#তবু_ভালো_আছি
#রাজেশ্বরী_দাস_রাজী
#পর্ব_৪
সকালে ঘুম ভাঙলে দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে লক্ষ্য করতেই শ্রুতি দেখলো দশটা বাজতে চলল প্রায়। শ্রুতি ধীরে সুস্থে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখ মুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। ঘরে রুশাকে দেখতে না পেয়ে চুলটা হাত খোঁপা করতে করতেই বাইরে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে এলো সে। বাইরে আসতেই ড্রয়িংরুমে সোফায় রুশা আর মৃন্ময়কে বসে থাকতে দেখলো সে। রুশা তাকে বাইরে আসতে দেখেই উঠে তার কাছে এসে হাসিমুখে বলল,
“তুমি উঠে গেছো? মৃন্ময় এই কিছুক্ষণ আগেই এসেছে, আজকে তো ওর অফিস নেই আর আমারো অফ ডে তাই আরকি আমরা দুই ভাই-বোন বসে কথা বলছিলাম একটু। আসলে তুমি ঘুমোচ্ছিলে বলে তোমাকে ডাকিনি, ভাবলাম একটু রেস্টের প্রয়োজন তোমার তাই। আচ্ছা শ্রুতি, তোমায় কিছু কথা বলার ছিল।”
“কী কথা রুশা দি?”
রুশা শ্রুতির হাত ধরে অনুনয়ের স্বরে বলল,
“শ্রুতি, তুমি আমার সাথেই থেকে যাও প্লীজ। এখানে তো আমি একা থাকি আর এই ফ্ল্যাটটা তো মোটামুটি যথেষ্ট বড়ই, পাশের ঘরটায় তুমি থাকবে আর এই ঘরটায় আমি। কোন অসুবিধে হবে না আশা করি।”
শ্রুতি সংকোচমিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
“কিন্তু রুশা দি এটা কীভাবে হয়! এমনিতেই আমার জন্য এতো অসুবিধেয় পড়তে হয়েছে তোমাদের। আমি তোমাদের আর অসুবিধের মধ্যে ফেলতে চাই না। আমি ঠিক নিজের কোন একটা ব্যবস্থা করে নেবো।”
শ্রুতির কথার মাঝেই রুশা নরম কণ্ঠে বলল,
“শ্রুতি প্লীজ, কীসের অসুবিধে বলো তো? তুমি এখানে থাকলে কোন অসুবিধে হবে না আমার বিশ্বাস করো। বরঙ আমার মনে হবে আমি এখানে একা নেই, আমার সাথে আমার একটা বোন আছে। তুমি আমায় দিদি মানো তো! আমার এটুকু কথা শোনো। বাইরের পরিবেশ কেমন সেটা নিশ্চয় তোমার অজানা নয়। সেটা কি পুরোপুরি সেফ বলো? একদমই তো নয়। একা একটা মেয়ের জন্য বাইরে কতরকম বিপদ অপেক্ষা করে থাকতে পারে আইডিয়া আছে তোমার? আর তুমি তো এখন একাও নও। এই অবস্থায় কোথায় যাবে তুমি?”
