#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:২৪
গাড়ি ছুটছে ঢাকার দিকে। আমি তাজ ভাইয়ের ওপর প্রচন্ড বিরক্ত। মনে হচ্ছে আজ বিরক্তির পরিমাণ বাকি দিনগুলোর থেকে একটু বেশিই। ঐ বাড়ি থেকে চলে আসার সময় নানুর মুখটা চুপসে ছিল। মামা আর বাকি সবার মনও খারাপ ছিল। আবার আগামী মাস ছাড়া আর আসা হবে না, বিধায় আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। গাড়িতে উঠে হতে আমি গাল ফুলিয়ে বসে আছি। জেমি আমার মুখের অবস্থা দেখে পেছনের সিটে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ইচ্ছা করছে তাজ ভাইয়ের ওপর নিজের সমস্ত রাগ উপড়ে দিতে। কিন্তু বেল্টের সাথে যে আস্ত এক মৃত্যুদূত আছে, তার ভয়েই মুখ তালাবন্ধ করে রেখেছি। প্রায় বিশ মিনিট স্ট্যাচু হয়ে বসে থাকার পর হঠাৎ আমার খেয়াল হলো গাড়ির স্পীড একদম কম। তাজ ভাই তো কখনও এতটা কম স্পীডে গাড়ি চালান না। উনি কি ইচ্ছে করেই আমাকে খেপাতে চাইছেন? আমি রাগত কন্ঠে বলে উঠলাম,“ঠেলাগাড়ি চালাচ্ছেন?”
তাজ ভাই ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে আমার দিকে তাকিয়েই গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিলেন। এবার মনে হচ্ছে গাড়ি উল্কার বেগে ছুটে চলেছে। আমি আবার বললাম,“ঘোড়া ছুটিয়েছেন?”
তাজ ভাই এবার ধমকে উঠে বললেন,“গাড়ি-ঘোড়া কিছুই না, নৌকা বাইছি। রাগ দেখাচ্ছিস কাকে? এক ধাক্কায় রাস্তায় ফেলে দিব বেয়াদব মেয়ে।”
আমি গাল ফুলিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি ফিরালাম। উনি এক হাতে স্টেয়ারিং সামলে আরেক হাতে আমার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে শক্ত মুখে বললেন,“রেজার সাথে ভালোভাবে ঘুরতে পারিসনি বলে এত দুঃখ হচ্ছে? ওহ্! আজ তো আবার রেজা হাত ধরে রাস্তা পার করিয়েছিল, তাই না? আহা! কত্ত সুন্দর মুহুর্ত! খুব ভালো লাগে পরপুরুষের ছোঁয়া?”
তাজ ভাই শক্ত মুখে কথাগুলো বললেও আমার রাগে গা রি-রি করে উঠল। সবসময় ওনার এসব অসভ্যের মতো কথা মেনে নেয়া সম্ভব না। আমি এক ঝটকায় ওনার হাত সরিয়ে খেকিয়ে উঠলাম,“একদম বাজে কথা বলবেন না। সব ছেলেদের আপনার মতো মনে করেন? রেজা ভাইয়া আমাকে ছোটো বেলা থেকে নিজের বোনের থেকে কম মনে করে না। আজেবাজে ভাবনা ছাড়া ভালো ভাবনা আপনার মাথায় আসে না?”
উনি রাস্তার দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন,“নাহ্। এখন একদম চুপ থাকবি। তোর সাথে কথা বলে আমার ক্ষুধা বেড়ে যাচ্ছে।”
“সবাই তো আপনাকে মাথায় তুলে নাচছিল। খাবার তো কম দেয়নি, পেটভরে খেতে নিষেধ করেছে কে?”
