#তবু_সুর_ফিরে_আসে
৪৭ পর্ব
নওশাদ পুতুলের মতো দেখতে তার রাজকন্যা কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুই কানের কাছে আযান দিলো। তারপর মোবাইল টা বের করে প্রথম ফোনটা নিশালকে দিলো। ওপাশে রিং হচ্ছে তিন চার বার রিং হতেই নিশাল ফোন ধরলো ,
হ্যালো পাপা!
কোথায় তুমি বাবা?
আমি কোচিং থেকে বাসায় ফিরছি গাড়িতে ।
শোনো তোমার মোবাইল এর ডাটা অন করো আমি ভিডিও কল দিচ্ছি।
ডাটা অন করে নিশালই মেসেঞ্জারে কল দিলো।
নওশাদ ফোন রিসিভ করে বলল, নিশাল তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে চাইছে !
কে ?
নওশাদ তার মেয়ের দিকে ক্যামেরা টা ধরে বলল, দেখো তো চিনতে পারো কিনা নিশাল ?
নিশাল চিৎকার দিয়ে উঠলো, পাপা ! কখন হলো বেবি ? ও মাই গড ! মামনি না বলল আরো দুই সপ্তাহ পর হবে!
এই তো মাত্র আমার কাছে দিয়ে গেল নার্স । তোমার বোন চলে এসেছে বাবা।
পাপা অনেক কিউট হয়েছে তো । মামনি কেমন আছে?
মামনি ভালো আছে !
পাপা ওর ছবি তুলে পাঠাও। তাড়াতাড়ি।
পাঠাচ্ছি এখানের ওয়েদার খুব খারাপ আমি তো হঠাৎ তোমার মামনি অসুস্থ হয়ে যাওয়াতে ভয় পেয়েছিলাম।
এখন সব ঠিক আছে পাপা ? আমার খুব কোলে নিতে ইচ্ছে করছে।
ঢাকায় আসি সারাদিন কোলে নিয়ে থেকো। তুমি এখন সবাইকে জানিয়ে দাও যে তোমার বোন চলে এসেছে।
জানাচ্ছি পাপা।
ফোন রেখে দিয়ে নওশাদ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ওর এত আনন্দ হচ্ছে মনে হচ্ছে সবাইকে চিৎকার দিয়ে জানাতে , তোমরা দেখো এই পুতুল টা আমার মেয়ে। নওশাদ মেয়ের কপালে চুমু খেলো আবার।
নার্স এসে জানালো হেরাকে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ও গিয়ে দেখতে পারে এখন।
নওশাদ মেয়েকে কোলে নিয়ে হেরার কেবিনে গিয়ে ঢুকলো।
হেরা ঘুম জড়ানো চোখে চোখ তুলে তাকালো নওশাদের দিকে।
হেরা দেখো আমার কোলে কে ?
কার মতো হয়েছে দেখতে ?
চোখ তোমার মতো কিন্তু আমার মেয়ে আমার মতো হয়েছে দেখতে। থ্যাংকস হেরা তুমি আমাকে পৃথিবীর সব ধন সম্পদ আমার কাছে তুলে দিয়েছো নওশাদ হেরার ঠোঁটে চুমু খেলো। বিশ্বাস করাতে পারব না আমি কাউকে, আমার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ভাগ্যবান মানুষ মনে হচ্ছে হেরা। পৃথিবীর সব রূপ সব সুখ নিয়ে আমাদের মেয়ে এসেছে হেরা। দেখো তুমি তাকিয়ে। নওশাদ হেরার পাশে শুয়ে দিলো মেয়েকে।
হেরা মেয়েকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।
নওশাদের চোখেও পানি ।
নওশাদ দুজনকে জড়িয়ে ধরে সেলফি তুলল।
তারপর সেই ছবি পাঠিয়ে দিলো নিশালকে।
জানো নিশাল বোনের নাম রেখেছে নিহাদ । আমাকে বলে দিয়েছিল। কি যে খুশি সে বোনকে দেখে ।
হেরা মেয়ের কপালে চুমু খেলো।
বুবুকে জানিয়েছেন ?