মৃন্ময় ধীর কণ্ঠে বলল,
“যে আসছে তারো তো একটা সেফ এইনভায়রমেন্ট প্রয়োজন, নিজের নাহলেও নিজের সন্তানের কথা ভেবেই না হয় রুশার কথাটা শোনো শ্রুতি। প্লীজ।”
শ্রুতি একবার তাকালো মৃন্ময়ের দিকে, রুশা আবারো বলল,
“প্লীজ শ্রুতি, থেকে যাও। অন্তত যতদিন পর্যন্ত না তুমি নির্দিষ্ট কিছু ব্যবস্থা করে উঠতে না পারছো ততদিনই থেকে যাও।”
শ্রুতি অবশেষে বলল,
“ঠিক আছে, তবে আমার শর্ত আছে। আমি দ্রুত কোন চাকরির ব্যবস্থা করে নিজের আর নিজের সন্তানের খরচ নিজে চালাবো, আমি বোঝা হয়ে থাকতে চাই না কারোর ওপর। এই ব্যপারে তুমি কিছু বলতে পারবে না আমাকে।”
“বোঝা! কী বলছো এইসব? এইসব ব্যপারে কেন ভাবছো তুমি? আমি তো আছি! আর আমি তো একজন ডক্টর, এইসব বিষয়ে আমি থাকতে তোমার কোন চিন্তা করার তো কারণ নেই।”
শ্রুতি রুশাকে কথার মাঝে বাঁধা দিয়ে বলল,
“না সেটা হয় না। প্লীজ রুশা দি, নাহলে কিন্তু আমি থাকতে পারবো না এখানে।”
রুশা তাকালো মৃন্ময়ের দিকে, সে অত্যন্ত হালকা মাথা নেড়ে তাকে রাজি হয়ে যেতে ইশারা করলে রুশা বলল,
“বেশ, তবে তাই হবে। কিন্তু এইসব নিয়ে এই অবস্থায় বেশি স্ট্রেস নেবে না একদম। আচ্ছা এবার এখানে একটু বসো তো, সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছো তুমি।”
রুশা শ্রুতিকে হাত ধরে সোফার কাছে নিয়ে এলো। রুশা আর সে বসলো সোফায়। পাশে চোখ পড়তেই ঘরের এককোণে একটা গিটার দেখতে পেলো শ্রুতি। শ্রুতিকে গিটারের দিকে তাকাতে দেখেই রুশা বলল,
“গিটারটা চিনতে পারছো? এটা মৃন্ময়ের গিটার। সেই কতবছর থেকে ফেলেই রেখেছিল ওর ঘরের এককোণে। যদিও বাজাতে পারি না আমি খুব একটা, তাও কয়েকমাস আগে ওদের বাড়ি যখন গিয়েছিলাম ঘুরতে তখন পিপিকে মানে ওর মাকে বলে নিয়ে এসেছিলাম সাথে করে। কারণ মৃন্ময় তো আর গান-টান কিছুই করেনা, গিটারও ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখে না।”
শ্রুতি অবাক হলো। একসময় গান গাইতে এত ভালোবাসতো যেই মানুষটা সে গান গাইনা! কেন? শ্রুতি মৃন্ময়ের দিকে দৃষ্টি ফেলে বলল,
“তুমি আর গান গাওনা?”
মৃন্ময় জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল,
“না, ভালো লাগে না আর সেইসব।”
“প্রায় চার বছর হয়ে গেলো ও গান গাওয়া ছেড়েছে। বললে, এমনকি জোর করলেও গলা দিয়ে গান বেরোই না ওর।”
রুশার কথা শুনে শ্রুতি চুপ করেই রইলো, কিছু বলে উঠতে পারলো না এই বিষয়ে। কিছুসময় নিরবতা বিরাজ করলো সেই স্থানে। রুশা একবার মৃন্ময়ের মুখের দিকে তো আরেকবার শ্রুতির মুখের দিকে তাকালো। শ্রুতি হাত কচলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে শেষে মুখে হাসি টানার চেষ্টা করে বলল,
“আঙ্কেল আন্টি আর তোমার বোন কেমন আছে মৃন্ময়?”
মৃন্ময় ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
“ভালো আছে সবাই। দেখা কম হয় ওদের সাথে, আমি যেহেতু এখানে থাকি। মাঝে মাঝে আসে অবশ্য ওরা, আমিও তো যাই ওখানে।”
শ্রুতি কথায় কথায় মৃন্ময়কে শুধালো,
“তা বিয়ে করোনি?”
মৃন্ময় স্বাভাবিকস্বরেই উত্তর দিলো,
“না।”
“সেকি! তুমি তো এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছো, বিয়ের বয়সও হয়েছে, আঙ্কেল আন্টি বিয়ে দিতে চাননি তোমার? মেয়ে দেখেননি?”
