তাজ ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব:২৭

0
348

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:২৭

রাত প্রায় নয়টা। সায়মা আপুর বিদায়ের মুহূর্ত। সায়মা আপুর মা-বাবা, ভাই-বোন, আপনজনরা কেঁদেকেটে একাকার। এদিকে সায়মা আপু কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়েছে। অজ্ঞান অবস্থাতেই তাকে গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়েছে। মানুষের ভীড়ে আমি একপাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এত কান্নাকাটি দেখে আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এই মুহূর্তে আমার মাথায় ঘুরছে, আমার বিয়ে হয়ে গেলে আমাকেও এভাবে বাবাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে? তাহলে তো বাবা একা হয়ে যাবে। না বাবা, আমি কিছুতেই বিয়ে-টিয়ে করব না। সায়মা আপুকে যে গাড়িতে তোলা হয়েছে, সেটা যেই মুহুর্তে ছাড়ল, সেই মুহূর্তেই আমার হাতে টান পড়ল। আমি হকচকিয়ে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলাম তাজ ভাই। আমি অবাক হয়ে কিছু বলতে চাইলাম। ততক্ষণে উনি আমার হাত ধরে টানতে টানতে কোথাও একটা নিয়ে এলেন। উনি থামতেই আমি হন্তদন্ত হয়ে বললাম,“আরে, এভাবে কোথায় নিয়ে এলেন আমাকে?”

উনি কোনো উত্তর না দিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে সুইচ অফ করে দিলেন। তারপর আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে ফোনটা কেড়ে নিয়ে ওটাও সুইচ অফ করে দিলেন। আমি আবার বললাম,“কী করছেন? ফোন অফ করলেন কেন? আমার ফোন দিন।”

উনি ভ্রুকুটি করে আমার দিকে তাকালেন। তারপর আবার আমার ডান হাতটা নিজের বাঁ হাতের মুঠোয় নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালেন। অগত্যা আমিও ওনার সাথে পা মিলালাম। পা বাড়াতে-বাড়াতে আবার প্রশ্ন করলাম,“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”

উনি তবু চুপ। ওনার মধ্যে উত্তর দেওয়ার কোনো উপসর্গ না দেখে আমি এদিক-ওদিক তাকালাম। এতক্ষণে খেয়াল হলো যে এই রাস্তায় কোনো ল্যাম্পপোস্ট নেই। চাঁদের আলোয় যেটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে বুঝলাম রাস্তাটা বেশ নির্জন। দুপাশে বোধ হয় সারি-সারি গাছ। আকাশের দিকে তাকাতেই থালার মতো চাঁদটা চোখে পড়ল। রাত বোধ হয় দশটা। তাজ ভাইয়ের হাতের মুঠোয় আমার হাত বন্দী। ধীর গতিতে পা চালিয়ে হাঁটছি তো হাঁটছি, থামা-থামির কোনো নাম নেই। হাঁটতে হাঁটতে আমার মনটাও বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল। আবেগী মন কড়া নেড়ে বলল,“তোমার ইচ্ছে ছিল না, কোনো এক ভরা জ্যোৎস্না রাতে কারো হাতে হাত রেখে, নির্জন রাস্তা ধরে উদ্দেশ্যহীন পথ চলতে? দেখো, আজ কেউ একজন তা পূর্ণ করল। মাইন্ড রিডার বলে কথা!”

সঙ্গে সঙ্গে আমি তাজ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। উনি সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে পথ চলছেন। চাঁদের আলোয় ওনার অস্পষ্ট মুখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করলাম,“আর কত হাঁটব?”

উনি আমার দিকে না তাকিয়েই উলটো প্রশ্ন করলেন,“পা ব্যথা করছে?”

“নাহ্। আমাদের গন্তব্য?”

“অজানা।”

“এই রাত-বিরেতে আপনার সাথে আমি অজানা গন্তব্যে হাঁটব কেন?”

