফুঁপিয়ে উঠলাম। তাজ ভাই শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
“কাঁদছিস কেন?”
সঙ্গে সঙ্গে আমি সব অস্বস্তি ভুলে ওনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। পাঞ্জাবী আঁকড়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে অনবরত কাঁদতে শুরু করলাম। তাজ ভাই আমাকে ধরলেন না, সরিয়েও দিলেন না। যেভাবে বসে ছিলেন চুপচাপ সেভাবেই বসে রইলেন। হয়তো উনি এমন কিছু আশা করেননি। কিছু সময় পর নিচু স্বরে বললেন,
“এখন সুইডেন আর বাংলাদেশের তফাত মাপা হবে না? না কি মেয়ে বলে পার পেয়ে যাবি?”
আমি ওনার কথায় কানও দিলাম না। উনি আবার বললেন,
“আমার চা কোথায়?”
আমি বুঝলাম উনি আমাকে থামানোর জন্য এসব বলছেন। তবু একচুলও নড়লাম না। কান্নার গতি কমলেও আমার চোখের পানি ফুরাচ্ছিল না। তাজ ভাই আবার চুপ মেরে বসে রইলেন। তারপর অনেকটা সময় কেটে গেল। উনি একটা বারের জন্য আমাকে আলিঙ্গনও করলেন না। অতঃপর নিরবতা ভেঙে আমাকে বুক থেকে উঠিয়ে সোজা করে বসিয়ে দিলেন। দুহাতে আলতো করে আমার মুখটা তুলে ধরে চোখের পানি মুছে কপালে ক্ষণিকের জন্য ঠোঁট ছোঁয়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার দুচোখ মুদে এল। হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গেল। তাজ ভাই ফিসফিস করে বলে উঠলেন,
“আমি বেশি জ্বালাই বলে প্রতিশোধ নিচ্ছিস?”
আমি চোখ মেলে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে উনি পুনরায় বললেন,
“আমার না প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাতে দিবি একটু?”
ওনার অসহায় মুখে বাচ্চাদের মতো আবদার শুনে আমার বুকটা কেঁপে উঠল। গাল থেকে ওনার হাত দুটো নামিয়ে নিজের মুঠোবন্দী করে নাক টেনে বললাম,
“কাল সারারাত যে ঘুমাননি। আবার মাথা ব্যথা করেনি?”
তাজ ভাই আমার কথায় মৃদু হাসলেন। তাচ্ছিল্য মাখা হাসি। আমার একহাত নিয়ে ওনার বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরে বললেন,
“এখানে প্রচন্ড ব্যথা করেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়েছে। মরতে মরতে বেঁচে গেছি।”
আমার চোখ দুটো আবার টইটুম্বুর হয়ে উঠল। তা দেখেই তাজ ভাই আমার হাত ছেড়ে দিয়ে ধমকের সুরে বলে উঠলেন,
“এই খবরদার, একদম ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচ করে কাঁদবি না আমার সামনে। অনেকক্ষণ ধরে সহ্য করছি। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। সামনে থেকে বিদায় হ।”
আমি কপাল খানিক কুঁচকে সামনে থেকে সরে ওনার পাশ ঘেঁষে বসে পড়লাম। তাজ ভাই কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। আমি কিছু না বলে চুপচাপ ওনার মুখের দিকে তাকালাম। উনি আমার চোখে চোখ রাখলেন। গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন,
“এত সুখ লাগছে কেন?”
আমার কেন জানি কিছুটা লজ্জা লাগল। ওড়নার কোণা টেনে ওনার মুখের ওপর ফেলে মুখ ঢেকে ফেললাম। উনি ওড়নাটা সরালেন না। কোমল কন্ঠে বললেন,
“ওড়নার ঘ্রাণ শুঁকিয়ে যন্ত্রণা কমানো হচ্ছে, না বাড়ানো হচ্ছে?”
আমি ওড়নায় ঢাকা ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসলাম। উত্তর না দিয়ে চুপচুপ ওনার চুলের ফাঁকে আঙুল চালিয়ে বিলি কাটতে লাগলাম। এতক্ষণের ব্যথায় জখম হওয়া মনে হঠাৎ করেই সতেজতা অনুভব করলাম। এই বিপজ্জনক লোকটাকে আমি এতটা ভালোবেসে ফেললাম কখন? এমন তো কিছু হওয়ার কথা ছিল না। তবু কীভাবে হয়ে গেল? আশ্চর্য!

চলবে………………..?

(হেই জনগণস, অনুভূতি প্রকাশ করিয়া যান।?)

পার্সোনাল গ্রুপ লিংক:
https://www.facebook.com/groups/935884643636506/?ref=share

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here