শ্রুতির প্রশ্ন শুনে মৃন্ময় হেসে উত্তর দিলো,
“বলেছিল অবশ্য বিয়ের কথা তারা, তবে আমি চাইনি।
“কেন?”
মৃন্ময় তাকালো শ্রুতির মুখপানে, উত্তর দিলো না কোনো।
“বেলা হয়েছে কতো! কারোর তো কিছু খাওয়া হয়নি এখনো! আমি আমাদের তিনজনের জন্য চা-জলখাবার কিছু বানিয়ে আনি যাই।”
রুশা কথাটুকু বলে উঠে দাঁড়াতেই শ্রুতি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“চা-জলখাবার আমি বানাই?”
“তুমি এখন আবার এইসব করতে যাবে নাকি!”
রুশার কথার উত্তরে শ্রুতি জবাব দিলো,
“কিছু হবে না, আমার ভালোই লাগবে।”
টুকি-টাকি কাজের মধ্যে থাকলে শ্রুতির হয়তো ভালো লাগবে ভেবে রুশা আর বারণ করলো না তাকে। শ্রুতি আর রুশা রান্নাঘরে এলো। শ্রুতিকে রান্নাঘরের কোথায় কী রাখা আছে সব বুঝিয়ে দিলো রুশা। মৃন্ময়ও এসে দাঁড়ালো রান্নাঘরে। তারই মাঝে ড্রয়িংরুম থেকে ফোনের রিংটোনের মৃদু শব্দ ভেসে এলো তাদের কানে। রুশার মনে পড়লো সে নিজের ফোনটা রেখে এসেছে সেখানেই। শ্রুতি রুশাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি যাও, দেখো কে ফোন করছে। আমি এদিকটা একাই সামলে নিতে পারবো এবার।”
রুশা “ঠিক আছে।” বলে বেরিয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। শ্রুতি তাদের তিনজনের জন্য টোস্ট আর অমলেটটা বানিয়ে রেখে চা বানানোর প্রস্তুতি নিলো। চিনি, চা পাতা রান্নাঘরের ওপরের সেলফে রাখা ছিল, সেটার উচ্চতা ছিল খানিকটা বেশি। শ্রুতি পা উঁচু করে চিনির কৌটোটা নামাতে গিয়েই ভুলবশত হাতে ধাক্কা লেগে চা পাতার কৌটোটা সরে গেলো সেলফের কিছুটা ভেতরের দিকে। অনেক চেষ্টা করেও একটুর জন্য চা পাতার কৌটোটার নাগাল পাচ্ছিল না সে আর কিছুতেই, কিন্তু সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। ব্যপারটা দেখে মৃন্ময় আপনমনে হাসলো, এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে চা পাতার কৌটোটা নামিয়ে দিতে দিতে বিড়বিড় করে বলল সে,
“ছুটকু!”
কথাটা কানে আসতেই শ্রুতি মৃন্ময়ের দিকে আঙুল উঁচিয়ে একহাত নিজের কোমরে রেখে প্রতিবাদী স্বরে বলে উঠলো,
“এই আমি মোটেও ছুটকু না, আমার হাইট প্রায় পাঁচ ফিট চার, মেয়ে হিসেবে আমি যথেষ্ট লম্বা। তুমি আমাকে এইসব বলতে পারো না। তুমি বেশি লম্বা এতে আমার কী দোষ?”