“তোর সাংঘাতিক মামার সামনে খেতে ভয় পেয়েছিলাম, বুঝলি? লোকটা না আবার নজর দিয়ে বসে।”
“মামা আপনাকে দেখে কত খুশি হয়েছে। ওনার মতো মানুষকে দুচোখের বিষ মনে করা কেবল আপনার পক্ষেই সম্ভব।”
“কী করব বল? আমি আবার অত তেল দিয়ে কথা বলতে পারি না।”
“মামার সামনে তো খুব হেসে হেসে কথা বললেন।”
“সে তো আমি নিতান্তই ভদ্র ছেলে বলে।”
“ভদ্র না ছাই!” বলেই আমি ভেংচি কাটলাম।
ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত নয়টা বাজল। বাড়িতে ঢুকেই আমি নিজের লাগেজ নিয়ে সোজা রুমে চলে গেলাম। বাবা হয়তো কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল ছিল না। লাগেজ একপাশে ফেলে রেখে আমি হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। জার্নি করার পর সবসময় আমি এমন ক্লান্ত হয়ে পড়ি। মিতা এসে লাগেজের জামা-কাপড় বের করতে করতে বলল,“আপু, আবার তো লাগেজ গোছাতেই হবে। বিয়েতে যাবে না? কোন কোন জামা-কাপড় নিবে বলো, আমি বরং এখনই গুছিয়ে রাখি। কাল সকালেই তো রওনা দিবে।”
আমি শুয়ে থেকেই মিতাকে বললাম কী কী লাগবে। ও একে একে সবকিছু লাগেজে গুছিয়ে রাখল। তারপর আমাকে প্রশ্ন করল,“আপু, জামা পালটাবে না?”
আমি অলস ভঙ্গিতে বললাম,“হুম, একটু কফি খাওয়াতে পারিস?”
মিতা বলল,“এখন কফি খাবে? ভাইয়া তো বলল এখন ভাত খাওয়ার কথা।”
আমি কপাল কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বললাম,“তোর ভাইয়াকে গিয়ে ভাত খাওয়া। আমাকে বলছিস কেন? আমি ভাত খাব না। আমার মাথা ধরেছে, কফি খাব।”
“আচ্ছা, আনছি।”
মিতা চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থেকে ধীরে ধীরে উঠে জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখলাম তাজ ভাই আমার বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। এক হাতে ফোন আর অপর হাতে কফি মগ নিয়ে দিব্যি আরামে আছেন। আমি বেড সাইড টেবিলের দিকে তাকালাম। কারণ ওয়াশরুমে থাকাকালীন মিতা এসে কফি রেখে গিয়েছিল। আমাকে ডাকতেই আমি ওয়াশরুম থেকে বলেছিলাম বেড সাইড টেবিলে রেখে যেতে। কিন্তু সেখানে কফি নেই। আমি তাজ ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম,“আপনি আমার কফি খাচ্ছেন কেন?”
উনি ফোন থেকে চোখ উঠিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু না বুঝার ভান করে বললেন,“তোর কফি?”
আমি তেতে উঠে বললাম,“ঢং করছেন? কফি খেতে ইচ্ছে করলে নিজে গিয়ে বানিয়ে খেতে পারেননি? আমারটা খেলেন কেন?”
উনি বার দুয়েক চোখ ঝাপটা দিয়ে বললেন,“এই কফি তুই বানিয়েছিস?”
“মিতা বানিয়েছে।”
“তাহলে এটা তোর হয় কীভাবে?”
“উফ্! আপনি আসলেই একটা অসহ্য লোক! যান তো এখান থেকে।”
তাজ ভাই কফি শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,“ডিনার করতে চল।”
আমি বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললাম,“আমি খাব না। আপনি তো খেতে পারেননি আমার মামার জন্য। আপনিই পেটভরে খান গিয়ে।”
“বাড়তি কথা বলতে বলিনি। কাল সকালে আবার জার্নি করতে হবে। এখন ঘুম দরকার। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়বি। চল তাড়াতাড়ি।”
“বললাম না খাব না? আপনাকে অযথা চিন্তা করতে হবে না আমার জন্য।”
“আবার বল।” কথাটা বলতে বলতে তাজ ভাই শার্ট উঁচিয়ে কোমরের বেল্টে হাত রাখলেন। আমি চোখ বড়ো করে ঢোক গিললাম। রাগের বশে এই গানের কথা তো আমি ভুলেই বসেছিলাম। উনি দু’পা এগিয়ে এসে বললেন,“কী হলো? বল।”
আমি মেকি হাসার চেষ্টা করে বললাম,“কী বলব?”