না বলব না, ও আসছে আজকে এসে সারপ্রাইজ হবে বেবিকে দেখে।
নওশাদের ফোনে রিং হচ্ছে , আরমান ফোন দিয়েছে।
নার্স এসে ঢুকলো , বেবিকে ফীড করাতে হেরাকে সাহায্য করার জন্য। নওশাদ ফোন ধরতে বাহিরে চলে এলো। বাংলাদেশ থেকে একেরপর এক ফোন আসা শুরু হয়েছে। ভাই, ভাইয়ের বউ রা, রেজোয়ান, সুমনা, অফিসের লোকজন । সবাই শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।
নওশাদ অনেক বছর পর এত আনন্দ নিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলছে। এত ফোন রিসিভ করতে একটুও বিরক্ত লাগছে না আজ তার।
বিকেলে ডাক্তার সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডিসচার্জ করে দিলো হেরাকে।
নওশাদ হেরা আর মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলো।
সন্ধ্যায় বুবু তার ফ্যামিলি নিয়ে জর্জিয়া থেকে ফিরে নওশাদের কোলে বাচ্চা দেখে আকাশ থেকে পড়ল।
চিৎকার দিয়ে উঠলো কবে ,কখন বাবু তুই আমাকে কিচ্ছু বললি না !
বুবু তোমার ভাস্তি পুরো মিয়ামি তোলপাড় করে ঝড় তুলে এই পৃথিবীতে এসেছে। তিনি আসার পর ঝড় ঠান্ডা হয়ে সকালে রোদ উঠেছে।
জান্নাত আজমী আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে নওশাদের কোল থেকে নিহাদকে নিয়ে আদর করা শুরু করলো।
বাবু দেখ চেয়ে আম্মার মতো হয়েছে তোর মেয়ে বুবু চোখ মুছতে মুছতে বলল!
আমার মেয়ে আমার মতো হয়েছে শুধু চোখ তার মায়ের মতো নওশাদ বলল।
তুই তো দেখতে আম্মার মতোই রে বোকা । সে জন্য আম্মার সব আদর তোর জন্য বেশি ছিল।
হেরা বুবুর হাতে তাকে দেয়া চেইনটা তুলে দিলো , বুবু আপনি নিজে হাতে ওকে এটা পড়িয়ে দেন।
জান্নাত আজমী নওশাদ আর হেরার মেয়ের গলায় চেইন পড়িয়ে দিলো।
বাসার সবাই নিহাদকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। সে এখন বাসার মধ্যমনি।
নিশাল সারাক্ষণ একটু পর পর ভিডিও কল দিয়ে দেখছে বোনকে। তার একটুও ভালো লাগছে না ঢাকায়। পরীক্ষা না থাকলে সে অবশ্যই চলে আসতো বোনের কাছে।
আনারের মা পর্যন্ত নিশালের ফোন থেকে ভিডিও কল দিয়ে দেখলো ।
নওশাদ সারাক্ষণ তার মেয়েকে নিয়ে থাকছে। হেরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নওশাদ শুয়ে শুয়ে রাজ্যের গল্প করে মেয়ের সঙ্গে।
হেরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি গল্প করেন ওর সঙ্গে?
এটা আমাদের বাবা আর মেয়ের গল্প তোমাকে কেন বলব?
আমিও একটু শুনি হেরা নওশাদের পাশে শুয়ে বলল।
না না আমরা কাউকে বলব না ।
হেরা এই যে এখানে সারাক্ষণ ওকে নিয়ে থাকছি দেশে ফিরে গেলেই আমি তো অফিসে গিয়ে থাকতে পারবোনা ওকে ছেড়ে !