“বাধ্য।”

“কেন? আপনি আমার কে হন যে বাধ্য হব?”

“কেউ না।”

“তাহলে?”

উনি আবার নিশ্চুপ। আমিও মাঝপথে প্রশ্ন থামিয়ে দিলাম। মিনিট পাঁচেক পর উনি নিজেই মুখ খুললেন। আপন মনে বলে উঠলেন,“হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, সাদা শাড়ি পরে মেয়েরা অনায়াসে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার সাথে মিশে যেতে পারে। কথাটা মন্দ বলেননি।”

কথাটা শেষ করেই আবার ঠোঁটে নেড়ে আওড়ালেন,

“শুভ্র শাড়ি পরিহিতা রমণীর
জ্যোৎস্না বিলাসের আকাঙ্ক্ষা থাকবে কেন?
এ তো অন্যায়! ঘোর অন্যায়!
সে কি জানে না, তার নজরকাড়া সৌন্দর্যে
চাঁদও বিমোহিত হয়ে লজ্জায় মুখ লুকায়?
এরূপ অন্যায়ের শাস্তিস্বরূপ
তাকে আমৃত্যু শুভ্র শাড়ি পরিয়ে,
চাঁদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে রাখা হোক।
চাঁদ হিংসুটে হয়ে আহাজারি করুক
তার রূপের পবিত্র মহিমায়।”

আমি স্থির মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনলাম। আবেগগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আমি মৃদু হেসে বললাম,“চাঁদ একজন সঙ্গীর অভাবেও আহাজারি করুক, যে ইনডিরেক্টলি তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করছে না।”

তাজ ভাইয়ের মুখ দেখে মনে হলো উনি মৃদু হাসলেন। আমি লম্বা একটা দম নিয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললাম,“মোহনা বলছিল, আপনি খুব বেশি অধিকার দেখিয়ে ফেলছেন আমার ওপর। কথাটা ফেলতে পারিনি। এমন অধিকাররে মানে কী?”

জবাবে উনি নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী আমার হাতটাকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরলেন। কিন্তু কোনো জবাব দিলেন না। আমি পুনরায় হতাশ হলাম। অনেক ভেবেচিন্তে বেশ ভালো একটা প্রশ্ন বের করেছিলাম। শয়তানটা তারও জবাব দিলো না। আমি প্রশ্ন করলে বোধ হয় ওনার ঘাড়ে বোবা ভূত চেপে বসে। হাঁটতে-হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছি। এর মধ্যে এই রাস্তা ধরে কয়েকটা ভ্যান গাড়ি আর চার-পাঁচজন পথচারী দেখেছি। তারা আমাদের দেখে বেশ অবাক চোখে তাকালেও কোনো প্রশ্ন করেনি। অবশেষে তাজ ভাই পা থামালেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। পরক্ষণেই চারদিকে চোখ বুলিয়ে ঠোঁট উলটে বললাম,“আর হাঁটতে পারব না, পা ব্যথা করছে।”

উনি পকেট থেকে নিজের ফোন বের করে সুইচ অন করলেন। তারপর কাকে যেন ফোন করে বললেন,“চলে এসেছি, তুই কোথায়? তাড়াতাড়ি আয়।”

উনি ফোন রাখতেই আমি প্রশ্ন করলাম,“কাকে ফোন করলেন?”

“ফ্রেন্ড।”

“এখানে আপনার ফ্রেন্ড এল কোত্থেকে? বাড়ি-ঘর তো কিছুই দেখছি না।”

“সামনেই আছে।”

“তাদের বাড়িতে যাবেন?”

“হুম।”

“ধুর? এত রাতে কারো বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না আমার।”

উনি আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বন্ধুর অপেক্ষা করতে লাগলেন। আমি কয়েকবার বললাম,“চলুন, বাড়ি ফিরে যাই।” উনি আমার কথা শুনেও শুনলেন না। মিনিট দশেক পার হতেই হাতে টর্চ লাইট নিয়ে আমাদের দিকে ছুটে এল একজন শ্যাম বর্ণের বেঁটে লোক। আমাদের দেখেই লোকটার চোখে-মুখে খুশি খেলে গেল। মনখোলা হাসি দিয়ে তাজ ভাইয়ের সাথে কোলাকুলি করে গদগদ কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,“আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?”