“এইমাত্র যা বললি।”
“ভুলে গেছি।”
“গুড, চলে আয় এবার।”
আমি চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে তাজ ভাইকে রেখেই ধুপধাপ পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
_____________________________
সকাল দশটায় আবার শুরু হলো জার্নি। বাসা থেকে বেরোনোর সময় বাবা একগাদা উপদেশ দিয়ে দিয়েছেন। মূলকথা, এক মুহুর্তের জন্যও তাজ ভাইয়ের নজরের বাইরে না যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে আমার ওপর। এদিকে আমি বরাবরের মতোই বিরক্ত। খুব সুন্দর মনের একজন সঙ্গী থাকলে জার্নিটা জমে ওঠে। অথচ আমার কপাল দেখ! কপালের কথা আর কী-ই বা বলব? এই লোক আসার পর থেকেই তো আমার কপাল ফেটেছে। কিছুদূর গিয়ে তাজ ভাই হঠাৎ ব্রেক কষলেন। আমি প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকালাম। কিন্তু পরক্ষণেই বিস্মিত হলাম শ্রেয়ান ভাইয়া আর আরেকটা লোককে গাড়িতে উঠতে দেখে। লোকটার দিকে ভালোভাবে তাকাতেই চিনতে পারলাম। এই লোককে আমি এর আগে আরও দুইবার দেখেছিলাম। প্রথমবার এক মধ্যরাতে রাস্তায় তাজ ভাই লোকটার ওপর চেঁচামেচি করছিল। দ্বিতীয়বার গ্রামে তাজ ভাইয়ের সাথে লোকটা চায়ের দোকানে বসে ছিল। শ্রেয়ান ভাইয়া একগাল হেসে হাত নেড়ে বললেন,“হাই ইলোমিলো। কেমন আছো?”
আমি বললাম,“ভালো। আপনারা কি আমাদের সাথে যাচ্ছেন?”
শ্রেয়ান ভাইয়া মাথা দোলালেন। শ্রেয়ান ভাইয়ার যাওয়ার কথা শুনে আমি বেশ খুশিই হলাম। তাহলে এই বিপজ্জনক লোকটাকে আমার সহ্য করতে হবে না। কিন্তু ঐ লোকটাকে আমি ঠিক মানতে পারছি না। আমাদের সাথে ঐ লোক কেন যাচ্ছেন? আবার ভাবলাম, লোকটা হয়তো তাজ ভাইয়ের দলের লোক। কিন্তু তাতেই কী? এসব গুন্ডা-পান্ডা নিয়ে দাদা বাড়ি যাবেন না-কি উনি? আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য শ্রেয়ান ভাইয়াকে বললাম,“ইনি কে? আপনাদের দলের কেউ?”
শ্রেয়ান ভাইয়ার মুখ দেখে মনে হলো উনি একটু ইতস্তত করছেন। আমার পাশ থেকে তাজ ভাই বললেন,“ও নাসের, আমাদের টিমেরই।”
আমার সন্দেহই সত্যি হলো। আজকের জার্নিটা যতটা খারাপ হবে ভেবেছিলাম তার চেয়ে ভালোই হলো। সারাটা পথ আমি শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে বকবক করেছি। মাঝে আবার শ্রেয়ান ভাইয়া গাড়ি থামিয়ে অনেক খাবার কিনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। দীর্ঘ চার ঘন্টা জার্নির পর আমরা দুপুর দুইটায় গন্তব্যে পৌঁছুলাম। তাজ ভাইয়ের দাদা বাড়ি এসেছিলাম খুব ছোটো বেলায়। তাই তেমন কিছুই মনে নেই। বাড়িটা দোতলা। খুব বেশি বড়ো না হলেও বাড়ি দেখে খুব মজবুত বলে মনে হচ্ছে। হয়তো অনেক আগের বাড়ি। তাজ ভাইয়ের দাদা-দাদি কেউ নেই। বাড়িতে দুই কাকা আর তাদের পরিবার থাকেন। কিন্তু বাড়িতে ঢুকে আমি বেশ অবাক হলাম। কারণ আমার জানামতে তাজ ভাইয়ের দুই কাকার পরিবার খুব বেশি বড়ো না। বড়ো কাকার দুই যমজ ছেলে আফনান, আদনান। আর ছোটো কাকার এক ছেলে এক মেয়ে মাহিন, সায়মা। সায়মারই বিয়ে। তাহলে বাড়িতে এত মানুষ এল কোত্থেকে? তারপর মাথায় এল, বিয়ে বাড়িতে তো অনেক আত্মীয়-স্বজন আসে। আমরা বাড়িতে প্রবেশ করতেই বাড়িতে হৈচৈ পড়ে গেল। দীর্ঘ আট বছর পর ভাগনেকে