#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-০৮
লেখা: ShoheL Rana শামী
সুফিয়া বাজার নিয়ে ভেতরে চলে গেল। রিহান মালা দুটো হাতে নিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। জাফর মাস্টার পেছন থেকে এসে তার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘আসো, তোমাকে একটা কাজ দিই।’
‘কী কাজ?’
‘ভেতরে আসো। টেবিলের ওখানে বসে কাগজ-কলম নাও।’
রিহান টেবিলের পাশে গিয়ে বসলো। কাগজ কলম টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী করবো এখন?’
‘চিঠি লিখবা একটা।’
‘চিঠি? কাকে?’
‘আমার একমাত্র বোন, কলকাতায় থাকে। ওখানে বিয়ে হয়েছে তার। ওর ঠিকানায় লিখবা।’
‘টেলিফোন করলেই তো পারেন?’
‘টেলিফোন কি ঘরে ঘরে আছে? তাই তো চিঠি লিখতে হয়। লিখো তো তুমি, আমি যা বলবো, লিখো।’
‘বলুন…’
‘প্রিয় হাসি…’
‘হাসি? হাসি আপনার বোনের নাম?’
‘হ্যাঁ, ওর নামটা আমিই রেখেছিলাম। জন্মের সময় খুব মিষ্টি চেহারা ছিল ওর। আমার চেয়ে দশ বছরের ছোটো ছিল।’
‘আপনার আর কোনো ভাই-বোন নেই?’
‘না, আমরা এই দুই ভাই-বোন শুধু।’
‘আচ্ছা, প্রিয় হাসি, তারপর?’
‘অনেকদিন তোর কোনো খোঁজ নেই।’
‘অ..নে..ক দি..ই..ন তো..র কো..নো খোঁ..ও..জ নেই। হ্যাঁ, তারপর?’ লিখতে লাগলো রিহান।
‘শীতের সময় তুই আসবি বলেছিলি, কত শীত পেরিয়ে গেল তুই আসিসনি।’
রিহান মাথা তুলে একবার তাকালো জাফর মাস্টারের দিকে। মাস্টার সাহেব হঠাৎ যেন অন্য জগতে হারিয়ে গেলেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে সামনের কপাটে একধ্যানে চেয়ে বলে যাচ্ছিলেন তিনি, ‘তোর কি মনে পড়ে না তোর এই ভাইয়ের কথা? শোন, দেশের অবস্থা ভালো না। দেশে দেশে যুদ্ধ চলছে। নিজেদের দেশেও আমরা শান্তিতে নেই। আমরা পারি না নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে। এভাবেই আমাদের থাকতে হবে। দেশ এখন ব্রিটিশদের। একটু সাবধানে থাকিস…’ বলে চললেন জাফর মাস্টার। রিহানও লিখতে লিখতে অনুধাবন করলো, কথাগুলো খুব গভীর থেকে আসছে। শেষে জাফর মাস্টার নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘লেখা শেষ? যা যা বলছি লিখছো তো?’
‘হ্যাঁ, সব লিখেছি। পড়ে দেখুন।’ বলেই চিঠিটা মাস্টার সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলো রিহান। মনোযোগ দিয়ে তিনি কিছুক্ষণ চিঠিটা পড়ে ভাজ করতে করতে বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে। পোস্ট অফিস চিনো তো? এটা পোস্ট অফিসে দিয়ে আসো। ঠিকানা যেটা লিখছো, ঐ ঠিকানায়।’
‘আমি তো পোস্ট অফিস চিনি না কোথায়।’
‘আহ্ রিহান মিয়া, একটু আশপাশটা চিনে রাখবা না?’
‘আমি তো এই সময়ের কেউ না আংকেল। ভবিষ্যত থেকে এসে আমি কী করে চিনবো?’