তাজ ভাইও হেসে বললেন,“না।”

“গাড়ি নিয়ে আসিসনি?”

“না হেঁটে এসেছি।”

লোকটা অবাক হয়ে বললেন,“এতদূর হেঁটে এলি!”

তাজ ভাই হাসিমুখেই আমাকে দেখিয়ে বললেন,“মিট উইথ ইলোরা।”

লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বললেন,“আরে বাহ্! তোর থেকে তো ভাবি বেশি সুন্দর। কেমন আছেন ভাবি?”

আমি ড্যাবড্যাব একবার লোকটার দিকে আরেকবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তাজ ভাই বলে উঠলেন,“ভালো আছে।”

আমি এবার ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেললাম। লোকটা ভাবি ডাকা সত্ত্বেও উনি কোনো প্রশ্ন না করে উলটো উত্তর দিয়ে দিলেন! যেন আমি ওনার বিয়ে করা বউ! লোকটা তাড়া দেখিয়ে বললেন,“চল চল।”

লোকটা সামনের দিকে পা বাড়াতেই তাজ ভাই আমার হাতটা ধরে লোকটার পেছন পেছন হাঁটা ধরলেন। হাঁটতে হাঁটতে লোকটার আর তাজ ভাইয়ের কথোপকথন শুনে জানতে পারলাম লোকটার নাম পলাশ। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। ছোটো বেলায় যখন তাজ ভাই তার দাদা বাড়ি আসত, তখন থেকেই এই পলাশ ভাইয়ার সাথে তার বন্ধুত্ব। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমরা একটা খোলা মাঠে চলে এলাম। সেখানে পৌঁছে আমি বেশ অবাক হলাম। কারণ মাঝারি আকৃতির মাঠটা বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে সাজানো হয়েছে। বিভিন্ন রংয়ের লাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে দশ-পনেরো জনের মতো বাচ্চা এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করছে। আমাদের দেখেই তারা ছুটে এল। পলাশ ভাইয়া একটা বাচ্চা ছেলের মাথায় সযত্নে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,“বাবা, যাও তোমার আম্মুকে ডেকে আনো।”

“আচ্ছা বাবা।” বলেই ছেলেটা এক ছুটে মাঠের একদিকে ছুটে হারিয়ে গেল। আমি কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করে বসলাম,“এখানে কী হচ্ছে?”

পলাশ ভাইয়া স্বভাবসুলভ হেসে বললেন,“আসলে আজ আমার একমাত্র ছেলের বার্থডে ছিল। সন্ধ্যায় জলদি জলদি সেলিব্রেশন হয়ে গেছে।তাজকেও ইনভাইট করেছিলাম, কিন্তু সায়মা আপুর বিয়ে বলে তো ও আসতে পারেনি। তাই আমি বলেছিলাম আপুর বিদায়ের পর যেন একবার আসে।”

এতক্ষণে আমি আসল কাহিনি বুঝতে পারলাম। পরক্ষণেই মাথায় এল, তাজ ভাই আমার ইচ্ছে পূরণ করতে নয়, বরং বন্ধুর কথা রাখতেই এখানে এসেছে। কথাটা মাথায় আসতেই কেন জানি আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু সেই মন খারাপটা সাময়িক ছিল। পলাশ ভাইয়ার বউ এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললেন,“কেমন আছেন ভাবি?”

