#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:০৩
কান্নার মধ্যে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়ালই নেই আমার। ঘুম ভাঙার পর দেখলাম বিকেল হয়ে গেছে। কান্নার কারণে মাথাটা একটু ধরেছে। বিছানা ছেড়ে ধীর পায়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি বিধায় ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। জেমিকে নিয়ে খাবার টেবিলে বসে মারজিয়া খালাকে ডেকে বললাম টেবিলে খাবার দিতে। উনি খাবার এনে টেবিলে রাখলেন। জেমিকে ওর প্লেটে মাছ খেতে দিয়ে নিজের প্লেটে খাবার নিলাম। তখনই তাজ ভাইয়া কোত্থেকে এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। দেখলাম তার হাতে ভাঁজ করা একটা সাদা কাগজ। আমি প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম। উনি বাঁকা হেসে কাগজের ভাঁজ খুলে নিজের চোখের সামনে মেলে ধরলেন। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। তাজ ভাইয়া জোরে জোরে পড়তে শুরু করলেন,
ইলো,
গত আট মাস ধরে তোমার সাথে রিলেশনে ছিলাম। কিন্তু কী জানো? আমার মনে হচ্ছে আমি ভুল করেছিলাম। আমার জন্য তুমি পারফেক্ট নও। তোমার চেয়ে আলাইনা অনেক বেটার। তোমার একসাথে ঘুরতে যেতে সমস্যা, বেশিক্ষণ ফোনে কথা বলতে সমস্যা, হাত ধরতে চাইলে সমস্যা, কিস করতে চাইলে সমস্যা, কাপল পিক তুলতে চাইলে সমস্যা। এত সমস্যা নিয়ে তোমার রিলেশনে না জড়ানোই ভালো। তাছাড়া তুমি এত আহামরি সুন্দরীও না যে আমি তোমার প্রেমে পাগল হয়ে যাব। রিলেশনে ছিলাম, আজ থেকে ব্রেকআপ। আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো না। এক সপ্তাহ পর আমি লন্ডন চলে যাব। হঠাৎ করেই বাবা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাই আমিও না করিনি। ওখান থেকে ফিরে এসে আলাইনাকে বিয়ে করব। নিজের মতো কাউকে খুঁজে নিও। ভালো থেকো। আল্লাহ্ হাফেজ।
নেহাল।
চিঠি পড়া শেষ করে তাজ ভাইয়া আমার দিকে তাকালেন। আমি ইতোমধ্যে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছি। এই চিঠি ওনার হাতে গেল কীভাবে? এটা তো আমার ব্যাগে ছিল। তার মানে উনি আমার রুমে গিয়ে ব্যাগ থেকে এটা বের করেছেন। একদিকে রাগ লাগছে আরেকদিকে ভয় লাগছে। এসব যদি উনি বাবাকে দেখান? বাবা আমাকে খুব বেশি ভালোবাসলেও আমি বাবার রাগকে ভয় পাই। ভার্সিটিতে গিয়েই আমি কারো সাথে রিলেশনে জড়িয়ে গেছি শুনলে তিনি কেমন রিয়েক্ট করবে কে জানে? এই তাজ ভাইয়াকেই যেভাবে হোক বুঝাতে হবে। তাজ ভাইয়া ভ্রু নাচিয়ে বললেন,“কী? এই বয়সে এতদূর! এইটুকু একটা পিচ্চি কি না আটমাস রিলেশনে ছিল আবার এখন ব্রেকআপও হয়েছে। হায় আল্লাহ্! মাটি ফাঁক করো আমি ঢুকে পড়ি।”
আমি বিরক্ত মুখে তার দিকে তাকালাম। আমার বয়স ১৮+। নিঃসন্দেহে আমি একজন এডাল্ট। আর উনি কি না বলছেন আমার এইটুকু বয়স! আমার ক্লাসমেটদের অনেকের তো বিয়ে হয়ে বাচ্চাও হয়ে গেছে। তাজ ভাইয়া বললেন,“তুই এডাল্ট কোন দিক থেকে বুঝা আমাকে। বয়সেই শুধু বড়ো হচ্ছিস। আর সবদিক থেকেই তুই সেই এইটুকুন পিচ্চিই আছিস।”
আমার মুখটা হা হয়ে গেল। এই শয়তানটা কি মাইন্ড রিড করতে জানে না-কি? হায় হায়! এখন তো মনে হচ্ছে মনে মনেও কোনো কথা বলা যাবে না। তাজ ভাইয়া আবার বললেন,“বোবা হয়ে গেছিস?”