‘একটু ক্লান্তি লাগছে বলে আর বের হতে চাচ্ছিলাম না। ঠিক আছে, চলো, আমিও যাই সাথে।’
‘বাবা, তুমি বসো। আমি যাচ্ছি উনার সাথে।’ শাড়ির আচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে এলো সুফিয়া। জাফর মাস্টার বললেন, ‘ঠিক আছে, তোরা দুজন যা। তাড়াতাড়ি চলে আসিস।’
ঘর থেকে বের হলো দুজন। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে রিহান প্রশ্ন করলো, ‘পোস্ট অফিস কোনদিকে? দূরে না-কি বেশি?’
‘নাহ্, কাছেই। ঐ তো সামনেই।’
‘তাইলে ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন? ওদিকে তো পুকুরটাই আছে।’
‘আমরা এখন পুকুরে বসবো, আপত্তি আছে আপনার?’
‘কিন্তু চিঠিটা?’
‘ওটা পোস্ট-অফিসে দিতে হবে না।’
‘কেন?’
সুফিয়া মুহূর্তেই জবাব না দিয়ে পুকুরঘাটে গিয়ে বসলো। বাইরে ততক্ষণে প্রখর রোদ পরিবেশটাকে উষ্ণ করে রেখেছে। পুকুরঘাটে বড়ো একটা আমগাছ থাকায় ছায়া পড়েছে ওখানে। গাছের ছায়াতে সুফিয়ার পাশে কিঞ্চিৎ দূরত্বে বসলো রিহান। তখন সুফিয়া বলে উঠলো, ‘আমার ফুপিটা বেঁচে নেই। মারা গেছেন।’
‘মানে?’
‘মানে এই চিঠিটা না দিলেও হবে। যার কাছে যাবে তিনিই তো বেঁচে নেই।’
রিহান অবাক হয়ে যায়। সুফিয়া পুকুরের পানির দিকে চেয়ে বলতে লাগলো, ‘ব্রিটিশরা তো এই দেশে অনেক বছর ধরে শাসন করছেন। আমাদেরকে সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দেশের সম্পদ লুট করে নিত্য তারা তাদের দেশে নিয়ে যায়। এখানকার রাস্তাঘাট ঠিক নেই, পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই, এসবের দিকে ব্রিটিশ সরকারের নজরও নেই। আমার ফুপা ছিলেন একজন সাংবাদিক। খুব সাহসী তিনি। প্রতিদিন তিনি ব্রিটিশদের এসব অনাচারের বিরুদ্ধে লিখে যেতেন। একদিন ব্রিটিশ সেনারা আমার ফুপির বাসায় ঢুকে পড়ে।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কী? একটা নৃশংস ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলো ঐদিনটা। ফুপা, ফুপু, এবং তাদের একমাত্র সন্তান শফিক ভাইয়াকে ওরা গুলি করে হত্যা করে।’
নির্বাক হয়ে সুফিয়ার কথাগুলো শুনতে লাগলো রিহান। সুফিয়া থামতেই সে প্রশ্ন করলো, ‘এটা কবেকার ঘটনা?’
‘প্রায় এগারো বছর হতে চললো। এরপর থেকে বাবা একটু অন্যরকম হয়ে যায়। বাবা জানে তার বোন মারা গেছে, কিন্তু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে না। প্রায় বোনকে এভাবে চিঠি লিখে।’
‘আর আপনার মা? উনার কি হয়েছিল?’