দেখে তাজ ভাইয়ের দুই কাকা তাকে পারলে মাথায় তুলে রাখেন। আমাদের বসিয়ে বেশ আপ্যায়ন করা হলো। সবার সাথে পরিচয় হতে হতে বুঝতে পারলাম তাজ ভাইয়ের আসার খবর শুনে তার ফুপুর পরিবারও এসেছেন। আর এত জনসংখ্যার কারণ হচ্ছে তাজ ভাইয়ের ফুপুর দুই ছেলে, দুই মেয়ে। বড়ো ছেলে জায়েদ বিবাহিত আর তার এক বছরের একটা বাচ্চা মেয়েও আছে। ছোটো ছেলে জুম্মান তাজ ভাইয়ের সমবয়সী। আর বড়ো মেয়ে মিনহা মাহিন ভাইয়ার সমবয়সী, ছোটো মেয়ে আমিরা আমার থেকে দুই এক বছরের বড়ো হবে। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর আমি ছাড় পেলাম। তাজ ভাইয়ের ফুপু আমাকে দোতলার একটা রুমে নিয়ে গেলেন। রুমটা বেশি বড়ো না হলেও বেশ পরিপাটি। আমি লাগেজ খুলে জামা বের করলাম। এ বাড়ির মানুষদের এতটাই তাড়া ছিল যে বেশি দেরি হবে বলে ফ্রেশ হওয়ার সুযোগ না দিয়ে আগেই দুপুরের খাবার খাইয়েছেন। এখন একটা লম্বা শাওয়ার নেয়া নিতান্ত জরুরী।
_________________________
আজ দুদিন হলো তাজ ভাইয়ের দাদা বাড়ি এসেছি। এরমধ্যে বাড়ির প্রায় অনেকের সাথেই আমার বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু তাজ ভাইয়ের ছোটো কাকি আর ফুপির ছোটো মেয়ে আমিরার কথাবার্তার ধরণে আমি ইতোমধ্যে বুঝতে পারছি তারা আমার প্রতি খুব একটা সন্তুষ্ট নন। কিন্তু অসন্তুষ্টির কারণটাও আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তবু আমি বিষয়টাকে একদমই পাত্তা দিলাম না। কারণ আমি এ বাড়িতে দুদিনের অতিথি মাত্র।
আজ সন্ধ্যায় বাড়ির ছাদে সব কাজিনদের আড্ডা বসেছে। ছাদের মাঝ বরাবর বড়ো একটা পাটি বিছিয়ে সবাই বৃত্তাকারভাবে বসেছে। সাথে কড়া ঝালের ঝালমুড়ি আর ফলমূল। অনেকক্ষণ বিভিন্ন আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো ট্রুথ অর ডেয়ার খেলা হবে। ট্রুথ নিলে তাকে যে প্রশ্ন করা হবে তার সঠিক উত্তর দিতে হবে। মিথ্যা বলা চলবে না। আর ডেয়ার নিলে তাকে যা করতে বলা হবে তা-ই করতে হবে। সিদ্ধান্ত মতো খেলা শুরু হলো। এদিকে আমি তাজ ভাইয়ের পাশে গালে হাত দিয়ে বসে আছি। মাঝে মাঝে ঝালমুড়ি চিবোচ্ছি। তাজ ভাই একেক জনকে ট্রুথ-ডেয়ার দিয়ে নাস্তানাবুদ করতে ব্যস্ত। এই যেমন আদনান ভাইয়াকে ডেয়ার দিলেন, তার গার্লফ্রেন্ডকে ফোন করে সবার সামনে ভালোবাসা নিবেদন করতে হবে। বেচারা লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন। কিন্তু ডেয়ার রক্ষার্থে গার্লফ্রেন্ডকে ফোন করে প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে একগাদা বকা শুনলেন। কারণ তার গার্লফ্রেন্ড আজ কোনো এক কারণে তার ওপর প্রচন্ড বিরক্ত। এই নিয়ে সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়েছে, আর বেচারা আদনান ভাইয়া অসহায় মুখে বসে ছিলেন। জায়েদ ভাইয়াকে প্রশ্ন করলেন, বিয়ের আগে সে কতবার তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে ডেটে গিয়েছেন। জায়েদ ভাইয়া এই প্রশ্ন শুনে পারলে সবার মাঝ থেকে উঠে চলে যান। কিন্তু এতগুলো বিচ্ছুর সাথে বেচারা পেরে উঠলেন না। শেষমেষ নিজের বউয়ের সামনে স্বীকার করলেন বিয়ের আগে উনি তিনবার তিন গার্লফ্রেন্ডের সাথে ডেটে গিয়েছিলেন। এ কথা শুনে