আমি আবারও অবাক হলাম। পরক্ষণেই মাথায় শয়তানি বুদ্ধি কড়া নাড়ল। মুখ ফসকে বলার ভান করে বলে ফেললাম,“সরি ভাবি, আপনি ভুল করছেন। আমি তাজ ভাইয়ের বোন হই।”

ফর্সা গড়নের বেঁটে মহিলাটা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাজ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,“সেকি ভাইয়া! আপনার বউকে আনেননি? পলাশ তো বলল আপনার বউও আসবে। আনলেন না কেন ভাইয়া?”

তাজ ভাই গলা ঝাড়া দিয়ে মাথা চুলকাতে শুরু করলেন। পলাশ ভাইয়া তার বউকে অন্যদিকে ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,“ওসব পরে জিজ্ঞেস কোরো। আগে গিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করো তাড়াতাড়ি।”

আমি তাজ ভাইয়ের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,“আপনি বিয়ে করলেন কবে?”

উনি কোনো উত্তর দিলেন না। আমি আবার বললাম,“আপনি তো সাংঘাতিক লোক! দেশে এসে কাউকে না জানিয়ে আবার গোপনে বিয়ে করে বসে আছেন! অথচ আফরা আপু, আমিরা আপুকেও পেছন পেছন ঘুরাচ্ছেন। যাই একবার ঢাকায়, বাবাকে বলব তার আদরের ভাগনের কীর্তিকলাপের কথা।”

তাজ ভাই কপাল কুঁচকে আমার মাথায় হালকা চাটি মেরে বললেন,“মাথামোটা!”

আমি গাল ফুলিয়ে ডান হাতের তালুতে মাথা ঘষতে-ঘষতে বললাম,“সত্য কথা বললেই আমি মাথামোটা তাই না? শয়তান লোক!”

“সাট আপ।”

তাজ ভাইয়ের চাপা স্বরের ধমক শুনে আমি চুপ মেরে গেলাম। গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই চোখে পড়ল বাচ্চাদের দল। ওদের মধ্যে কয়েকজন হাতে জ্বলন্ত আতশ বাজি নিয়ে খেলছে, আবার কয়েকজন ভয়ে দূর থেকে দেখেই হাসছে আর চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করছে। দৃশ্যটা দেখে আমি অজান্তেই হেসে ফেললাম। বেশ ভালোই লাগছে বাচ্চাগুলোর খেলা দেখতে। হঠাৎ করে আমরও ইচ্ছে জাগল বাচ্চাদের মতো আতশ বাজি হাতে নিতে। কিন্তু কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। যদি ভুলবশত গায়ে আগুন লেগে যায়! ঐ দূরে দাঁড়ানো ভীতু বাচ্চাদের সাথে নিজেকে তুলনা করতেই আমি পুনরায় হেসে উঠলাম। এক ধ্যানে মগ্ন হয়ে আমি কতক্ষণ যে বাচ্চাদের খেলা দেখলাম নিজেই ভুলে গেছি। তাজ ভাইয়ের দিকেও একবার ফিরে তাকাতে ভুলে বসে আছি। আমার ধ্যান ভাঙল তখন যখন পেছন থেকে কেউ আমার হাত স্পর্শ করল। আমি হাতের দিকে তাকাতেই শিউরে উঠলাম। তাজ ভাই ততক্ষণে আমার হাতের মুঠোয় আতশবাজি ধরিয়ে দিয়েছেন। আমি ভয় পেয়ে ফেলে দিতে যেতেই তাজ ভাই আমার হাতটা শক্ত করে ধরে ফেললেন। উনি হাত না ছাড়ায় আমি মনে বেশ সাহস পেলাম। ভয় ভুলে গিয়ে বাচ্চাদের মতো খুশিতে মগ্ন হয়ে উঠলাম। আতশবাজি যতক্ষণ পর্যন্ত আমার হাতে ছিল, পুরোটা সময় এক মুহূর্তের জন্যও উনি আমার হাতটা ছাড়লেন না। একইভাবে শক্ত করে ধরে রইলেন। শেষে পলাশ ভাইয়া যখন খাবারের জন্য ডাকল, তখন উনি নিজেই আমার হাত ছাড়লেন। পলাশ ভাইয়ার সাথে আমরা মাঠ পেরিয়ে তার বাড়িতে চলে এলাম। আসতে আসতে তাজ ভাই চাপা স্বরে বললেন,“খাবার নিয়ে যেন কোনো অজুহাত না শুনি। একটু খাবারও নষ্ট করবি না, চুপচাপ খেয়ে উঠবি।”