‘মা? মা তো আরও আগে মারা যায়। তখন আমি খুব ছোটো। কী যেন অসুখ হয়েছিল। ডাক্তারও রোগটা ধরতে পারেনি। জানেন, আমি ছিলাম মায়ের খুব আদরের। মা আমাকে খুব ভালোবাসতো। বিয়ের অনেক বছর পরও মায়ের কোনো সন্তান হচ্ছিল না। এজন্য আমার মা’টা কত অপমান সহ্য করেছিল। সবাই বলাবলি করতো আমার মা অপয়া, বন্ধ্যা। দাদাবাড়ির লোকজন বেশি বলতো এই কথাগুলো। শেষে বাবা সবার সাথে সম্পর্ক শেষ করে এখানে চলে আসে মাকে নিয়ে। এখানে ঘর করে। পরে আমার জন্ম হলেও কারও সাথে আর যোগাযোগ করেনি বাবা। আমিও দাদা-বাড়ির কাউকে চিনি না।’ থামলো সুফিয়া। রিহান আর প্রশ্ন করলো না। জানে সে, সুফিয়ার মন ভালো নেই এখন। গাঁদা ফুলের মালা দুটো তখনও রিহানের হাতে ছিল। পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। সুফিয়ার খোপায় এগুলো পরানোর মতো সময় এটা না। দেরি হলে হয়তো ফুলগুলো শুকিয়ে যাবে। সুফিয়াকে আর মালা পরা খোপায় দেখা হলো না তার। সুফিয়া হয়তো তার মনের কথা বুঝতে পেরেছে। বললো, ‘কী রিহান সাহেব, মালাটা কি দেয়ার ইচ্ছে নেই?’ হাসলো সুফিয়া। দুঃখী ভাবটা কেটে গেছে তার চেহারা থেকে। অদ্ভুত মেয়ে। নিজেকে কত সহজেই মানিয়ে নেয় পরিস্থিতির সাথে।
‘পরিয়ে দেবো খোপায়?’ মালা দুটো দুহাতে ধরে প্রশ্ন করে রিহান।’
‘হুমম, দিন।’ বলেই সুফিয়া রিহানের দিকে পিঠ দিয়ে বসলো। রিহান আলতো করে স্পর্শ করলো সুফিয়ার খোপা। অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো তার ভেতরে। সুফিয়ার চুলের খোপা ছুঁতে পারাটাও যেন অনেক কিছু। খোপার নিচে সুফিয়ার ফরসা ঘাড়ে উঁকি দিয়ে আছে কালো একটা তিল। আলতো করে ওটা ছুঁতে গিয়েও ছুঁলো না রিহান। একটা মালা সে কয়েকটা প্যাঁচ দিয়ে পরালো খোপায়। অন্যটা দুবার প্যাঁচ দিয়ে ঝুলিয়ে দিলো কাঁধ বরাবর। সুফিয়া চোখ বন্ধ করে আছে। বন্ধ-চোখে সে অনুভব করছে রিহানের স্পর্শ। অনুভূতিগুলো ভিন্ন।
মালা পরানো হয়ে গেলে সুফিয়া উঠে দাঁড়ালো। রাস্তা দিয়ে তখন পত্রিকার হকার যাচ্ছিল সাইকেল নিয়ে। সুফিয়া রিহানের উদ্দেশ্যে বললো, ‘যান, দুইটা পত্রিকা নিয়ে আসুন। আমি চুলোয় তরকারি দিয়ে এসেছি। এতক্ষণে হয়তো ঝোল সব শুকিয়ে গেছে।’ বলতে বলতে সুফিয়া তার শাড়ির আঁচলের কোণার গিটটা খুলতে লাগলো। ওখানে গিট দিয়ে সে কয়েকটা পয়সা রেখেছিল। ওখান থেকে দু পয়সা নিয়ে রিহানের হাতে দিলো পত্রিকার জন্য। তারপর সে চলে গেল চুলোয় বসানো তরকারি দেখতে। চিঠিটাও সাথে নিয়ে গেল সে।
আজকের পত্রিকায় তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ নিউজ এলো না। কিছুক্ষণ শিরোনামগুলোতে চোখ বুলিয়ে জাফর মাস্টার পত্রিকা দুটো রেখে খেতে বসলেন। রিহানও বসেছে খেতে। সুফিয়া দুজনকে খাবার বেড়ে দিতে দিতে রিহানের উদ্দেশ্যে বললো, ‘রিহান সাহেব, তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠবেন। আপনি ঘুম থেকে দেরিতে উঠছেন বলে বাজারটাও দেরিতে হয়েছে, খাওয়াটাও দেরিতে হচ্ছে।’
রিহান বুঝলো না তার দেরিতে ঘুম থেকে উঠার সাথে বাজার দেরিতে করার কী সম্পর্ক? আংকেল তো একা গিয়েই বাজার আনতে পারতেন। পরক্ষণে রিহান বুঝলো, উনি আসলে রিহানের সাথে মেয়েকে একা ঘরে রেখে যেতে চাননি। সুফিয়ার কথার জবাবে সে বললো, ‘ডেকে দিলেই পারতেন…’
‘ডেকে দিলে যদি আবার ঘুম হয়নি বলে পাগলামি করতেন, তখন তো ভবিষ্যতের কথা মুখ থেকে আপনার সরতোই না। তখন বলতেন, আপনি যুদ্ধ করে স্বাধীন করেছেন এই দেশ, তারপর দেশের নাম দিয়েছেন বাংলাদেশ। কী নাম যেন বলেছিলেন, বাংলাদেশ না?