তার বউ অর্নি রেগেমেগে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলেন। জায়েদ ভাইয়ার চেহারার অবস্থা যা হয়েছিল! অর্নি ভাবিকে অবশ্য অনেক বুঝিয়ে সবাই শান্ত করতে পারল। মিনহা আপুকে প্রশ্ন করা হলো, সে বর্তমানে কার সাথে রিলেশনে আছে। এটা ছিল আজকের খেলার বেশ উপভোগ্য অংশ। কারণ অনেক জোরাজুরির পর জানা গেল মিনহা তার মামাতো ভাইদের বেস্ট ফ্রেন্ড মৃদুলের সাথে রিলেশনে আছে। এ কথা শুনে আফনান আর আদনান ভাইয়া রক্তচক্ষু নিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল। বেচারি মিনহা তখন ভয়ে কেঁদেই ফেলল। কিন্তু তাজ ভাই ব্যাপারটা খুব সহজভাবেই মিটিয়ে দিলেন। মাহিন ভাইয়া আমিরা আপুকে প্রশ্ন করলেন, তার ক্রাশ কে। আমিরা আপুর সোজাসাপ্টা উত্তর,“তাজ ভাইয়া।” তার উত্তর শুনে সবাই মিলে তাজ ভাইকে বেশ খেপানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাজ ভাই দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,“আরে ও আমার ছোটো বোন। মাথায় বোধ হয় এখনও বুদ্ধি খোলেনি, তাই ভুল দিকে এন্ট্রি নিয়ে ফেলেছে।”
আমিরা আপুর মন ভঙ্গ হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল। আমিরা আপু শ্রেয়ান ভাইয়াকে ডেয়ার দিলো, তাকে মেয়েদের মতো মেকআপ করতে হবে। শ্রেয়ান ভাইয়া চোখ রসগোল্লার মতো করে সঙ্গে সঙ্গে না বলে দিলেন। কিন্তু খেলার নিয়ম তো ভঙ্গ করা চলবে না। তাই শ্রেয়ান ভাইয়াকে ধরে-বেঁধে জোরপূর্বক মেকআপ করানো হলো। শ্রেয়ান ভাইয়াকে মেকআপ লুকে দেখে হাসতে হাসতে আমাদের পেট ব্যথা হবার জোগাড়। কিন্তু সবাই ছবি তোলতে উদ্যত হতেই শ্রেয়ান ভাইয়া উঠেপড়ে দৌড়ে ছাদ থেকে পালিয়েছেন। তারপর অবশ্য ফ্রেশ হয়ে দ্রুতই চলে এসেছেন। অর্নি ভাবি মাহিন ভাইয়াকে ডেয়ার দিলেন, এক গ্লাস তেঁতুল গোলা পানি খেতে হবে। আমিরা ছুটে গিয়ে নিচ থেকে এক গ্লাস তেঁতুল গোলা পানি নিয়ে এল। তা গলধঃকরণ করতে গিয়ে মাহিন ভাইয়ার মুখের এক্সপ্রেশন এমন ছিল যে, তাকে ছাদ থেকে লাফ দিতে বললেও সে তা নির্দ্বিধায় করতেন। কারণ মাহিন ভাইয়া টক জাতীয় জিনিস একদমই পছন্দ করেন না। আর তেঁতুল তো তার দুচোখের বিষ! আদনান ভাইয়া নাসের ভাইয়াকে ডেয়ার দিলেন, যেকোনো একটা মেয়ের মাথায় গাঁট্টা মারতে হবে। এটা শোনামাত্র সব মেয়েরা এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। অর্থাৎ এতে কোনো মেয়েই রাজি নয়। নাসের ভাইয়ার মুখ দেখে মনে হলো সেও বিষয়টা হজম করতে পারছেন না। কিন্তু তাজ ভাই আর আফনান ভাইয়ার ধমক শুনে আমরা বাধ্য মেয়ের মতো পুনরায় বসে পড়লাম। নাসের ভাইয়াও অনেকক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে হঠাৎ করেই আমিরা আপুর মাথায় এক গাঁট্টা মেরে বসলেন। আমিরা আপু এমন একটা ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না, বিধায় গাঁট্টা মারার সাথে সাথে সে চিৎকার দিয়ে উলটে পড়ল অর্নি ভাবির গায়ের ওপর। এহেন ঘটনায় সবার সাথে নাসের ভাইয়াও হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেলেন। কিন্তু পরক্ষণেই আমিরা আপুর গগন কাঁপানো ধমক শুনে চুপ মেরে গেলেন। আমিরা আপু আবার মাহিন ভাইয়ার ধমকিতে চুপ মেরে গেল। আমিরা