ওকে সঙ্গে করে অফিসে নিয়ে যাবেন তাহলে , হেরা মজা করে বলল।
অফিসে তো ওকে নিয়ে যাবই আমার মেয়ে একজন সফল বিজনেস উইমেন হবে একদিন ইনশাআল্লাহ।
আপনার মতো।
আমার চেয়েও সফল । আমি ওদের দুই ভাইবোনের জন্য পৃথিবীর সব সুখ হাতের মুঠোয় এনে দিব। ওরা আমার জান হেরা। ওদের জীবনটা আমি আলো দিয়ে ভরিয়ে দিব।
নওশাদ ছোট ছোট দুটো সোনার চুড়ি এনে মেয়ের হাতে পড়িয়ে দিলো । তারপর সারাক্ষণ মুগ্ধ হয়ে মেয়েকে দেখে। হেরা ওর চুল গুলোতে ঝুটি করে দেয়। নানান রঙের ব্যান্ড মাথায় পড়িয়ে রাখে। মেয়ে যেন ওর আর নওশাদের জীবন্ত পুতুল।
হেরা অল্পদিনেই খেয়াল করলো নওশাদ মেয়ের বেলায় খুব সেনসেটিভ। প্রথম যেদিন বুবু ওকে গোসল করালো নিহাদ খুব কান্না শুরু করলো তখন। নওশাদ মেয়ের কান্না দেখে পাগল হয়ে গেল। কেন এত কান্নাকাটি করছে নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হচ্ছে! তোমরা ওকে ব্যথা দিচ্ছো না তো?
বুবু বলল, হ্যাঁ আমরা তোর মেয়েকে ব্যথা দিচ্ছি !
বুবু খুব সাবধানে করাও ওর খারাপ লাগছে । নওশাদের উদ্বেগ দেখে বুবু বলল, পরদিন তুই করাবি গোসল তোর মেয়েকে তখন দেখব কাঁদে কিনা।
পরদিন সত্যি সত্যি নওশাদ গোসল করাচ্ছে যথারীতি নিহাদ কাঁদছে ওর ঠোঁট কাঁপছে । নওশাদ ঘোষণা করলো, যেহেতু তার মেয়ে গোসল পছন্দ করছে না তাকে গোসল করানোর দরকার নেই সপ্তাহে একদিন গোসল দিলেই হলো ও তো ধুলোবালিতে যায় না এত গোসলের কি দরকার!
বুবু দিলেন ধমক ,চুপ কর পাগল কোথাকার!
একদিন সন্ধ্যায় নিহাদ কাঁদছে খুব কেউ থামাতে পারছেনা ! নওশাদ অস্থির হয়ে গেল। বুবু ওর অস্থিরতা দেখে বলল, ছোট বাচ্চারা প্রথম প্রথম এভাবে কাঁদে হয়তো ওর পেটে ব্যথা করছে তুই চিন্তা করিস না।
নওশাদ অস্থির হয়ে গেল ডাক্তারের কাছে নেয়ার জন্য এবং এক পর্যায়ে সে নিজেই কেঁদে ফেলল।
বুবু আমি এক্ষুনি নিয়ে যাব ডাক্তারের কাছে অগত্যা মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলই সে । ডাক্তার বলে দিলো কোন সমস্যা নেই , হয়তো পেটে গ্যাস হয়েছে তাই কেঁদেছে । ওষুধ খেয়ে মেয়ে ঠান্ডা হলো তো এদিকে তার পাপা ঠান্ডা হলো।
জান্নাত আজমী নওশাদকে দেখে হাসছেন, তুই এত পাগল কেন ?
আমি কি করলাম বুবু?
আচ্ছা নিশালের সময় এমন করতি তুই ?
আমার সামনে কান্নাকাটি করলে আমি অস্থির হতাম । আমার বাচ্চাদের কষ্ট হলে আমি সহ্য করতে পারি না।
ঠিক আছে বুঝেছি তাই বলে এত সামান্য তে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে !
সামান্য কোথায় দেখলে আমার মেয়েটা এক ঘন্টা ধরে কাঁদছিল বুবু !