‘হ্যাঁ, বাংলাদেশ। কিন্তু, আমি যুদ্ধ করিনি। যুদ্ধ হবে ১৯৭১ সালে, আর আমার জন্ম ১৯৯০ সালে।’
‘হা হা হা, এই তো সুযোগ পেয়ে আবার শুরু করে দিলেন ভবিষ্যতের কথা।’ জোরে হেসে ওঠলো সুফিয়া। রিহান মুখটা কালো করে বললো, ‘আপনি সবসময় আমার সাথে এমন করেন।’
এবার জাফর মাস্টার তার পক্ষ নিয়ে বললেন, ‘দেখো দেখি, ছেলেটার মনটা খারাপ করে দিলে। ওর কথায় কান দিয়ো না বাবা তুমি। খাও, খাও। সুফিয়া, তুইও বস খেতে।’
‘না বাবা, তোমরা খাও। আমি পরে খাবো।’ হাসি থামিয়ে বললো সুফিয়া। পত্রিকা দুটো হাতে নিয়ে সেও উল্টিয়ে দেখতে লাগলো। খেলার নিউজে চোখ যেতেই সে চমকে উঠে বললো, ‘আহ্, এ কী নিউজ হলো?’
‘কী হলো?’ ভাতের গ্রাস মুখে দিয়ে প্রশ্ন করলেন জাফর মাস্টার।
‘রস গ্রেগরি হাতে আঘাত পেয়েছেন। গতকাল জাপানি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় অস্ট্রেলিয়ান সেনাদের সাথে রস গ্রেগরিও ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ান সেনাদের বিমানটা উনিই চালিয়েছিলেন। হাতে গুলি লেগেছে তাঁর।’
‘কোন গ্রেগরি? আপনার প্রিয় খেলোয়াড়?’
‘হ্যাঁ, উনি এখন ক্রিকেট খেলার চেয়ে যুদ্ধটাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।’
‘কী আর করা? বুকে যে গুলিটা লাগেনি। খুশি হোন এতে।’
সুফিয়া রিহানের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর পত্রিকা দুটো হাতে নিয়ে উঠে চলে গেল ওখান থেকে। রিহান বুঝেছে, সুফিয়া রেগে গেছে। ওভাবে কথাটা বলা ঠিক হয়নি তার। রস গ্রেগরিকে কখনও সামনাসামনি না দেখলেও, সুফিয়া মনে মনে তাকে স্বপ্নের-পুরুষ ভাবে। আগেরদিন তার রুমে রিহান উঁকি দিয়ে দেখেছিল, রস গ্রেগরির বেশকিছু পেপার কাটিং ছবি দেয়ালে আঠা দিয়ে সাজানো। সুফিয়া হয়তো পত্রিকা থেকে ছবিগুলো কেটে কেটে নিয়ে যত্ন করে রেখেছে।
[[চলবে…]]