মৃন্ময় তাকালো শ্রুতির মুখপানে। কথাটুকু বলে ফেলেই দমে গেলো শ্রুতি। আগেও এমন হতো তাদের সাথে। একবার লাইব্রেরির ওপরের তাকে রাখা বইয়ের নাগাল পাচ্ছিল না শ্রুতি, সেটা দেখে মৃন্ময় নামিয়ে দিয়েছিল তাকে বইটা। তখনো তাকে এভাবেই “ছুটকু” বলেছিল মৃন্ময়, শ্রুতিও তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছিল তাতে। সেইসব কথা চোখের সামনে ভেসে ওঠে শ্রুতির। আরো অনেক স্মৃতি মস্তিষ্কের কোণে উঁকি দিয়ে যায় তার। একসাথে রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটা, ফুচকা খাওয়া, মৃন্ময়ের তাকে গান গেয়ে শোনানো, শ্রুতির করা বকবক মৃন্ময়ের একমনে শোনা, কত-শত সুন্দর স্মৃতি! আর তারপর? শ্রুতি আর ভাবতে পারে না। সে সরে এসে অন্যপাশে মুখ ফিরে দাঁড়ায়। মৃন্ময় কিছু না বলে চা পাতার কৌটোটা গ্যাস ওভেনের পাশে রেখে চলে যায় রান্নাঘর থেকে।
.
.
বাইরে সন্ধ্যে নেমেছে বেশ অনেক্ষণ আগেই। রুশার ঘরের বিছানায় বসে টুকিটাকি কথা বলছিল শ্রুতি আর রুশা। কথার মাঝেই শ্রুতি বলল,
“রুশা দি একটা বাচ্চাদের স্কুলে টিচারের চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। আসলে এক পরিচিত, মানে আমি আর রণজয় যেই ফ্ল্যাটে থাকতাম তারই নীচের ফ্ল্যাটের একজন আন্টি ছিলেন। তিনি ওই স্কুলের হেড মিস্ট্রেস, তিনি অত্যন্ত ভালো একজন মহিলা, এক মাস আগে নাগাদ তিনি আমায় এই চাকরির ব্যাপারে বলেছিলেন। ইনফ্যাক্ট আমি তাকে নিজের ডকুমেন্ট পর্যন্ত জমা দিয়েছিলাম তখন, কিন্তু পরে রণজয় যখন ব্যপারটা জানতে পেরেছিল তখন এটা নিয়ে খুব ঝেমেলা হয়। তার বক্তব্য ছিল যে বাড়ির বউ বাইরে চাকরি করতে পারবে না কিছুতেই, শেষে সেইসবের জন্য আমি আর চাকরিটা করতে পারিনি তখন। তারপর এখন আমি আবার সেই আন্টির সাথে কথা বলি ব্যপারটা নিয়ে, তিনি আমাকে জানান যে তিনি আমার কাজের ব্যবস্থা করবেন আর তিনি আমাকে তার সাথে স্কুলে গিয়ে দেখা করতে বলেছেন।”
রুশা হাসিমুখে বলল,
“বাহ! তুমি একটা চাকরি পেয়েছো, এটা তো ভালো খবর শ্রুতি।”
“হ্যাঁ, যদিও পার্মানেন্ট নয় এটা, আর মাইনে খুব একটা বেশি নয়, তবুও এখন আমার জন্য এটাও অনেকই। পরের কথা না হয় পরে দেখা যাবে।”
“এইসব নিয়ে বেশি স্ট্রেস নেওয়ার প্রয়োজন নেই বোন। একটা কথা মাথায় রাখবে, আমি আছি তোমার পাশে।”
শ্রুতি হাসি টানলো মুখে, চোখটা সামান্য ছলছল করে উঠলো তার, সে রুশার কাঁধ একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তোমরা আমার জন্য যা যা করেছো সেটা আমার বাড়ির লোকেও আমার জন্য করেনি রুশা দি। তোমার এই উপকার যে আমি কখনো ভুলবো না, সবসময় ঋণী হয়ে থাকবো আমি তোমার কাছে।”
রুশা শ্রুতির মাথায় হাত রেখে বলল,
“ধুর পাগলী মেয়ে! এভাবে বলতে আছে নাকি! তুমি আমার বোন না!”
শ্রুতি রুশাকে ছেড়ে হেসে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালো। শ্রুতি আবারো কথায় কথায় বলল,
“আচ্ছা রুশা দি, তা তোমার কেউ নেই মনের মানুষ?”