আচ্ছা এখন শান্ত হ ওকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে আয় যা।
নওশাদ সেদিন সারারাত মেয়েকে বুকের উপর নিয়ে ঘুমালো।
হেরা মুগ্ধ হয়ে দেখে নওশাদ আর নিহাদ কে । বাবা রা বুঝি এভাবেই মেয়েদের আদর করে !
নওশাদ জিজ্ঞেস করলো , কি দেখো ?
আপনাকে আর নিহাদকে দেখি বাবার আদর বুঝি এমন হয় মেয়ের জন্য। আমি তো কখনো বাবার আদর ভালোবাসা পাইনি তাই মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম।
নওশাদ হাত বাড়িয়ে হেরাকেও বুকে টেনে নিলো , মন খারাপ করো না ।
মন খারাপ করছি না আমি আপনার কাছ থেকে এত ভালোবাসা,আদর পেয়েছি পৃথিবীর আর কারো আদর ভালোবাসার জন্য আমার আফসোস নেই সত্যি বলছি। হেরা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল।
একটা কথা বলব, আমি আমার বাচ্চাদের অনেক ভালো মা হবো দেখবেন নিজের সুখের জন্য সন্তানকে ভুলে যায় যে মা তাদের মতো হবো না।
নওশাদ হেরার কপালে চুমু দিয়ে বলল, আমি জানি তুমি অনেক ভালো মা হেরা। নিশাল, নিহাদ দুজনই ভাগ্যবান ওদের মা ওদের অনেক ভালোবাসে।
হেরা নিহাদের কপালে চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিল।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রায় তিন মাস হওয়ার পর নওশাদ হেরা আর তাদের মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশের ফিরে এলো। সঙ্গে করে বুবু আর দুলাভাইকে নিয়ে এসেছে। বুবু আব্বাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল।
এয়ারপোর্টে নিশাল তার বোনকে রিসিভ করার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। সে আর্কিটেকচারে চান্স পেয়েছে। এখন তার স্বপ্ন পাপার মতো আর্কিটেক হবে । কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে সবচেয়ে খুশির ঘটনা আজ তার বোন আসছে।
ইমিগ্রেশন এর ফর্মালিটিজ শেষ করে ওরা বের হয়ে আসতেই নিশাল দৌড়ে গিয়ে বোনকে কোলে তুলে নিলো। নতুন কাউকে দেখে চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে নিহাদ। তারপর স্বভাব সুলভ হাসি দিলো।
নিশাল বোনের হাসি দেখে আনন্দে আত্মহারা।
নওশাদ তাকিয়ে দেখে নিশাল ওর গাড়ি রঙিন বেলুন দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে এসেছে।
এটা তুমি করেছো ?
হ্যাঁ পাপা নিহাদের জন্য।
হেরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে নিশাল চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে নিহাদকে। ওর মনটা ভরে যাচ্ছে বোনের প্রতি নিশালের ভালোবাসা দেখে।
নওশাদ তাগাদা দিলো তাড়াতাড়ি উঠো গাড়িতে, অনেক ধুলোবালি এখানে বেবির সমস্যা হবে।
ওরা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো। পুরো রাস্তা নিশাল বোনকে কোলে নিয়ে বসে আদর করলো ওর সঙ্গে কথা বলছে, তুমি জানো আমি কত অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্য।
বাসায় চলো তোমার জন্য অনেক সারপ্রাইজ আছে !
বাসায় এসে নিহাদ তো আর বুঝতে পারছেনা ওর ভাই ওর জন্য কত ভালোবাসা পুষে রেখেছে , নওশাদ, হেরা মুগ্ধ হয়ে দেখছে নিশাল পুরো বাড়ি বেলুন দিয়ে ডেকোরেশন করেছে। ‘ওয়েলক্যাম মাই লিটিল সিস’ লেখা ব্যানার বানিয়ে লাগিয়েছে। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে ওরা নওশাদ আর হেরার পুরো বেড রুম বিভিন্ন পুতুল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে নিশাল।
হেরা অবাক হয়ে নিশালকে বলল, তুমি এত পুতুল কিনেছো !