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। উনি প্রশ্ন করলেন,“ছেলেটা কে?”
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি ওনার ফোনটা আমার সামনে তুলে ধরে বললেন,“বলবি না-কি এই ছবি আর চিঠি মামুকে দেখাব?”
আমি চোখ বড়ো করে তার দিকে তাকালাম। তার ফোনে আমার আর নেহালের একটা সেলফি। নেহালই একদিন আমার ফোন দিয়ে সেলফিটা তুলেছিল। এটা ওনার ফোনে গেল কীভাবে? নিশ্চয়ই আমার ফোন থেকে চুরি করেছে। কী বিপজ্জনক লোক রে বাবা! আজই ফোন লক করতে হবে। উনি বললেন,“সোজাসাপ্টা সবকিছু বলে দিলে দেখাব না।”
এতক্ষণে আমার মুখ থেকে কথা বের হলো,“কী নিশ্চয়তা আছে যে বলবেন না?”
“আমি কথা রাখতে জানি। বলে ফেল।”
ওনার কথায় দৃঢ়তা স্পষ্ট। মনে হলো সত্যিই উনি বলবেন না কিছু। সবকিছু বললে হয়তো এগুলো ফেরত দিয়ে দিবেন। আমি সাহস জুগিয়ে বলতে শুরু করলাম,“নেহাল আমাদের ভার্সিটিরই স্টুডেন্ট। এবার অনার্স শেষ করেছে। আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পরপরই ও আমাকে প্রপোজ করেছিল। প্রথমে একসেপ্ট করিনি। রিলেশনে জড়ানোর ইচ্ছে ছিল না আমার। কিন্তু ও প্রতিদিন আমার পেছনে ঘুরত। আমাকে অনেক বুঝাত। তারপর আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো আমাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসে। আমি ওকে একসেপ্ট করি ঠিকই কিন্তু ওর সাথে আমার কোনো কিছুরই মিল ছিল না। ও আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চাইত কিন্তু আমি বাবার সাথে ভার্সিটিতে যাই আসি, আর ক্লাসও কামাই করতে নারাজ ছিলাম। কথায় কথায় ও আমাকে ছুঁতে চাইত কিন্তু আমি বাঁধা দিয়ে বলতাম এসব আমার অপছন্দ। কাপল পিক তুলতে চাইত সবসময় কিন্তু আমার ভালো লাগত না। এই পিকটা ও অনেক জোরাজুরি করায় তুলেছিলাম। ফোনে বেশিক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছে করে না আমার তাই ও রেগে যেত। তবু আমার বিশ্বাস ছিল ও আমাকে ভালোবাসে। আলাইনা আপু হচ্ছে ওর ক্লাসমেট। আপু ওকে অনেক পছন্দ করে। প্রপোজও করেছিল কিন্তু ও তখন আমার সাথে রিলেশনে ছিল বলে রিজেক্ট করেছিল। মাঝে মাঝেই ও আমার ওপর রেগে যেত আর আমি ডিপ্রেশনে চলে যেতাম। রাগ আবার ভেঙেও যেত। আটমাসের রিলেশন হলেও আমাদের মধ্যে খুব বেশি কথা হয়নি। আর সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হচ্ছে ওর সাথে কথা বলার সময় বা দেখা করলে আমার প্রচন্ড অস্বস্তি হত। আট মাসেও আমি অস্বস্তি কাটাতে পারিনি। কিন্তু এতদিন পর ও যে এমন কিছু করবে তা আমি ভাবতেও পারিনি। এই চিঠিটা ও আমার এক ফ্রেন্ডকে দিয়ে পাঠিয়েছে।”
আমার চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল। তাজ ভাইয়া খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলো শুনলেন। তারপর কিছু একটা ভেবে প্রশ্ন করলেন,“ও কি বিয়ের ব্যাপারে কখনও কিছু বলেছে?”
আমি দুদিকে মাথা নেড়ে বললাম,“না।”
“জিজ্ঞেস করিসনি?”