আমি ঠোঁট ফুলিয়ে ওনার দিকে তাকালাম। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। পলাশ ভাইয়ার বাড়িটা বেশ বড়োসড়ো। আত্মীয়-স্বজনরা অনেকেই এখনও রয়ে গেছেন। হয়তো তারা আজ বাড়ি ফিরবেন না। আমাদের নিয়ে ডায়নিং টেবিলে বসানো হলো। আমাদের সাথে পলাশ ভাইয়াও খেতে বসলেন। টেবিল ভর্তি খাবার সাজানো। এত খাবার দেখে আমার খাবারের প্রতি অনীহা এসে গেল। এমনিতেও পেটে ক্ষুধা নেই। পলাশ ভাইয়ার বউ আমাদের খাবার পরিবেশন করলেন। তার সাথে আরও দুজন মহিলা আছে। আমি আগেভাগেই বললাম আমাকে যেন অল্প পরিমাণে খাবার দেয়। আমার কথামতো পলাশ ভাইয়ার বউ অল্প করেই খাবার দিলেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি খাবার মুখে তুললাম। তাজ ভাই আর পলাশ ভাইয়া কব্জি ডুবিয়ে খাচ্ছেন। অথচ আমি এক লোকমা খাবার মুখে তুলে ধীরে সুস্থে গলধঃকরণ করছি। আমার খাবারের গতিবিধি লক্ষ্য করে পলাশ ভাইয়ার বউ বললেন,“আপনি তো খাচ্ছেনই না। ওদের খাওয়া হয়ে যাচ্ছে আর আপনার খাবার প্লেটেই পড়ে আছে।”

মহিলার সাথে তাল মিলিয়ে বাকি মহিলারাও একই কথা বললেন। আমি আমতা-আমতা করে বললাম,“আমার আসলে তেমন ক্ষুধা নেই।”

তাজ ভাই বললেন,“যতটুকু পারিস খা আস্তে আস্তে।”

পলাশ ভাইয়াও বললেন,“খান ভাবি। আপনাকে তো একদম কম খাবার দিয়েছে। এটুকু খেতে পারবেন না!”

ইচ্ছে হচ্ছে এই পলাশ ভাইয়ার মাথা ফাটাতে। আন্দাজে কী ভাবি, ভাবি শুরু করল লোকটা! অনেক কষ্টে প্লেটের খাবারটাকু পেটে চালান করে ক্ষান্ত হলাম। ততক্ষণে তাজ ভাই আর পলাশ ভাইয়ার জব্বর ভোজন হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বেশ অনেকটা সময় আমরা পলাশ ভাইয়ার পরিবারের সাথে গল্প করে কাটালাম। আমরা যখন পলাশ ভাইয়ার বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম তখন রাত প্রায় বারোটা। এবার আর পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরা লাগল না। পলাশ ভাইয়া তার গাড়ি দিয়ে আমাদের বাড়ি পৌঁছে দিলেন। বাড়ির সামনে থেকেই পলাশ ভাইয়া ফিরে গেলেন, ভেতরে যেতে রাজি হলেন না। ভেবেছিলাম এত রাতে হয়তো বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল হলো। দরজা ভেজানো পেয়ে আমরা সহজেই ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে ঢুকেই তাজ ভাইয়ের ফুপু আর বড়ো কাকির সামনে পড়লাম। ওনারা বোধ হয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বাড়ি নিস্তব্ধ, তার মানে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। তাজ ভাইয়ের কাকি এগিয়ে এসে বললেন,“এতক্ষণে তোদের ফেরার সময় হলো? আমরা তো চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। শেষে তোর বন্ধু শ্রেয়ান বলল তোর একজায়গায় দাওয়াত আছে, ওখানে গিয়েছিস। ফোন বন্ধ ছিল কেন?”

