#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে: ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:২৩
‘খাদ্যনালী শুকিয়ে গেছে’ কথাটা শুনেই আমার হা-হুতাশ শুরু হয়ে গেছে। বান্ধবীদের গ্রুপ কল করে কাঁদো কাঁদো গলায় কথাটা বলতেই সবাই মিলে আমাকে দিলো এক ধমক। ওদের ধমকিতে আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। আমার এই দুঃখের দিনে ওরা দুঃখ প্রকাশ না করে উলটো আমাকেই ধমকাচ্ছে! ওদের রাগের কারণ জানতে চাইতেই ঐশী কপাল চাপড়ে বলল,“সাধে কি তোকে তাজ ভাইয়া মাথামোটা বলে? উনি বলল তোর খাদ্যনালী শুকিয়ে গেছে আর তুই বিশ্বাস করে নিলি? আরে গাধি মেয়ে, খাদ্যনালীতে কোনো প্রবলেম হলে তো আগে তার লক্ষণ দেখা যায়। তোর মাঝে এমন কোনো লক্ষণ ছিল, না আছে? ভাইয়া তোকে বোকা বানিয়েছে।”
আমি পুরোপুরি আহাম্মক বনে গেলাম। বোকা বোকা মুখে প্রশ্ন করলাম,“কী লক্ষণ?”
ফারহা বলল,“গুগলে সার্চ দে যাহ্।”
ওদের সাথে কথা শেষ না করেই আমি ফোন কেটে দিলাম। তাড়াতাড়ি গুগলে সার্চ দিলাম ‘খাদ্যনালী শুকিয়ে যাওয়ার লক্ষণ কী কী?’ সঙ্গে সঙ্গে গোটা গোটা অক্ষরে উত্তর এল,‘পেটে প্রচন্ড ব্যথা হওয়া, পেট শক্ত হয়ে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি।’ অথচ এমন কোনো লক্ষণই আমার নেই। বজ্জাত লোকটা তাহলে আমাকে মিথ্যা কথা কেন বলল? আমি হনহন করে হেঁটে সোজা চলে গেলাম তাজ ভাইয়ের রুমের দিকে। কিন্তু গিয়ে ওনাকে রুমে পেলাম না। তারপর গেলাম বাবার কাছে। বাবা আমাকে কিছু বলার আগেই আমি প্রশ্ন করলাম,“বাবা, আমার কী হয়েছে?”
বাবা হেসে বলল,“কী হয়েছে মানে?”
“মানে আমার খাবারে অনিয়মের কারণে কী সমস্যা হয়েছে?”
“ডক্টর বলেছে খাবারে অনিয়মের কারণে তোর শরীর খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর এভাবে চলতে থাকলে খাদ্যনালীতে সমস্যা হতে পারে।”
“ওহ্। তাজ ভাই কোথায়?”
“ও তো কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়েছে। তোর শরীর কেমন লাগছে এখন?”
“ভালো।”
“খাবার নিয়ে কিন্তু আর হেলাফেলা চলবে না আম্মা। খুব চিন্তায় ফেলেছিস আমাকে।”
আমি মাথা ঝাঁকালাম। বাবার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ড্রয়িংরুমে চলে এলাম। তাজ ভাই না আসা পর্যন্ত আজ এখানেই অপেক্ষা করব। টিভি অন করে রিতাকে ডাকলাম। রিতা খুব চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে। ওর সাথে গল্প করতে বেশ ভালো লাগে আমার। রিতার সাথে গল্প করতে করতে টিভি দেখছিলাম। এর মাঝে অনেকটা সময় কেটেছে, কিন্তু মহারাজের আসার নাম নেই। বিরক্ত হয়ে আমি রুমের দরজা পর্যন্ত চলে যেতেই কলিংবেল বেজে উঠল। রিতার আগে আমি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললাম। তাজ ভাই ভেতরে ঢুকে ধপ করে সোফায় বসে গা এলিয়ে দিলেন। আমার দিকে একবার তাকালেনও না। আমি দরজা বন্ধ করে ওনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি ততক্ষণে চোখ বন্ধ করেছেন। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। আমি কিছুটা জোরেই ডাকলাম,“তাজ ভাই, তাজ ভাই।”
উনি চোখ খুললেন। প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি শক্ত মুখে বললাম,“আপনি আমাকে মিথ্যে কেন বলেছেন? আমার না-কি খাদ্যনালী শুকিয়ে গেছে? আমি জেনে গেছি এসব মিথ্যা কথা। এমন কিছুই হয়নি আমার। তাহলে আপনি এসব কেন বললেন?”