“করেছিলাম একবার। ও বলেছিল ওর পড়াশুনা শেষ করে কোনো জব জয়েন না করা পর্যন্ত এ ব্যাপারে কাউকে কিছু জানাবে না।”
তাজ ভাইয়া আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বললেন,“আমার সাথে আয়।”
বলেই উনি নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলেন। ওনার হাবভাব কিছু বুঝে উঠতে না পেরে অগত্যা ওনার পেছন পেছন রুমে গেলাম। উনি ওনার ফোন নিয়ে বিছানায় বসেছেন। আমি অদূরে দাঁড়িয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম। উনি কিছুক্ষণ ফোন ঘেঁটে আমাকে বললেন,“এখানে বস।”
আমি গিয়ে ওনার থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসলাম। ফোনের দিকে চোখ যেতেই দেখলাম উনি কারো সাথে চ্যাটিং করছেন। তখনই একটা অডিও কল এল। উনি রিসিভ করে কথা বলতে শুরু করলেন,“হ্যাঁ শ্রেয়ান। শ্রোতা আমার পাশেই আছে।”
ওপাশ থেকে একটা পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে এল,“হ্যালো ইলোরা। কেমন আছো?”
আমি অবাক হয়ে গেলাম। এ আবার কে? মনে তো হচ্ছে আমাকে চেনে। আর তাজ ভাইয়া আর তার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে আগে থেকেই আমার সাথে কথা বলার প্ল্যান করে রেখেছেন। প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাজ ভাইয়ার দিকে তাকাতেই উনি বললেন,“আমার ফ্রেন্ড। কথা বল।”
আমি ইতস্তত করে উত্তর দিলাম,“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি ভাইয়া। আপনি?”
শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“আলহামদুলিল্লাহ। শোনো আমি তোমাকে আমার লাভ স্টোরি শোনাব। আমার হাতে এখন বেশি সময় নেই কথা বলার মতো। সংক্ষেপে বলি কেমন?”
আমি আরও অবাক হলাম। চিনি না জানি না, কিসের লাভ স্টোরি শুনব? আর লোকটাই আমাকে নিজের লাভ স্টোরি শুনাবে কেন? তাজ ভাইয়া ফিসফিস করে বললেন,“চুপচাপ শুনে যা। কোনো কথা বলবি না।”
তারপর ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,“বল।”
শ্রেয়ান ভাইয়া বলতে শুরু করলেন,“ভার্সিটি লাইফে আমার এক ক্লাসমেটের সাথে আমার রিলেশন ছিল। মেয়েটা যেমনি সুন্দরী তেমনি ভীতু ছিল। নাম ছিল রামিশা। আমিই ওকে প্রপোজ করেছিলাম। ও নিজেও আমাকে পছন্দ করত তাই একসেপ্ট করেছিল। ওর বাবার ভয়ে ও কখনও আমার সাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সাহস পেত না। এমনকি ফোনেও কথা হত না। ওর বাবা খুবই কঠিন মানুষ ছিলেন। ওকে ফোন ইউজ করতে দিতেন না। কাউকে ফোন করার প্রয়োজন হলে ওর মায়ের ফোন থেকে করত। কিন্তু আমাকে করার সাহস পেত না। প্রতিদিন ভার্সিটিতে আমাদের দেখা হত। আমরা পুরোটা সময় একসাথে কাটাতাম। প্রথম প্রথম ওর মধ্যে কিছুটা জড়তা ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে সেটা কাটিয়ে উঠেছিল। আমরা একসাথে যতটুকু সময় কাটাতাম তার পুরোটা সময় গল্প করেই কাটাতাম। দুজনের ফ্যামিলির গল্প, ছোটো বেলার গল্প, কবে কার জীবনে কী ঘটল সেসব গল্প, আমাদের স্বপ্নের বিয়ের গল্প, ভবিষ্যতের গল্প। এই এত এত গল্প আর স্বপ্ন বোনার মধ্যে কখনও ওকে ছুঁয়ে দেখার কথাও মাথায় আসেনি। সবসময় মনে হত ও তো আমারই। একদিন না একদিন ও আমারই হবে। পাশে আছি, কত স্বপ্ন আর গল্পের ডালা সাজাচ্ছি এর বেশি আর কী লাগে? মাঝে মাঝে ওকে সামান্য কিছু উপহার দিতাম। ও সেসব সামান্য উপহারকে অনেক মূল্যবান মনে করত। সামান্য উপহার পেয়ে ওর চোখেমুখে যে খুশি দেখতাম তা বোধ হয় কোনো দামি