আপু আমাকে প্রশ্ন করল, প্রথম দেখায় আমি কার ওপর ক্রাশ খেয়েছি। পড়লাম বিপাকে। জীবনে আমি একজনের ওপরই ক্রাশ খেয়েছি। আর সেই বান্দা স্বয়ং আমার পাশে বসা। কিন্তু সেই ক্রাশ খাওয়াটা আমার মস্ত বড়ো ভুল ছিল, তাই এটা বলা চলবে না। কিন্তু নিয়ম রক্ষার্থে ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে উত্তর দিতে হবে। আমি গলা ঝেড়ে জবাব দিলাম,“আমাদের এক আত্মীয় আছে। আপনারা চিনবেন না। ওই ভাইয়াটাকে প্রথম দেখেই ক্রাশ খেয়েছিলাম।”
আমার উত্তর শুনে তাজ ভাই ভ্রুকুটি করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আর বাকি সবাই প্রশ্ন করে বসল আমার ক্রাশের নাম কী, বাড়ি কোথায়, কী করে, সে এখনও আমার ক্রাশ কি না। কিন্তু আমি মেকি হেসে বললাম,“একের অধিক প্রশ্ন করা কিন্তু খেলার নিয়মে নেই। সো আমি এসবের উত্তরও দিব না। শুধু এটুকু বলছি যে সে এখন আর আমার ক্রাশ নেই।”
আমার মুখ থেকে আর কোনো কথা বের করতে না পেরে সবাই দমে গেল। জুম্মান ভাইয়া আর আফনান ভাইয়াকে তাজ ভাই ডেয়ার দিলেন, তাদের একে অপরকে চুমু খেতে হবে। এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আফনান ভাইয়া আর জুম্মান ভাইয়া পালানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। অনেকক্ষণ জোর জবরদস্তি করার পর অবশেষে তাদের রাজি করানো গেল। দুজন ইয়াক ইয়াক করতে করতে নাক-মুখ কুঁচকে একে অপরকে চুমু খেল। তারপর দুজনেই লজ্জায় পড়ে গেল। জুম্মান ভাইয়া সায়মা আপুকে প্রশ্ন করলেন, তার প্রাক্তনের নাম কী। কিন্তু অনেক গবেষণার মাধ্যমে জানা গেল সায়মা আপুর কোনো প্রাক্তনই ছিল না। সে স্বভাবতই খুব চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। সবার শেষে এল তাজ ভাইয়ের পালা। তাজ ভাই বেশ সাহস নিয়ে ডেয়ার নিলেন। এবার সবাই কোমর বেঁধে ভাবতে নামল তাজ ভাইকে ঠিক কী ডেয়ার দিয়ে দমানো যাবে। কিন্তু সবার ভবনায় ইতি টেনে জায়েদ ভাইয়া বলে বসলেন,“এখানকার যেকোনো একজন মেয়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হাত ধরে বল, আই রিয়েলি লাভ ইউ মাই ড্রিম গার্ল। উইল ইউ ম্যারি মি?”
জায়েদ ভাইয়ার ডেয়ারটা সবারই বেশ পছন্দ হলো। কারণ সবার ধারণা তাজ ভাই এটা নিয়ে খুব দ্বিধায় ভুগবেন। আমিও মনে মনে বেশ খুশি হলাম। এতক্ষণ সবাইকে নাকানি-চুবানি খাইয়েছে, এবার ঠেলা সামলাক। জায়েদ ভাইয়া সব মেয়েদের এক লাইনে দাঁড় করালেন। আমি আর অর্নি ভাবিও বাদ পড়লাম না। তাজ ভাইকে সবার সামনে দাঁড় করানো হলো। ছেলেরা সবাই একেকটা বলছে আর পেট চেপে ধরে হাসছে। তাজ ভাই দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ভ্রু বাঁকিয়ে সবার দিকে তাকাচ্ছে আর চিন্তা করছে। এদিকে আমিরা আপু মিটমিট করে হাসছে আর হেলেদুলে তাজ ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালাচ্ছে। আমার ধারণা তাজ ভাই এই মেয়েকে দিয়েই ডেয়ার পূরণ করবেন। কিন্তু হলো তার উলটোটাটা। তাজ ভাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। আমার ডান হাতটা নিজের ডান হাতের মুঠোয় নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,“আই রিয়েলি লাভ ইউ মাই ড্রিম গার্ল। উইল ইউ ম্যারি মি?”