নিশাল হাসছে আনারের মা বলল, আম্মা ভাইয়া কবে থাইকা এসব পুতুল কিইনা কিইনা ঘর ভরছে । সব আপুর জন্য ভাইয়া সাজাইছে। আমাদের আপু নিজেই তো একটা পুতুল আম্মা। কি সুন্দর ফর্সা মুখ চোখ গুলা আপনের মতো বড় বড় আপুরে কালা টিপ দিয়া রাখতে হইব কারো নজর না লাগে ।
নিশাল হেরার কাছে এসে বলল, মামনি নিহাদকে দেখতে আমার ফ্রেন্ডরা আসবে সন্ধ্যায় তখন তুমি ওর বড় বড় চুল গুলোতে ঝুঁটি বেঁধে দিও ওকে ঝুটি বাঁধা থাকলে পুতুলের মত লাগে।
ঠিক আছে দিব বাবা।
আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু- বান্ধব নিহাদকে দেখতে ছুটে এসেছে নওশাদ মেয়েকে কোলে নিয়ে সারাক্ষণ সবাই কে দেখাচ্ছে। কখনো নিশাল নিয়ে বসে থাকে বোনকে।
হেরার পড়াশোনার প্রতি নওশাদ আবার তাগিদ দেয়া শুরু করলো। হেরা দুটো সেমিস্টার পিছিয়ে গেছে এতে তার মোটেও আফসোস নেই। কিন্তু নওশাদ আবার তাকে পড়াশোনা শুরু করতে বলল।
মেয়েকে আনারের মায়ের কাছে রেখে হেরা ক্লাস করা শুরু করেছে। আনারের মা নিশালকে যত্ন নিয়ে বড় করেছে এখন নিহাদকে করছে। হেরার কোন চিন্তা হয় না আনারের মায়ের কাছে মেয়েকে রেখে যেতে।
নওশাদ বাসায় থাকলে মেয়ের সঙ্গে সারাক্ষণ সময় কাটায়। ওর অফিসের ব্যস্ততা এখন অনেক বেশি তবুও সে ছেলে আর মেয়ের জন্য সময় বের করে রাখে।
দেখতে দেখতে নিহাদের বয়স চার মাস হয়ে গেছে। ও দেখতে সত্যি সত্যি নওশাদের চেহারা পেয়েছে কিন্তু চোখ গুলো যেন হেরার চোখ। গোলাপি তুলতুলে একটা জীবন্ত পুতুল। বাসার সবাই সারাক্ষণ ওকে নিয়ে ব্যস্ত।
নিশাল ভার্সিটি থেকে এসে বাসায় সারাক্ষণ বোনের সঙ্গে সময় কাটায়। নিহাদ এখন উপুড় হয়ে গড়াগড়ি দেয়। প্রায় সময়ই ওকে কোলে দোল দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় নিশাল। হেরা ভার্সিটিতে গেলে নিশাল বাসায় না থাকলে আনারের মা কে ফোন দিয়ে বোনের খোঁজ নিবে। তার বুকের ভিতরে বোনের জন্য অন্যরকম ভালোবাসা অনুভব করে সে। বেশিক্ষণ ওকে না দেখলে সে অস্থির হয়ে যায়।
নওশাদ আজ সাত দিন হলো দুবাই গিয়েছে। ওর মন পড়ে আছে তার মেয়ের কাছে । ছোট্ট মেয়েটার জন্য এত মায়া এত পিছুটান ওর। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে যখন হাসতে থাকে নওশাদের কাছে মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত আলো যেন সেই হাসিতে ছড়িয়ে পড়ছে। অফিস থেকে বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য ওর মন উতলা হয়ে উঠে কারণ বাসায় ফিরতেই মেয়ে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। পৃথিবীতে বাবা আর মেয়ের সম্পর্ক যেন একটা অন্যরকম অনুভূতির নাম। এর সঙ্গে কিছুর তুলনা হয় না।