শ্রুতির হঠাৎ এমন প্রশ্নে রুশা যেন লজ্জা পেলো সামান্য, বলল,
“আছে তো, আকাশ।”
“সেও ডাক্তার?”
“হ্যাঁ।”
তাদের কথার মাঝে ফোনটা বাজলো রুশার। রুশা একপলক ফোনের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে ফোনটা শ্রুতিকে দেখাতেই স্ক্রিনের ওপর “আকাশ” নামটা দেখতে পেলো শ্রুতি। শ্রুতি ঠোঁট টিপে হেসে আবার ছোট্ট একটা হাই তুলে বলল,
“তোমরা কথা বলো, আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে গো, আমি আমার ঘরে যাই। শুভ রাত্রি।”
শ্রুতি উঠে চলে এলো পাশের ঘরে।
.
.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে প্রায়, আকাশে সামান্য মেঘের আনাগোনা দেখা যাওয়ায় সূর্যের তেজ খানিকটা কমই ছিল পুরোটা দিন। তবে গরমের পরিমাণ যে খুব একটা কমেছে তা নয়। চোখ পিটপিট করে আকাশের পানে একবার চেয়েই স্কুল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়ালো শ্রুতি। আজকের মতো কাজ শেষ তার, এখন বাড়ি ফেরার পালা। যদিও কিছু নির্দিষ্ট কারণবশত আজকে খানিক দেরিই হয়েছে শ্রুতির। নতুন নতুন জয়েন করার ফলে সবটা বুঝে নিতে একটু বেশিই সময় লাগছে শ্রুতিকে, ধীরে ধীরে অবশ্য অভ্যেস হয়ে যাবে তার সেটা সে বেশ ভালোভাবেই জানে, তাছাড়া স্কুলে ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে অবশ্য বেশ ভালোই লাগছে শ্রুতির।
আপনমনে ধীরে সুস্থে বাইরে স্কুলের মাঠের দিকে আসতেই হুট করে রণজয়ের দেখা পেল শ্রুতি। রণজয়কে এখানে দেখে প্রথমটায় বেশ অবাকই হলো সে, রণজয় তার দিকে এগিয়ে এলে সেও খানিক এগিয়ে গেলো তার দিকে। শ্রুতি গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলো,
“তুমি এখানে কী করছো?”
“সেটা তো আমার তোমাকে বলা উচিত। কী প্রমাণ করতে চাইছো সবার কাছে? তুমি মহান আর আমি পাপী? তোমার জন্য আমাকে কতো কথা শুনতে হচ্ছে! সেইদিন মাঝরাতে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কেন গিয়েছিলে?”
রণজয়ের কথায় শ্রুতি তার মুখপানে চেয়ে শান্ত স্বরে জবাব দিল,
“সত্যিটা বলবো? আমার ঘেন্না করছিলো তোমার মতো জঘন্য একটা মানুষের সাথে একই বাড়িতে আর একমুহুর্তও থাকতে তাই।”
রণজয় রাগী গলায় বলল,
“শ্রুতি অনেক নাটক হয়েছে, এবার চুপচাপ তুমি আমার সাথে বাড়ি ফিরে যাবে চলো।”
“আমি কোথাও যাবো না। আমি আগেই জানিয়েছি আমার সিদ্ধান্ত থেকে আমাকে কেউ সরাতে পারবে না।”
“শ্রুতি!”