তাজ ভাই কপালটা খানিক কুঁচকে পুনরায় চোখ বন্ধ করলেন, যেন আমার কথা ওনার কানেই যায়নি। আমি
বিরক্ত হয়ে আবার বললাম,“আশ্চর্য! এখন চুপ করে আছেন কেন? আপনার মাথায় সবসময় এত বদ বুদ্ধি আসে কোত্থেকে, হ্যাঁ? কখনও কি ভালো কথা মুখে আসে না। মিথ্যা কথার জাহাজ!”
তাজ ভাই এবার চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এক নজর তাকিয়েই সোজা রুমের দিকে হাঁটা দিতে দিতে বললেন,“চা নিয়ে আয়।”
আমি পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলাম,“আনব না। আপনি মিথ্যা কথা কেন বললেন?”
তাজ ভাই আর পেছন ফিরে তাকালেন না। আমি শক্ত মুখে সোফায় বসে পড়লাম। রিতা এতক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ও এগিয়ে এসে বলল,“আপু, আমার মনে হয় ভাইয়া অসুস্থ।”
আমি ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,“অসুস্থ?”
“হুম।”
“তুই কীভাবে বুঝলি?”
“ভাইয়ার চেহারা দেখেননি? কেমন যেন ফ্যাকাশে আর ক্লান্ত লাগছিল।”
আমি একটু ভেবে বললাম,“তাই তো!”
পরক্ষণেই আবার মুখ বাঁকিয়ে বললাম,“তাতে আমার কী?”
রিতা বলল,“ভাইয়া তো চা চাইল আপু। চা নিয়ে যান। হয়তো তার মাথা ব্যথা করছে।”
“পারব না। তুই নিয়ে যা।”
“ভাইয়া তো আমাদের হাতের চা খায় না আপু।”
“তাহলে না খেয়েই থাকুক।”
রিতা আমার দিকে দু’পা এগিয়ে এসে বলল,“ভাইয়ার মাথা ব্যথা বেড়ে গেলে বিষয়টা কি ভালো হবে আপু? চাচা শুনলে যদি আপনাকে বকে?”
রিতার কথাটা ফেলে দেয়ার মতো না। মেয়েটার বুদ্ধি আছে বৈকি! আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে রান্নাঘরে চলে গেলাম। মারজিয়া খালা বেসিনে থালা-বাসন পরিষ্কার করছিলেন। আমাকে দেখে বললেন,“কী মা? কিছু লাগবে?”
আমি খালার প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। গাল ফুলিয়ে চায়ের পানি বসালাম। মারজিয়া খালা আর প্রশ্ন করলেন না। রিতাও চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। চা করে আমি এক কাপ চা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। দ্রুত পায়ে হেঁটে তাজ ভাইয়ের রুমে চলে গেলাম। তাজ ভাই বিছানায় পা ঝুলিয়ে দুহাতে মাথার চুল টেনে ধরে মাথানত করে বসে আছেন। পরনের জামা-কাপড়ও এখনও পালটাননি। আমি বেড সাইড টেবিলে শব্দ করে চায়ের কাপটা রেখে গম্ভীর গলায় বললাম,“আপনার চা।”
তাজ ভাই মাথা তুলে তাকালেন। ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি থমকে গেলাম। চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে আর চেহারাটা কেমন যেন দেখাচ্ছে। ভালোভাবে তাকাতেও পারছেন না। লোকটা কি নেশা-টেশা করেছে না-কি? কী জানি! করতেও পারে। মাফিয়া বলে কথা! এসব তো তাদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার। আজ হয়তো অতিরিক্ত খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু নেশা করলে তো মানুষ তাল সামলাতে পারে না। অথচ এই লোক তো দিব্যি হেঁটে হেঁটে রুমে চলে এল। আমি ভ্রুকুটি করে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছিলাম। তাজ ভাই এক হাত এগিয়ে আমার হাতটা মুঠোয় নিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসালেন। আমি কিছু বলার আগেই উনি হুট করে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। ওনার এহেন কান্ডে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। এতদিন শুধু কপালে চুমু দেয়া, কোলে তোলা পর্যন্ত ছিলেন, আর আজ কোলে মাথা রেখেই শুয়ে পড়লেন! আমি হন্তদন্ত হয়ে বললাম,“আরে, এসব কেমন আচরণ? সরুন তাড়াতাড়ি। শোয়ার জন্য কি বালিশ নেই? কেউ দেখলে কী ভাববে? সরছেন না কেন? আপনার কানে ঢুকছে না আমার কথা? তাজ ভাই….।”