সাতদিন পর নওশাদ দেশে ফিরছে। গাড়ি যখন এয়ার পোর্ট রোড দিয়ে বাসার দিকে ছুটে যাচ্ছে ওর হঠাৎ মনে পড়ে গেল এভাবেই এই রাস্তা দিয়ে হেরাকে নিয়ে প্রথম বাসায় ফিরেছিল একদিন। সেদিন সে জানতো না তার জীবনটা কোন দিকে ঘুরে যাচ্ছে আজ সে বুঝতে পারে আল্লাহ তার জীবনটা আনন্দে, সুখে, ভালোবাসায় ভরিয়ে দিবেন বলেই হঠাৎ সেরকম একটা পরিস্থিতিতে হেরার সঙ্গে বিয়েটা লিখে রেখেছিল। আজ প্রতিনিয়ত সে এটার জন্য কৃতজ্ঞতা বোধ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে।
বাসায় ফিরতে ফিরতে যথেষ্ট রাত হয়ে গেছে। গাড়ি থেকে নামতেই হেরা ছুটে এলো। সাতদিন প্রিয়জনদের থেকে দূরে ছিল কিন্তু মনে হচ্ছে সাত মাস সে ওদের দেখেনি।
হেরার হাসি মুখটা দেখেই ক্লান্তি দূর হয়ে গেল।
আমার রাজকন্যা কোথায় হেরা তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো এই সাতদিন আমার খুব কষ্টে গেছে?
মনে হয় ঘুমিয়ে গেছে আপনি চলে যান নিশালের
রুমে ওরা ওখানেই।
নওশাদ বলল, থাক একবারে ডিনার করেই যাই তারপর বাকি সময়টা ওদের দুজনের সঙ্গে কাটাব আর কোন কাজ করব না । তাড়াতাড়ি ডিনার দাও।
হেরা আর নওশাদ ডিনার করছে নওশাদ এই কয়দিন মেয়ের জন্য কত কি শপিং করেছে সব বলছে।
হেরা চুপচাপ শুনছে।
নওশাদ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো তোমার কি শরীর খারাপ হেরা ?
না তো কেন ?
এত চুপচাপ কেন ? পরশু ভিডিও কল দিলাম তখনও দেখলাম তুমি অনেক অন্যমনস্ক । নিহাদ রাতে ঘুমাতে দিচ্ছে না বুঝি? চিন্তা করোনা আমি চলে এসেছি নিহাদকে তার পাপা রাখবে।
হেরা আসলে অন্য একটা বিষয়ে খুব চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে, নিহাদের বয়স মাত্র চার মাস কিন্তু এর মাঝেই সে আবার কনসিভ করেছে এটা নওশাদকে বলতে তার খুব অস্বস্তি হচ্ছে।
হেরা মুখে বলল, ভাবছি এখন শুধু মেয়ের জন্যই শপিং করেন আমার আর নিশালের জন্য কিছু নেই ?
ও এই কথা , তোমাদের জন্য আছে কিন্তু আমার জান বাচ্চার জন্য ইদানিং যাই দেখি তাই কিনতে ইচ্ছা করে নওশাদ হাসতে হাসতে বলল।
খাওয়া শেষ করে নওশাদ দোতলায় উঠে এসে নিশালের রুমে গিয়ে দেখে সেখানে ওরা নেই ।
তারপর নিজের রুমে ঢুকে সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে, নিহাদকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে নিশাল।
নওশাদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে দৃশ্যটা ওর এত ভালো লাগছে ছোট্ট নিহাদ কত নির্বিঘ্নে, আরামে ঘুমাচ্ছে ভাইয়ের বুকে। নওশাদ জানে এভাবেই তার ভাই তাকে বুকে আগলে রাখবে সারাজীবন।
হেরা এসে পাশে দাঁড়ালো ।
দেখো হেরা কি সুন্দর লাগছে দুই ভাইবোনকে !