তাদের দুজনের কথার মাঝে হঠাৎ মৃন্ময়ের গলার মৃদুস্বর শুনে একদফা পাশে তাকালো শ্রুতি। মৃন্ময় এগিয়ে এলো খানিকটা তাদের দিকে। তাদের কিছু কিছু কথা আসামাত্রই কানে এসেছে মৃন্ময়ের। শ্রুতি আবারো বলল,
“তুমি এখান থেকে চলে যাও রণজয়, আমি আর তোমার সাথে কথা বাড়াতে চাই না।”
রণজয় তাচ্ছিল্যের হাসি টানলো, বলল,
“নিজেকে কী ভাবো তুমি? আমি দোষী আর তুমি সতী সাবিত্রী? তুমি কী ভাবো আমি কিছু বুঝি না? মাঝরাতে তো নিশ্চয় এমনি এমনি চলে যাওনি! আগের দিনও তো রাতে বাড়ি ফিরোনি। সব জানা আছে হ্যাঁ আমার। তুমি যে কী তা আমি খুব ভালোভাবে বুঝে গেছি।”
রণজয়ের কথার এই জঘন্য টোন বুঝতে পেরেই যেন রাগটা মাথায় চড়ে বসলো মৃন্ময়ের, সে কিছু বলতেও গেলো কিন্তু তার পূর্বেই শ্রুতি এবার গর্জে উঠে রণজয়ের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল,
“ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু ডু দিস রণজয়। খবরদার! আমার চরিত্র নিয়ে একটাও বাজে কথা উচ্চারণ করার চেষ্টাও তুমি করবে না। এমন কোনো কাজ কোরো না যে আমাকে ভুলে যেতে হয় এটা পাবলিক প্লেস। চলে যাও এখান থেকে, তুমি তোমার ডিভোর্স যথাসময়ে পেয়ে যাবে। আর আমি আবারো বলছি আমার এবং আমার সন্তানের জীবনে কোনো হস্তক্ষেপ করার চেষ্টাও করবে না, নাহলে তার ফল কিন্তু তোমার জন্য একটুও ভালো হবে না এই কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখো। আমি কিন্তু প্রয়োজনে পুলিশের সাহায্যও নিতে পারি। তাই তুমি যদি নিজের ভালো চাও তো একদম দূরে থাকো আমাদের থেকে, আমাকে এভাবে উত্যক্ত করার চেষ্টা করবে না আর ভুলেও কখনো।”
শ্রুতির চোখজোড়ায় তীব্র রাগ ও ঘৃণার আভাস পাওয়া গেল। রণজয় আর কিছু বলে উঠতে পারলো না ঠিক, সে বেশ অপমানিত বোধ করলো, আশেপাশে একবার তাকিয়ে চুপ করলো সে। শ্রুতি হনহন করে চলে গেলো সেই স্থান থেকে।
“আর কিছু না হোক মেয়েদের অন্তত সম্মান করতে শেখো।”
এই কথাগুলি বলেই শ্রুতির পিছু পিছু হাঁটা ধরলো মৃন্ময়। শ্রুতি স্কুল থেকে বেরিয়ে খানিকটা দূরে এসে রাস্তার একপাশে দাঁড়ালো। মৃন্ময় একপ্রকার দৌড়েই দ্রুত তার কাছে এলো। শ্রুতি ঘামছে, সামান্য হাঁপাচ্ছে। মৃন্ময় তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“রিল্যাক্স, এইসময় তোমার এতটা উত্তেজিত হওয়া ঠিক নয়। শান্ত হও, জল আছে না তোমার কাছে? একটু জল খাও তো।”
শ্রুতি ব্যাগ হাতড়ে জলের বোতল বের করে জল খেলো, গভীরে শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করলো।
“এখন ঠিক লাগছে?”
মৃন্ময়ের প্রশ্নে শ্রুতি স্বাভাবিক স্বরে বলল,
“হ্যাঁ, কিন্তু এখন তুমি এখানে?”
“আমি? আসলে আমার অফিস আজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে, আর তুমি রুশাকে বলেছিলে আজ বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হবে তোমার, তাই ভাবলাম আরকি যে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। তো এবার ফিরা যাক? একটা রিক্সা ডাকি?”
শ্রুতি আর কথা বাড়ালো না, এখন আর কোনো কথা বলতে তার ভালো লাগছে না। তাই সে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালো।
চলবে,…
[ বিঃদ্রঃ আজকের পার্টটা অন্যান্য দিনের থেকেও বড় হয়েছে কিছুটা। যা হোক, সামান্য ধৈর্য্য ধরে পাশে থাকুন। ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ। ]