তাজ ভাই মিথ্যা বললেন,“ওখানে নেটওয়ার্ক ছিল না।”

“তাই বলে একবার জানিয়ে যাবি না আমাদের?”

“শ্রেয়ান তো বলেছেই কাকি। বাদ দিন।”

তাজ ভাইয়ের ফুপু বললেন,“অনেক রাত হয়েছে। যা গিয়ে শুয়ে পড়।”

তাজ ভাই মাথা দুলিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন। ফুপুর থমথমে মুখটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আমিও তাজ ভাইয়ের পেছন পেছন ওপরে চলে এলাম। তাজ ভাই নিজের রুমে চলে গেলেন আর আমি আমার রুমে। রুমে ঢুকেই আমি জামাকাপড় নিয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। শাড়িটা চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসতেই সম্মুখে ফুপুকে দেখে শুকনো একটা ঢোক গিললাম। না জানি এই মহিলা এখন কী বলবে! ফুপুর কুঁচকানো কপাল আর গম্ভীর মুখটা দেখেই বুঝা হয়ে গেল এই রাত-বিরেতে এখন এক দফা ভাষণ শুনতে হবে। আমার ধারণার ষোলোকলা পূর্ণ করে ফুপু কটাক্ষ করে বলে উঠলেন,“কেমন মেয়ে গো তুমি? রাত-বিরেতে একটা ছেলের সাথে বাইরে ঘুরেফিরে সাড়ে বারোটা বাজিয়ে বাড়ি ফিরলে। বিবেক বলেও তো একটা জিনিস আছে। মেয়েদের এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকতে নেই জানো না? তা-ও আবার একটা ছেলের সাথে! তোমাকে বলবই বা কী? মায়ের শাসন নেই, বাবার আহ্লাদে বড়ো হওয়া মেয়ের থেকে এটাই কাম্য। ইকরাম ভাই টাকার পেছনে দৌড়াতে গিয়ে মেয়েকে শাসন করতে ভুলে গেছেন বোধ হয়।”

মা-বাবার কথা তুলতেই আমার চোখে পানি চলে এল। টলমলে চোখটা নামিয়ে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। এদিকে ফুপু বলেই চলেছেন,“শোনো মেয়ে, সময় থাকতে নির্লজ্জের মতো আমাদের ছেলের পিছু নেওয়া ছাড়ো। আমরা বড়োরা মিলে ঠিক করেছি আমার আমিরার সাথে তাজের বিয়ের কথা বলব। তাই ওর থেকে দূরে থাকাই তোমার জন্য ভালো। তাজকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে আবার বিয়েতে রাজি না হওয়ার কথা কানে ঢুকিয়ো না যেন। আমার কথাগুলো মাথায় রেখো। কাল সকাল হতেই আবার ভুলে বোসো না। যাও শুয়ে পড়ো।”

ফুপু আপন মনে বকবক করতে করতে রুম থেকে চলে গেলেন। এদিকে আমার দুচোখ বেয়ে টপ টপ করে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ছে। লজ্জায়, অপমানে ইচ্ছে করছে এখনই এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে। ফুপু চলে যেতেই আমি এগিয়ে গিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে দুহাতে মুখ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলাম। পাশে কারো অস্তিত্ব অনুভব করেও আমি ফিরে তাকালাম না। এতদিনে এই অস্তিত্বকে চেনার অভ্যাস হয়ে গেছে। বাহুতে হাতের স্পর্শ পেয়ে আমি মুখ থেকে হাত নামিয়ে তাকালাম। তাজ ভাই একহাতে আমাকে আলতো করে আগলে ধরে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওনাকে দেখে আমি আবারও ডুকরে কেঁদে উঠলাম। তাজ ভাই হন্তদন্ত হয়ে একহাতে আমার মুখটা তুলে ধরে বললেন,“ইলু, কান্না থামা। আমার কথা শোন। কান্না থামাতে বলেছি। হয়েছে, আর কাঁদতে হবে না। শোন না।”