নিশাল প্রায় সময়ই ওকে এভাবে নিয়ে ঘুমায়, হেরা বলল।
বাসায় থাকলে বোনের সঙ্গেই তো থাকে সারাক্ষণ। আমি বলেছি ওকে তোমার এত পড়াশোনা থাকে নিশাল ওর জন্য দেখো আবার পড়াশোনায় গ্যাপ না পরে।
আমাকে তখন নিশাল বলল, ওর পড়াশোনা পরে আগে তার বোন।
নওশাদ হেরার হাত ধরে বলল, ঠিক কথাই বলেছে আগে বোন তারপর পড়াশোনা ।
তোমার পড়াশোনার কি খবর হেরা ?
চলছে। আমি একটা কথা বলতে চাইছি কিন্তু ভয় হচ্ছে বলতে।
ভয় পাচ্ছো আমাকে কথা বলতে, কি এমন কথা হেরা !নওশাদ অবাক হয়ে তাকালো হেরার দিকে।
হেরা ইতস্তত করছে কথাটা বলতে ।
কি ব্যাপার তুমি এরকম অস্বাভাবিক আচরণ করছো কেন ? আমার ভয় হচ্ছে এখন হেরা বলো জলদি ! নওশাদ চিন্তিত চোখে তাকালো হেরার দিকে।
আপনি কথা দিন আপনি আমাকে আপনার থেকে দূরে সরিয়ে রেখে আসবেন না ! হেরা কাতর চোখে তাকালো ! তারপর ফিসফিস করে নওশাদের কানের কাছে মুখ এনে বলল, আমি মনে হয় আবার কনসিভ করেছি বলেই হেরা ঝরঝর করে কেঁদে দিলো প্লিজ আমাকে এবার ফ্লোরিডা পাঠাবেন না। আমি নিজের বাসা, নিজের সংসার সবচেয়ে বড় কথা আপনাকে রেখে কোথাও গিয়ে একদিন ও থাকতে পারবো না।
নওশাদ হেরাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমাকে কোথাও পাঠাচ্ছি না আর কাঁদতে হবে না চোখ তুলে তাকাও। বোকা মেয়ে।
কেমন একটা ব্যাপার হয়ে গেল হেরা এত তাড়াতাড়ি আবার একটা বেবি । কি একটা কান্ড জ্ঞানহীন এর মতো কাজ হয়ে গেল আমার। ও মাই গড!
প্লিজ এভাবে বলবেন না, সব আল্লাহর ইচ্ছা। আমার ভয় হচ্ছিল আপনি না আবার বুবুর ওখানে রেখে দিয়ে আসেন আমাকে আর নিহাদকে। এছাড়া এটা আমার কাছে অনেক আনন্দের খবর।
একটা জিনিস কি জানো যা হয় ভালোর জন্যই হয় সন্তানের চেয়ে সুখ আর কিছুতেই নেই। এই যে তাকিয়ে দেখো কি শান্তি ওদের দুজনকে দেখে।
ঠিক বলেছেন।
নওশাদ হেরার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, দেখবে হেরা এবার এই দুজনের একটা দুষ্টু ভাই হবে এবং দুজনকে খুব জ্বালাবে।
আপনি এখনি জেনে গেছেন ওদের ভাই হবে !