ব্যাপারটা এতটাই দ্রুত ঘটল যে উপস্থিত সবাই হা হয়ে গেল। এদিকে আমি স্থির হয়ে আছি। ওনার গভীর দৃষ্টি আর এই মুহূর্তে বলা কথাটা কর্ণগুহরে পৌঁছাতেই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি থমকে গেলাম। হারিয়ে গেলাম গভীর দুটো চোখে। পরক্ষণেই সবার চিৎকার কানে আসতেই নিজেকে সামলে নিলাম। তাজ ভাই ততক্ষণে আমার হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। এদিকে সবাই মিলে নানা কথা বলে তাজ ভাই আর আমাকে খেপানো শুরু করেছে। কিন্তু তাজ ভাই তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,“স্টপ গাইস। আগে আমার কথা শোন। এখানে অর্নি ভাবি আমার বড়ো ভাবি। সো আমি তাকে বিয়ে করতে পারি না। সায়মার অলরেডি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। মিনহার বয়ফ্রেন্ড আছে। আর আমিরা তো আমার ছোটো বোন।”
মাহিন ভাইয়া কটাক্ষ করে বললেন,“ইলোও তো তোর ছোটো বোন। তাহলে?”
তাজ ভাই মুখ কুঁচকে বললেন,“ভাই রে, এই মাথামোটার সম্পর্কে যদি জানতি তাহলে এটা বলতে পারতি না। না জানে বড়োদের রেসপেক্ট করতে, আর না জানে বড়োদের সাথে সুন্দর করে কথা বলতে। কথায় কথায় পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে নেমে পড়ে। অথচ আমিরাকে দেখ, এই মাথামোটার তো আমাদের আমিরার থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। ওর মতো মেয়ের তো আমার বোন হবারই যোগ্যতা নেই। আর বউ তো বহু দূরের কথা। কিন্তু এখানে ও ছাড়া কোনো অপশন নেই। তাই খেলার নিয়ম রক্ষার্থে ওকেই বেছে নিলাম। নাউ, দ্যা গেইম ইজ ওভার। ওকে বাই।”
তাজ ভাই এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই দ্রুত পায়ে হেঁটে ছাদ থেকে চলে গেলেন। এদিকে তাজ ভাইয়ের কথা শুনে উপস্থিত সবাই একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। আমিরা আপু তো আমার দিকে তাকিয়ে জয়ের হাসি হাসছে। এদিকে আমি নির্বোধের মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি। কেন জানি তাজ ভাইয়ের বলা কথাগুলো আমার মস্তিষ্কে আঘাত হানতে পারেনি। হয়তো এতদিনে আমার মস্তিষ্ক ওনার সব রকমের বিদ্রুপ আর তাচ্ছিল্যের কথা সহ্য করতে শিখে গেছে। সবই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। শ্রেয়ান ভাইয়া আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বললেন,“ইলোমিলো, মন খারাপ কোরো না প্লিজ। তাজ ওসব কথা মন থেকে বলেনি। জানোই তো ও সবসময় তোমাকে খেপানোর জন্য কত কথাই বলে। আমার মনে হয় ঐ আমিরাকে ওর সুবিধার মনে হয়নি, তাই বাধ্য হয়ে তোমাকেই বেছে নিয়েছে। আর এটা তো জাস্ট একটা গেইম ছিল। ফরগেট ইট এন্ড স্মাইল প্লিজ।”
আমি মাথাটা হালকা ঝাঁকিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসার চেষ্টা করলাম। বিড়বিড় করে বললাম,“আমি এতটাও বোকা নই যে সত্য মিথ্যার পার্থক্য বুঝব না।”
চলবে……………………?