তাজ ভাই আমার কথাগুলো এড়িয়ে গিয়ে আমার ডান হাতটা ওনার কপালে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করলেন। আমি হাতটা সরানোর চেষ্টা করেও পারলাম না। বাঁ হাতে অনেক ঠেলাঠেলি করার পরও উনি এক চুলও নাড়লেন না। মুখে যে রাগ উপচে ফেলছি তা-ও তিনি কানে নিচ্ছেন না। হতাশ হয়ে আমি অসহায় মুখে বসে রইলাম। তাজ ভাইয়ের নিঃশ্বাস চলছে দ্রুত গতিতে। নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট আমার কানে আসছে। নিঃশ্বাসের সাথে সাথে তার শরীরের মৃদু কম্পন আমি অনুভব করছি। উনি বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ ফোনের রিংটোনের শব্দে আমি কিছুটা চমকে উঠলাম। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম পাশেই তাজ ভাইয়ের ফোনটা বাজছে। আমি সেদিকে তোয়াক্কা করলাম না। কিন্তু দ্বিতীয়বার পুনরায় বাজতেই ভাবলাম শ্রেয়ান ভাইয়াও হতে পারে। কিছুটা ঝুঁকে গিয়ে এক হাতে ফোনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে সোজা হয়ে বসলাম। স্ক্রিনে ইংরেজি বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ‘ভাইয়া।’ মানে রাজ ভাইয়া। আমি ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে সালাম দিলাম। ওপাশ থেকে রাজ ভাইয়া সালামের জবাব দিয়ে বললেন,“কে? ইলু?”
আমি বললাম,“হ্যাঁ ভাইয়া। কেমন আছো?”
“ভালো। তুই কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ্। ভাবি কেমন আছে?”
“ভালো। তাজ কোথায়?”
“উনি তো ঘুমাচ্ছেন।”
রাজ ভাইয়া একটু অবাক হয়ে বললেন,“এই অসময়ে তো ও কখনও ঘুমায় না। শরীর খারাপ না-কি আবার?”
“তাই তো মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই বাইরে থেকে ফিরল। তখন থেকেই চোখ দুটো লাল হয়ে মুখটা কেমন যেন দেখাচ্ছে। মনে হয় মাথা ব্যথা।”
রাজ ভাইয়া কিছুটা ব্যস্ত হয়ে বললেন,“ওহ্ গড! ওর মাইগ্রেনের সমস্যা আছে ইলু। মাঝে মাঝেই ব্যথা ওঠে। কিন্তু ও মুখ বুজে সহ্য করে বলে সবাই স্বাভাবিক মাথা ব্যথা ভেবে নেয়।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,“মাইগ্রেন!”
“হ্যাঁ। ওর একটু খেয়াল রাখিস বোন। আমার ভাইটা বড্ড চাপা স্বভাবের মানুষ। ঘুম ভাঙলে জিজ্ঞেস করিস ব্যথা কমেছে কি না।”
আমি আস্তে করে বললাম,“আচ্ছা।”
“পরে আবার ফোন করব আমি। এখন রাখছি, আল্লাহ্ হাফেজ।”
“আল্লাহ্ হাফেজ।”
ওপাশ থেকে রাজ ভাইয়া ফোন কেটে দিলেন। আমি কান থেকে ফোন নামিয়ে বিছানায় রাখলাম। তাজ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। মানুষটা ঘুমে মগ্ন। ওনার হাতটা আলগা হয়ে আসায় আমি ওনার হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতটা আলগোছে ছাড়িয়ে নিলাম। ওনার হাতটা সাবধানে ওনার বুকের ওপর রাখলাম। তারপর কী মনে করে ডান হাতের আঙুলে ওনার চুলে বিলি কাটতে লাগলাম। হঠাৎ করেই যেন আমার ওপর কিছু একটা ভর করল। আমি তাজ ভাইয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম,“এমন নিষ্পাপ মুখের মানুষটা বাস্তব জীবনে আসলেই কি ভয়ঙ্কর? সত্যিই কি সে মাফিয়া? আমার প্রতি তার অনুভূতিগুলোর আসল নাম কী? ভালোবাসা, না-কি আবেগ? এত কেয়ার কেন করে সে আমার? আমি কি মানুষটাকে চিনতে পারছি না? না-কি চেনার চেষ্টা করছি না? উনি কি ঠিকই বলেন? আমি সত্যিই মাথামোটা?”
পরক্ষণেই আবার নিজেকে সামলে নিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করলাম,“ধুর ধুর! এই শয়তান লোক তো নিজেই আমাকে সবসময় ধাঁধায় ফেলে দেয়। এত কনফিউশনের মধ্যে থেকে আমি সত্যিটা বুঝব কীভাবে? সাধেই কি বলি, লোকটা বিপজ্জনক?”