হুম আমার মন ভুল বলে না হেরা নওশাদ হাসছে।
আচ্ছা এখন আমি ফ্রেশ হয়ে আমার বাচ্চাদের সঙ্গে ঘুমাবো নিশাল গভীর ঘুমে ওকে ডাকার দরকার নেই আজ ও থাক আমাদের সঙ্গে বলেই নওশাদ তাড়াতাড়ি ঘরে পড়ার ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
হেরা নিশাল আর নিহাদের গায়ে চাদর টেনে দিলো।
নওশাদ ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে বিছানায় গিয়ে বাচ্চাদের পাশে শুয়ে দুজনের কপালে চুমু খেলো।
হেরা পাশে বসতে বসতে বলল, আপনি ওদের সঙ্গে শুয়ে পড়ুন আমি ইজি চেয়ারে শুয়ে থাকি সমস্যা হবে না।
কেন এখানে জায়গা আছে তো তুমি আমার পাশে এসো তো।
সমস্যা নেই আপনি থাকেন বাচ্চাদের সঙ্গে।
আমি আমার সব সন্তানের সঙ্গে থাকব হেরা , যে তোমার পেটে আছে তার সঙ্গেও কাছে এসো।
হেরা নওশাদের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
নওশাদ হেরার হাত ধরে বলল, তুমি চিন্তা করো না তোমার আরামের জন্য আমি সব ব্যবস্থা করবো। আনারের মা আছে নিহাদের জন্য আমি আয়া রেখে দিচ্ছি তুমি কোন কষ্ট করো না ।
আপনি যখন আছেন আমার কিসের চিন্তা ! হেরা নওশাদকে জড়িয়ে ধরে বলল।
জানো হেরা এই ঘরটাতে একটা সময় কত চোখের পানি ফেলেছি গীতি যাওয়ার পর, কত দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে রাত পার করতাম।আর আজ আল্লাহ আমার সব সুখ সব আনন্দ এখানেই গুছিয়ে রেখেছিলেন।
আমরা যা ভাবি কিন্তু উপরে যে আছেন তাঁর পরিকল্পনা আমাদের ভাবনার চেয়েও বেশি সুন্দর।
ঠিক বলেছেন একটা সময় দুঃখে কষ্টে অপমানের জীবন কাটিয়েছি কিন্তু তিনি আমার জন্য এই যে কত সুন্দর জীবন সাজিয়ে রেখেছেন আপনার সঙ্গে।
দেখো আমাদের সন্তানেরা আমাদের সুখকে আরো বাড়িয়ে দিবে ইনশাআল্লাহ । আমাদের জীবনের সুর তো ওরাই।
হেরা নওশাদের হাতটা জড়িয়ে ধরলো। একদিন অচেনা এই মানুষটা তাকে আলোর জীবন দিয়েছে হেরা তার মাঝেই সব আলো সব আনন্দ খুঁজে পায় সব সময় ।
হোক তার চেয়ে বয়সে অনেক বড় কিন্তু ওর জীবনে নানা ভাইয়ের পর এই মানুষটাই তাকে সবচেয়ে বেশি আদর, ভালোবাসা আর সন্মান দিয়েছে। তার জীবনকে সুন্দর করে দিয়েছে। তিনটা সন্তান দিয়েছে।
হেরা আলোটা কমিয়ে দিয়ে নওশাদের বুকে মাথা রাখলো।
নওশাদ রুমের ভেতরে আলো আধারিতে তাকিয়ে আছে নিশাল আর নিহাদের দিকে। মনে মনে বলল, গীতি আমি সুখে আছি । তুমি কি দেখতে পাচ্ছো । আমি আজ আর একা নেই আমার তিন সন্তান আমার কাছে । হেরার মতো একজন সঙ্গী আমার কাছে। ওদের নিয়ে সত্যি সুখে আছি।
তুমি রোমানা ভাবির কাছে বলেছিলে আমার একা থাকাটা তুমি চাও না ।
আজ দেখো আমার জীবনের সুর গুলো কে নিয়ে জড়িয়ে আছি ভালোবাসায়, আদরে , নির্ভরতায়।
আজীবন তাই থাকতে চাই।
নওশাদ হাত বাড়িয়ে ওদের সবাইকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিলো।
~ সমাপ্ত~
আমার লেখাকে উৎসাহ দেয়ার জন্য, আমার গল্পের সঙ্গে নওশাদ আজমী, হেরা, নিশাল, বীথি, বুবু, আনারের মা, এলিন, নাহিন চরিত্র গুলোর সঙ্গে একান্ত ভাবে জড়িয়ে যাওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
সবাই ভালো থাকবেন । নিরাপদ থাকবেন।
আমার জন্য দোয়া করবেন।
গল্পাটা কেমন লাগলো কমেন্ট করবেন।