এবার আমার সমস্ত রাগ গিয়ে পরল তাজ ভাইয়ের ওপর। ওনার কারণেই আমাকে এখন কাঁদতে হচ্ছে। আচমকা আমি দুহাতে ওনাকে জোরেশোরে এক ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিলাম। উনি খাট আঁকড়ে ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতেই আমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠলাম,“সব আপনার জন্য হয়েছে। আপনি আমার জীবনে এসে হতে আমাকে এমন অশান্তিতে ভুগতে হচ্ছে। কেন আমার পেছনে পড়ে থাকেন সবসময়? ক্ষান্ত দিন এবার। এসব সহ্য ক্ষমতা নেই আমার। আপনার জন্য আমি এত বাজে কথা কেন শুনব?”

আরও কিছু বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই তাজ ভাই এগিয়ে এসে আমাকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরলেন। নিচু স্বরে বললেন,“একদম চুপ। আর একটা কথাও যেন না শুনি। এত রাতে এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করলে বাড়ির সবাই জেগে যাবে তো।”

আবেগী মন আমার আদুরে স্পর্শ পেয়ে কান্নার গতি দ্বিগুণ বাড়াল। আবেগের তাড়নায় আমি দুহাতে ওনার পিঠের কাছের পাঞ্জাবি খামচে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,“ফুপু এসব কেন বলল আমাকে? বলে কি না আমি নির্লজ্জের মতো আপনার পিছু নিই!”

তাজ ভাই আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,“বলতে হবে না। বাইরে থেকে শুনেছি আমি সব। তোর ফোন দিতে এসেছিলাম। এতরাতে ঝামেলা করতে চাইনি তাই চুপ করে ছিলাম।”

“সকালেই চলে যাব আমি। থাকব না এখানে আর।”

উনি আমাকে আরেকটু জোরে আঁকড়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,“বাচ্চামো করে না ইলোনি। বউ ভাতের অনুষ্ঠানটা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। তারপর আর একদিনও থাকব না এখানে, প্রমিজ।”

আমি ত্যাড়াভাবে বললাম,“না, কালই চলে যাব আমি।”

“আচ্ছা তা কাল দেখা যাবে। এখন কান্না থামা তো দেখি। তাকা আমার দিকে।” বলতে বলতে উনি আমার মুখটা দুহাতে তুলে ধরে সযত্নে চোখ মুছে দিতে লাগলেন। ধীরে ধীরে আমি কান্নার গতি কমিয়ে দিলাম। উনি আমার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াতেই আমি কেঁপে উঠলাম। এতক্ষণে আমার টনক নড়ল। মস্তিষ্ক আবেগ ভুলতেই আমি তাজ ভাইকে ছেড়ে দিয়ে ছিটকে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক দৃষ্টি বিচরণ করতেই তাজ ভাই বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিকভাবেই বললেন,“শুয়ে পড়, অনেক রাত হয়েছে। এখন না ঘুমালে পরে মাথা ব্যথা করবে।”

আমি ওনার দিকে মুখ তুলে তাকালাম না। উনি ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও আবার থেমে গেলেন। পুনরায় পেছন ফিরে না তাকিয়েই বললেন,“সরি, আজ আবার ভুলে গিয়েছিলাম সুইডেন আর বাংলাদেশের তফাৎ।”

আমি এবার মুখ তুলে সামনে তাকালাম। ততক্ষণে উনি দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেছেন। আমি হতভম্ব হয়ে এক জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আপন মনে বিড়বিড় করলাম,“অদ্ভুত লোক!”

চলবে…………………?

(রি-চেইক দিতে পারিনি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং।❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here