উপহারে দেখা সম্ভব হত না। এভাবে দিন, মাস, বছর পেরিয়ে আমাদের সম্পর্কটা চার বছর গড়িয়েছিল। ততদিনে আমরা দুজন দুজনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলাম। একটা সময় বুঝলাম ওই ভীতু মেয়েটা আমাকে আমার থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসে। এই একই ধারণা ওরও ছিল যে ওর থেকে আমি বেশি ভালোবাসি। ওকে একটা দিন না দেখলে দমবন্ধ হয়ে আসত। কখনও কখনও ওর বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম। ও কখনও বেলকনিতে এলে দেখা হত, তা না হলে ফেরত যেতাম। চার বছর পর হঠাৎ ও পরপর কয়েকদিন ভার্সিটি কামাই করে। আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলাম ওর দাদা অসুস্থ তাই ওর পুরো ফ্যামিলি ওর দাদা বাড়ি গেছে। ওর সাথে যোগাযোগ করার কোনো উপায় ছিল না। অস্থির হয়ে পড়েছিলাম আমি। বারবার মনে হচ্ছিল ওকে আমি হারিয়ে ফেলব। অপেক্ষা করতে থাকলাম কবে ও ফিরবে আর কবে ওকে একটাবার দেখব। এক সপ্তাহের মাথায় ও ফিরেছিল। ভার্সিটিতেও গিয়েছিল কিন্তু সেদিন ও একা যায়নি। ওর সাথে ওর হাসবেন্ডও ছিল। ওর আসার খবর পেয়ে আমি ছুটে গিয়েছিলাম ওর সাথে কথা বলার জন্য। সামনে গিয়ে ওর মলিন মুখটা দেখে আমার বুকটা ধক করে উঠেছিল। ওর হাসবেন্ডের সামনেই ও আমাকে দেখে কান্না করে দিয়েছিল। আমি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ওর হাসবেন্ড ওকে বুকে টেনে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছিল। ততক্ষণে আমার যা বোঝার বুঝে গিয়েছিলাম। নিজের চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে অন্য একটা পুরুষের বুকে দেখা ঠিক কতটা কষ্টকর তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল ওকে টেনে নিজের বুকে নিয়ে আসতে। কিন্তু একটা প্রশ্ন মাথায় জেঁকে বসেছিল যে ও কেন এমনটা করল। ওর হাসবেন্ডকে ও আমার কথা জানিয়েছিল। লোকটা অসম্ভব ভালো একজন মানুষ। সে আমাকে সবকথা খুলে বলেছিল। রামিশার দাদা ওর জন্য ওই পাত্র ঠিক করে রেখেছিলেন। ওর বাবা তাই নিজের বাবার কথা রাখতে ওই ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। ও খুব বেশি ভীতু ছিল বিধায় ওমন পরিস্থিতিতে সাহস করে আমার কথা কাউকে জানাতে পারেনি। তাছাড়া আমি তখন স্টুডেন্ট ছিলাম। বাসর রাতেই ওর হাসবেন্ডকে ও আমার কথা বলেছিল। সেদিন ও কান্না ছাড়া আমার সাথে একটা কথাও বলতে পারেনি। ওর হাসবেন্ড আমাকে অনেক বুঝিয়েছিল। এটাও বলেছিল যে আমি চাইলে ওকে সে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। কিন্তু আমি এতটা স্বার্থপর হতে পারিনি। কারণ এমনটা করলে ওর ফ্যামিলি ওকে ত্যাজ্য করত। সেদিন বুকে পাথর চেপে ওকে ওর হাসবেন্ডের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। খুব ইচ্ছে করছিল ওকে একবার ছুঁয়ে দেখতে। চার বছরের রিলেশনে তো আমি কখনও ওকে ছুঁয়ে দেখিনি। কিন্তু সেদিন আর সেটা সম্ভব ছিল না।”