টেবিল ঘড়িতে দেখলাম প্রায় আধঘণ্টা ধরে আমি এই রুমে আছি। এখন বেরোনো উচিত। কিন্তু এই বস্তাকে কীভাবে সরাবো? তাজ ভাইয়ের মাথাটা আস্তে করে দুহাতে তুলে ধরে আমি সরে বসে মাথাটা বিছানায় রাখলাম। তারপর অনেক কষ্টে ওনাকে টেনেহিঁচড়ে বিছানার কিনারা থেকে সরিয়ে নিয়ে বালিশে মাথা রেখে শোয়ালাম। মনে মনে ওনাকে হাজারটা বকা দিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। রাক্ষসটা কী খেয়ে এত ওজন বাড়িয়েছে আল্লাহ্ জানে। নিজেকে সামলে নিয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে তাজ ভাইয়ের রুম থেকে চলে এলাম। মিতাকে সামনে পেয়ে ওর হাতে কাপ ধরিয়ে দিতেই ও বলল,“চা তো ঠান্ডা হয়ে গেছে। ভাইয়া খায়নি?”
আমি বললাম,“না। এক কাজ করিস। তাজ ভাই ঘুম থেকে উঠলে ওনাকে তুই চা করে দিস।”
“আমার হাতের চা খাবে?”
“বলবি আমি দিতে বলেছি। আমি এখন পড়তে বসব। এক্সাম আছে।”
“আচ্ছা।”
__________________________
আজ আমার এক্সাম শেষ হয়েছে। এজন্য মনে মনে আল্লাহকে হাজারবার ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এক্সামের এ কদিন তাজ ভাই রীতিমতো আমার টিচারের দায়িত্ব পালন করেছেন। বাধ্য হয়ে আমাকে পড়ায় মনোযোগ দিতে হয়েছে। নিজেও রাত জেগেছেন আর আমাকেও গানের ভয় দেখিয়ে সজাগ রেখেছেন। আবার ঘুম কাটানোর জন্য মাঝে মাঝে চা, কফি করে খাইয়েছেন। বিকালের সময়টাতে কিছুক্ষণ পড়িয়ে আবার টেনেটুনে ছাদে নিয়ে গেছেন। নিজের হাতে চা, নুডলস্ করে খাইয়েছেন। অথচ ওনার নুডলস্ পছন্দ না। অদ্ভুত লোক! বলতে গেলে, এক্সামের পুরো সময়টাতে আমার স্পেশাল কেয়ার চলেছে। কিন্তু ওনার এই এক্সট্রা কেয়ারের কিছু অংশ আমার কাছে বেশ প্যারাময় ছিল। বিশেষ করে শাসন করে পড়ানো। অবশেষে আজ এই প্যারা থেকে মুক্তি পেলাম। এমনিতেই এক্সাম শেষ করে আজকের দিনটায় মনটা বেশ ফুরফুরে ছিল। তার মধ্যে আবার বিকালেই মামা এসে উপস্থিত। এক্সাম শেষ হয়েছে শুনেই সে ছুটে চলে এসেছে আমাকে নিতে। প্রতি মাসেই একবার করে আমি নানু বাড়ি যাই। কিন্তু এবার দেড় মাস হয়ে গেছে, তাই নানু মামাকে পাঠিয়েছে। মামা যখন এসেছে তখন তাজ ভাই বা বাবা কেউই বাড়ি ছিল না। এদিকে মামা বলল সে বিকালের মধ্যেই আমাকে নিয়ে যেতে চায়। তার না-কি অনেক কাজ পড়ে আছে তাই থাকতে পারবে না। বাধ্য হয়ে আমি বাবাকে ফোন করলাম। মামা বাবার সাথে কথা বলার পর বাবা যেতে বলল। আমিও ব্যাগপত্র গুছিয়ে নাচতে নাচতে মামার সাথে চলে গেলাম। আর যাই হোক, নানু বাড়িতে তাজ ভাইয়ের প্যারা সহ্য করতে হবে না। আহা কী আনন্দ! ভাবলাম এবার বেশ লম্বা সময় নানু বাড়ি থাকব। নানু বাড়ি যাওয়ার পর আমাকে দেখে হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেল। নানু তো চোখের পানিই ছেড়ে দিয়েছে। আমিও সবাইকে পেয়ে আনন্দে মেতে উঠেছিলাম। কিন্তু ঐ যে একটা জায়গায় এসে আমাকে থেমে যেতে হয় না? সুখ তো আর আমার জন্য না। আমার আনন্দকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে পরদিন সকালেই তাজ ভাই আমার নানু বাড়ি উপস্থিত হলেন। আমি ওনাকে দেখে বাকহীন হয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। অথচ আমার নানু আর মামি তাজ ভাইকে পেয়ে আমার থেকে বেশি আদর আপ্যায়ন করছে। আহ্লাদে আটখানা হয়ে সবাই পারলে শয়তানটাকে মাথায় তুলে নাচে। ইচ্ছে করছিল লোকটার গলাটা টিপে দিতে। আমার বিস্ময় আর বিরক্তি তখনই রাগে পরিণত হলো যখন শুনলাম তাজ ভাই আমাকে নিতে এসেছেন। তা-ও আবার ওনার দাদু বাড়ি আমাকে নিয়ে যাবার জন্য। যেখানে আমি ভেবে রেখেছিলাম আমার নানু বাড়ি এবার অনেকদিন থাকব, সেখানে না-কি এখন আমাকে ওনার সাথে ওনার দাদু বাড়ি যেতে হবে! আমি এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে না বলে দিয়েছিলাম কিন্তু তাজ ভাই স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন বাবা আমাকে যেতে বলেছে। কারণ তিনদিন বাদে তাজ ভাইয়ের চাচাতো বোনের বিয়ে। বাবা কাজ ফেলে রেখে যেতে পারবে না তাই আমাকে পাঠাবে। ব্যাস, হয়ে গেল আমার আনন্দে পচা জল ঢালা। এবার আর কোনো উপায় নেই, যেতেই হবে তাজ ভাইয়ের সাথে। রাগটাকে ধামাচাপা দিতে আমি আমার মামাতো ভাই রেজার কাছে গিয়ে বললাম,“ভাইয়া, ঘুরতে নিয়ে যাবে?”
রেজা ভাইয়া আজ পর্যন্ত আমার কোনো আবদার অপূর্ণ রাখেনি। নানু বাড়িতে নানু আর মামার পর সে-ই আমাকে বেশি আদর করে। রেজা ভাইয়া এ বছরই নতুন উকিল হয়েছে। আমার কাছে সে খুব ভালো আর মজার একটা ছেলে। মন খারাপের সময়ও বিভিন্ন মজার কথা বলে এক নিমেষে মন ভালো করতে পারে। নানু বাড়ি এসে আমি রেজা ভাইয়ার সাথে ঘুরঘুর করেই সময় কাটাই। আমি যখনই বলি,“ভাইয়া, ঘুরতে নিয়ে যাবে?” তখনই সে বিনা বাক্যে রাজি হয়ে যায়। এই যেমন আজ ঘুরতে যাওয়ার কথা বলার সাথে সাথে একগাল হেসে বলল,“কেন নয়? বল কোথায় যেতে চাস।”
আমি বললাম,“বাইরে কোথাও গিয়ে ফুসকা খেয়ে আসব।”
“আচ্ছা যা, রেডি হয়ে আয়।”
আমি চুপচাপ গিয়ে রেডি হয়ে নিলাম। জেমিকে নানুর কাছে রেখে রেজা ভাইয়ার সাথে বাড়ির বাইরে পা রাখতেই যমরাজ সম্মুখে দন্ডায়মান। রেজা ভাইয়া হেসে বলল,“তাজ, চলো বাইরে থেকে ঘুরে আসি।”
তাজ ভাইও হেসে মাথা দুলিয়ে বললেন,“চলো।”
শেষ আমার বাইরে ঘোরা। বুঝি না, এই লোক সবসময় কেন আমার আনন্দ মাটি করতে এক পা এগিয়ে থাকেন? কেন? আমার সাথে কিসের এত শত্রুতা? এই লোক আদৌ আমার ফুপির ছেলে কি না, এই নিয়ে তো এখন আমার যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে। এমন নয় তো? ভুলবশত আমার ফুপি আর অন্য কোনো মহিলার বেবি অদল-বদল হয়ে গেছে? কিংবা ইন্ডিয়ান সিরিয়ালগুলোর মতো কেউ ষড়যন্ত্র করে অদল-বদল করে দিয়েছে? হ্যাঁ এটাই হবে। নইলে যেই পরিবারে আমার ফুপির মতো মা ছিল, ফুপার মতো বাবা ছিল, রাজ ভাইয়ার মতো বড়ো ভাই ছিল, সেই পরিবারের ছোটো ছেলে কীভাবে এমন বিপজ্জনক হলো? আপন কেউ হলে তো পরিবারের কারো না কারো মতো হতই। জটিল ধাঁধা বটে! আজই রাজ ভাইয়াকে এই কথাটা জানাতে হবে।
চলবে………………..?