এটুকু বলে শ্রেয়ান ভাইয়া থামলেন। তার নাক টানার শব্দ পেলাম। বুঝতে পারলাম উনি কাঁদছেন। আমার চোখ দিয়েও অনবরত পানি পড়ছে। তাজ ভাইয়া থম মেরে বসে আছেন। দমবন্ধ করা মুহূর্ত তৈরি হয়েছে। শ্রেয়ান ভাইয়া নিজেকে সামলে আবার বলতে শুরু করলেন,“তারপর ওর হাসবেন্ড ওকে নিয়ে আমেরিকা চলে গিয়েছিল। ওর সাথে আর কখনও দেখা বা কথা হয়নি আমার। কিন্তু ওর হাসবেন্ড এখনও মাঝে মাঝে আমাকে ফোন করে। ওর এখন এক বছরের একটা বেবি আছে। কিন্তু ও আজও আমাকে ভুলতে পারেনি। ও তো সংসার নিয়ে আছে আর আমি ওকে হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে বাস্তবতা মেনে নিয়ে স্বাভাবিকও হয়ে গেছি। তবু মাঝে মাঝে কষ্টটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তখন আর নিজেকে সামলাতে পারি না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। আমি নিজেই ওকে বলেছিলাম আমার সাথে যোগাযোগ না করতে। তাহলে যে আমি নিঃশ্বাসটুকুও নিতে পারতাম না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর কোনো মেয়েকেই জীবনের সাথে জড়াবো না। কারণ এই জীবনে আর দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ওর স্মৃতি নিয়েই বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিব। কী জানো তো? কারোর জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। কিন্তু বড্ড অগোছালো হয়ে যায়। এমনই অগোছালো হয় যে প্রত্যেকটা শ্বাস নিঃশ্বাস তখন প্রচন্ড বিষাক্ত লাগে।”
এরপর শ্রেয়ান ভাইয়া ফট করে লাইনটা কেটে দিলো। নিশ্চয়ই এখন চিৎকার করে কাঁদছেন। এতটা ভালোও কেউ কাউকে বাসতে পারে জানা ছিল না আমার। শ্রেয়ান ভাইয়া আর রামিশা আপুর সাথে আমার আর নেহালের তুলনা করলাম। মুহুর্তে মনে হলো আসলে আমরা কেউ কোনোদিন কাউকে ভালোই বাসিনি। যেটা ছিল সেটা শুধুমাত্রই আবেগ আর মোহ। ভালোবাসায় যদি খানিক পাগলামিই না থাকে তবে সেটা কিসের ভালোবাসা? কই? নেহাল আর আমার মধ্যে তো কোনো পাগলামি ছিল না। ও আমাকে ছেড়ে দেয়ার পর আমার খারাপ লেগেছে ঠিকই কিন্তু দমবন্ধ করা কষ্ট তো হয়নি। তার মানে এটা ভালোবাসা না! তাজ ভাইয়া ফোনটা রেখে আমার দিকে তাকিয়েই বললেন,“কখনোই না। এটা ভালোবাসা ছিল না। যে ছেলে ব্রেকআপের এমন ফালতু কিছু কারণ দেখাতে পারে সে আর যাই হোক ভালোবাসতে পারে না। ভালোবাসা তো দূরের কথা, তোর প্রতি তো ওর ভালো লাগাই ছিল না। ওর মোহ ছিল তোর প্রতি। ও তোকে মনের চোখে দেখেনি কখনও। দেখলে অন্তত এটা বলতো না যে তুই ওর জন্য পারফেক্ট না। শ্রেয়ানের সাথে মিলিয়ে দেখ, ও কোনোদিনই তোকে ভালোবাসেনি। এমনকি তুইও বাসিসনি। তাই এসব ফালতু ছেলের জন্য কেঁদেকেটে চোখের মূল্যবান পানিটুকু নষ্ট করিস না। সঠিক চিন্তা ভাবনা করতে শিখ।”
আমি মুখ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। সত্যিই আবেগের বশে অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছি আমি। আবেগকে ভালোবাসা ভেবে বসে আছি। মনে মনে ঠিক করলাম আর কখনও এমন ফালতু কারণে কাঁদব না। তখনই তাজ ভাইয়া তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,“আমার রুমে সাগরের দরকার নেই। বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদ গিয়ে। তোর আদরের নেহাল তার আলিমুন ওরফে আলুকে নিয়ে দিব্বি আছে। তোর মতো মাথামোটাকে কে ভালোবাসবে? মাথায় তো শুধু গোবর ঠাসা। একটুখানি পিচ্চি, তার আবার বিরহ! যা গিয়ে ফিডার খা গাধি।”
আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। এমন একটা শোকাহত মুহূর্তে এমন কথা বলা শুধু এই লোকের পক্ষেই সম্ভব। একটু আগেই তো কী সুন্দর কথা বলে বুঝাচ্ছিল। আর এখন দেখ। শয়তান মাথায় চেপেছে। একটু আগের মতো সবসময় সুন্দর করে কথা বললে কী এমন ক্ষতি হত? জন্মের পর এই লোকের মুখে মধু দিতে বোধ হয় ভুলে গিয়েছিল ফুপি। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,“এমন মোমেন্টেও আপনার বাজে কথা না বললে চলে না?”
তাজ ভাইয়া বিদ্রুপ করে বললেন,“সত্য কথা বলেও শান্তি নেই দেখছি। আমার মতো সত্যবাদী ছেলেকে থামানো তোর মতো মাথামোটার কর্ম নয়।”
“আপনি সত্যবাদী!”
“কোনো সন্দেহ নেই। যা ভাগ এখান থেকে। এরপর থেকে আমার রুমে বেশিক্ষণ থাকবি না।”
আমি রগত কন্ঠে বললাম,“আমি কি ইচ্ছে করে এসেছি? আপনি নিজেই তো আমাকে ডেকে আনলেন।”
বলেই রেগেমেগে ওনার রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। উনিও পেছন পেছন এলেন। উনি গিয়ে খাবার টেবিলে বসে পড়লেন। আমি অবাক হলাম। এখনও দুপুরের খাবার খায়নি না-কি? এর সাথে বসে খাবার খেলে খাবারের থেকে বেশি বাজে কথা গিলতে হবে। তাই ঘুরে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। তিন কদম ফেলতেই পেছন থেকে তাজ ভাইয়া খপ করে হাত ধরে টেনে নিয়ে একটা চেয়ারে বসালেন। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,“কী সমস্যা আপনার?”
তাজ ভাইয়া পাত্তা না দিয়ে বললেন,“চুপচাপ খেয়ে নে। মামু আমাকে বলেছে তোকে দেখে রাখতে। এখন তুই না খেয়ে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়লে মামু ভাববে আমি তার মেয়ের খেয়াল রাখিনি। তোর জন্য আমার মামুর কাছে আমার প্রেস্টিজ পাংচার হবে তা আমি কিছুতেই বরদাস্ত করব না। নইলে তোর খেয়াল রাখব, অত ঠেকা পড়েনি আমার।”
“আমি খাব না এখন।”
“তুই কি চাইছিস ওই পিক আর চিঠি মামুর হাতে পড়ুক?”
“আপনি আমার রুমে কেন ঢুকেছিলেন? আর আমার জিনিস চুরি কেন করেছেন?”
“আমার ধারণা ছিল রুম থেকে কিছু ক্লু অবশ্যই পাওয়া যাবে। আর এটাকে চুরি না ইনভেস্টিগেশন বলে।”
“আসছে আমাদের আজাইরা ডিটেকটিভ রে! আমি তো সবকথা বলে দিয়েছি। আমার জিনিস আমাকে ফেরত দিন এবার।”
তাজ ভাইয়া বাঁকা হেসে সামনের চেয়ারে আরাম করে বসে বললেন,“এত তাড়াতাড়ি না। আমার সব কথা শুনলে দিয়ে দিব। এখন ভাত বেড়ে দে প্লেটে। প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে।”
“তো খাননি কেন এখনও?”
“সেই কৈফিয়ত আমি তোকে দিবো? চুপচাপ কাজ কর।”
আমি রাগে ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে প্লেটে খাবার বাড়লাম। এখন এই চিঠি আর পিকের অছিলায় যে আমার সাথে কী কী শয়তানি করবে আল্লাহ্ জানে। নিশ্চয়ই রীতিমতো ব্ল্যাকমেইল করবে এখন থেকে। সাধে কি আর এই লোককে বিপজ্জনক বলি!
চলবে…………………..?